মাসুদ রানা।
বিশ্বেন্দু নন্দ পশ্চিম বাংলার উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, লেখক, গবেষক ও অনুবাদক। ‘পরম’ পত্রিকার সম্পাদক। হকার, কারিগর সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় তিন দশক। দুটি মৌলিক গ্রন্থসহ কয়েকটি অনুবাদগ্রন্থ রয়েছে তাঁর। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের আমন্ত্রণে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
আজকের পত্রিকা: কোন উপলব্ধি থেকে আপনারা উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন শুরু করলেন?
বিশ্বেন্দু নন্দ: আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে উপনিবেশবাদ বিষয়টি স্পষ্ট করা দরকার। এ শব্দটি ইংরেজি ‘কলোনিয়ালিজম’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ। আবার উপনিবেশবাদ কথাটি এসেছে লাতিন ‘কলোনিয়া’ শব্দ থেকে, যার অর্থ বিশাল সম্পত্তি বা এস্টেট। সাধারণভাবে বলা যায়, কোনো দেশ যদি অন্য দেশের ভূখণ্ড বা অঞ্চলকে নিজের অধীন করে নেয়, তাহলে সেই অঞ্চলের নাম হয় উপনিবেশ। উপনিবেশবাদ হলো অন্য দেশের ভৌগোলিক অঞ্চলের ওপর শাসন প্রতিষ্ঠা ও সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ। আমরা মনে করি, আজকের উপনিবেশ করপোরেট উপনিবেশ। আমাদের স্বাধীনতা, নিজস্ব চিন্তা তারাই হরণ করছে, নামমাত্র স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের নামে।
ইংরেজরা প্রায় ২০০ বছর শাসন করার পর ভারতবর্ষ থেকে চলে গেলেও, তাদের শাসনের রেশ পুরো মাত্রায় সচল আছে আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোয়। তাই প্রকাশ্য বা লুকোনো উপনিবেশ যত দিন থাকবে, উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের রাশ উপনিবেশিত মানুষের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া যাবে না। দুর্ভাগ্যের কথা, তথাকথিত উপনিবেশবিরোধী চর্চার একটা অংশ মূলত ভদ্রবিত্তরা নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং করছে। করপোরেটের তৈরি জাতিরাষ্ট্রের পরিচালক ভদ্রবিত্তের স্বার্থপূরণই উপনিবেশবিরোধী চর্চা হিসেবে গণ্য হয়েছে। ভদ্রবিত্তীয় উপনিবেশবিরোধী চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়ে ভদ্রবিত্তের হাতের পুতুল হয়েছে চিরকাল। দেশের পর দেশ ‘স্বাধীন’ হয়েছে, উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের ভাগীদার ভদ্রবিত্তরা ক্ষমতায় গিয়ে স্বাধীন দেশে ইউরোপীয়দের ছেড়ে যাওয়া ঔপনিবেশিক কাঠামো যেমন বজায় রেখেছে, তেমনি যেনতেন প্রকারে ইউরোপীয়দের স্বার্থপূরণেও পিছপা হয়নি।
এশিয়া ছেড়ে ইংল্যান্ড, ডাচ, আফ্রিকা ছেড়ে ডাচ ফরাসি, বেলজিয়াম ও জার্মানির সাদা শাসকেরা ইউরোপে ফিরে গেলেও সেই সব দেশ-মহাদেশ থেকে উপনিবেশকাঠামো মুছে যায়নি। উপনিবেশে ভদ্রবিত্তরা চাকরি করেছে, ইউরোপ ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেও ভদ্রবিত্তের চাকরি, দালালিতে ঝামেলা হয়নি। এই দীর্ঘ সময়ে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঔপনিবেশিক ভদ্রবিত্ত সমাজ, বিপুল-বিশাল গ্রামনির্ভর উৎপাদনব্যবস্থাকে ঘেন্না করেছে। তাকে করপোরেট পুঁজির পায়ে বলি দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এসব ঘটেছে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন করা ভদ্রবিত্তের সহায়তায়। উপনিবেশের আগে বাংলাকে সোনার বাংলা বানানো হকার, কারিগর, চাষি বা অন্য পেশাদারের স্বার্থ, অধিকার, ভদ্রবিত্তপ্রণোদিত উপনিবেশবিরোধী চর্চা এত দিন অগ্রাহ্য করে তার স্বার্থ এবং ইউরোপের স্বার্থ পূরণ করেছে।
আমি এক দশকের বেশি সময় ধরে হকার আন্দোলনে জড়িয়ে ছিলাম। গত দেড় দশকের বেশি সময় কারিগর আন্দোলনের সার্বক্ষণিক কর্মী। একসময় বিক্রেতাদের সঙ্গে জড়িয়েছিলাম। আজ উৎপাদকদের স্বার্থে তাঁদের সংগঠনে যুক্ত হয়েছি। কারিগর, হকারা মনে করেন, এত দিনের উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে শহরের গরিব আর কারিগর চাষির স্বার্থ রক্ষা হয়নি। আজ তাঁরা বুঝে নিতে চাইছেন কোনটা বৃহত্তর সমাজের উন্নয়ন আর কোনটা ভদ্রবিত্তচালিত করপোরেটের স্বার্থবাহী আন্দোলন। হকার, চাষি ও কারিগরেরা আজ
এই আন্দোলনের অন্যতম প্রতিভূ। আমরা তাঁদের দাবির সঙ্গে সহমত হয়ে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি।
আজকের পত্রিকা: একসময় এই ভারতবর্ষে ভাগ্য অন্বেষণে বহিরাগতরা আসত। সবকিছুতে আমরা সমৃদ্ধ ছিলাম। ব্রিটিশদের প্রায় ২০০ বছর শাসনে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেলাম। আমরা আবার সেই অতীতে ফিরে যেতে পারব কি?
বিশ্বেন্দু নন্দ: যে অতীতের কথা বলছেন আপনি, সেই অতীতে বাংলার জিডিপি ছিল ৬ থেকে ৭ শতাংশ। তো সেই পলাশীর সময়ে ফিরে যাওয়ার কথা বললে ঔপনিবেশিক ভদ্রবিত্তের গায়ে-মনে তীব্র ছ্যাঁকা লাগে। অমিয় বাগচী, উতসা পট্টনায়েক, নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহ, সুশীল চৌধুরী, ওম প্রকাশ, কীর্তি নারায়ণ চৌধুরীরা পলাশী-পূর্ব সময়ের সোনার বাংলায় চাষি, কারিগর ও হকার পরিচালিত অর্থনীতির কথা বলেছেন। অথচ পলাশীর পরে ইউরোপীয় উপনিবেশের উদ্যমে আর বর্তমানে পরামর্শে করপোরেট অর্থনীতি আর রাষ্ট্রব্যবস্থা চাঁদে মানুষ পাঠালেও জাতিরাষ্ট্র প্রত্যেক মানুষের মুখে দুবেলা দুগ্রাস খাবার তুলে দিতে ব্যর্থ। মাথায় রাখতে হবে ভদ্রবিত্তকে চাকরি দেয় করপোরেটপ্রণোদিত রাষ্ট্র আর করপোরেটরা স্বয়ং। কারিগর, চাষি বা হকার ভদ্রবিত্তকে চাকরি দেয় না। তাই ভদ্রবিত্ত মোটের ওপরে করপোটের স্বার্থের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের স্বার্থ সুরক্ষায় ব্যস্ত।
দুর্ভাগ্য যে আমাদের শাসক ও ভদ্রবিত্তরা আজও ইউরোপীয়দের তৈরি করা ঔপনিবেশিক বিশ্বব্যবস্থাতেই নিজেদের দেশের উন্নয়নের নিদান খুঁজছে। ‘স্বাধীন’ সাবেক ঔপনিবেশিক দেশগুলোকে বুঝতে হবে। ইউরোপের এশিয়া, আফ্রিকার মতো প্রাকৃতিক ধনসম্বল, জনবল না থাকা সত্ত্বেও করপোরেটদের মাধ্যমে তারা আজও শোষণ চালাচ্ছে। আমাদের সংগঠনের অন্যতম কর্মী বহ্নিহোত্রী হাজরা, কোবাড গান্ধীর গবেষণা থেকে দেখিয়েছেন, গত বছর ভারতের জিডিপির ১৭ শতাংশ লুট হয়ে দেশের বাইরে চলে গেছে। আমাদের উন্নয়ন আমাদের মতো করে হতে হবে। তবেই আমরা বাংলার ৬-৭ শতাংশ জিডিপিতে পৌঁছাতে পারব।
আজকের পত্রিকা: সেটা কী করে সম্ভব?
বিশ্বেন্দু নন্দ: সেই দিশা দেখাতে পারে অতীত ইতিহাস। করপোরেট অর্থনীতি রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হলে কী ঘটতে পারে? সেই উদাহরণের জন্য পলাশীর পরের বাংলাই যথেষ্ট। তাই অতীতের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে বাংলাকে সোনার বাংলা বানাতে করপোরেটদের খাঁচায় পোরা একান্তই প্রাথমিক শর্ত—তারপর অন্য কিছু।
আজকের পত্রিকা: পশ্চিম বাংলার ইতিহাসচর্চায় উপনিবেশবিরোধী চর্চাটা কেমন?
বিশ্বেন্দু নন্দ: ভদ্রবিত্তের চরিত্র সারা বিশ্বে এক। সে ঢাকা, কলকাতা, নিউইয়র্ক বা কঙ্গোর রাজধানী ব্রাজাভিল—যেকোনো অঞ্চল হোক না কেন। কলকাতা ভোলে না সে ছিল দ্বিতীয় সাম্রাজ্যকেন্দ্র। তার প্রৌঢ়, বৃদ্ধ, জরাগ্রস্ত ঔপনিবেশিক ভদ্রবিত্ত সমাজ যেকোনো ছুতোয় করপোরেটের দাস। বাংলার নতুন প্রজন্ম ক্রমেই জাগছে, অপ্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা সংগঠনের সব গবেষকই তরুণ। তাঁরাও প্রভাব ছড়াচ্ছেন। আমাদের সংগঠনের কর্মী অত্রি ভট্টাচার্য হিন্দুত্বকে নতুন চোখে এবং নতুন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেখছেন, বহ্নিহোত্রী হাজরা সম্পদ লুটতত্ত্বে নতুন চরিত্র খুঁজে বেড়াচ্ছেন, দেবত্র দে আজকের কাঠামোগত সংস্কার নিয়ে কাজ করছেন এবং অমিয় চক্রবর্তী কাজ করছেন কথিত পলাশীর পরের সময়ের কাঠামোগত সংস্কারের ধারণা নিয়ে, সুদীঘ্ন দাস কাজ করছেন লুপ্ত হতে চলা জনপরিসর নিয়ে, ইমরাজ শেখ মির্জা কাজ করছেন হাটে করপোরেট দখলদারি বুঝতে, শাজাহান আলী কাজ করছেন মোগল আমলের জেন্ডার ফ্লুইডিটি নিয়ে।
শুধু কলকাতা নয়, আপনাদের বাংলাদেশের পঞ্চগড়ের নয়ন তানবীরুল বারী কাজ করছেন তাঁর অঞ্চল নিয়ে এবং চট্টগ্রামের সৈয়দ মোহাম্মদ মিনহাজ সুফি বাংলার শেষ হয়ে যাওয়া তুলো চাষ ফিরিয়ে আনতে উদ্যমী হয়েছেন। আমরা প্রতি মাসে একটা করে ছোট পুস্তক প্রকাশ করছি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিল্টন বিশ্বাস আর নবজাগরণের উদ্দেশ্য ও বিধেয় নিয়ে জরুরি প্রশ্ন তোলা দেবোত্তম চক্রবর্তী যৌথভাবে সম্পাদনা করছেন ১৭৭০ সালের গণহত্যা বুঝতে একটি বই।
কলকাতা, বাংলাদেশে প্রচুর প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উপনিবেশবিরোধী চর্চা করার গবেষক চাই। আমরা নতুন প্রজন্মের প্রতি একটু বেশিই আস্থাশীল। তাদের হাতেই মুক্তির লাগাম। এ কাজে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
আজকের পত্রিকা: উপনিবেশবিরোধী চর্চায় আপনার গুরু কারা?
বিশ্বেন্দু নন্দ: প্রথমত, চাষি, হকার ও কারিগর। তাঁরা শিখিয়েছেন ভদ্রবিত্ত সমাজ, পরজীবী রাষ্ট্র আর শহরব্যবস্থার বাইরে বিশাল বঙ্গভূমির উৎপাদনশীল মানুষদের দিকে চোখ ফেরাতে। বঙ্গভূমির কারিগরেরা উৎপাদনব্যবস্থার করপোরেট এবং কেন্দ্রীকরণবিরোধী। উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ে করপোরেটবিরোধী লড়াই প্রাণ দিয়ে লড়ে চলেছেন হাটুরেরা হাটের দোকানে, চাষিরা শস্য-শ্যামলা মাঠে আর বাড়ির ছোট্ট কারখানায় কামার, তাঁতি ও শঙ্খ কারিগরেরা স্লোগান-মিছিল ছাড়াই। কারণ তাঁদের তৈরি কারিগরব্যবস্থার চরিত্রটা তা-ই বলে।
১৭৬৩ সালে ফকির, সন্ন্যাসী, চাষি আর অন্য পেশাদার উপনিবেশের চরিত্র বুঝেছিলেন কয়েক বছরেই। তাঁরা অস্ত্র হাতে যে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, সেই যুদ্ধ চলেছিল ১৮৫৮ সালের পরেও গ্রামেগঞ্জে। তখন ভদ্রবিত্তরা উপনিবেশের শর্তে তাদের হয়ে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র গড়তে ব্যস্ত। জয়া মিত্র, ধরম পাল, সুশীল চৌধুরী, অনুপম মিশ্র নতুন ভাবনার পথ দেখিয়েছেন। মোগল আমল নিয়ে মরহুম আবদুল করিম আজও আমার শিক্ষক। তিনিই মোগল বাংলা দেখতে শেখালেন। তাঁরাই আমার গুরু। তরুণদের কাছে নিত্য শিখি। আমি তাঁদের বিনীত অনুগামী।
আজকের পত্রিকা: আমরা কীভাবে উপনিবেশ থেকে মুক্ত হতে পারি?
বিশ্বেন্দু নন্দ: উপনিবেশ থেকে মুক্তির সহজ পথ নেই। স্পষ্ট মনে করি, দেশকে উপনিবেশমুক্ত করার আগে নিজেদের মনকে উপনিবেশমুক্ত করতে হবে। উপনিবেশ-পূর্ব সময়কে দেখতে হবে জাতিরাষ্ট্রের তৈরি করা চশমা খুলেই। তবেই আমরা নতুন বাংলায় শ্বাস নিতে পারব।
বিশ্বেন্দু নন্দ পশ্চিম বাংলার উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, লেখক, গবেষক ও অনুবাদক। ‘পরম’ পত্রিকার সম্পাদক। হকার, কারিগর সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় তিন দশক। দুটি মৌলিক গ্রন্থসহ কয়েকটি অনুবাদগ্রন্থ রয়েছে তাঁর। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের আমন্ত্রণে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
আজকের পত্রিকা: কোন উপলব্ধি থেকে আপনারা উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন শুরু করলেন?
বিশ্বেন্দু নন্দ: আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে উপনিবেশবাদ বিষয়টি স্পষ্ট করা দরকার। এ শব্দটি ইংরেজি ‘কলোনিয়ালিজম’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ। আবার উপনিবেশবাদ কথাটি এসেছে লাতিন ‘কলোনিয়া’ শব্দ থেকে, যার অর্থ বিশাল সম্পত্তি বা এস্টেট। সাধারণভাবে বলা যায়, কোনো দেশ যদি অন্য দেশের ভূখণ্ড বা অঞ্চলকে নিজের অধীন করে নেয়, তাহলে সেই অঞ্চলের নাম হয় উপনিবেশ। উপনিবেশবাদ হলো অন্য দেশের ভৌগোলিক অঞ্চলের ওপর শাসন প্রতিষ্ঠা ও সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ। আমরা মনে করি, আজকের উপনিবেশ করপোরেট উপনিবেশ। আমাদের স্বাধীনতা, নিজস্ব চিন্তা তারাই হরণ করছে, নামমাত্র স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের নামে।
ইংরেজরা প্রায় ২০০ বছর শাসন করার পর ভারতবর্ষ থেকে চলে গেলেও, তাদের শাসনের রেশ পুরো মাত্রায় সচল আছে আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোয়। তাই প্রকাশ্য বা লুকোনো উপনিবেশ যত দিন থাকবে, উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের রাশ উপনিবেশিত মানুষের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া যাবে না। দুর্ভাগ্যের কথা, তথাকথিত উপনিবেশবিরোধী চর্চার একটা অংশ মূলত ভদ্রবিত্তরা নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং করছে। করপোরেটের তৈরি জাতিরাষ্ট্রের পরিচালক ভদ্রবিত্তের স্বার্থপূরণই উপনিবেশবিরোধী চর্চা হিসেবে গণ্য হয়েছে। ভদ্রবিত্তীয় উপনিবেশবিরোধী চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়ে ভদ্রবিত্তের হাতের পুতুল হয়েছে চিরকাল। দেশের পর দেশ ‘স্বাধীন’ হয়েছে, উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের ভাগীদার ভদ্রবিত্তরা ক্ষমতায় গিয়ে স্বাধীন দেশে ইউরোপীয়দের ছেড়ে যাওয়া ঔপনিবেশিক কাঠামো যেমন বজায় রেখেছে, তেমনি যেনতেন প্রকারে ইউরোপীয়দের স্বার্থপূরণেও পিছপা হয়নি।
এশিয়া ছেড়ে ইংল্যান্ড, ডাচ, আফ্রিকা ছেড়ে ডাচ ফরাসি, বেলজিয়াম ও জার্মানির সাদা শাসকেরা ইউরোপে ফিরে গেলেও সেই সব দেশ-মহাদেশ থেকে উপনিবেশকাঠামো মুছে যায়নি। উপনিবেশে ভদ্রবিত্তরা চাকরি করেছে, ইউরোপ ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেও ভদ্রবিত্তের চাকরি, দালালিতে ঝামেলা হয়নি। এই দীর্ঘ সময়ে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঔপনিবেশিক ভদ্রবিত্ত সমাজ, বিপুল-বিশাল গ্রামনির্ভর উৎপাদনব্যবস্থাকে ঘেন্না করেছে। তাকে করপোরেট পুঁজির পায়ে বলি দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এসব ঘটেছে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন করা ভদ্রবিত্তের সহায়তায়। উপনিবেশের আগে বাংলাকে সোনার বাংলা বানানো হকার, কারিগর, চাষি বা অন্য পেশাদারের স্বার্থ, অধিকার, ভদ্রবিত্তপ্রণোদিত উপনিবেশবিরোধী চর্চা এত দিন অগ্রাহ্য করে তার স্বার্থ এবং ইউরোপের স্বার্থ পূরণ করেছে।
আমি এক দশকের বেশি সময় ধরে হকার আন্দোলনে জড়িয়ে ছিলাম। গত দেড় দশকের বেশি সময় কারিগর আন্দোলনের সার্বক্ষণিক কর্মী। একসময় বিক্রেতাদের সঙ্গে জড়িয়েছিলাম। আজ উৎপাদকদের স্বার্থে তাঁদের সংগঠনে যুক্ত হয়েছি। কারিগর, হকারা মনে করেন, এত দিনের উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে শহরের গরিব আর কারিগর চাষির স্বার্থ রক্ষা হয়নি। আজ তাঁরা বুঝে নিতে চাইছেন কোনটা বৃহত্তর সমাজের উন্নয়ন আর কোনটা ভদ্রবিত্তচালিত করপোরেটের স্বার্থবাহী আন্দোলন। হকার, চাষি ও কারিগরেরা আজ
এই আন্দোলনের অন্যতম প্রতিভূ। আমরা তাঁদের দাবির সঙ্গে সহমত হয়ে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি।
আজকের পত্রিকা: একসময় এই ভারতবর্ষে ভাগ্য অন্বেষণে বহিরাগতরা আসত। সবকিছুতে আমরা সমৃদ্ধ ছিলাম। ব্রিটিশদের প্রায় ২০০ বছর শাসনে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেলাম। আমরা আবার সেই অতীতে ফিরে যেতে পারব কি?
বিশ্বেন্দু নন্দ: যে অতীতের কথা বলছেন আপনি, সেই অতীতে বাংলার জিডিপি ছিল ৬ থেকে ৭ শতাংশ। তো সেই পলাশীর সময়ে ফিরে যাওয়ার কথা বললে ঔপনিবেশিক ভদ্রবিত্তের গায়ে-মনে তীব্র ছ্যাঁকা লাগে। অমিয় বাগচী, উতসা পট্টনায়েক, নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহ, সুশীল চৌধুরী, ওম প্রকাশ, কীর্তি নারায়ণ চৌধুরীরা পলাশী-পূর্ব সময়ের সোনার বাংলায় চাষি, কারিগর ও হকার পরিচালিত অর্থনীতির কথা বলেছেন। অথচ পলাশীর পরে ইউরোপীয় উপনিবেশের উদ্যমে আর বর্তমানে পরামর্শে করপোরেট অর্থনীতি আর রাষ্ট্রব্যবস্থা চাঁদে মানুষ পাঠালেও জাতিরাষ্ট্র প্রত্যেক মানুষের মুখে দুবেলা দুগ্রাস খাবার তুলে দিতে ব্যর্থ। মাথায় রাখতে হবে ভদ্রবিত্তকে চাকরি দেয় করপোরেটপ্রণোদিত রাষ্ট্র আর করপোরেটরা স্বয়ং। কারিগর, চাষি বা হকার ভদ্রবিত্তকে চাকরি দেয় না। তাই ভদ্রবিত্ত মোটের ওপরে করপোটের স্বার্থের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের স্বার্থ সুরক্ষায় ব্যস্ত।
দুর্ভাগ্য যে আমাদের শাসক ও ভদ্রবিত্তরা আজও ইউরোপীয়দের তৈরি করা ঔপনিবেশিক বিশ্বব্যবস্থাতেই নিজেদের দেশের উন্নয়নের নিদান খুঁজছে। ‘স্বাধীন’ সাবেক ঔপনিবেশিক দেশগুলোকে বুঝতে হবে। ইউরোপের এশিয়া, আফ্রিকার মতো প্রাকৃতিক ধনসম্বল, জনবল না থাকা সত্ত্বেও করপোরেটদের মাধ্যমে তারা আজও শোষণ চালাচ্ছে। আমাদের সংগঠনের অন্যতম কর্মী বহ্নিহোত্রী হাজরা, কোবাড গান্ধীর গবেষণা থেকে দেখিয়েছেন, গত বছর ভারতের জিডিপির ১৭ শতাংশ লুট হয়ে দেশের বাইরে চলে গেছে। আমাদের উন্নয়ন আমাদের মতো করে হতে হবে। তবেই আমরা বাংলার ৬-৭ শতাংশ জিডিপিতে পৌঁছাতে পারব।
আজকের পত্রিকা: সেটা কী করে সম্ভব?
বিশ্বেন্দু নন্দ: সেই দিশা দেখাতে পারে অতীত ইতিহাস। করপোরেট অর্থনীতি রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হলে কী ঘটতে পারে? সেই উদাহরণের জন্য পলাশীর পরের বাংলাই যথেষ্ট। তাই অতীতের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে বাংলাকে সোনার বাংলা বানাতে করপোরেটদের খাঁচায় পোরা একান্তই প্রাথমিক শর্ত—তারপর অন্য কিছু।
আজকের পত্রিকা: পশ্চিম বাংলার ইতিহাসচর্চায় উপনিবেশবিরোধী চর্চাটা কেমন?
বিশ্বেন্দু নন্দ: ভদ্রবিত্তের চরিত্র সারা বিশ্বে এক। সে ঢাকা, কলকাতা, নিউইয়র্ক বা কঙ্গোর রাজধানী ব্রাজাভিল—যেকোনো অঞ্চল হোক না কেন। কলকাতা ভোলে না সে ছিল দ্বিতীয় সাম্রাজ্যকেন্দ্র। তার প্রৌঢ়, বৃদ্ধ, জরাগ্রস্ত ঔপনিবেশিক ভদ্রবিত্ত সমাজ যেকোনো ছুতোয় করপোরেটের দাস। বাংলার নতুন প্রজন্ম ক্রমেই জাগছে, অপ্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা সংগঠনের সব গবেষকই তরুণ। তাঁরাও প্রভাব ছড়াচ্ছেন। আমাদের সংগঠনের কর্মী অত্রি ভট্টাচার্য হিন্দুত্বকে নতুন চোখে এবং নতুন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেখছেন, বহ্নিহোত্রী হাজরা সম্পদ লুটতত্ত্বে নতুন চরিত্র খুঁজে বেড়াচ্ছেন, দেবত্র দে আজকের কাঠামোগত সংস্কার নিয়ে কাজ করছেন এবং অমিয় চক্রবর্তী কাজ করছেন কথিত পলাশীর পরের সময়ের কাঠামোগত সংস্কারের ধারণা নিয়ে, সুদীঘ্ন দাস কাজ করছেন লুপ্ত হতে চলা জনপরিসর নিয়ে, ইমরাজ শেখ মির্জা কাজ করছেন হাটে করপোরেট দখলদারি বুঝতে, শাজাহান আলী কাজ করছেন মোগল আমলের জেন্ডার ফ্লুইডিটি নিয়ে।
শুধু কলকাতা নয়, আপনাদের বাংলাদেশের পঞ্চগড়ের নয়ন তানবীরুল বারী কাজ করছেন তাঁর অঞ্চল নিয়ে এবং চট্টগ্রামের সৈয়দ মোহাম্মদ মিনহাজ সুফি বাংলার শেষ হয়ে যাওয়া তুলো চাষ ফিরিয়ে আনতে উদ্যমী হয়েছেন। আমরা প্রতি মাসে একটা করে ছোট পুস্তক প্রকাশ করছি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিল্টন বিশ্বাস আর নবজাগরণের উদ্দেশ্য ও বিধেয় নিয়ে জরুরি প্রশ্ন তোলা দেবোত্তম চক্রবর্তী যৌথভাবে সম্পাদনা করছেন ১৭৭০ সালের গণহত্যা বুঝতে একটি বই।
কলকাতা, বাংলাদেশে প্রচুর প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উপনিবেশবিরোধী চর্চা করার গবেষক চাই। আমরা নতুন প্রজন্মের প্রতি একটু বেশিই আস্থাশীল। তাদের হাতেই মুক্তির লাগাম। এ কাজে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
আজকের পত্রিকা: উপনিবেশবিরোধী চর্চায় আপনার গুরু কারা?
বিশ্বেন্দু নন্দ: প্রথমত, চাষি, হকার ও কারিগর। তাঁরা শিখিয়েছেন ভদ্রবিত্ত সমাজ, পরজীবী রাষ্ট্র আর শহরব্যবস্থার বাইরে বিশাল বঙ্গভূমির উৎপাদনশীল মানুষদের দিকে চোখ ফেরাতে। বঙ্গভূমির কারিগরেরা উৎপাদনব্যবস্থার করপোরেট এবং কেন্দ্রীকরণবিরোধী। উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ে করপোরেটবিরোধী লড়াই প্রাণ দিয়ে লড়ে চলেছেন হাটুরেরা হাটের দোকানে, চাষিরা শস্য-শ্যামলা মাঠে আর বাড়ির ছোট্ট কারখানায় কামার, তাঁতি ও শঙ্খ কারিগরেরা স্লোগান-মিছিল ছাড়াই। কারণ তাঁদের তৈরি কারিগরব্যবস্থার চরিত্রটা তা-ই বলে।
১৭৬৩ সালে ফকির, সন্ন্যাসী, চাষি আর অন্য পেশাদার উপনিবেশের চরিত্র বুঝেছিলেন কয়েক বছরেই। তাঁরা অস্ত্র হাতে যে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, সেই যুদ্ধ চলেছিল ১৮৫৮ সালের পরেও গ্রামেগঞ্জে। তখন ভদ্রবিত্তরা উপনিবেশের শর্তে তাদের হয়ে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র গড়তে ব্যস্ত। জয়া মিত্র, ধরম পাল, সুশীল চৌধুরী, অনুপম মিশ্র নতুন ভাবনার পথ দেখিয়েছেন। মোগল আমল নিয়ে মরহুম আবদুল করিম আজও আমার শিক্ষক। তিনিই মোগল বাংলা দেখতে শেখালেন। তাঁরাই আমার গুরু। তরুণদের কাছে নিত্য শিখি। আমি তাঁদের বিনীত অনুগামী।
আজকের পত্রিকা: আমরা কীভাবে উপনিবেশ থেকে মুক্ত হতে পারি?
বিশ্বেন্দু নন্দ: উপনিবেশ থেকে মুক্তির সহজ পথ নেই। স্পষ্ট মনে করি, দেশকে উপনিবেশমুক্ত করার আগে নিজেদের মনকে উপনিবেশমুক্ত করতে হবে। উপনিবেশ-পূর্ব সময়কে দেখতে হবে জাতিরাষ্ট্রের তৈরি করা চশমা খুলেই। তবেই আমরা নতুন বাংলায় শ্বাস নিতে পারব।
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৬ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৬ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৬ দিন আগে