সিদ্দিক বেলাল
অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী রুমানা, চতুর্থ শ্রেণির সূর্য এবং ষষ্ঠ শ্রেণির সাগর (সবগুলো ছদ্মনাম)—এই তিন শিশুর ঘটনা আলাদা হলেও একসূত্রে গাঁথা। রুমানা মেয়ে হয়েও ছেলেদের মতো আচরণ করে। সূর্য ও সাগর ছেলে হয়েও আচরণ ও ভাবভঙ্গি মেয়েদের মতো এবং বন্ধুদের বুলির শিকার হয়। রুমানা ও সূর্যের অভিভাবকেরা বিষয়টি ‘ফালতু শখ’ হিসেবে বিবেচনা করেন এবং স্কুল থেকে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে বলায় তাদের অন্য বিদ্যালয়ে নিয়ে গেছেন।
সাগরের অভিভাবক নিজেরা এমনিতেই সচেতন ছিলেন, ডাক্তার দেখিয়েছেন এবং হরমোনের ভারসাম্যজনিত সমস্যা আছে বলে জেনেছেন। পরিবার ও বিদ্যালয়ের বিশেষ সহযোগিতায় সে তার সমস্যা মেনে নিয়ে সহজভাবে চলতে শিখছে। সম্ভবত অভিভাবকদের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা এসবকে সমস্যা মনে না করা।
সাধারণভাবে জন্মকালে লিঙ্গ-পরিচয় নির্ধারিত হয় নবজাতকের জননেন্দ্রিয় অনুসারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই লিঙ্গ-পরিচয় বার্ধক্য পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকে। ফলে সাধারণ মানুষ লিঙ্গ-পরিচয় ও প্রজননের ভূমিকার মধ্যে কোনো পার্থক্য স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু সব অভিধান লিঙ্গ-পরিচয় ও প্রজননের ভূমিকা বা যৌন-পরিচয় ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে। লিঙ্গ-পরিচয় নিয়ে বিশ্বব্যাপী মতামতের বৈচিত্র্য এমনই যে নর ও নারী ছাড়া আর কোনো সর্বজনস্বীকৃত বিভাজনরেখা টানা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
তবে চার ধরনের লিঙ্গের ক্ষেত্রে ঐকমত্য পাওয়া যায়। নর ও নারী ছাড়া আরও দুই দল—একদল নর ও নারী মিশিয়ে নিজের পরিচয় দিতে পারে (কিন্তু উভয় লিঙ্গ বা হার্মোফ্রোডাইট বলা হয় না) এবং অন্য দল নর বা নারীর কোনো পরিচয়ই দিতে রাজি নয়। মনে রাখতে হবে, যৌন আচরণ (সেক্সুয়াল ওরিয়েনটেশন) ও প্রজননের ভূমিকাও আলাদা বিষয়। বিভিন্ন কারণে এখন আর এই ধারার বিভাজন মানা হয় না।
ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়া
ব্রিটেনিকা, অক্সফোর্ড, কলিন্স ও কেমব্রিজ অভিধানে ট্রান্সজেন্ডার অর্থ বা সংজ্ঞা হিসেবে যা লিখেছে তা এককথায়—যেসব মানুষের লিঙ্গ-পরিচয় জন্মকালের লিঙ্গ-পরিচয় থেকে ভিন্ন, তারাই ট্রান্সজেন্ডার। তবে অভিধানে ট্রান্সজেন্ডারের ব্যাখ্যায় অনেক উপবিভাজনের উল্লেখ আছে। প্রকৃত অর্থে সমাজে পৌরুষ বা নারীত্বের প্রচলিত রূপের মাঝখানের স্পেকট্রাম অনেক বিস্তৃত। এই স্পেকট্রামের সবটাই বা কতটুকু ট্রান্সজেন্ডার, তা নিয়ে দ্বিমত বা বহুমত আছে এবং কোন অংশকে হিজড়া বলা হবে, তা নিয়েও নানা মুনির নানা মত। গুগল বা অনলাইন অভিধান থেকে হিজড়ার ইংরেজি পাওয়া যাবে ট্রান্সজেন্ডার। কিন্তু নৃবিজ্ঞানীরা হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডারকে আলাদাভাবে দেখেন। লক্ষণীয়, হিজড়া প্রমিত শব্দ হিসেবে বিবেচনা করা না হলেও এটি ভারতীয় অঞ্চলের একটি বহুল প্রচলিত শব্দ।
অন্যদিকে ইংরেজি ভাষায় শব্দ হিসেবে ট্রান্সজেন্ডার প্রথম ব্যবহার করা হয়েছে ১৯৭৪ সালে (অক্সফোর্ড) অথবা ১৯৮৮ সালে (কলিন্স)।অন্যদিকে গুগল সার্চ করে মাত্র ৯টি ভাষায় ট্রান্সজেন্ডারের প্রতিশব্দ পাওয়া গেছে, অর্থাৎ বাংলা ভাষার মতো অনেক ভাষাতেই ট্রান্সজেন্ডারের প্রতিশব্দের প্রয়োজন হয়নি। আগে সম্ভবত ‘উভয় লিঙ্গ’ (হার্মাফ্রোডাইট) শব্দ ব্যবহার করা হতো। জীববিজ্ঞানে হার্মাফ্রোডাইট শব্দের ব্যবহার থাকলেও মানুষের ক্ষেত্রে এই শব্দ ব্যবহার করা হয় না। তবে চিকিৎসাশাস্ত্রে মানুষের বেলায় ‘উভয় লিঙ্গ’ শব্দটির ব্যবহার এখনো আছে। সহজেই অনুমেয়, ট্রান্সজেন্ডারের ধারণা একেবারেই ইদানীং কালের বিষয়, যার সর্বজনগৃহীত ব্যাখ্যা এখনো প্রতিষ্ঠা পায়নি। আরও লক্ষণীয়, এসব বিষয়ের কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসাশাস্ত্র ও নৃবিজ্ঞান ঐকমত্যে আসতে পারেনি।
লিঙ্গবৈচিত্র্যে চিকিৎসাশাস্ত্রের ব্যাখ্যা
ক. জেনেটিক বৈশিষ্ট্যে XY ও অণ্ডকোষ আছে, নরের আনুষঙ্গিক বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট। ছেলে হিসেবে জন্ম নিয়ে পুরুষ হিসেবে বড় হয়, যারা কোনোভাবেই (অপারেশন করেও) নারী হতে পারবে না।
খ. জেনেটিক বৈশিষ্ট্যে XX ও ডিম্বাশয় আছে, নারীর আনুষঙ্গিক বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট। মেয়ে হিসেবে জন্ম নিয়ে নারী হিসেবেই বড় হয়, যারা কোনোভাবেই (অপারেশন করেও) পুরুষ হতে পারবে না।
গ. i. জেনেটিক বৈশিষ্ট্যে XY ও অণ্ডকোষ থাকে, কিন্তু মেয়েদের আনুষঙ্গিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে মেয়ের মতো হয়ে ওঠে। এরা শরীরের অভ্যন্তরীণ দিক থেকে ছেলে। উপযুক্ত ওষুধপত্র ও সার্জারির মাধ্যমে এরা পুরুষ হয়ে উঠতে পারে এবং বাবা হতে পারে। চিকিৎসার মাধ্যমে পরিবর্তন করা না হলে এই জনগোষ্ঠী পুরুষ হিজড়া বলে পরিচিত। চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায়, ‘মেল সিউডোহার্মাফ্রোডাইট’।
ii. জেনেটিক বৈশিষ্ট্যে XX ও ডিম্বাশয় থাকে, কিন্তু ছেলেদের আনুষঙ্গিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বড় হয় বলে দেখতে হয় ছেলেদের মতো। কিন্তু শরীরের অভ্যন্তরীণ দিক থেকে মেয়ে। যথাযথ ওষুধ ও সার্জারির মাধ্যমে এরা মেয়ে হয়ে উঠতে পারে এবং মা হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। এই জনগোষ্ঠী মেয়ে হিজড়া বলে পরিচিত। চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায়, ‘ফিমেল সিউডোহার্মাফ্রোডাইট’।
iii. কোনো কোনো সময় জিনগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে অনির্দিষ্ট একদলের অণ্ডকোষ ও ডিম্বাশয় একসঙ্গে থাকে। এদের প্রকৃত জননেন্দ্রিয় সুনির্দিষ্ট নয়, লিঙ্গ নির্ধারণ করা দুষ্কর এবং এই দলের পুরো বিষয়টিই বেশ জটিল। এরা সংখ্যায় অতিনগণ্য। সমাজে এদের প্রকৃত হিজড়া বলা হয়ে থাকে। চিকিৎসাশাস্ত্রে এদের বলা হয়, ‘ট্রু হার্মাফ্রোডাইট’।
তৃতীয় লিঙ্গ ও ট্রান্সজেন্ডার
ওপরের বর্ণনা অনুসারে লিঙ্গ বৈশিষ্ট্যের কারণে আমরা সমাজের একদল মানুষকে আলাদা সম্প্রদায়ভুক্ত করে থাকি। তাদের নাম কী হতে পারে, তা নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই। বাংলায় উভয় লিঙ্গ, নপুংসক, বৃহন্নলা, ক্লীব জাতীয় শব্দ ব্যবহার করা হতো, যার ব্যবহারিক দিক তুচ্ছার্থে। অন্যদিকে এদের মধ্যেও বৈচিত্র্যের কারণে একটি মাত্র নামে সংজ্ঞায়িত করা যাচ্ছে না। উভয় লিঙ্গ বা লিঙ্গহীনের বদলে নাম দেওয়া হলো তৃতীয় লিঙ্গ বা থার্ড জেন্ডার।
প্রশ্ন উঠেছে, ‘তৃতীয়’ বলে কি আমরা তাদের ‘থার্ড ক্লাস’ জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করছি? ‘এক’ ও ‘দুই’ না থাকলে ‘তিন’ কোনো অর্থ তৈরি করে না। তাহলে প্রথম ও দ্বিতীয় লিঙ্গ কারা? এই জনগোষ্ঠীকে বোঝাতে অনেকে তৃতীয় লিঙ্গ বাদ দিয়ে ট্রান্সজেন্ডার বলার প্রস্তাব করে। অবশ্য ট্রান্সজেন্ডার যে অর্থে ব্যবহার করা হয়, তার সঙ্গে হিজড়া শব্দের অমিল খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে অন্য দল। হিজড়া প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় অঞ্চলের শব্দ, যা মূলত পরিবার ও সমাজ থেকে বঞ্চিত বলে একটি বিশেষ কমিউনিটি হিসেবে গড়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে হিজড়া বলে কিছু আছে—এমনটি শোনা যায়নি।
একটু মেয়েলি স্বভাবের পুরুষ কিংবা পুরুষ স্বভাবের মেয়ে আমরা প্রায়ই দেখি। মেয়ে হলে এদের ইংরেজিতে ‘টমবয়’ বলা হয়, বাংলায় ‘গেছো মেয়ে’ বলা যায় হয়তো। একটু ‘মেয়েলি স্বভাব’-এর ছেলেদের জন্য এমন কোনো শব্দ আছে বলে জানা নেই। এরা ওপরে বর্ণিত গ i ও ii দলের অন্তর্ভুক্ত নয়, বিশেষ কিছু হরমোনের পরিমাণগত হেরফেরের কারণে এই বৈশিষ্ট্যগত বৈচিত্র্য দেখা যায়। এমন পুরুষ বা নারী বাবা কিংবা মা হতে সক্ষম।
কিন্তু সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এদের কেউ কেউ দাম্পত্য সম্পর্ক এড়িয়ে জীবন অতিবাহিত করে। হয়তো সমাজ সমকামী তকমা দিয়ে দেয়। সামাজিক সচেতনতার অভাবে এদের মধ্যে কেউ কেউ মানবেতর জীবন অতিবাহিত করে, কেউ কেউ নিজেকে সন্তর্পণে আড়ালে রাখে। হিজড়াদের সম্পর্কে যে তিনটি দলের বিবরণ আগে দেওয়া হয়েছে, তাদের সঙ্গে এই দলের বায়োলজিক্যাল মিল নেই, কিন্তু বাহ্যিক কিছু মিল থাকায় অজ্ঞতাবশত সহজে গুলিয়ে ফেলার আশঙ্কা আছে।
প্রকৃত অর্থে পূর্ণাঙ্গ নর বা পরিপূর্ণ নারী বলে কিছু হতে পারে বলে বোধ হয় না। একজন পুরুষ কিছুটা হলেও নারী এবং একইভাবে একজন নারী কিছুটা হলেও পুরুষের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে—বিশ্বের সব পুরুষ ও নারী এ কথা মেনে নিতে পারলে লিঙ্গবৈষম্য থেকে বিদ্বেষের বিষবাষ্প কমিয়ে ফেলা সম্ভব হতো। এককথায় সাধারণ মানুষ পৌরুষ বা নারীত্বের প্রচলিত রূপের মাঝখানের বিস্তৃত স্পেকট্রামের অস্তিত্ব মেনে নিয়ে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করতে পারে। জীব আচরণে বিশেষজ্ঞ, নৃবিজ্ঞানী ও মানবাধিকারকর্মী এই সম্প্রদায়ের জনমানুষকে বর্গে-উপবর্গে বিভক্ত করবেন, নানা বৈচিত্র্য খুঁজে বৈজ্ঞানিক উপায়ে এসব বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করে নানা নামকরণের কাজ করবেন, কারণ খুঁজবেন। এভাবে জ্ঞানের প্রসার ঘটবে। এ কাজ সামাজিক সমস্যা কমিয়ে আনতে ইতিবাচক ভূমিকাও রাখবে।
সর্বত্র বিরাজমান প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কথা আমরা জানি, এই বৈচিত্র্যে আস্থা পোষণ করাই বিজ্ঞানমনস্কতা। এর জন্য পণ্ডিত বা জ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই, বৈচিত্র্যে শ্রদ্ধার চর্চা থেকে একজন মানুষ আরও একটু বেশি মানুষ হয়ে উঠতে পারে। যাবতীয় বৈচিত্র্যের মতো লিঙ্গভেদের বৈচিত্র্য মেনে নেওয়ার মাধ্যমে সমাজের বিতর্কিত সম্প্রদায়ের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির আশু পরিবর্তন আসতে পারে। এ প্রসঙ্গে আরেক দলের কথা না বললেই নয়। অজ্ঞতার কারণে অনেক সময় একটি মানসিক ব্যাধিকে অপরাধ বা বিশেষ কোনো লিঙ্গভুক্ত বলতে পারে। পরিপূর্ণ নারী বা নর হয়েও মানসিক দিক থেকে লিঙ্গ-পরিচয়ের সংকটকে চিকিৎসাশাস্ত্র মানসিক রোগ হিসেবে বিবেচনা করে, এই রোগের নাম জেন্ডার ডিস্ফোরিয়া। এদের জন্য আলাদা ধরনের লিঙ্গের স্বীকৃতির প্রশ্ন উঠতে পারে না, মানসিক অসুস্থতা বিবেচনায় উপযুক্ত মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে এই রোগ সারিয়ে তোলা সম্ভব বলে প্রমাণিত।
লেখক: সদস্য, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের লেখক দল
অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী রুমানা, চতুর্থ শ্রেণির সূর্য এবং ষষ্ঠ শ্রেণির সাগর (সবগুলো ছদ্মনাম)—এই তিন শিশুর ঘটনা আলাদা হলেও একসূত্রে গাঁথা। রুমানা মেয়ে হয়েও ছেলেদের মতো আচরণ করে। সূর্য ও সাগর ছেলে হয়েও আচরণ ও ভাবভঙ্গি মেয়েদের মতো এবং বন্ধুদের বুলির শিকার হয়। রুমানা ও সূর্যের অভিভাবকেরা বিষয়টি ‘ফালতু শখ’ হিসেবে বিবেচনা করেন এবং স্কুল থেকে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে বলায় তাদের অন্য বিদ্যালয়ে নিয়ে গেছেন।
সাগরের অভিভাবক নিজেরা এমনিতেই সচেতন ছিলেন, ডাক্তার দেখিয়েছেন এবং হরমোনের ভারসাম্যজনিত সমস্যা আছে বলে জেনেছেন। পরিবার ও বিদ্যালয়ের বিশেষ সহযোগিতায় সে তার সমস্যা মেনে নিয়ে সহজভাবে চলতে শিখছে। সম্ভবত অভিভাবকদের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা এসবকে সমস্যা মনে না করা।
সাধারণভাবে জন্মকালে লিঙ্গ-পরিচয় নির্ধারিত হয় নবজাতকের জননেন্দ্রিয় অনুসারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই লিঙ্গ-পরিচয় বার্ধক্য পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকে। ফলে সাধারণ মানুষ লিঙ্গ-পরিচয় ও প্রজননের ভূমিকার মধ্যে কোনো পার্থক্য স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু সব অভিধান লিঙ্গ-পরিচয় ও প্রজননের ভূমিকা বা যৌন-পরিচয় ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে। লিঙ্গ-পরিচয় নিয়ে বিশ্বব্যাপী মতামতের বৈচিত্র্য এমনই যে নর ও নারী ছাড়া আর কোনো সর্বজনস্বীকৃত বিভাজনরেখা টানা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
তবে চার ধরনের লিঙ্গের ক্ষেত্রে ঐকমত্য পাওয়া যায়। নর ও নারী ছাড়া আরও দুই দল—একদল নর ও নারী মিশিয়ে নিজের পরিচয় দিতে পারে (কিন্তু উভয় লিঙ্গ বা হার্মোফ্রোডাইট বলা হয় না) এবং অন্য দল নর বা নারীর কোনো পরিচয়ই দিতে রাজি নয়। মনে রাখতে হবে, যৌন আচরণ (সেক্সুয়াল ওরিয়েনটেশন) ও প্রজননের ভূমিকাও আলাদা বিষয়। বিভিন্ন কারণে এখন আর এই ধারার বিভাজন মানা হয় না।
ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়া
ব্রিটেনিকা, অক্সফোর্ড, কলিন্স ও কেমব্রিজ অভিধানে ট্রান্সজেন্ডার অর্থ বা সংজ্ঞা হিসেবে যা লিখেছে তা এককথায়—যেসব মানুষের লিঙ্গ-পরিচয় জন্মকালের লিঙ্গ-পরিচয় থেকে ভিন্ন, তারাই ট্রান্সজেন্ডার। তবে অভিধানে ট্রান্সজেন্ডারের ব্যাখ্যায় অনেক উপবিভাজনের উল্লেখ আছে। প্রকৃত অর্থে সমাজে পৌরুষ বা নারীত্বের প্রচলিত রূপের মাঝখানের স্পেকট্রাম অনেক বিস্তৃত। এই স্পেকট্রামের সবটাই বা কতটুকু ট্রান্সজেন্ডার, তা নিয়ে দ্বিমত বা বহুমত আছে এবং কোন অংশকে হিজড়া বলা হবে, তা নিয়েও নানা মুনির নানা মত। গুগল বা অনলাইন অভিধান থেকে হিজড়ার ইংরেজি পাওয়া যাবে ট্রান্সজেন্ডার। কিন্তু নৃবিজ্ঞানীরা হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডারকে আলাদাভাবে দেখেন। লক্ষণীয়, হিজড়া প্রমিত শব্দ হিসেবে বিবেচনা করা না হলেও এটি ভারতীয় অঞ্চলের একটি বহুল প্রচলিত শব্দ।
অন্যদিকে ইংরেজি ভাষায় শব্দ হিসেবে ট্রান্সজেন্ডার প্রথম ব্যবহার করা হয়েছে ১৯৭৪ সালে (অক্সফোর্ড) অথবা ১৯৮৮ সালে (কলিন্স)।অন্যদিকে গুগল সার্চ করে মাত্র ৯টি ভাষায় ট্রান্সজেন্ডারের প্রতিশব্দ পাওয়া গেছে, অর্থাৎ বাংলা ভাষার মতো অনেক ভাষাতেই ট্রান্সজেন্ডারের প্রতিশব্দের প্রয়োজন হয়নি। আগে সম্ভবত ‘উভয় লিঙ্গ’ (হার্মাফ্রোডাইট) শব্দ ব্যবহার করা হতো। জীববিজ্ঞানে হার্মাফ্রোডাইট শব্দের ব্যবহার থাকলেও মানুষের ক্ষেত্রে এই শব্দ ব্যবহার করা হয় না। তবে চিকিৎসাশাস্ত্রে মানুষের বেলায় ‘উভয় লিঙ্গ’ শব্দটির ব্যবহার এখনো আছে। সহজেই অনুমেয়, ট্রান্সজেন্ডারের ধারণা একেবারেই ইদানীং কালের বিষয়, যার সর্বজনগৃহীত ব্যাখ্যা এখনো প্রতিষ্ঠা পায়নি। আরও লক্ষণীয়, এসব বিষয়ের কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসাশাস্ত্র ও নৃবিজ্ঞান ঐকমত্যে আসতে পারেনি।
লিঙ্গবৈচিত্র্যে চিকিৎসাশাস্ত্রের ব্যাখ্যা
ক. জেনেটিক বৈশিষ্ট্যে XY ও অণ্ডকোষ আছে, নরের আনুষঙ্গিক বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট। ছেলে হিসেবে জন্ম নিয়ে পুরুষ হিসেবে বড় হয়, যারা কোনোভাবেই (অপারেশন করেও) নারী হতে পারবে না।
খ. জেনেটিক বৈশিষ্ট্যে XX ও ডিম্বাশয় আছে, নারীর আনুষঙ্গিক বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট। মেয়ে হিসেবে জন্ম নিয়ে নারী হিসেবেই বড় হয়, যারা কোনোভাবেই (অপারেশন করেও) পুরুষ হতে পারবে না।
গ. i. জেনেটিক বৈশিষ্ট্যে XY ও অণ্ডকোষ থাকে, কিন্তু মেয়েদের আনুষঙ্গিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে মেয়ের মতো হয়ে ওঠে। এরা শরীরের অভ্যন্তরীণ দিক থেকে ছেলে। উপযুক্ত ওষুধপত্র ও সার্জারির মাধ্যমে এরা পুরুষ হয়ে উঠতে পারে এবং বাবা হতে পারে। চিকিৎসার মাধ্যমে পরিবর্তন করা না হলে এই জনগোষ্ঠী পুরুষ হিজড়া বলে পরিচিত। চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায়, ‘মেল সিউডোহার্মাফ্রোডাইট’।
ii. জেনেটিক বৈশিষ্ট্যে XX ও ডিম্বাশয় থাকে, কিন্তু ছেলেদের আনুষঙ্গিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বড় হয় বলে দেখতে হয় ছেলেদের মতো। কিন্তু শরীরের অভ্যন্তরীণ দিক থেকে মেয়ে। যথাযথ ওষুধ ও সার্জারির মাধ্যমে এরা মেয়ে হয়ে উঠতে পারে এবং মা হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। এই জনগোষ্ঠী মেয়ে হিজড়া বলে পরিচিত। চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায়, ‘ফিমেল সিউডোহার্মাফ্রোডাইট’।
iii. কোনো কোনো সময় জিনগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে অনির্দিষ্ট একদলের অণ্ডকোষ ও ডিম্বাশয় একসঙ্গে থাকে। এদের প্রকৃত জননেন্দ্রিয় সুনির্দিষ্ট নয়, লিঙ্গ নির্ধারণ করা দুষ্কর এবং এই দলের পুরো বিষয়টিই বেশ জটিল। এরা সংখ্যায় অতিনগণ্য। সমাজে এদের প্রকৃত হিজড়া বলা হয়ে থাকে। চিকিৎসাশাস্ত্রে এদের বলা হয়, ‘ট্রু হার্মাফ্রোডাইট’।
তৃতীয় লিঙ্গ ও ট্রান্সজেন্ডার
ওপরের বর্ণনা অনুসারে লিঙ্গ বৈশিষ্ট্যের কারণে আমরা সমাজের একদল মানুষকে আলাদা সম্প্রদায়ভুক্ত করে থাকি। তাদের নাম কী হতে পারে, তা নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই। বাংলায় উভয় লিঙ্গ, নপুংসক, বৃহন্নলা, ক্লীব জাতীয় শব্দ ব্যবহার করা হতো, যার ব্যবহারিক দিক তুচ্ছার্থে। অন্যদিকে এদের মধ্যেও বৈচিত্র্যের কারণে একটি মাত্র নামে সংজ্ঞায়িত করা যাচ্ছে না। উভয় লিঙ্গ বা লিঙ্গহীনের বদলে নাম দেওয়া হলো তৃতীয় লিঙ্গ বা থার্ড জেন্ডার।
প্রশ্ন উঠেছে, ‘তৃতীয়’ বলে কি আমরা তাদের ‘থার্ড ক্লাস’ জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করছি? ‘এক’ ও ‘দুই’ না থাকলে ‘তিন’ কোনো অর্থ তৈরি করে না। তাহলে প্রথম ও দ্বিতীয় লিঙ্গ কারা? এই জনগোষ্ঠীকে বোঝাতে অনেকে তৃতীয় লিঙ্গ বাদ দিয়ে ট্রান্সজেন্ডার বলার প্রস্তাব করে। অবশ্য ট্রান্সজেন্ডার যে অর্থে ব্যবহার করা হয়, তার সঙ্গে হিজড়া শব্দের অমিল খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে অন্য দল। হিজড়া প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় অঞ্চলের শব্দ, যা মূলত পরিবার ও সমাজ থেকে বঞ্চিত বলে একটি বিশেষ কমিউনিটি হিসেবে গড়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে হিজড়া বলে কিছু আছে—এমনটি শোনা যায়নি।
একটু মেয়েলি স্বভাবের পুরুষ কিংবা পুরুষ স্বভাবের মেয়ে আমরা প্রায়ই দেখি। মেয়ে হলে এদের ইংরেজিতে ‘টমবয়’ বলা হয়, বাংলায় ‘গেছো মেয়ে’ বলা যায় হয়তো। একটু ‘মেয়েলি স্বভাব’-এর ছেলেদের জন্য এমন কোনো শব্দ আছে বলে জানা নেই। এরা ওপরে বর্ণিত গ i ও ii দলের অন্তর্ভুক্ত নয়, বিশেষ কিছু হরমোনের পরিমাণগত হেরফেরের কারণে এই বৈশিষ্ট্যগত বৈচিত্র্য দেখা যায়। এমন পুরুষ বা নারী বাবা কিংবা মা হতে সক্ষম।
কিন্তু সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এদের কেউ কেউ দাম্পত্য সম্পর্ক এড়িয়ে জীবন অতিবাহিত করে। হয়তো সমাজ সমকামী তকমা দিয়ে দেয়। সামাজিক সচেতনতার অভাবে এদের মধ্যে কেউ কেউ মানবেতর জীবন অতিবাহিত করে, কেউ কেউ নিজেকে সন্তর্পণে আড়ালে রাখে। হিজড়াদের সম্পর্কে যে তিনটি দলের বিবরণ আগে দেওয়া হয়েছে, তাদের সঙ্গে এই দলের বায়োলজিক্যাল মিল নেই, কিন্তু বাহ্যিক কিছু মিল থাকায় অজ্ঞতাবশত সহজে গুলিয়ে ফেলার আশঙ্কা আছে।
প্রকৃত অর্থে পূর্ণাঙ্গ নর বা পরিপূর্ণ নারী বলে কিছু হতে পারে বলে বোধ হয় না। একজন পুরুষ কিছুটা হলেও নারী এবং একইভাবে একজন নারী কিছুটা হলেও পুরুষের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে—বিশ্বের সব পুরুষ ও নারী এ কথা মেনে নিতে পারলে লিঙ্গবৈষম্য থেকে বিদ্বেষের বিষবাষ্প কমিয়ে ফেলা সম্ভব হতো। এককথায় সাধারণ মানুষ পৌরুষ বা নারীত্বের প্রচলিত রূপের মাঝখানের বিস্তৃত স্পেকট্রামের অস্তিত্ব মেনে নিয়ে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করতে পারে। জীব আচরণে বিশেষজ্ঞ, নৃবিজ্ঞানী ও মানবাধিকারকর্মী এই সম্প্রদায়ের জনমানুষকে বর্গে-উপবর্গে বিভক্ত করবেন, নানা বৈচিত্র্য খুঁজে বৈজ্ঞানিক উপায়ে এসব বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করে নানা নামকরণের কাজ করবেন, কারণ খুঁজবেন। এভাবে জ্ঞানের প্রসার ঘটবে। এ কাজ সামাজিক সমস্যা কমিয়ে আনতে ইতিবাচক ভূমিকাও রাখবে।
সর্বত্র বিরাজমান প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কথা আমরা জানি, এই বৈচিত্র্যে আস্থা পোষণ করাই বিজ্ঞানমনস্কতা। এর জন্য পণ্ডিত বা জ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই, বৈচিত্র্যে শ্রদ্ধার চর্চা থেকে একজন মানুষ আরও একটু বেশি মানুষ হয়ে উঠতে পারে। যাবতীয় বৈচিত্র্যের মতো লিঙ্গভেদের বৈচিত্র্য মেনে নেওয়ার মাধ্যমে সমাজের বিতর্কিত সম্প্রদায়ের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির আশু পরিবর্তন আসতে পারে। এ প্রসঙ্গে আরেক দলের কথা না বললেই নয়। অজ্ঞতার কারণে অনেক সময় একটি মানসিক ব্যাধিকে অপরাধ বা বিশেষ কোনো লিঙ্গভুক্ত বলতে পারে। পরিপূর্ণ নারী বা নর হয়েও মানসিক দিক থেকে লিঙ্গ-পরিচয়ের সংকটকে চিকিৎসাশাস্ত্র মানসিক রোগ হিসেবে বিবেচনা করে, এই রোগের নাম জেন্ডার ডিস্ফোরিয়া। এদের জন্য আলাদা ধরনের লিঙ্গের স্বীকৃতির প্রশ্ন উঠতে পারে না, মানসিক অসুস্থতা বিবেচনায় উপযুক্ত মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে এই রোগ সারিয়ে তোলা সম্ভব বলে প্রমাণিত।
লেখক: সদস্য, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের লেখক দল
পর্দার নায়িকারা নিজেদের বয়স আড়ালে রাখা পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আজমেরী হক বাঁধন। প্রতিবছর নিজের জন্মদিনে জানান দেন তাঁর বয়স। গতকাল ছিল বাঁধনের ৪১তম জন্মদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই জানালেন এই তথ্য।
২ দিন আগে১০ বছরের বেশি সময় ধরে শোবিজে কাজ করছেন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। নাটকের পাশাপাশি ওটিটিতে দেখা গেছে তাঁকে। সরকারি অনুদানের ‘দেবী’ নামের একটি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। প্রশংসিত হলেও সিনেমায় আর দেখা মেলেনি তাঁর। ছোট পর্দাতেও অনেক দিন ধরে অনিয়মিত তিনি। এবার শবনম ফারিয়া হাজির হচ্ছেন নতুন পরিচয়ে। কমেডি রিয়েলিটি
২ দিন আগেআমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য যাত্রাপালা। গণমানুষের সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত এই যাত্রাপালা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করছে ‘যাত্রা উৎসব-২০২৪’। আগামী ১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে শুরু হবে ৭ দিনব্যাপী এই উৎসব।
২ দিন আগে‘বঙ্গবন্ধু’ পদবি বিলীন হবে না। হতে পারে না। যেমনটি ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশের পদবি বিলীন হয়নি। ইতিহাসে এসব পদবি অম্লান ও অক্ষয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ। আপনজনকে তো অবশ্যই, শত্রুপক্ষের লোকেরাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপদের
২ দিন আগে