ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম
পৃথিবীর ইতিহাসে যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ আছে, এর মধ্যে অন্যতম একটি হলো ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ। ৭ মার্চের বক্তব্যের আবেদন অপরিসীম। একটি ভাষণেই পাল্টে দিল বাঙালির ইতিহাস। বাঙালি হয়ে উঠল স্বাধীনতাকামী। রাজনৈতিক বা স্বাধীনতার ঘোষণার ইঙ্গিতবাহী ভাষণ হলেও সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও এটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৭ মার্চের বক্তব্যের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়, অনুরণিত করে। এই বক্তব্য বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতা অনুরাগী মানুষেরও অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে যুগ যুগ টিকে থাকবে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের এই ঐতিহাসিক মহাকাব্যিক ভাষণে যেমন স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়ার কথা বলা আছে, তেমনি বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তির কথাও বলা হয়েছে। তত্ত্বগত ধারণার দিক থেকে অর্থনৈতিক মুক্তি না থাকলে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অর্থহীন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সেটা খুব ভালোভাবে জানতেন। এ কারণেই তিনি একদিকে যেমন স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন, অন্যদিকে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলেছেন। ভাবলে খুব অবাক হতে হয় বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত স্বাধীনতার দিকটিতে জোর দিয়েছিলেন। কারণ অর্থনৈতিক মুক্তি পেতে গেলে সমাজের পরিবর্তন প্রয়োজন হয়। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে সেই অর্থনৈতিক মুক্তির প্রসঙ্গ তুলে ধরতে গিয়ে বললেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’
১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলা যে স্বপ্ন নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, সেটা দেখা যায়নি। সেখানে গণতন্ত্র যেমন প্রতিষ্ঠা হতে পারেনি, ঠিক তেমনি সুখী ও সুন্দর সমাজও প্রতিষ্ঠা হতে পারেনি। পরিবর্তে এ দেশের মানুষ পেয়েছিল লুটেরা ধনিক গোষ্ঠীকে। যেখানে সামরিকতন্ত্র এবং পুঁজিবাদ চেপে বসেছিল বছরের পর বছর। এ জন্যই আমরা দেখি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ছয় দফা ঘোষণা করলেন। এরপর থেকেই পূর্ব বাংলার জনগণ এক নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। বাঙালির প্রাণের দাবি ছয় দফাকে আওয়ামী লীগ সত্তরের নির্বাচনে নির্বাচনী মেনিফেস্টো হিসেবে ঘোষণা করলে বাঙালি জনসাধারণ সেটাকে প্রাণের দাবি হিসেবে মেনে নেয়। কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ফল পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিকে বিপুল বিজয় এনে দিলেও ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা এমনকি গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান নিয়ে বাঙালিদের হতাশায় ফেলে দেয়।
এমনি পটভূমিতে ১৯৭১ সালের মার্চ ছিল উত্তাল। রাজনৈতিক আন্দোলন পরিণতির দিকে যায় স্বাধীনতার আন্দোলনে। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো শুরু হয়। স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার অলিগলিসহ সমগ্র দেশের রাজপথ। স্লোগানে স্লোগানে প্রতিধ্বনিত হয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে কর্মসূচির ঘোষণার দাবি জানাতে থাকে ছাত্রসহ বীর জনতা। ১৯৭১ সালের মার্চের এই পটভূমিতেই বঙ্গবন্ধু ২ ও ৩ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানে সর্বাত্মক হরতালের ডাক এবং ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভার ঘোষণা দেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সেই ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দিলেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাকের মধ্যেই ছিল সামাজিক বিপ্লব। গণ-আন্দোলন যাতে ব্যাহত না হয়, এ জন্য তিনি গণমানুষের রুটিরুজির পথও খোলা রেখেছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যেও যাতে নিম্নবর্গের খেটে খাওয়া মানুষের আর্থিক আয়ের পথ চালু রাখা যায়, সে ব্যবস্থা নিয়েও তিনি কথা বলেছেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে সংবাদপত্রে এক বিবৃতি পাঠানো হয়। এই বিবৃতি ৮ মার্চ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন। এই বিবৃতিতেও বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক বিষয়ের দিকেও দৃষ্টিপাত করেন। এতে বলা হয়: ‘আমাদের জনসাধারণ বিশ্ববাসীর কাছে ঘোষণা করেছে যে, তারা উপনিবেশ বা বাজার হয়ে আর শোষিত হতে চায় না। তারা তাদের দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা ব্যক্ত করেছে যে, তারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হয়ে বাঁচতে চায়। ধ্বংসের হাত থেকে আমাদের অর্থনীতিকে রক্ষা করতে হবে। আমাদের মেহনতি মানুষকে রক্ষা করতে হবে। ঘূর্ণিদুর্গত এলাকার লাখ লাখ মানুষকে এখনো পুনর্বাসন দিতে হবে। যদি ক্ষমতাশীল কোটারী এ সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা নস্যাৎ করার প্রয়াস পায়, তাহলে তারা তাদের মুক্তির জন্য দীর্ঘ এবং অব্যাহতভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।’ (পূর্বদেশ, ৮ মার্চ ১৯৭১)
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণেও বঙ্গবন্ধু শোষণমুক্ত এক সমাজের কথা বলেছেন। তাঁর এই রাজনৈতিক দর্শন, রাষ্ট্রচিন্তা, আত্মত্যাগ এবং আদর্শের প্রতি বিশ্বস্ততা বাঙালিকে নিয়ে গেছে চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে। রাজনীতি ও অর্থনীতির চমৎকার সমন্বয় ঘটিয়ে এক নতুন দেশ বিনির্মাণে এগিয়ে গিয়েছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণে তাই তো আমরা দেখি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি তুলে ধরার পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের চাপিয়ে দেওয়া বৈষম্য, নির্যাতন এবং অধিকার ও সম্পদ লুটপাটের করুণ কাহিনি। বলা যায় বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের দর্শন ছিল গণতন্ত্র, সাম্য, অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
পাকিস্তানের আধিপত্য থেকে বেরিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জন এবং শোষণ-বঞ্চনাহীন স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির প্রধান উদ্দেশ্য। যার পেছনে ছিল সম্পদের সুষম বণ্টন করার মতামত। তিনি চাইতেন সমাজের বিশেষ একটা শ্রেণির হাতে যাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত না হয় তার নিশ্চয়তা প্রদান করা। তিনি দেখেছেন পাকিস্তানের রাজনীতিতে সম্পদের সুষম বণ্টন না হওয়ার কারণে বাঙালি দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হতে চলেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ গিয়ে জমা হচ্ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে।
স্বাধীনতা যেমন একদিনে অর্জিত হয়নি, তেমনি স্বাধীনতাসংগ্রামের এ পথ কখনোই মসৃণ ছিল না। সময়োপযোগী রাজনৈতিক কৌশল রচনা ও অবলম্বন এবং তার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে বাঙালি জাতিকে পৌঁছে দেন স্বাধীনতার লক্ষ্যে। আর এগুলোর উন্মুক্ত মঞ্চ ছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি প্রায় ৫০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এখনো এই ভাষণ শুনে আবেগতাড়িত হয় যেকোনো বয়সের নারী-পুরুষ। কিন্তু দুর্ভাগ্য, দীর্ঘদিন এই ভাষণ জাতির সামনে তুলে ধরা হয়নি। সামরিক এবং অগণতান্ত্রিক সরকারগুলোর রোষানলেও পড়েছিল এই ভাষণ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে দীর্ঘদিন সরকারি প্রচারমাধ্যমে এই ভাষণ নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্যে স্থান পেয়েছে।
বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ভাষণের সঙ্গে যেমন আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’, উইনস্টন চার্চিলের ‘উই শ্যাল ফাইট অন দি বিচেস’, জওহর লাল নেহরুর ‘ট্রাইস্ট ইউথ ডেস্টিনি’, মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ বিখ্যাত এই চার ভাষণের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের তুলনা করা হয়। তাঁর ভাষণের কারণেও আজ আমাদের দেশ ও জাতি সম্মানিত হয়েছে। মহিমান্বিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় বাংলা ভাষা ও সোনার বাংলাদেশ। তাই এই ভাষণকে এবং ৭ মার্চ দিনটিকে বাঙালি জাতির শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
পৃথিবীর ইতিহাসে যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ আছে, এর মধ্যে অন্যতম একটি হলো ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ। ৭ মার্চের বক্তব্যের আবেদন অপরিসীম। একটি ভাষণেই পাল্টে দিল বাঙালির ইতিহাস। বাঙালি হয়ে উঠল স্বাধীনতাকামী। রাজনৈতিক বা স্বাধীনতার ঘোষণার ইঙ্গিতবাহী ভাষণ হলেও সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও এটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৭ মার্চের বক্তব্যের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়, অনুরণিত করে। এই বক্তব্য বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতা অনুরাগী মানুষেরও অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে যুগ যুগ টিকে থাকবে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের এই ঐতিহাসিক মহাকাব্যিক ভাষণে যেমন স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়ার কথা বলা আছে, তেমনি বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তির কথাও বলা হয়েছে। তত্ত্বগত ধারণার দিক থেকে অর্থনৈতিক মুক্তি না থাকলে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অর্থহীন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সেটা খুব ভালোভাবে জানতেন। এ কারণেই তিনি একদিকে যেমন স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন, অন্যদিকে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলেছেন। ভাবলে খুব অবাক হতে হয় বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত স্বাধীনতার দিকটিতে জোর দিয়েছিলেন। কারণ অর্থনৈতিক মুক্তি পেতে গেলে সমাজের পরিবর্তন প্রয়োজন হয়। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে সেই অর্থনৈতিক মুক্তির প্রসঙ্গ তুলে ধরতে গিয়ে বললেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’
১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলা যে স্বপ্ন নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, সেটা দেখা যায়নি। সেখানে গণতন্ত্র যেমন প্রতিষ্ঠা হতে পারেনি, ঠিক তেমনি সুখী ও সুন্দর সমাজও প্রতিষ্ঠা হতে পারেনি। পরিবর্তে এ দেশের মানুষ পেয়েছিল লুটেরা ধনিক গোষ্ঠীকে। যেখানে সামরিকতন্ত্র এবং পুঁজিবাদ চেপে বসেছিল বছরের পর বছর। এ জন্যই আমরা দেখি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ছয় দফা ঘোষণা করলেন। এরপর থেকেই পূর্ব বাংলার জনগণ এক নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। বাঙালির প্রাণের দাবি ছয় দফাকে আওয়ামী লীগ সত্তরের নির্বাচনে নির্বাচনী মেনিফেস্টো হিসেবে ঘোষণা করলে বাঙালি জনসাধারণ সেটাকে প্রাণের দাবি হিসেবে মেনে নেয়। কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ফল পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিকে বিপুল বিজয় এনে দিলেও ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা এমনকি গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান নিয়ে বাঙালিদের হতাশায় ফেলে দেয়।
এমনি পটভূমিতে ১৯৭১ সালের মার্চ ছিল উত্তাল। রাজনৈতিক আন্দোলন পরিণতির দিকে যায় স্বাধীনতার আন্দোলনে। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো শুরু হয়। স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার অলিগলিসহ সমগ্র দেশের রাজপথ। স্লোগানে স্লোগানে প্রতিধ্বনিত হয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে কর্মসূচির ঘোষণার দাবি জানাতে থাকে ছাত্রসহ বীর জনতা। ১৯৭১ সালের মার্চের এই পটভূমিতেই বঙ্গবন্ধু ২ ও ৩ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানে সর্বাত্মক হরতালের ডাক এবং ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভার ঘোষণা দেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সেই ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দিলেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাকের মধ্যেই ছিল সামাজিক বিপ্লব। গণ-আন্দোলন যাতে ব্যাহত না হয়, এ জন্য তিনি গণমানুষের রুটিরুজির পথও খোলা রেখেছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যেও যাতে নিম্নবর্গের খেটে খাওয়া মানুষের আর্থিক আয়ের পথ চালু রাখা যায়, সে ব্যবস্থা নিয়েও তিনি কথা বলেছেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে সংবাদপত্রে এক বিবৃতি পাঠানো হয়। এই বিবৃতি ৮ মার্চ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন। এই বিবৃতিতেও বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক বিষয়ের দিকেও দৃষ্টিপাত করেন। এতে বলা হয়: ‘আমাদের জনসাধারণ বিশ্ববাসীর কাছে ঘোষণা করেছে যে, তারা উপনিবেশ বা বাজার হয়ে আর শোষিত হতে চায় না। তারা তাদের দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা ব্যক্ত করেছে যে, তারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হয়ে বাঁচতে চায়। ধ্বংসের হাত থেকে আমাদের অর্থনীতিকে রক্ষা করতে হবে। আমাদের মেহনতি মানুষকে রক্ষা করতে হবে। ঘূর্ণিদুর্গত এলাকার লাখ লাখ মানুষকে এখনো পুনর্বাসন দিতে হবে। যদি ক্ষমতাশীল কোটারী এ সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা নস্যাৎ করার প্রয়াস পায়, তাহলে তারা তাদের মুক্তির জন্য দীর্ঘ এবং অব্যাহতভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।’ (পূর্বদেশ, ৮ মার্চ ১৯৭১)
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণেও বঙ্গবন্ধু শোষণমুক্ত এক সমাজের কথা বলেছেন। তাঁর এই রাজনৈতিক দর্শন, রাষ্ট্রচিন্তা, আত্মত্যাগ এবং আদর্শের প্রতি বিশ্বস্ততা বাঙালিকে নিয়ে গেছে চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে। রাজনীতি ও অর্থনীতির চমৎকার সমন্বয় ঘটিয়ে এক নতুন দেশ বিনির্মাণে এগিয়ে গিয়েছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণে তাই তো আমরা দেখি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি তুলে ধরার পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের চাপিয়ে দেওয়া বৈষম্য, নির্যাতন এবং অধিকার ও সম্পদ লুটপাটের করুণ কাহিনি। বলা যায় বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের দর্শন ছিল গণতন্ত্র, সাম্য, অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
পাকিস্তানের আধিপত্য থেকে বেরিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জন এবং শোষণ-বঞ্চনাহীন স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির প্রধান উদ্দেশ্য। যার পেছনে ছিল সম্পদের সুষম বণ্টন করার মতামত। তিনি চাইতেন সমাজের বিশেষ একটা শ্রেণির হাতে যাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত না হয় তার নিশ্চয়তা প্রদান করা। তিনি দেখেছেন পাকিস্তানের রাজনীতিতে সম্পদের সুষম বণ্টন না হওয়ার কারণে বাঙালি দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হতে চলেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ গিয়ে জমা হচ্ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে।
স্বাধীনতা যেমন একদিনে অর্জিত হয়নি, তেমনি স্বাধীনতাসংগ্রামের এ পথ কখনোই মসৃণ ছিল না। সময়োপযোগী রাজনৈতিক কৌশল রচনা ও অবলম্বন এবং তার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে বাঙালি জাতিকে পৌঁছে দেন স্বাধীনতার লক্ষ্যে। আর এগুলোর উন্মুক্ত মঞ্চ ছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি প্রায় ৫০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এখনো এই ভাষণ শুনে আবেগতাড়িত হয় যেকোনো বয়সের নারী-পুরুষ। কিন্তু দুর্ভাগ্য, দীর্ঘদিন এই ভাষণ জাতির সামনে তুলে ধরা হয়নি। সামরিক এবং অগণতান্ত্রিক সরকারগুলোর রোষানলেও পড়েছিল এই ভাষণ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে দীর্ঘদিন সরকারি প্রচারমাধ্যমে এই ভাষণ নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্যে স্থান পেয়েছে।
বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ভাষণের সঙ্গে যেমন আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’, উইনস্টন চার্চিলের ‘উই শ্যাল ফাইট অন দি বিচেস’, জওহর লাল নেহরুর ‘ট্রাইস্ট ইউথ ডেস্টিনি’, মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ বিখ্যাত এই চার ভাষণের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের তুলনা করা হয়। তাঁর ভাষণের কারণেও আজ আমাদের দেশ ও জাতি সম্মানিত হয়েছে। মহিমান্বিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় বাংলা ভাষা ও সোনার বাংলাদেশ। তাই এই ভাষণকে এবং ৭ মার্চ দিনটিকে বাঙালি জাতির শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
পর্দার নায়িকারা নিজেদের বয়স আড়ালে রাখা পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আজমেরী হক বাঁধন। প্রতিবছর নিজের জন্মদিনে জানান দেন তাঁর বয়স। গতকাল ছিল বাঁধনের ৪১তম জন্মদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই জানালেন এই তথ্য।
২ দিন আগে১০ বছরের বেশি সময় ধরে শোবিজে কাজ করছেন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। নাটকের পাশাপাশি ওটিটিতে দেখা গেছে তাঁকে। সরকারি অনুদানের ‘দেবী’ নামের একটি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। প্রশংসিত হলেও সিনেমায় আর দেখা মেলেনি তাঁর। ছোট পর্দাতেও অনেক দিন ধরে অনিয়মিত তিনি। এবার শবনম ফারিয়া হাজির হচ্ছেন নতুন পরিচয়ে। কমেডি রিয়েলিটি
২ দিন আগেআমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য যাত্রাপালা। গণমানুষের সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত এই যাত্রাপালা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করছে ‘যাত্রা উৎসব-২০২৪’। আগামী ১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে শুরু হবে ৭ দিনব্যাপী এই উৎসব।
২ দিন আগে‘বঙ্গবন্ধু’ পদবি বিলীন হবে না। হতে পারে না। যেমনটি ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশের পদবি বিলীন হয়নি। ইতিহাসে এসব পদবি অম্লান ও অক্ষয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ। আপনজনকে তো অবশ্যই, শত্রুপক্ষের লোকেরাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপদের
২ দিন আগে