গাজার জন্য আন্দোলনের জোয়ার

সৌরভ সরকার
প্রকাশ : ০১ মে ২০২৪, ০৮: ২১

যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বের ৪০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা তাঁদের ক্যাম্পাসে শিবির স্থাপন করেছেন। সেখান থেকে তাঁরা ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে আন্দোলনের শিখা প্রজ্বালিত করেছেন। তাঁদের দাবি, গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা এবং ফিলিস্তিনের দখলদারত্বের অবসানের বিষয়ে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে জটিলতার মধ্যে আছে, তার অবসান ঘটাতে হবে।

শিক্ষার্থীদের এই প্রতিবাদের সবচেয়ে প্রথম ও দীর্ঘস্থায়ী ঘটনা ঘটেছে টেনেসির ন্যাশভিলের ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটিতে। আসলে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা এই প্রতিবাদের শিখা জ্বালিয়েছিলেন, যা বিশ্বব্যাপী সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে। অভিজাত নিউইয়র্ক সিটি স্কুলে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীদের দমনের সিদ্ধান্ত নেয় নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগ। আর এই এক সিদ্ধান্তে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন শুরু হয় এবং এই প্রথম এ ধরনের আন্দোলন অগণিত মানুষের মাঝে আশার আলো জাগিয়েছে। গত ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক ডজন ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ায় প্রসার লাভ করেছে।

কলাম্বিয়া ছাড়াও অন্যান্য স্থানে পুলিশি দমন-পীড়ন ছিল সাংঘাতিক। বোস্টন পুলিশ বিভাগ ২৫ এপ্রিল সেখানকার এমারসন ইউনিভার্সিটিতে প্রথম দিকে বিক্ষোভকারীদের আন্দোলনের লাইভ স্ট্রিমিং করেছিল। জর্জিয়ার আটলান্টার এমোরি ইউনিভার্সিটিতে পুলিশ ছাত্রদের গ্রেপ্তার করতে গেলে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন অর্থনীতির অধ্যাপক ক্যারোলিন ফোহলিন। পুলিশ তাঁকে ছুড়ে ফেলে দেয় মাটিতে। তারপর কংক্রিটের সঙ্গে তাঁর মাথা ঠুকে দেয়। ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার কর্মকর্তারা ছাত্রদের ওপর রাবার বুলেট ছোড়ার অনুমতি দেন। ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে স্থানীয় ও রাজ্য পুলিশ মোটরসাইকেলে, ঘোড়ায় ও হেঁটে টহল দিয়ে ছাত্রদের গ্রেপ্তার করে।

কিন্তু পুলিশ সব সময় যা খুশি তা-ই করতে পারেনি। ক্যাল পলির হামবোল্টের ছাত্ররা সফলভাবে একটি ভবনে নিজেরা ব্যারিকেড তৈরি করে তাদের ঠেকিয়ে দিয়েছেন। নিউইয়র্কের সিটি কলেজের বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে পিছু হঠতে বাধ্য করেন।

ছাত্ররা প্রতিবাদ করে আসলে যা বলতে চাইছেন তা গুরুত্বপূর্ণ: এক. গাজার পরিস্থিতি এবং দুই. ইসরায়েলের সঙ্গে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক। এমনকি শিক্ষার্থীদের এই প্রতিবাদের মুখে সমাজে প্রতিষ্ঠিত গণ্যমান্য ব্যক্তিরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই শিক্ষার্থীদের গায়ে অ্যান্টি-সেমিটিক বা ইহুদিবিদ্বেষী বলে বিশেষণ সেঁটে দিলেন। অথচ ফিলিস্তিনে দুটি গণকবর পাওয়া গেছে, যা গাজার দুটি হাসপাতালে সন্ত্রাসবাদী ইসরায়েলি হামলার পর হয়েছে। সেখানে প্রায় ৪০০ চিকিৎসক, রোগী, শিশু এবং অন্যদের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। এমনকি সেখানে কিছু লোককে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছে।

বিশ্বজুড়ে ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ, বোর্ডরুমে আলোচনা এবং ক্ষমতার শীর্ষপর্যায়ের আলাপচারিতার পরে ইসরায়েলের ভয়ংকর ও গণহত্যার কৌশল নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। গাজায় ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের গণহত্যা ইতিমধ্যে ২০০তম দিনে পৌঁছেছে। কমপক্ষে ৩৪ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। দক্ষিণের শহর রাফায় অভিযান চালানোর হুমকি দিচ্ছে। কয়েক লাখ ফিলিস্তিনির শেষ আশ্রয়স্থল রাফায় আক্রমণ আসন্ন বলে জানা গেছে।

যদিও কেউ কেউ দাবি করেছেন, প্রধানত মার্কিন ছাত্র আন্দোলন একটি বিচ্যুতি মাত্র। তবে আন্দোলনের মুখপাত্র হার্শা ওয়ালিয়া বলছেন, এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এবং অন্যত্র বর্ণবাদী রাষ্ট্রের সহিংসতার একটি সংযোগ আছে। এ থেকে যদি সত্যিই অন্য কিছু না হয়েও থাকে, তবে ত্রাণসহায়তা বহনকারী জাহাজ ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা’ পাঠানো বড় ঘটনা। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে এই ছাত্র আন্দোলন অগণিত ফিলিস্তিনি সংহতি কর্মীকে কিছুটা হলেও অন্য রকম ভাবতে সাহায্য করবে। যাঁরা দিনের পর দিন গাজার ভয়ংকর চিত্রগুলো দেখে ক্লান্ত, বিমর্ষ, তাঁরা তো এই চলমান গণহত্যার মুখে নিজেদের দৈনন্দিন জীবন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।  

অধিকন্তু, বিশেষ উদ্দেশ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শত শত কোটি ডলার দেওয়া, সামাজিক মূলধন এবং কিছু ক্ষেত্রে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি যোগসূত্র ছাড়াও এই আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বয়কট এবং তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি তেল আবিবে একটি ক্যাম্পাস চালু রেখেছে।

যুক্তরাষ্ট্র ক্রমবর্ধমানভাবে বাক্‌স্বাধীনতার প্রতি অসহনশীল হয়ে পড়ছে বলেই প্রমাণিত হচ্ছে। অথচ বাক্‌স্বাধীনতা হলো গণতন্ত্রের ভিত্তিপ্রস্তর। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রায় প্রতিটি বেসরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠান করপোরেটের খপ্পরে চলে গেছে, সামরিকীকরণ হয়ে গেছে অথবা দুটোই হয়েছে। শুধু গাজার গণহত্যার বিষয়ে নয়, জ্ঞান ও জনস্বার্থের কেন্দ্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ঐতিহাসিক ভূমিকার পুনরুদ্ধার শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনের মাধ্যমে কিছুটা হলেও করতে পারে।

আগামী দিনগুলোতে বিশ্বজুড়ে এ রকম আরও অনেক শিবির হবে ক্যাম্পাসগুলোতে। হয়তো তার পরিসর আরও বড় হবে। আন্দোলনকারীরা তাদের উদ্দেশে ঐক্যবদ্ধ। তাদের একটাই মন্ত্র, ‘প্রকাশ করো, বিচ্ছিন্ন করো; আমরা থামব না, আমরা বিশ্রাম নেব না!’ যা শোনা যাচ্ছে সারা বিশ্বে। 

সৌরভ সরকার, লেখক, সম্পাদক ও আন্দোলনকর্মী, লং আইল্যান্ড, নিউইয়র্ক

(কাউন্টার পাঞ্চে প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আবু সাঈদকে ৪–৫ ঘণ্টা পরে হাসপাতালে নেওয়া হয়—শেখ হাসিনার দাবির সত্যতা কতটুকু

মেট্রোরেল থেকে আমলাদের বিদায়, অগ্রাধিকার প্রকৌশলীদের

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

বিমানবন্দরে সাংবাদিক নূরুল কবীরকে হয়রানির তদন্তের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার

কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ৩৫ কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত