মোনায়েম সরকার
আজকাল কী যে হয়েছে, মোবাইল ফোন বেজে উঠলেই বুকের ভেতর কেমন একটা ধুকপুক ভাব হয়। কোনো খারাপ খবর নয় তো! বয়স হয়েছে। রাজনীতির অঙ্গনে জীবনের ৬০ বছরের বেশি সময় কাটিয়ে ভালো-খারাপ বহু খবর শুনে অভ্যস্ত হয়েছি। তবে জীবনের এই শেষবেলায় দুঃসংবাদ শুনে আর সহজভাবে নিতে পারি না।
বুধবার, ১৬ অক্টোবর দুপুর গড়িয়ে যেতেই ফোনটা বেজে উঠল। হ্যালো বলতেই ও প্রান্ত থেকে এক পরিচিত জনের কণ্ঠ, ‘মতিয়া আপা নেই।’ বুকটা কেঁপে উঠল। বলে কী!
মতিয়া চৌধুরী। বাংলাদেশের রাজনীতির এক অতিপরিচিত নাম। গত শতকের ষাট দশকের শুরু থেকেই আমরা পরিচিত, বন্ধু এবং সহযোদ্ধা। একসঙ্গে বহু পথ হেঁটেছি। মিছিল-মিটিং করেছি। আলাপ-আলোচনা করেছি। তর্ক-বিতর্ক করেছি। একমত হয়েছি, ভিন্নমত পোষণ করেছি। মনোমালিন্যও কখনো কখনো হয়েছে। কিন্তু দূরত্ব তৈরি হয়নি আমাদের মধ্যে। ভাইবোনের মতোই থেকেছি।
পরিচয়ের সূত্র অবশ্যই ছাত্র ইউনিয়ন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে থেকেই আমি ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। মতিয়া চৌধুরীও তাই। তিনি বয়সে আমার চেয়ে সামান্য বড়। ইডেন কলেজে পড়ার সময়ই মতিয়া চৌধুরী ছাত্র ইউনিয়নের পতাকাবাহী হন। ইডেন কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি বা ভিপিও নির্বাচিত হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তিনি প্রথমে রোকেয়া হল ছাত্র সংসদের ভিপি এবং পরে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। বিশেষ করে বক্তৃতায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার ছিল। আমার সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিকে অবশ্য তাঁকে জ্বালাময়ী বক্তা বলে মনে হয়নি।
একবার শহীদ মিনারে এক প্রতিবাদ সভায় তিনি তো খুব সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিয়ে আমাকে হতাশই করেছিলেন। কিন্তু ওই একবারই। তারপর অতিদ্রুত তিনি বক্তৃতা রপ্ত করেন, ভালো বক্তা হয়ে ওঠেন। শব্দ চয়ন, প্রচলিত ছোট ছোট গল্প, বাংলা ভাষায় চালু বিশেষ কিছু উপমা ইত্যাদি প্রয়োগ করে তিনি এমন বক্তৃতা করতেন, যা শ্রোতা-দর্শকেরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত। অল্প সময়ের মধ্যেই মতিয়া চৌধুরী হয়ে ওঠেন বাংলার ‘অগ্নিকন্যা’।
তখন চলছিল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন। সেই সময় সারা দেশে চারণের মতো ছুটে বেড়িয়েছেন মতিয়া চৌধুরী। মুখ দিয়ে যেন বেরোত আগুনের গোলা। ছাত্র-জনতাকে মাতিয়ে তুলত তাঁর বক্তৃতা।
ছাত্রজীবন শেষে আমরা একই সঙ্গে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপের রাজনীতিতে যোগ দিই। সেটা ছিল ১৯৬৭ সাল। অবশ্য তার আগেই আমরা গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করি। বলা যায়, কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশেই আমরা ন্যাপে যোগ দিয়ে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কার্যকলাপ করার সুযোগ নিয়েছি। তত দিনে অবশ্য রাশিয়া-চীন মতাদর্শিক দ্বন্দ্বে কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। চীনপন্থী ন্যাপের নেতৃত্বে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আর মস্কোপন্থী ন্যাপের নেতৃত্বে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। আমরা ছিলাম মোজাফফর ন্যাপে।
১৯৬৫ সালে ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নও দ্বিধাবিভক্ত হয়। এক অংশের সভাপতি মতিয়া চৌধুরী, আরেক অংশে রাশেদ খান মেনন। মতিয়া চৌধুরীর বক্তৃতার কারণে স্বভাবতই ছাত্র ইউনিয়নের মতিয়া গ্রুপের সাংগঠনিক অবস্থা ছিল ভালো। মতিয়া চৌধুরী ন্যাপে যোগ দেওয়ার পর মূলত তাঁর জনপ্রিয়তাকে ভিত্তি করে রাজনৈতিক দল হিসেবে ন্যাপেরও বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। দলের সভাপতি মোজাফফর আহমদের চেয়ে মতিয়া চৌধুরীর পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা বেশি ছিল। দলের জনসভায় সভাপতি আগে বক্তৃতা করতেন, শেষের বক্তা ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। কারণ, তাঁর বক্তৃতার পর অনেক শ্রোতা সভাস্থল ত্যাগ করত।
মতিয়া চৌধুরীর সঙ্গে কত স্মৃতি। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি। বামপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার তুলনা হয় না। শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই বাম-প্রগতিশীলদের রাজনীতি করতে হয়েছে। অনেকের জীবনের সিংহভাগ কেটেছে কারাগারে কিংবা আত্মগোপনে।
আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। তাঁকে আন্দোলন থেকে কোনোভাবে নিবৃত্ত করতে না পেরে সরকার ভিন্ন পন্থা বেছে নেয়। তাঁর বাবা তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তা মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে চাপ দিতে শুরু করে সরকার। একপর্যায়ে মতিয়া চৌধুরীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়। অসম সাহসী মতিয়া চৌধুরী আপসের পথে হাঁটার বিরোধী ছিলেন। তিনি আইয়ুবশাহীর চাপের মুখে সিদ্ধান্ত নেন বাবাকে অভিভাবকের দায়িত্ব থেকে মুক্ত করার।
তিনি তাঁর বাবাকে জানান, বিয়ে করে তিনি অভিভাবকত্ব পরিবর্তন করবেন কিন্তু রাজনীতি থেকে দূরে সরবেন না। ১৯৬৪ সালের ১৮ জুন খ্যাতিমান সাংবাদিক বজলুর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মতিয়া চৌধুরী। কিন্তু বিয়ের অল্প কিছুদিন পরই তিনি গ্রেপ্তার হন; শুরু হয় ছন্নছাড়া জীবন।
এখানে এটা বলা প্রয়োজন যে রাজনীতি এবং সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে মতিয়া চৌধুরীকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে মোট ১৫ বার জেলে যেতে হয়েছে কিংবা পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে বারবার পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। রাজনৈতিক জীবনে মতিয়া চৌধুরীকে ১৫ বার গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। এর মধ্যে আইয়ুব শাসনামলে চারবার কারাগারে যেতে হয়েছে তাঁকে। আইয়ুবের শেষ দুই বছর টানা কারাগারেই থাকতে হয়েছে মতিয়া চৌধুরীকে। ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতনের পর অন্য সব রাজবন্দীর সঙ্গে তিনিও জেল থেকে মুক্তি পান। কারাগারের অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর লেখা গ্রন্থ ‘দেয়াল দিয়ে ঘেরা’ পাঠকপ্রিয় হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের শাসন আমল ছাড়া সব সরকারের আমলেই মতিয়া চৌধুরীকে জেলে যেতে হয়েছে। জিয়াউর রহমানের আমলে তাঁকে কারাগারে যেতে হয়েছে। এরশাদ সরকারের আমলে যেতে হয়েছে ৯ বার। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার আমলেও মতিয়া চৌধুরীকে কারাগারে যেতে হয়।
১৯৭১ সালে মতিয়া চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। ১৯৭৫ সালে বিশেষ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠন করলে মতিয়া চৌধুরীকে বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়। আওয়ামী লীগের সামনে দেখা দেয় ঘোর দুঃসময়।
ন্যাপ সভাপতি মোজাফফর আহমদ এক দোদুল্যমান অবস্থান গ্রহণ করেন, এমনকি জিয়াউর রহমানের প্রতি নমনীয় নীতি নিয়ে চলতে শুরু করেন। তখন মতিয়া চৌধুরীসহ আমরা কয়েকজন ন্যাপ ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিই। ১৯৭৯ সালের ১০ ডিসেম্বর মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে আমরা কয়েকজন আওয়ামী লীগে যোগ দিই। ক্ষমতার রাজনীতির মোহে নয়, আমরা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলাম দেশে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক ধারার রাজনীতিকে শক্তি জোগানোর জন্য। তখন মতিয়া চৌধুরী বলতেন, ছোট দলের বড় নেতা হওয়ার চেয়ে বড় দলের ছোট নেতা হয়ে যদি দেশ ও জনগণের জন্য ভালো কিছু করা যায়, তাহলে মন্দ কী!
আওয়ামী লীগে গিয়েও মতিয়া চৌধুরী ধীরে ধীরে বড় নেতাই হয়েছিলেন। একপর্যায়ে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হয়েছেন। তিনি শেরপুর থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৯৬ ও ২০০৯ এবং ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলে তিনি কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুর পর ২০২৩ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে জাতীয় সংসদের সংসদ উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন। দল এবং সরকার পরিচালনায় সমান দক্ষতার পরিচয় দেন মতিয়া চৌধুরী।
ক্ষমতার রাজনীতির ভেতরে থেকেও একজন ব্যক্তি চাইলে যে সৎ থাকা যায়, তার উজ্জ্বল উদাহরণ মতিয়া চৌধুরী। তাঁর বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতির কোনো অভিযোগ তাঁর শত্রুরাও তুলতে পারবে না। মতিয়া চৌধুরী চলনে-বলনে-পোশাকে ছিলেন সাদাসিধা। ক্ষমতার দাপট দেখাননি কখনো।
আমি সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে আছি তা-ও দুই দশক হয়ে গেল। মতিয়া আপা ছিলেন আমৃত্যু সক্রিয় রাজনীতির মানুষ। কিন্তু আমার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। আমরা সব সময় ছিলাম পরস্পরের হিতাকাঙ্ক্ষী। তিনি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চের একজন ট্রাস্টি ছিলেন। আমার বসবাসের ঠিকানা ২৩ নম্বর চামেলীবাগের বাড়িতে তিনি কতবার যে এসেছেন, তার হিসাব করা কঠিন। আমি সাধারণত কারও বাসাবাড়িতে তেমন যাই না, কিন্তু মতিয়া আপার বাসায় আমিও কম যাইনি। আগেই বলেছি, আমরা একসঙ্গে পথ চলেছি, আমাদের মতান্তর হয়েছে, কিন্তু মনান্তর হয়নি কখনো।
১৯৪২ সালে পিরোজপুরে জন্ম হয়েছিল মতিয়া চৌধুরীর। ২০২৪ সালের ১৬ অক্টোবর ৮২ বছর বয়সে তিনি চিরবিদায় নিলেন। তাঁর এই চলে যাওয়া বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য বড় ক্ষতি। মতিয়া আপার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
মোনায়েম সরকার, রাজনীতিবিদ, লেখক ও চেয়ারম্যান, বিএফডিআর
আজকাল কী যে হয়েছে, মোবাইল ফোন বেজে উঠলেই বুকের ভেতর কেমন একটা ধুকপুক ভাব হয়। কোনো খারাপ খবর নয় তো! বয়স হয়েছে। রাজনীতির অঙ্গনে জীবনের ৬০ বছরের বেশি সময় কাটিয়ে ভালো-খারাপ বহু খবর শুনে অভ্যস্ত হয়েছি। তবে জীবনের এই শেষবেলায় দুঃসংবাদ শুনে আর সহজভাবে নিতে পারি না।
বুধবার, ১৬ অক্টোবর দুপুর গড়িয়ে যেতেই ফোনটা বেজে উঠল। হ্যালো বলতেই ও প্রান্ত থেকে এক পরিচিত জনের কণ্ঠ, ‘মতিয়া আপা নেই।’ বুকটা কেঁপে উঠল। বলে কী!
মতিয়া চৌধুরী। বাংলাদেশের রাজনীতির এক অতিপরিচিত নাম। গত শতকের ষাট দশকের শুরু থেকেই আমরা পরিচিত, বন্ধু এবং সহযোদ্ধা। একসঙ্গে বহু পথ হেঁটেছি। মিছিল-মিটিং করেছি। আলাপ-আলোচনা করেছি। তর্ক-বিতর্ক করেছি। একমত হয়েছি, ভিন্নমত পোষণ করেছি। মনোমালিন্যও কখনো কখনো হয়েছে। কিন্তু দূরত্ব তৈরি হয়নি আমাদের মধ্যে। ভাইবোনের মতোই থেকেছি।
পরিচয়ের সূত্র অবশ্যই ছাত্র ইউনিয়ন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে থেকেই আমি ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। মতিয়া চৌধুরীও তাই। তিনি বয়সে আমার চেয়ে সামান্য বড়। ইডেন কলেজে পড়ার সময়ই মতিয়া চৌধুরী ছাত্র ইউনিয়নের পতাকাবাহী হন। ইডেন কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি বা ভিপিও নির্বাচিত হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তিনি প্রথমে রোকেয়া হল ছাত্র সংসদের ভিপি এবং পরে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। বিশেষ করে বক্তৃতায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার ছিল। আমার সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিকে অবশ্য তাঁকে জ্বালাময়ী বক্তা বলে মনে হয়নি।
একবার শহীদ মিনারে এক প্রতিবাদ সভায় তিনি তো খুব সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিয়ে আমাকে হতাশই করেছিলেন। কিন্তু ওই একবারই। তারপর অতিদ্রুত তিনি বক্তৃতা রপ্ত করেন, ভালো বক্তা হয়ে ওঠেন। শব্দ চয়ন, প্রচলিত ছোট ছোট গল্প, বাংলা ভাষায় চালু বিশেষ কিছু উপমা ইত্যাদি প্রয়োগ করে তিনি এমন বক্তৃতা করতেন, যা শ্রোতা-দর্শকেরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত। অল্প সময়ের মধ্যেই মতিয়া চৌধুরী হয়ে ওঠেন বাংলার ‘অগ্নিকন্যা’।
তখন চলছিল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন। সেই সময় সারা দেশে চারণের মতো ছুটে বেড়িয়েছেন মতিয়া চৌধুরী। মুখ দিয়ে যেন বেরোত আগুনের গোলা। ছাত্র-জনতাকে মাতিয়ে তুলত তাঁর বক্তৃতা।
ছাত্রজীবন শেষে আমরা একই সঙ্গে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপের রাজনীতিতে যোগ দিই। সেটা ছিল ১৯৬৭ সাল। অবশ্য তার আগেই আমরা গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করি। বলা যায়, কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশেই আমরা ন্যাপে যোগ দিয়ে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কার্যকলাপ করার সুযোগ নিয়েছি। তত দিনে অবশ্য রাশিয়া-চীন মতাদর্শিক দ্বন্দ্বে কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। চীনপন্থী ন্যাপের নেতৃত্বে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আর মস্কোপন্থী ন্যাপের নেতৃত্বে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। আমরা ছিলাম মোজাফফর ন্যাপে।
১৯৬৫ সালে ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নও দ্বিধাবিভক্ত হয়। এক অংশের সভাপতি মতিয়া চৌধুরী, আরেক অংশে রাশেদ খান মেনন। মতিয়া চৌধুরীর বক্তৃতার কারণে স্বভাবতই ছাত্র ইউনিয়নের মতিয়া গ্রুপের সাংগঠনিক অবস্থা ছিল ভালো। মতিয়া চৌধুরী ন্যাপে যোগ দেওয়ার পর মূলত তাঁর জনপ্রিয়তাকে ভিত্তি করে রাজনৈতিক দল হিসেবে ন্যাপেরও বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। দলের সভাপতি মোজাফফর আহমদের চেয়ে মতিয়া চৌধুরীর পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা বেশি ছিল। দলের জনসভায় সভাপতি আগে বক্তৃতা করতেন, শেষের বক্তা ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। কারণ, তাঁর বক্তৃতার পর অনেক শ্রোতা সভাস্থল ত্যাগ করত।
মতিয়া চৌধুরীর সঙ্গে কত স্মৃতি। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি। বামপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার তুলনা হয় না। শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই বাম-প্রগতিশীলদের রাজনীতি করতে হয়েছে। অনেকের জীবনের সিংহভাগ কেটেছে কারাগারে কিংবা আত্মগোপনে।
আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। তাঁকে আন্দোলন থেকে কোনোভাবে নিবৃত্ত করতে না পেরে সরকার ভিন্ন পন্থা বেছে নেয়। তাঁর বাবা তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তা মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে চাপ দিতে শুরু করে সরকার। একপর্যায়ে মতিয়া চৌধুরীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়। অসম সাহসী মতিয়া চৌধুরী আপসের পথে হাঁটার বিরোধী ছিলেন। তিনি আইয়ুবশাহীর চাপের মুখে সিদ্ধান্ত নেন বাবাকে অভিভাবকের দায়িত্ব থেকে মুক্ত করার।
তিনি তাঁর বাবাকে জানান, বিয়ে করে তিনি অভিভাবকত্ব পরিবর্তন করবেন কিন্তু রাজনীতি থেকে দূরে সরবেন না। ১৯৬৪ সালের ১৮ জুন খ্যাতিমান সাংবাদিক বজলুর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মতিয়া চৌধুরী। কিন্তু বিয়ের অল্প কিছুদিন পরই তিনি গ্রেপ্তার হন; শুরু হয় ছন্নছাড়া জীবন।
এখানে এটা বলা প্রয়োজন যে রাজনীতি এবং সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে মতিয়া চৌধুরীকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে মোট ১৫ বার জেলে যেতে হয়েছে কিংবা পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে বারবার পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। রাজনৈতিক জীবনে মতিয়া চৌধুরীকে ১৫ বার গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। এর মধ্যে আইয়ুব শাসনামলে চারবার কারাগারে যেতে হয়েছে তাঁকে। আইয়ুবের শেষ দুই বছর টানা কারাগারেই থাকতে হয়েছে মতিয়া চৌধুরীকে। ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতনের পর অন্য সব রাজবন্দীর সঙ্গে তিনিও জেল থেকে মুক্তি পান। কারাগারের অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর লেখা গ্রন্থ ‘দেয়াল দিয়ে ঘেরা’ পাঠকপ্রিয় হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের শাসন আমল ছাড়া সব সরকারের আমলেই মতিয়া চৌধুরীকে জেলে যেতে হয়েছে। জিয়াউর রহমানের আমলে তাঁকে কারাগারে যেতে হয়েছে। এরশাদ সরকারের আমলে যেতে হয়েছে ৯ বার। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার আমলেও মতিয়া চৌধুরীকে কারাগারে যেতে হয়।
১৯৭১ সালে মতিয়া চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। ১৯৭৫ সালে বিশেষ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠন করলে মতিয়া চৌধুরীকে বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়। আওয়ামী লীগের সামনে দেখা দেয় ঘোর দুঃসময়।
ন্যাপ সভাপতি মোজাফফর আহমদ এক দোদুল্যমান অবস্থান গ্রহণ করেন, এমনকি জিয়াউর রহমানের প্রতি নমনীয় নীতি নিয়ে চলতে শুরু করেন। তখন মতিয়া চৌধুরীসহ আমরা কয়েকজন ন্যাপ ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিই। ১৯৭৯ সালের ১০ ডিসেম্বর মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে আমরা কয়েকজন আওয়ামী লীগে যোগ দিই। ক্ষমতার রাজনীতির মোহে নয়, আমরা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলাম দেশে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক ধারার রাজনীতিকে শক্তি জোগানোর জন্য। তখন মতিয়া চৌধুরী বলতেন, ছোট দলের বড় নেতা হওয়ার চেয়ে বড় দলের ছোট নেতা হয়ে যদি দেশ ও জনগণের জন্য ভালো কিছু করা যায়, তাহলে মন্দ কী!
আওয়ামী লীগে গিয়েও মতিয়া চৌধুরী ধীরে ধীরে বড় নেতাই হয়েছিলেন। একপর্যায়ে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হয়েছেন। তিনি শেরপুর থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৯৬ ও ২০০৯ এবং ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলে তিনি কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুর পর ২০২৩ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে জাতীয় সংসদের সংসদ উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন। দল এবং সরকার পরিচালনায় সমান দক্ষতার পরিচয় দেন মতিয়া চৌধুরী।
ক্ষমতার রাজনীতির ভেতরে থেকেও একজন ব্যক্তি চাইলে যে সৎ থাকা যায়, তার উজ্জ্বল উদাহরণ মতিয়া চৌধুরী। তাঁর বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতির কোনো অভিযোগ তাঁর শত্রুরাও তুলতে পারবে না। মতিয়া চৌধুরী চলনে-বলনে-পোশাকে ছিলেন সাদাসিধা। ক্ষমতার দাপট দেখাননি কখনো।
আমি সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে আছি তা-ও দুই দশক হয়ে গেল। মতিয়া আপা ছিলেন আমৃত্যু সক্রিয় রাজনীতির মানুষ। কিন্তু আমার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। আমরা সব সময় ছিলাম পরস্পরের হিতাকাঙ্ক্ষী। তিনি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চের একজন ট্রাস্টি ছিলেন। আমার বসবাসের ঠিকানা ২৩ নম্বর চামেলীবাগের বাড়িতে তিনি কতবার যে এসেছেন, তার হিসাব করা কঠিন। আমি সাধারণত কারও বাসাবাড়িতে তেমন যাই না, কিন্তু মতিয়া আপার বাসায় আমিও কম যাইনি। আগেই বলেছি, আমরা একসঙ্গে পথ চলেছি, আমাদের মতান্তর হয়েছে, কিন্তু মনান্তর হয়নি কখনো।
১৯৪২ সালে পিরোজপুরে জন্ম হয়েছিল মতিয়া চৌধুরীর। ২০২৪ সালের ১৬ অক্টোবর ৮২ বছর বয়সে তিনি চিরবিদায় নিলেন। তাঁর এই চলে যাওয়া বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য বড় ক্ষতি। মতিয়া আপার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
মোনায়েম সরকার, রাজনীতিবিদ, লেখক ও চেয়ারম্যান, বিএফডিআর
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে