মৃত্যুঞ্জয় রায়
জলবায়ু পরিবর্তন এখন আমাদের নানামুখী সংকটের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। এগুলোর মধ্যে একটি হলো মশার বিস্তার। কর্মক্ষেত্রে প্রায় ২০ বছরে আমি পাঁচজন ডেনিশ ও ইউরোপীয় সহকর্মী পেয়েছিলাম এ দেশে। চাকরি শেষে সবাই যাঁর যাঁর দেশে ফিরে গেছেন।
এদের মধ্যে একজন রসিকতা করে আমাকে জানিয়েছেন, ‘তোমাদের দেশ আমাকে এক দারুণ অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছে, তা হলো মশা। ছোটবেলা থেকে কখনো এ জীবটিকে ডেনমার্কে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। বাংলাদেশে গিয়ে তার কামড় খেয়েছি। এখন ফিরে এসে হঠাৎ গ্রীষ্মে ডেনমার্কে ওই আপদের দেখা পেয়েছি। মনে হচ্ছে, তোমাদের দেশ থেকে এখন আমাদের মশারি আমদানি করতে হবে। আমরা কখনো এই খুদে জীবটার কথা ভাবিনি। আর ভাবিনি যে আমাদের ঘরগুলোর হিটিং সিস্টেমের পাশাপাশি এখন কুলিং সিস্টেমেও যেতে হবে। তাই মশারির সঙ্গে সিলিং ফ্যানও লাগবে আমাদের। আমদানির এ ব্যবসাটা ধরতে পারলে মন্দ হয় না!’
যতই এটাকে হেসে উড়িয়ে দিই না কেন, বাস্তবতাটা এখন তা-ই। বিশ্বের বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা গত সোয়া লাখ বছরে যা হয়নি, তার রেকর্ড ছাড়িয়েছে, জুনে এক দিন বিশ্বের বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে নাসা ১৭ দশমিক ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা নিকট অতীতে কখনো হয়নি। প্রতিদিনই এই গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির রেকর্ড ভাঙছে আর গড়ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে পরিচালিত কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস সম্প্রতি দুবাইতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলনের (কপ-২৮) প্রস্তুতিমূলক সভায় জানিয়েছে, কিছুদিন ধরে ভূপৃষ্ঠে বায়ুর তাপমাত্রার বৃদ্ধি শিল্পযুগের আগের চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি রয়েছে।
অথচ গত বছর গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ-২৭ সম্মেলনে বিশ্বনেতারা এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন চরম আবহাওয়ার মাত্রা ও বিস্তৃতি বাড়ছে। চলতি বছর বিশ্বের অনেক দেশে যে পরিমাণ গরম পড়েছে, সেসব দেশে অতীতে কখনো তা দেখা যায়নি, বিশ্বজুড়ে যে খরা ও দাবানল দেখা দিয়েছে, ভেনিসের খালগুলো শুকিয়ে গেছে, ইউফ্রেটিস নদীর তলা দেখা গেছে, অতীতে তেমনটি দেখা যায়নি।
অন্যদিকে, বিরল শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আফ্রিকায় আঘাত হেনেছে, আফ্রিকার কোনো কোনো দেশের তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি চলে গেছে, এতে ফসল উৎপাদন মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে, বেড়েছে রোগের প্রকোপ, অতীতে এমনটি ঘটেনি।
এর প্রভাবে সময়ে-অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে, কখনো বৃষ্টি হচ্ছে না আবার অতিবৃষ্টিতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ভারতের উত্তরাখন্ড, হরিয়ানা, হিমাচল, দিল্লি। থেমে থেমে বৃষ্টি ও গরম আবহাওয়ায় আমাদের ক্ষতি হলেও লাভ হচ্ছে মশার। এতে ওদের প্রজনন ও বংশবিস্তারের সুবিধা হয়েছে। আর এতে দ্রুত বেড়ে গেছে মশাবাহী রোগের বিস্তার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, জলবাযু পরিবর্তন, নির্বণীকরণ ও নগরায়ণের কারণে বিশ্বে