মোনায়েম সরকার
বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের কোনো ছাত্রসংগঠন শিক্ষাঙ্গনে নানান অপকর্ম করে নিজেদের ভাবমূর্তির ক্ষতি করেনি—এ প্রশ্ন অবশ্যই তোলা যেতে পারে। তবে এ প্রশ্ন তুলে কোনো সংগঠন যদি নিজেদের ছাত্র কর্মীদের অপরাধ আড়াল করতে চায়, সেটা কি গ্রহণযোগ্য হবে? আমি মনে করি তা হবে না। কোনো ছাত্রসংগঠনের দশ ভাগ নেতা-কর্মীও যদি আইনবিরোধী কাজে যুক্ত হয়, তাহলেও এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য হবে না। বর্তমানে রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং টানা তিন মেয়াদে তারা ক্ষমতায় রয়েছে। তাদের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এটিকে এখন ‘ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে। ভ্রাতৃপ্রতিম হোক আর সহযোগী হোক, ছাত্রলীগের একাংশও যদি শিক্ষাঙ্গনে বা এর বাইরে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়, তবে এর একটা দায় মূল সংগঠনের ওপরও এসে বর্তায়। তবে প্রাথমিকভাবে এসবে জড়িত নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব ছাত্রলীগেরই। আমরা লক্ষ করব, অপরাধমূলক ঘটনার খবর পাওয়া গেলে ছাত্রলীগ সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বুয়েট এলাকায় পণ্যবাহী লরি থামিয়ে চাঁদাবাজি এবং অপর একটি ঘটনায় ছিনতাইয়ের খবর পাওয়া যায়। দেখা গেল, হল পর্যায়ের ছাত্রলীগ নেতারা এসবে জড়িত। এ ঘটনাগুলোয় সংগঠন থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অপরাধমূলক ঘটনা বিধায় পুলিশও আশা করা যায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে।
গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নতুন কমিটি পেয়েছে। নতুন নেতৃত্বের পক্ষ থেকে সবাইকে আশ্বস্ত করে বলা হয়েছিল, ছাত্রলীগকে সব রকম বিতর্ক থেকে মুক্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কিন্তু লক্ষ করলাম, দুই মাসের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের একাংশ জড়িয়ে পড়েছে নানান অপরাধে। কোথাও কোথাও আবার তারা নিজেদের মধ্যেই জড়িয়েছে সংঘাতে। এর কারণ খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, প্রায় সব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব বা অর্থসম্পদ অর্জন নিয়ে তারা কলহে জড়িয়েছে। এসব ঘটনায় রক্তক্ষয়ও ঘটে। খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে, আজ পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে যাঁরা হতাহত হয়েছেন, তাঁদের কয়টি পরিবার ন্যায়বিচার পেয়েছে। বর্তমানে প্রধান প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যেখানে ছাত্ররাজনীতি চালু আছে, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ কোনো সংগঠন সক্রিয় নেই। এটা অবশ্য সব সরকারের আমলেই দেখা যায়। ক্রমে এ ‘সংস্কৃতি’ জোরদার হচ্ছে। এ অবস্থায় সব আমলেই ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের বেপরোয়া নেতা-কর্মীরা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়ান। তাতে সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দেশবাসীর কাছেও এর ভাবমূর্তি হয় বিপন্ন।
নিজেদের মধ্যে সংঘাত বা অন্য ছাত্রসংগঠন কিংবা সাধারণ ছাত্রের ওপর হামলা যে ঘটনাই ঘটুক, তাতে শিক্ষার পরিবেশও নষ্ট হয় এবং এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, একশ্রেণির ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী ক্যাম্পাসের বাইরে গিয়েও নিজেদের পরিচয় ব্যবহার করে অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হচ্ছেন। এ নিবন্ধ লেখার দিন সংবাদপত্রে একটি খবর রয়েছে সোনার বার ছিনতাইয়ের। দেখা যাচ্ছে, এক উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি এতে জড়িত। তাঁকে অবশ্য এরই মধ্যে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ঘটনাটি ঘটে ফরিদপুরের মধুখালীতে। এক ব্যবসায়ীর কাছে সোনার বার আছে—জানতে পেরে তাঁরা বাস থেকে নামিয়ে এক কোটি টাকার বেশি মূল্যের বারগুলো ছিনিয়ে নিয়ে পালান। ওই ঘটনায় যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশি, স্থানীয় পর্যায়ে তাঁর ছাত্রলীগ নেতা হয়ে প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে একটি পত্রিকায় যে খবর এসেছে, তা-ও উদ্বেগজনক। সংগঠনে ধারাবাহিকভাবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছাড়াই নিছক আত্মীয়তার সূত্রে নাকি তিনি নেতা হয়ে ওঠেন। এভাবে নেতৃত্ব অর্জনকারী লোকজনের সব সময়ই চেষ্টা থাকে অন্যায় পথে সহায়সম্পদ অর্জন করার। এটা কেবল ছাত্রসংগঠনের নয়, জাতীয় পর্যায়ের সংগঠনেও লক্ষ করা যায়। কোনো দল যখন ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকে, তখন এর সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যেও এভাবে নেতৃত্ব দখলের চেষ্টা তীব্র হয়ে ওঠে। দল ও সংগঠনের কমিটিতে স্থান পেতে অনেকেই নানান অনৈতিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করেন এবং তাতে সফলও হন। সংগঠনের জন্য এটা কোনো সুফল বয়ে আনে না। দল বা সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বের সাফল্য ওখানে যে, তাঁরা এ ক্ষতিকর প্রবণতা রোধ করে দল পরিচালনা করতে পারছেন কি না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর দল এবং দলের বাইরের সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের আস্থা আছে বলেই মনে করি। ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন না হলেও এর ওপর দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রভাব রয়েছে বৈকি। এটি ইতিবাচকভাবে কাজে লাগিয়ে ছাত্রলীগের যে অংশটি নানান অপরাধে লিপ্ত হয়ে সংগঠন, মূল দল ও সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়াটি তিনি শক্তিশালী করবেন বলেই প্রত্যাশা।
অনেক ক্ষেত্রেই আবার দেখা যাচ্ছে, ছাত্রলীগের দুর্বৃত্ত অংশের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ প্রশাসনের যোগসাজশ না হলেও প্রশ্রয় রয়েছে। শিক্ষকরাজনীতিও নানাভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে এবং শিক্ষকেরা সামগ্রিকভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। ছাত্রদের মধ্যে যাঁরা প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংগঠনের নামে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত, তাঁদের নিয়ন্ত্রণে আনার নৈতিক অধিকারও তাঁরা হারিয়েছেন। এটা কীভাবে ঘটল, সে প্রক্রিয়াও অনুসন্ধান করে দেখার বিষয়।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নামধারী কিছু ছেলে ও মেয়ে যেসব ঘটনা ঘটিয়েছে, আমাদের ছাত্রজীবনে তা কখনো কল্পনাও করতে পারতাম না। এসব খবর সংবাদপত্রে বিস্তারিতভাবে আসে শুধু তা-ই নয়; দেশের টিভি চ্যানেলে দ্রুত চলে আসে। তারও আগে এসব চলে আসে ফেসবুকে এবং তা বহির্বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষ দেখা যাচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ নিতে পারেনি। কোনো কোনো ঘটনায় মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ প্রশাসন ছাত্রলীগের ওই অংশটির কাছে জিম্মি, যারা নানান অপরাধে জড়িত। যেসব ঘটনার নিষ্পত্তি হল পর্যায়েই হতে পারত, তার নিষ্পত্তি দেখা যাচ্ছে প্রক্টর পর্যায়েও হচ্ছে না; এমনকি ভিসিও সে ব্যাপারে মনে হচ্ছে নির্বিকার। এটা কোনো গ্রহণযোগ্য পরিস্থিতি নয়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী নির্যাতনের অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনায় শেষে হাইকোর্টকে হস্তক্ষেপ করতে হলো। তাঁদের নির্দেশে পরিচালিত হচ্ছে তদন্ত। আমরা অবশ্যই চাইব তদন্তে যে-ই দোষী সাব্যস্ত হোক, তাঁর উপযুক্ত শাস্তি হবে। এসব ঘটনায় সাংগঠনিকভাবে শাস্তি হওয়াই যথেষ্ট নয়, এগুলো অপরাধমূলক ঘটনা বলে রাষ্ট্রীয় আইনেও শাস্তি হতে হবে।
ছাত্রলীগের একাংশের দ্বারা সংঘটিত এসব ঘটনার খবর পড়লে কেবলই মনে হয়, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং তার আগে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, এমনকি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ভূমিকা কত ইতিবাচক ছিল! তারা যে কেবল শিক্ষাঙ্গনে ভূমিকা পালন করেছে তা নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল। এ সংগঠনের জন্ম হয় এমনকি আওয়ামী লীগের জন্মের আগে এবং একটা সময় পর্যন্ত ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের ঘোষিত অঙ্গসংগঠন না হয়েও তার ভূমিকা রেখে গেছে। তাতে জাতীয় রাজনীতি ও দেশ হয়েছে উপকৃত। পাকিস্তান আমলে কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় ছাত্রলীগের ইতিবাচক ভূমিকা ছিল না? ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬ থেকে ৬ দফাকে জনপ্রিয় করার কর্মপ্রয়াস, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সব ক্ষেত্রেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য ছাত্রলীগ কর্মী দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। একটা সময় পর্যন্ত ছাত্রলীগ থেকে জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিকেরও জন্ম হয়েছে এবং তাঁরা রাজনীতিতে বড় ভূমিকা রেখেছেন। স্বাধীনতার পর অবশ্য ছাত্রলীগে বিভক্তি আসে। একটি বড় অংশ মূল সংগঠন ছেড়ে যায়। তাদের রাজনীতি আবার ’৭৫-এর রক্তাক্ত পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপট তৈরি করে।
তারপর দেশে সামরিক শাসনের অবসান এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামেও ছাত্রলীগ বড় ভূমিকা রাখে।
সেই গৌরবময় অতীতের অধিকারী সংগঠনের একশ্রেণির নেতা-কর্মী যখন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, তখন সেটা আমাদের শুধু বেদনার্ত করে না, চিন্তিতও করে। অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে, কেন গোটা ছাত্ররাজনীতিতেই অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। ছাত্রলীগে অবক্ষয়ের ঘটনা তো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালে আমরা দেখেছি তাদের ছাত্রসংগঠনও নানান অপকর্মে জড়িয়ে নিজেদের কলুষিত করেছে। একসময় শিক্ষাঙ্গনে জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরও অনেক নৃশংস অপরাধমূলক ঘটনা ঘটায়। মূল দলের সঙ্গে তারা অবশ্য দুর্বল হয়ে পড়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঘটনায়। ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। এ অবস্থায় শিক্ষাঙ্গনে একচ্ছত্রভাবে থেকেও ছাত্রলীগ যদি এর একাংশের নেতা-কর্মীদের কারণে বদনাম কামাই করে, তাহলে সেটা শুধু তার জন্য নয়, মূল দল ও সরকারের জন্য খুব নেতিবাচক ঘটনা হবে। সামনেই জাতীয় নির্বাচন, এটা মনে রাখাও জরুরি।
মোনায়েম সরকার, রাজনীতিবিদ, লেখক ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ
বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের কোনো ছাত্রসংগঠন শিক্ষাঙ্গনে নানান অপকর্ম করে নিজেদের ভাবমূর্তির ক্ষতি করেনি—এ প্রশ্ন অবশ্যই তোলা যেতে পারে। তবে এ প্রশ্ন তুলে কোনো সংগঠন যদি নিজেদের ছাত্র কর্মীদের অপরাধ আড়াল করতে চায়, সেটা কি গ্রহণযোগ্য হবে? আমি মনে করি তা হবে না। কোনো ছাত্রসংগঠনের দশ ভাগ নেতা-কর্মীও যদি আইনবিরোধী কাজে যুক্ত হয়, তাহলেও এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য হবে না। বর্তমানে রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং টানা তিন মেয়াদে তারা ক্ষমতায় রয়েছে। তাদের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এটিকে এখন ‘ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে। ভ্রাতৃপ্রতিম হোক আর সহযোগী হোক, ছাত্রলীগের একাংশও যদি শিক্ষাঙ্গনে বা এর বাইরে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়, তবে এর একটা দায় মূল সংগঠনের ওপরও এসে বর্তায়। তবে প্রাথমিকভাবে এসবে জড়িত নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব ছাত্রলীগেরই। আমরা লক্ষ করব, অপরাধমূলক ঘটনার খবর পাওয়া গেলে ছাত্রলীগ সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বুয়েট এলাকায় পণ্যবাহী লরি থামিয়ে চাঁদাবাজি এবং অপর একটি ঘটনায় ছিনতাইয়ের খবর পাওয়া যায়। দেখা গেল, হল পর্যায়ের ছাত্রলীগ নেতারা এসবে জড়িত। এ ঘটনাগুলোয় সংগঠন থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অপরাধমূলক ঘটনা বিধায় পুলিশও আশা করা যায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে।
গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নতুন কমিটি পেয়েছে। নতুন নেতৃত্বের পক্ষ থেকে সবাইকে আশ্বস্ত করে বলা হয়েছিল, ছাত্রলীগকে সব রকম বিতর্ক থেকে মুক্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কিন্তু লক্ষ করলাম, দুই মাসের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের একাংশ জড়িয়ে পড়েছে নানান অপরাধে। কোথাও কোথাও আবার তারা নিজেদের মধ্যেই জড়িয়েছে সংঘাতে। এর কারণ খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, প্রায় সব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব বা অর্থসম্পদ অর্জন নিয়ে তারা কলহে জড়িয়েছে। এসব ঘটনায় রক্তক্ষয়ও ঘটে। খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে, আজ পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে যাঁরা হতাহত হয়েছেন, তাঁদের কয়টি পরিবার ন্যায়বিচার পেয়েছে। বর্তমানে প্রধান প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যেখানে ছাত্ররাজনীতি চালু আছে, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ কোনো সংগঠন সক্রিয় নেই। এটা অবশ্য সব সরকারের আমলেই দেখা যায়। ক্রমে এ ‘সংস্কৃতি’ জোরদার হচ্ছে। এ অবস্থায় সব আমলেই ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের বেপরোয়া নেতা-কর্মীরা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়ান। তাতে সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দেশবাসীর কাছেও এর ভাবমূর্তি হয় বিপন্ন।
নিজেদের মধ্যে সংঘাত বা অন্য ছাত্রসংগঠন কিংবা সাধারণ ছাত্রের ওপর হামলা যে ঘটনাই ঘটুক, তাতে শিক্ষার পরিবেশও নষ্ট হয় এবং এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, একশ্রেণির ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী ক্যাম্পাসের বাইরে গিয়েও নিজেদের পরিচয় ব্যবহার করে অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হচ্ছেন। এ নিবন্ধ লেখার দিন সংবাদপত্রে একটি খবর রয়েছে সোনার বার ছিনতাইয়ের। দেখা যাচ্ছে, এক উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি এতে জড়িত। তাঁকে অবশ্য এরই মধ্যে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ঘটনাটি ঘটে ফরিদপুরের মধুখালীতে। এক ব্যবসায়ীর কাছে সোনার বার আছে—জানতে পেরে তাঁরা বাস থেকে নামিয়ে এক কোটি টাকার বেশি মূল্যের বারগুলো ছিনিয়ে নিয়ে পালান। ওই ঘটনায় যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশি, স্থানীয় পর্যায়ে তাঁর ছাত্রলীগ নেতা হয়ে প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে একটি পত্রিকায় যে খবর এসেছে, তা-ও উদ্বেগজনক। সংগঠনে ধারাবাহিকভাবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছাড়াই নিছক আত্মীয়তার সূত্রে নাকি তিনি নেতা হয়ে ওঠেন। এভাবে নেতৃত্ব অর্জনকারী লোকজনের সব সময়ই চেষ্টা থাকে অন্যায় পথে সহায়সম্পদ অর্জন করার। এটা কেবল ছাত্রসংগঠনের নয়, জাতীয় পর্যায়ের সংগঠনেও লক্ষ করা যায়। কোনো দল যখন ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকে, তখন এর সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যেও এভাবে নেতৃত্ব দখলের চেষ্টা তীব্র হয়ে ওঠে। দল ও সংগঠনের কমিটিতে স্থান পেতে অনেকেই নানান অনৈতিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করেন এবং তাতে সফলও হন। সংগঠনের জন্য এটা কোনো সুফল বয়ে আনে না। দল বা সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বের সাফল্য ওখানে যে, তাঁরা এ ক্ষতিকর প্রবণতা রোধ করে দল পরিচালনা করতে পারছেন কি না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর দল এবং দলের বাইরের সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের আস্থা আছে বলেই মনে করি। ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন না হলেও এর ওপর দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রভাব রয়েছে বৈকি। এটি ইতিবাচকভাবে কাজে লাগিয়ে ছাত্রলীগের যে অংশটি নানান অপরাধে লিপ্ত হয়ে সংগঠন, মূল দল ও সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়াটি তিনি শক্তিশালী করবেন বলেই প্রত্যাশা।
অনেক ক্ষেত্রেই আবার দেখা যাচ্ছে, ছাত্রলীগের দুর্বৃত্ত অংশের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ প্রশাসনের যোগসাজশ না হলেও প্রশ্রয় রয়েছে। শিক্ষকরাজনীতিও নানাভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে এবং শিক্ষকেরা সামগ্রিকভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। ছাত্রদের মধ্যে যাঁরা প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংগঠনের নামে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত, তাঁদের নিয়ন্ত্রণে আনার নৈতিক অধিকারও তাঁরা হারিয়েছেন। এটা কীভাবে ঘটল, সে প্রক্রিয়াও অনুসন্ধান করে দেখার বিষয়।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নামধারী কিছু ছেলে ও মেয়ে যেসব ঘটনা ঘটিয়েছে, আমাদের ছাত্রজীবনে তা কখনো কল্পনাও করতে পারতাম না। এসব খবর সংবাদপত্রে বিস্তারিতভাবে আসে শুধু তা-ই নয়; দেশের টিভি চ্যানেলে দ্রুত চলে আসে। তারও আগে এসব চলে আসে ফেসবুকে এবং তা বহির্বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষ দেখা যাচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ নিতে পারেনি। কোনো কোনো ঘটনায় মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ প্রশাসন ছাত্রলীগের ওই অংশটির কাছে জিম্মি, যারা নানান অপরাধে জড়িত। যেসব ঘটনার নিষ্পত্তি হল পর্যায়েই হতে পারত, তার নিষ্পত্তি দেখা যাচ্ছে প্রক্টর পর্যায়েও হচ্ছে না; এমনকি ভিসিও সে ব্যাপারে মনে হচ্ছে নির্বিকার। এটা কোনো গ্রহণযোগ্য পরিস্থিতি নয়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী নির্যাতনের অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনায় শেষে হাইকোর্টকে হস্তক্ষেপ করতে হলো। তাঁদের নির্দেশে পরিচালিত হচ্ছে তদন্ত। আমরা অবশ্যই চাইব তদন্তে যে-ই দোষী সাব্যস্ত হোক, তাঁর উপযুক্ত শাস্তি হবে। এসব ঘটনায় সাংগঠনিকভাবে শাস্তি হওয়াই যথেষ্ট নয়, এগুলো অপরাধমূলক ঘটনা বলে রাষ্ট্রীয় আইনেও শাস্তি হতে হবে।
ছাত্রলীগের একাংশের দ্বারা সংঘটিত এসব ঘটনার খবর পড়লে কেবলই মনে হয়, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং তার আগে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, এমনকি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ভূমিকা কত ইতিবাচক ছিল! তারা যে কেবল শিক্ষাঙ্গনে ভূমিকা পালন করেছে তা নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল। এ সংগঠনের জন্ম হয় এমনকি আওয়ামী লীগের জন্মের আগে এবং একটা সময় পর্যন্ত ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের ঘোষিত অঙ্গসংগঠন না হয়েও তার ভূমিকা রেখে গেছে। তাতে জাতীয় রাজনীতি ও দেশ হয়েছে উপকৃত। পাকিস্তান আমলে কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় ছাত্রলীগের ইতিবাচক ভূমিকা ছিল না? ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬ থেকে ৬ দফাকে জনপ্রিয় করার কর্মপ্রয়াস, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সব ক্ষেত্রেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য ছাত্রলীগ কর্মী দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। একটা সময় পর্যন্ত ছাত্রলীগ থেকে জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিকেরও জন্ম হয়েছে এবং তাঁরা রাজনীতিতে বড় ভূমিকা রেখেছেন। স্বাধীনতার পর অবশ্য ছাত্রলীগে বিভক্তি আসে। একটি বড় অংশ মূল সংগঠন ছেড়ে যায়। তাদের রাজনীতি আবার ’৭৫-এর রক্তাক্ত পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপট তৈরি করে।
তারপর দেশে সামরিক শাসনের অবসান এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামেও ছাত্রলীগ বড় ভূমিকা রাখে।
সেই গৌরবময় অতীতের অধিকারী সংগঠনের একশ্রেণির নেতা-কর্মী যখন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, তখন সেটা আমাদের শুধু বেদনার্ত করে না, চিন্তিতও করে। অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে, কেন গোটা ছাত্ররাজনীতিতেই অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। ছাত্রলীগে অবক্ষয়ের ঘটনা তো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালে আমরা দেখেছি তাদের ছাত্রসংগঠনও নানান অপকর্মে জড়িয়ে নিজেদের কলুষিত করেছে। একসময় শিক্ষাঙ্গনে জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরও অনেক নৃশংস অপরাধমূলক ঘটনা ঘটায়। মূল দলের সঙ্গে তারা অবশ্য দুর্বল হয়ে পড়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঘটনায়। ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। এ অবস্থায় শিক্ষাঙ্গনে একচ্ছত্রভাবে থেকেও ছাত্রলীগ যদি এর একাংশের নেতা-কর্মীদের কারণে বদনাম কামাই করে, তাহলে সেটা শুধু তার জন্য নয়, মূল দল ও সরকারের জন্য খুব নেতিবাচক ঘটনা হবে। সামনেই জাতীয় নির্বাচন, এটা মনে রাখাও জরুরি।
মোনায়েম সরকার, রাজনীতিবিদ, লেখক ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৬ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৬ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৬ দিন আগে