এখন ডেঙ্গু, জিকা, চিকুনগুনিয়া ইত্যাদি ভাইরাসজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব ও ঝুঁকি খুব বেড়ে গেছে। সে গবেষণায় তারা পেয়েছে যে, উষ্ণ ও অবউষ্ণ অঞ্চলের দেশগুলোতে সাম্প্রতিক দশকে মশাবাহিত রোগের সংক্রমণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০০ সালে যেখানে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৫ লাখের একটু বেশি, সেখানে ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২ লাখ। এ বছরে দ্রুত সে পরিমাণ আশঙ্কা জনকভাবে বেড়েছে। এটা শুধু বাংলাদেশের চিত্র নয়, সারা বিশ্বেরই একই অবস্থা।
ডেঙ্গু যে বেড়েছে, তা আমরা সম্প্রতি আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিত্যদিনের দেওয়া রিপোর্ট থেকেই দেখতে পাচ্ছি। চলতি বছরের জুলাইয়ের শেষ দিকে এসে দেশের লক্ষাধিক মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এ বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগে মারা গেছে ৫০০-এর বেশি মানুষ। এ দেশে ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ দেখা যায়। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো বছরে এত বেশি লোক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়নি ও মরেনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানে না এর শেষ কোথায়! ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ারও রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। এর আগে ২০১৯, ২০২১ ও ২০২২ সালেও ডেঙ্গু রোগে মৃত্যু ১০০ ছাড়িয়েছিল। কিন্তু চলতি আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু রোগ বাড়ার মোক্ষম সময় এখনো পড়ে রয়েছে। তাই আশঙ্কা করা হচ্ছে, এবার অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে ডেঙ্গু। মজার বিষয় হলো, প্রতিবছর বিশ্বে মানুষের হাতে মারা পড়ে ৪ লাখ ৩৭ হাজার লোক। আর মশার কামড়ে প্রাণ হারায় ৭ লাখ ৫০ হাজার মানুষ! বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষ মরে মশার কামড়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল প্রোগ্রাম অন কন্ট্রোল অব নেগলেক্টেড ট্রপিক্যাল ডিজিজেস কো-অর্ডিনেটিং ডেঙ্গু অ্যান্ড আরবোভাইরাস ইনিশিয়েটিভ ইউনিটের প্রধান র্যামন ভেলায়ুধান বলেছেন, ‘বিশ্বের সব দেশেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে, আর এ কারণে বর্তমানে বিশ্বের ১২৯টি দেশ ডেঙ্গু রোগের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এসব দেশের অন্তত ১০০টি দেশে ডেঙ্গু মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রতিবছর এখন বিশ্বে ১০০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন লোক ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।’ জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত জলবায়ু পরিবর্তনে অধিক বৃষ্টিপাত, অধিক তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা এসব রোগবাহী মশার বংশবৃদ্ধি বাড়িয়ে দিয়েছে।
তবে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনই যে এর জন্য একমাত্র কারণ তা নয়, আমাদের অসচেতনতা ও মশক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যর্থতাও কম দায়ী নয়। বছরে প্রায় ১৪৪ কোটি টাকা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশকনিধনের পেছনে ব্যয় করছে। কিন্তু তারা বলেছে, তারা ভুল কৌশলে এত দিন মশক নিধন করেছে, ওষুধ দিয়ে শুধু মশার বাচ্চাদের মারা হচ্ছে। মশক নিয়ন্ত্রণে প্রকৃতিরও একটা নিয়ম আছে, সে নিয়মের লঙ্ঘন ঘটেছে। একটি সহজ উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে বিষয়টি। মশারা যেখানে পানি জমে থাকে সেখানে ডিম পাড়ে। সেখানে গঙ্গা ফড়িং আর সুই ফড়িংরাও ডিম পাড়ে, ব্যাঙরাও। এসব পোকা ও ব্যাঙের বাচ্চারা ডিম ফুটে বের হলে ওরা মশার বাচ্চাদের বিরিয়ানির মতো খায়! কীটনাশক দেওয়ায় সে খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়েছে।
ঢাকায় ডেঙ্গু সংক্রমণ বেশি, কিন্তু অন্য নগরের অবস্থাও প্রায় একই রকম। দুর্বল নিষ্কাশনব্যবস্থা ও নির্মাণাধীন ভবনগুলো ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। ডেঙ্গু রোগের টিকাও সুলভ নয়, একটি মাত্র টিকার অনুমোদন রয়েছে মাত্র ২০টি দেশে, ২টি টিকা অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। বিপুলসংখ্যক রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার মতো সক্ষমতাও আমাদের নেই। মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লে তাই আমাদের জন্য তা মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে। ব্যাপক সামাজিক সচেতনতা ও নিজেদের করণীয় সম্পর্কে সচেতন না হলে কোনো সরকারের পক্ষেই শতভাগ সফলভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
শেষে ডেনমার্কের একটি রূপকথা মনে পড়ছে। ১৮৪০ সালে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেন ‘দ্য উইকড প্রিন্স’ নামে একটা রূপকথা লেখেন। রূপকথার সেই রাজপুত্র ছিল খুবই পাজি। একের পর এক রাজ্য জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সে সব তার দখলে নিত। সে চেয়েছিল সারা পৃথিবী জয় করতে। সে চাইত, সবাই যেন তাকে ভয় করে। তার প্রাসাদ, সম্পদ আর শক্তি দেখে সবাই তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাজপুত্র মনে করত। একদিন তার ইচ্ছে হলো সে শহরের সবচেয়ে সুন্দর গির্জাটায় ঈশ্বরের মূর্তিটা সরিয়ে নিজের মূর্তি সেখানে বসাতে। চাটুকারেরা সবাই তাতে সায় দিলেও গির্জার পাদরিরা তাতে বাদ সাধল। তারা বলল, আপনি শক্তিমান, কিন্তু ঈশ্বর আপনার চেয়েও শক্তিমান। এ কথা শুনে সে রেগে গেল, বলল, আমি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জিতে দেখাতে চাই আমি তার চেয়েও শক্তিমান। সে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য এক আশ্চর্যজনক আকাশযান বানাল। তাতে চড়ে সে আকাশে চলল ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। ঈশ্বর তা টের পেয়ে এক ছোট্ট মশাকে আদেশ করল শয়তান রাজপুত্রকে শায়েস্তা করতে। মশা তার কানের কাছে ভন ভন করে তাকে রাগিয়ে দিল। কিন্তু কেউই মশাটাকে মারতে বা ধরতে পারল না। অবশেষে রাজপুত্রকে মশারি দিয়ে ঢাকা হলো। কিন্তু মশারির কাপড় দিয়ে ঢাকার সময়ই মশাটা তার ভেতরে ঢুকে পড়ল। মশাটা রাজপুত্রের দেহে হুল ফুটিয়ে বিষ ঢুকিয়ে দিল। সে বিষের যন্ত্রণায় রাজপুত্রের দেহে প্রচণ্ড জ্বালা শুরু হলো, চোখটা রক্তে লাল হয়ে উঠল। অবশেষে সে পাগলের মতো নাচতে লাগল। সেনারা তার এসব কাণ্ড দেখে হেসে কুটিকুটি হলো আর বলতে লাগল, আহারে বীর রাজপুত্র! যে সামান্য ছোট্ট একটা মশাকে হারাতে পারে না, সে আবার জিতবে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে!
রূপকথার সেই রাজপুত্রের মতো আমরাও কি হেরে যাব শেষে এই এডিস মশার কাছে?
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও লেখক; সিন্ডিকেট সদস্য, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
জলবায়ু পরিবর্তন এখন আমাদের নানামুখী সংকটের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। এগুলোর মধ্যে একটি হলো মশার বিস্তার। কর্মক্ষেত্রে প্রায় ২০ বছরে আমি পাঁচজন ডেনিশ ও ইউরোপীয় সহকর্মী পেয়েছিলাম এ দেশে। চাকরি শেষে সবাই যাঁর যাঁর দেশে ফিরে গেছেন।
এদের মধ্যে একজন রসিকতা করে আমাকে জানিয়েছেন, ‘তোমাদের দেশ আমাকে এক দারুণ অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছে, তা হলো মশা। ছোটবেলা থেকে কখনো এ জীবটিকে ডেনমার্কে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। বাংলাদেশে গিয়ে তার কামড় খেয়েছি। এখন ফিরে এসে হঠাৎ গ্রীষ্মে ডেনমার্কে ওই আপদের দেখা পেয়েছি। মনে হচ্ছে, তোমাদের দেশ থেকে এখন আমাদের মশারি আমদানি করতে হবে। আমরা কখনো এই খুদে জীবটার কথা ভাবিনি। আর ভাবিনি যে আমাদের ঘরগুলোর হিটিং সিস্টেমের পাশাপাশি এখন কুলিং সিস্টেমেও যেতে হবে। তাই মশারির সঙ্গে সিলিং ফ্যানও লাগবে আমাদের। আমদানির এ ব্যবসাটা ধরতে পারলে মন্দ হয় না!’
যতই এটাকে হেসে উড়িয়ে দিই না কেন, বাস্তবতাটা এখন তা-ই। বিশ্বের বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা গত সোয়া লাখ বছরে যা হয়নি, তার রেকর্ড ছাড়িয়েছে, জুনে এক দিন বিশ্বের বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে নাসা ১৭ দশমিক ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা নিকট অতীতে কখনো হয়নি। প্রতিদিনই এই গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির রেকর্ড ভাঙছে আর গড়ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে পরিচালিত কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস সম্প্রতি দুবাইতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলনের (কপ-২৮) প্রস্তুতিমূলক সভায় জানিয়েছে, কিছুদিন ধরে ভূপৃষ্ঠে বায়ুর তাপমাত্রার বৃদ্ধি শিল্পযুগের আগের চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি রয়েছে।
অথচ গত বছর গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ-২৭ সম্মেলনে বিশ্বনেতারা এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন চরম আবহাওয়ার মাত্রা ও বিস্তৃতি বাড়ছে। চলতি বছর বিশ্বের অনেক দেশে যে পরিমাণ গরম পড়েছে, সেসব দেশে অতীতে কখনো তা দেখা যায়নি, বিশ্বজুড়ে যে খরা ও দাবানল দেখা দিয়েছে, ভেনিসের খালগুলো শুকিয়ে গেছে, ইউফ্রেটিস নদীর তলা দেখা গেছে, অতীতে তেমনটি দেখা যায়নি।
অন্যদিকে, বিরল শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আফ্রিকায় আঘাত হেনেছে, আফ্রিকার কোনো কোনো দেশের তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি চলে গেছে, এতে ফসল উৎপাদন মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে, বেড়েছে রোগের প্রকোপ, অতীতে এমনটি ঘটেনি।
এর প্রভাবে সময়ে-অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে, কখনো বৃষ্টি হচ্ছে না আবার অতিবৃষ্টিতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ভারতের উত্তরাখন্ড, হরিয়ানা, হিমাচল, দিল্লি। থেমে থেমে বৃষ্টি ও গরম আবহাওয়ায় আমাদের ক্ষতি হলেও লাভ হচ্ছে মশার। এতে ওদের প্রজনন ও বংশবিস্তারের সুবিধা হয়েছে। আর এতে দ্রুত বেড়ে গেছে মশাবাহী রোগের বিস্তার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, জলবাযু পরিবর্তন, নির্বণীকরণ ও নগরায়ণের কারণে বিশ্বে এখন ডেঙ্গু, জিকা, চিকুনগুনিয়া ইত্যাদি ভাইরাসজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব ও ঝুঁকি খুব বেড়ে গেছে। সে গবেষণায় তারা পেয়েছে যে, উষ্ণ ও অবউষ্ণ অঞ্চলের দেশগুলোতে সাম্প্রতিক দশকে মশাবাহিত রোগের সংক্রমণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০০ সালে যেখানে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৫ লাখের একটু বেশি, সেখানে ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২ লাখ। এ বছরে দ্রুত সে পরিমাণ আশঙ্কা জনকভাবে বেড়েছে। এটা শুধু বাংলাদেশের চিত্র নয়, সারা বিশ্বেরই একই অবস্থা।
ডেঙ্গু যে বেড়েছে, তা আমরা সম্প্রতি আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিত্যদিনের দেওয়া রিপোর্ট থেকেই দেখতে পাচ্ছি। চলতি বছরের জুলাইয়ের শেষ দিকে এসে দেশের লক্ষাধিক মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এ বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগে মারা গেছে ৫০০-এর বেশি মানুষ। এ দেশে ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ দেখা যায়। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো বছরে এত বেশি লোক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়নি ও মরেনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানে না এর শেষ কোথায়! ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ারও রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। এর আগে ২০১৯, ২০২১ ও ২০২২ সালেও ডেঙ্গু রোগে মৃত্যু ১০০ ছাড়িয়েছিল। কিন্তু চলতি আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু রোগ বাড়ার মোক্ষম সময় এখনো পড়ে রয়েছে। তাই আশঙ্কা করা হচ্ছে, এবার অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে ডেঙ্গু। মজার বিষয় হলো, প্রতিবছর বিশ্বে মানুষের হাতে মারা পড়ে ৪ লাখ ৩৭ হাজার লোক। আর মশার কামড়ে প্রাণ হারায় ৭ লাখ ৫০ হাজার মানুষ! বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষ মরে মশার কামড়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল প্রোগ্রাম অন কন্ট্রোল অব নেগলেক্টেড ট্রপিক্যাল ডিজিজেস কো-অর্ডিনেটিং ডেঙ্গু অ্যান্ড আরবোভাইরাস ইনিশিয়েটিভ ইউনিটের প্রধান র্যামন ভেলায়ুধান বলেছেন, ‘বিশ্বের সব দেশেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে, আর এ কারণে বর্তমানে বিশ্বের ১২৯টি দেশ ডেঙ্গু রোগের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এসব দেশের অন্তত ১০০টি দেশে ডেঙ্গু মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রতিবছর এখন বিশ্বে ১০০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন লোক ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।’ জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত জলবায়ু পরিবর্তনে অধিক বৃষ্টিপাত, অধিক তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা এসব রোগবাহী মশার বংশবৃদ্ধি বাড়িয়ে দিয়েছে।
তবে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনই যে এর জন্য একমাত্র কারণ তা নয়, আমাদের অসচেতনতা ও মশক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যর্থতাও কম দায়ী নয়। বছরে প্রায় ১৪৪ কোটি টাকা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশকনিধনের পেছনে ব্যয় করছে। কিন্তু তারা বলেছে, তারা ভুল কৌশলে এত দিন মশক নিধন করেছে, ওষুধ দিয়ে শুধু মশার বাচ্চাদের মারা হচ্ছে। মশক নিয়ন্ত্রণে প্রকৃতিরও একটা নিয়ম আছে, সে নিয়মের লঙ্ঘন ঘটেছে। একটি সহজ উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে বিষয়টি। মশারা যেখানে পানি জমে থাকে সেখানে ডিম পাড়ে। সেখানে গঙ্গা ফড়িং আর সুই ফড়িংরাও ডিম পাড়ে, ব্যাঙরাও। এসব পোকা ও ব্যাঙের বাচ্চারা ডিম ফুটে বের হলে ওরা মশার বাচ্চাদের বিরিয়ানির মতো খায়! কীটনাশক দেওয়ায় সে খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়েছে।
ঢাকায় ডেঙ্গু সংক্রমণ বেশি, কিন্তু অন্য নগরের অবস্থাও প্রায় একই রকম। দুর্বল নিষ্কাশনব্যবস্থা ও নির্মাণাধীন ভবনগুলো ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। ডেঙ্গু রোগের টিকাও সুলভ নয়, একটি মাত্র টিকার অনুমোদন রয়েছে মাত্র ২০টি দেশে, ২টি টিকা অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। বিপুলসংখ্যক রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার মতো সক্ষমতাও আমাদের নেই। মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লে তাই আমাদের জন্য তা মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে। ব্যাপক সামাজিক সচেতনতা ও নিজেদের করণীয় সম্পর্কে সচেতন না হলে কোনো সরকারের পক্ষেই শতভাগ সফলভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
শেষে ডেনমার্কের একটি রূপকথা মনে পড়ছে। ১৮৪০ সালে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেন ‘দ্য উইকড প্রিন্স’ নামে একটা রূপকথা লেখেন। রূপকথার সেই রাজপুত্র ছিল খুবই পাজি। একের পর এক রাজ্য জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সে সব তার দখলে নিত। সে চেয়েছিল সারা পৃথিবী জয় করতে। সে চাইত, সবাই যেন তাকে ভয় করে। তার প্রাসাদ, সম্পদ আর শক্তি দেখে সবাই তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাজপুত্র মনে করত। একদিন তার ইচ্ছে হলো সে শহরের সবচেয়ে সুন্দর গির্জাটায় ঈশ্বরের মূর্তিটা সরিয়ে নিজের মূর্তি সেখানে বসাতে। চাটুকারেরা সবাই তাতে সায় দিলেও গির্জার পাদরিরা তাতে বাদ সাধল। তারা বলল, আপনি শক্তিমান, কিন্তু ঈশ্বর আপনার চেয়েও শক্তিমান। এ কথা শুনে সে রেগে গেল, বলল, আমি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জিতে দেখাতে চাই আমি তার চেয়েও শক্তিমান। সে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য এক আশ্চর্যজনক আকাশযান বানাল। তাতে চড়ে সে আকাশে চলল ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। ঈশ্বর তা টের পেয়ে এক ছোট্ট মশাকে আদেশ করল শয়তান রাজপুত্রকে শায়েস্তা করতে। মশা তার কানের কাছে ভন ভন করে তাকে রাগিয়ে দিল। কিন্তু কেউই মশাটাকে মারতে বা ধরতে পারল না। অবশেষে রাজপুত্রকে মশারি দিয়ে ঢাকা হলো। কিন্তু মশারির কাপড় দিয়ে ঢাকার সময়ই মশাটা তার ভেতরে ঢুকে পড়ল। মশাটা রাজপুত্রের দেহে হুল ফুটিয়ে বিষ ঢুকিয়ে দিল। সে বিষের যন্ত্রণায় রাজপুত্রের দেহে প্রচণ্ড জ্বালা শুরু হলো, চোখটা রক্তে লাল হয়ে উঠল। অবশেষে সে পাগলের মতো নাচতে লাগল। সেনারা তার এসব কাণ্ড দেখে হেসে কুটিকুটি হলো আর বলতে লাগল, আহারে বীর রাজপুত্র! যে সামান্য ছোট্ট একটা মশাকে হারাতে পারে না, সে আবার জিতবে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে!
রূপকথার সেই রাজপুত্রের মতো আমরাও কি হেরে যাব শেষে এই এডিস মশার কাছে?
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও লেখক; সিন্ডিকেট সদস্য, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে