চিররঞ্জন সরকার গবেষক ও কলামিস্ট
এমনিতেই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বস্তিকর নয়। হামলা-হত্যা-গণপিটুনির ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। আইনবহির্ভূত হত্যকাণ্ডের ঘটনা বাড়ছে। এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেই হঠাৎ করে পার্বত্য জেলাগুলো অশান্ত হয়ে পড়েছে। ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল খাগড়াছড়ি জেলায়, এরপর দীঘিনালা হয়ে রাঙামাটি পর্যন্ত আতঙ্ক-সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত দুই জেলায় পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে সরকারিভাবে চারজনের মৃত্যুর খবর বেরিয়েছে। আহত হয়েছে শতাধিক মানুষ। তবে অনেকের আশঙ্কা, হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি। ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অনেক সরকারি স্থাপনা, ঘরবাড়ি, ও দোকানপাট। পুরো পাহাড়ি অঞ্চল এখনো থমথমে। কখন কী ঘটে যায়, তা নিয়ে জনমনে রয়েছে আতঙ্ক, ভয়।
পাহাড়ে অশান্তি আপাতত থামলেও, যে ক্ষোভ, বিতৃষ্ণা ও ক্রোধ সৃষ্টি হয়েছে, তা যদি ভবিষ্যতে আরও গভীর হয়, তাকে প্রশাসন সামলাবে কী করে? বিভেদ এবং পার্থক্য আরও গভীর হলে শুধু প্রশাসনের ক্ষতি নয়, দেশের ক্ষতি। হয়তো এক অর্থে অপূরণীয়।
ইতিমধ্যেই সরকারিভাবে চারজনের প্রাণহানির কথা বলা হয়েছে। হিংসা-প্রতিহিংসার অন্তহীন আবর্তে তা যে আরও বাড়বে না, কে বলতে পারে? বর্তমান সংঘাত নিরসনে অবিলম্বে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে প্রশাসনকেই, কারণ দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানুষের নিরাপত্তাবিধানের দায়িত্ব তাদের।
পার্বত্যাঞ্চলে এ পরিণতি কি অমোঘ ছিল? এই সহিংসতার সূত্রপাত হয়েছে নাকি একটি মোটরসাইকেল চুরির ঘটনাকে ঘিরে। ১৮ সেপ্টেম্বর সকালে খাগড়াছড়ির পানখাইয়া পাড়ার রাস্তায় মামুন নামের একজনের লাশ পাওয়া যায়। পুলিশের তথ্যমতে, মামুন বাইক চুরি করে দ্রুতগতিতে পালাতে গিয়ে বিদ্যুতের পোলের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আহত হলে তাঁকে ধাওয়া করা লোকজন পিটুনি দেয়। এতে ঘটনাস্থলে মামুনের মৃত্যু হয়। খাগড়াছড়ি থানা-পুলিশ জানিয়েছে, মামুনের বিরুদ্ধে ১৪টি চুরির মামলা এবং দুটি মাদক মামলা ছিল।
গণপিটুনিতে মামুনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে অভিবাসীদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়। তারা বিক্ষোভ মিছিল বের করলে পাহাড়িরা বাধা দেয়। একপর্যায়ে পাহাড়ি ও অভিবাসীদের মধ্যে সহিংসতা শুরু হয়। ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
ঘটনার জন্য পাহাড়ি ও অভিবাসী দুই পক্ষ থেকে পরস্পরকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে ঘটনাটিকে চরম সহিংসতার দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে গুজব। সশস্ত্র আক্রমণের গুজব, অসংখ্য মানুষকে মেরে ফেলার গুজব। গুজবে গুজবে হিংসা ছড়ায়। আর জ্বলতে থাকে বাড়িঘর। এরপর মাঠে নামে সেনাবাহিনী। পাহাড়িদের অভিযোগ, অভিবাসীরা সেনাদের প্রশ্রয়ে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। পাহাড়িদের ওপর গুলি চালায়। সেনাদের অভিযোগ, পাহাড়িরা সশস্ত্র হয়ে সেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। আত্মরক্ষার্থে সেনারাও গুলি করে।
শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো যে, কোনো মৃত্যু, কোনো অন্যায়ই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না, তা সে যে উদ্দেশ্যে, যে কারণেই ঘটুক না কেন! খাগড়াছড়ির পানখাইয়া পাড়ার রাস্তায় মামুন নামের যে ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে, তা কোনোমতেই মেনে নেওয়া যায় না। চোর হোক, আর ডাকাত হোক, কাউকে পিটিয়ে মারার অধিকার কারও নেই। এই মুত্যুর কারণ অবশ্যই খুঁজে বের করা উচিত। যদি কোনো পাহাড়ি এই হত্যার সঙ্গে যুক্ত থাকে তবে অবশ্যই তার যথাযথ বিচার ও শাস্তি হওয়া উচিত। কারণ, কোনো অন্যায়ের প্রতিবিধান যেমন নাগরিকেরা নিজের হাতে করতে পারে না, কাউকে হত্যাও করতে পারে না।
কিন্তু একটি মৃত্যুর ঘটনাকে পুঁজি করে, কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া কেবল অনুমানের বশবর্তী হয়ে একটি জনগোষ্ঠীর ওপর সব দায় চাপিয়ে দেওয়া, তারপর হিংসা আর ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পুরো এলাকার মানুষজনের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া, গুলি করে মারা, এ কোন রীতি? কেন এই আদিম হিংস্রতাকে উসকে দেওয়া হচ্ছে? এ কোন সমাজ, কিসের সমাজ? কোথায় আইন, কোথায় আইনের শাসন?
পাহাড়ে এমন ঘটনা আগেও বহুবার ঘটেছে। মিথ্যে একটা অভিযোগ তুলে কোনো একটা গুজব রটিয়ে দিয়ে বা বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে মানুষকে খেপিয়ে দিয়ে বাড়িঘরে হামলা, আগুন দিয়ে ব্যাপক ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। কয়েক বছর ধরে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এই অস্ত্র প্রয়োগ করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এই কাজটি করা হয় সবচেয়ে বেশি।
একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে একদল মানুষ আরেক দল মানুষের ওপর শ্বাপদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আর তারা স্রেফ জীবন বাঁচাতে বাড়িঘর, সহায়-সম্পদ ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাচ্ছে! হ্যাঁ, এটাই হচ্ছে আমাদের একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের চিত্র! এমন দেশ নিয়ে আমরা কীভাবে নিশ্চিন্ত হব? সুখেশান্তিতে ঘুমাব?
প্রশাসনের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে। তারা শুরুতে ঘটনাটিকে উপেক্ষা করেছে। পরে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কঠোর হয়েছে। মানুষের জীবনকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। প্রশাসনের এই ভূমিকা নিয়ে পাহাড়ি-অভিবাসী উভয়েরই ক্ষোভ রয়েছে। অবশ্য পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন ঘটনার ‘আলাদা মানে’ আছে। ভিন্ন মনস্তত্ত্ব আছে। ওখানে যেসব অভিবাসী আছে, তাদের, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের মনস্তত্ত্ব অনেক সময়ই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মনস্তত্ত্বের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে বলে অভিযোগ। এক-আধটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে অভিবাসী, প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তারা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকদের ‘শত্রু’ মনে করে। ওরা সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, উগ্র, ভিনদেশের এজেন্ট, অভিবাসীদের বিরুদ্ধশক্তি—এমন একটা ভাবধারা নিয়ে চলে। তাই তো যখনই কোনো সুযোগ আসে পাহাড়িদের জব্দ করার, তাদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার, সবাই একযোগে সেই সুযোগটা গ্রহণ করে।
অপ্রিয় সত্য হলো, যুগের পর যুগ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানকে একটা ‘ভিন্ন দেশ’ বানিয়ে রাখা হয়েছে। যেখানে পুলিশ-র্যাবের পাশাপাশি হাজার হাজার সেনাকেও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখানে এমনই এক মেকানিজম তৈরি করা হয়েছে যে পাহাড়িদের হত্যা, ধর্ষণ, গ্রেপ্তার, হয়রানি, হেফাজতে নিয়ে শারীরিক অত্যাচার, সামরিক কর্মকর্তা ও সেটেলারদের ভূমি দখলের বেশির ভাগ খবর কখনোই মিডিয়ায় আসে না। দলীয় সরকারের আমলেও না। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও না। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মিডিয়ার ‘ব্ল্যাক আউট’ এবং ‘সেন্সরশিপ’-এর অন্ধকারে পাহাড়ের খবরগুলো কখনোই আলোর দেখা পায় না।
পার্বত্য চট্টগ্রামে যা হয়েছে, যা হচ্ছে, এর প্রতিবিধান হওয়া দরকার। সরকারের ভূমিকাও পর্যালোচনা করে দেখার সুযোগ রয়েছে। সরকারের কাজ রক্ষা করা, হামলা করা নয়। পাহাড়িদের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ থাকে, তাহলে তো আইন আছে। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করেই সমস্যার সমাধানে পৌঁছাতে হবে। সরকার যেন কোনো পক্ষভুক্ত না হয়ে পড়ে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
পাহাড়ে উগ্রতা সামলাতে প্রশাসনকে দৃঢ় থাকতে হবে ঠিকই। কিন্তু এই সামলানোরই আবশ্যিক অঙ্গ হলো আলোচনা, যাতে পার্বত্যাঞ্চলে মধ্যপন্থী মানুষও নানা সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির পক্ষে পথে নামতে পারেন। প্রশাসনকে ভেবে বের করতে হবে, কীভাবে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়, যাতে সংঘাতের তীব্রতা কমে আসে, আলোচনা সহজ হয়।
সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে এই অচলাবস্থা থেকে বের হওয়া যাবে বলে মনে হয় না। গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে সরকার বিপুল সামরিক বাহিনীর সদস্য পাঠিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চেয়ে পাহাড়ের সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তুলেছিল। তখন সেখানে সশস্ত্র সংঘর্ষও হয়। প্রায় দুই দশকের সশস্ত্র লড়াইয়ের ইতি হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ২ জুলাই পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এই চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে পরে সরকারিভাবে তেমন কোনো আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
যদি কোনো পাহাড়ি ছেলেমেয়ে প্রতিবাদ করে, নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেতন হয়, তাদের নানা রাজনৈতিক মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করা হয়। এর আগে ১৯৯৬ সালে কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা হয়েছিল। এখনো তাঁর হদিস মেলেনি। ২০১৭ সালে নির্যাতন চালিয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় রোমেল চাকমাকে। এই ধারা নিয়মিত চলছে। আর দেশের মানুষের একটা বড় অংশ এখনো পাহাড়ে দমন-পীড়নকে অন্ধ সমর্থন দিয়ে চলেছে তথাকথিত দেশপ্রেম আর উগ্র জাতীয়তাবাদের মোহে অন্ধ হয়ে।
দীর্ঘ তিন দশক ধরে পাহাড়ের সমস্যাকে জিইয়ে রাখা হয়েছে। এই ধারা থেকে বের হয়ে আসার পথ-পদ্ধতি অবিলম্বে খুঁজে বের করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখা দরকার যে পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে না পারলে দেশের শান্তিও বিনষ্ট হবে।
এমনিতেই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বস্তিকর নয়। হামলা-হত্যা-গণপিটুনির ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। আইনবহির্ভূত হত্যকাণ্ডের ঘটনা বাড়ছে। এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেই হঠাৎ করে পার্বত্য জেলাগুলো অশান্ত হয়ে পড়েছে। ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল খাগড়াছড়ি জেলায়, এরপর দীঘিনালা হয়ে রাঙামাটি পর্যন্ত আতঙ্ক-সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত দুই জেলায় পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে সরকারিভাবে চারজনের মৃত্যুর খবর বেরিয়েছে। আহত হয়েছে শতাধিক মানুষ। তবে অনেকের আশঙ্কা, হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি। ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অনেক সরকারি স্থাপনা, ঘরবাড়ি, ও দোকানপাট। পুরো পাহাড়ি অঞ্চল এখনো থমথমে। কখন কী ঘটে যায়, তা নিয়ে জনমনে রয়েছে আতঙ্ক, ভয়।
পাহাড়ে অশান্তি আপাতত থামলেও, যে ক্ষোভ, বিতৃষ্ণা ও ক্রোধ সৃষ্টি হয়েছে, তা যদি ভবিষ্যতে আরও গভীর হয়, তাকে প্রশাসন সামলাবে কী করে? বিভেদ এবং পার্থক্য আরও গভীর হলে শুধু প্রশাসনের ক্ষতি নয়, দেশের ক্ষতি। হয়তো এক অর্থে অপূরণীয়।
ইতিমধ্যেই সরকারিভাবে চারজনের প্রাণহানির কথা বলা হয়েছে। হিংসা-প্রতিহিংসার অন্তহীন আবর্তে তা যে আরও বাড়বে না, কে বলতে পারে? বর্তমান সংঘাত নিরসনে অবিলম্বে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে প্রশাসনকেই, কারণ দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানুষের নিরাপত্তাবিধানের দায়িত্ব তাদের।
পার্বত্যাঞ্চলে এ পরিণতি কি অমোঘ ছিল? এই সহিংসতার সূত্রপাত হয়েছে নাকি একটি মোটরসাইকেল চুরির ঘটনাকে ঘিরে। ১৮ সেপ্টেম্বর সকালে খাগড়াছড়ির পানখাইয়া পাড়ার রাস্তায় মামুন নামের একজনের লাশ পাওয়া যায়। পুলিশের তথ্যমতে, মামুন বাইক চুরি করে দ্রুতগতিতে পালাতে গিয়ে বিদ্যুতের পোলের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আহত হলে তাঁকে ধাওয়া করা লোকজন পিটুনি দেয়। এতে ঘটনাস্থলে মামুনের মৃত্যু হয়। খাগড়াছড়ি থানা-পুলিশ জানিয়েছে, মামুনের বিরুদ্ধে ১৪টি চুরির মামলা এবং দুটি মাদক মামলা ছিল।
গণপিটুনিতে মামুনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে অভিবাসীদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়। তারা বিক্ষোভ মিছিল বের করলে পাহাড়িরা বাধা দেয়। একপর্যায়ে পাহাড়ি ও অভিবাসীদের মধ্যে সহিংসতা শুরু হয়। ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
ঘটনার জন্য পাহাড়ি ও অভিবাসী দুই পক্ষ থেকে পরস্পরকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে ঘটনাটিকে চরম সহিংসতার দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে গুজব। সশস্ত্র আক্রমণের গুজব, অসংখ্য মানুষকে মেরে ফেলার গুজব। গুজবে গুজবে হিংসা ছড়ায়। আর জ্বলতে থাকে বাড়িঘর। এরপর মাঠে নামে সেনাবাহিনী। পাহাড়িদের অভিযোগ, অভিবাসীরা সেনাদের প্রশ্রয়ে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। পাহাড়িদের ওপর গুলি চালায়। সেনাদের অভিযোগ, পাহাড়িরা সশস্ত্র হয়ে সেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। আত্মরক্ষার্থে সেনারাও গুলি করে।
শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো যে, কোনো মৃত্যু, কোনো অন্যায়ই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না, তা সে যে উদ্দেশ্যে, যে কারণেই ঘটুক না কেন! খাগড়াছড়ির পানখাইয়া পাড়ার রাস্তায় মামুন নামের যে ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে, তা কোনোমতেই মেনে নেওয়া যায় না। চোর হোক, আর ডাকাত হোক, কাউকে পিটিয়ে মারার অধিকার কারও নেই। এই মুত্যুর কারণ অবশ্যই খুঁজে বের করা উচিত। যদি কোনো পাহাড়ি এই হত্যার সঙ্গে যুক্ত থাকে তবে অবশ্যই তার যথাযথ বিচার ও শাস্তি হওয়া উচিত। কারণ, কোনো অন্যায়ের প্রতিবিধান যেমন নাগরিকেরা নিজের হাতে করতে পারে না, কাউকে হত্যাও করতে পারে না।
কিন্তু একটি মৃত্যুর ঘটনাকে পুঁজি করে, কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া কেবল অনুমানের বশবর্তী হয়ে একটি জনগোষ্ঠীর ওপর সব দায় চাপিয়ে দেওয়া, তারপর হিংসা আর ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পুরো এলাকার মানুষজনের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া, গুলি করে মারা, এ কোন রীতি? কেন এই আদিম হিংস্রতাকে উসকে দেওয়া হচ্ছে? এ কোন সমাজ, কিসের সমাজ? কোথায় আইন, কোথায় আইনের শাসন?
পাহাড়ে এমন ঘটনা আগেও বহুবার ঘটেছে। মিথ্যে একটা অভিযোগ তুলে কোনো একটা গুজব রটিয়ে দিয়ে বা বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে মানুষকে খেপিয়ে দিয়ে বাড়িঘরে হামলা, আগুন দিয়ে ব্যাপক ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। কয়েক বছর ধরে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এই অস্ত্র প্রয়োগ করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এই কাজটি করা হয় সবচেয়ে বেশি।
একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে একদল মানুষ আরেক দল মানুষের ওপর শ্বাপদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আর তারা স্রেফ জীবন বাঁচাতে বাড়িঘর, সহায়-সম্পদ ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাচ্ছে! হ্যাঁ, এটাই হচ্ছে আমাদের একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের চিত্র! এমন দেশ নিয়ে আমরা কীভাবে নিশ্চিন্ত হব? সুখেশান্তিতে ঘুমাব?
প্রশাসনের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে। তারা শুরুতে ঘটনাটিকে উপেক্ষা করেছে। পরে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কঠোর হয়েছে। মানুষের জীবনকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। প্রশাসনের এই ভূমিকা নিয়ে পাহাড়ি-অভিবাসী উভয়েরই ক্ষোভ রয়েছে। অবশ্য পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন ঘটনার ‘আলাদা মানে’ আছে। ভিন্ন মনস্তত্ত্ব আছে। ওখানে যেসব অভিবাসী আছে, তাদের, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের মনস্তত্ত্ব অনেক সময়ই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মনস্তত্ত্বের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে বলে অভিযোগ। এক-আধটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে অভিবাসী, প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তারা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকদের ‘শত্রু’ মনে করে। ওরা সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, উগ্র, ভিনদেশের এজেন্ট, অভিবাসীদের বিরুদ্ধশক্তি—এমন একটা ভাবধারা নিয়ে চলে। তাই তো যখনই কোনো সুযোগ আসে পাহাড়িদের জব্দ করার, তাদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার, সবাই একযোগে সেই সুযোগটা গ্রহণ করে।
অপ্রিয় সত্য হলো, যুগের পর যুগ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানকে একটা ‘ভিন্ন দেশ’ বানিয়ে রাখা হয়েছে। যেখানে পুলিশ-র্যাবের পাশাপাশি হাজার হাজার সেনাকেও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখানে এমনই এক মেকানিজম তৈরি করা হয়েছে যে পাহাড়িদের হত্যা, ধর্ষণ, গ্রেপ্তার, হয়রানি, হেফাজতে নিয়ে শারীরিক অত্যাচার, সামরিক কর্মকর্তা ও সেটেলারদের ভূমি দখলের বেশির ভাগ খবর কখনোই মিডিয়ায় আসে না। দলীয় সরকারের আমলেও না। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও না। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মিডিয়ার ‘ব্ল্যাক আউট’ এবং ‘সেন্সরশিপ’-এর অন্ধকারে পাহাড়ের খবরগুলো কখনোই আলোর দেখা পায় না।
পার্বত্য চট্টগ্রামে যা হয়েছে, যা হচ্ছে, এর প্রতিবিধান হওয়া দরকার। সরকারের ভূমিকাও পর্যালোচনা করে দেখার সুযোগ রয়েছে। সরকারের কাজ রক্ষা করা, হামলা করা নয়। পাহাড়িদের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ থাকে, তাহলে তো আইন আছে। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করেই সমস্যার সমাধানে পৌঁছাতে হবে। সরকার যেন কোনো পক্ষভুক্ত না হয়ে পড়ে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
পাহাড়ে উগ্রতা সামলাতে প্রশাসনকে দৃঢ় থাকতে হবে ঠিকই। কিন্তু এই সামলানোরই আবশ্যিক অঙ্গ হলো আলোচনা, যাতে পার্বত্যাঞ্চলে মধ্যপন্থী মানুষও নানা সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির পক্ষে পথে নামতে পারেন। প্রশাসনকে ভেবে বের করতে হবে, কীভাবে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়, যাতে সংঘাতের তীব্রতা কমে আসে, আলোচনা সহজ হয়।
সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে এই অচলাবস্থা থেকে বের হওয়া যাবে বলে মনে হয় না। গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে সরকার বিপুল সামরিক বাহিনীর সদস্য পাঠিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চেয়ে পাহাড়ের সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তুলেছিল। তখন সেখানে সশস্ত্র সংঘর্ষও হয়। প্রায় দুই দশকের সশস্ত্র লড়াইয়ের ইতি হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ২ জুলাই পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এই চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে পরে সরকারিভাবে তেমন কোনো আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
যদি কোনো পাহাড়ি ছেলেমেয়ে প্রতিবাদ করে, নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেতন হয়, তাদের নানা রাজনৈতিক মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করা হয়। এর আগে ১৯৯৬ সালে কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা হয়েছিল। এখনো তাঁর হদিস মেলেনি। ২০১৭ সালে নির্যাতন চালিয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় রোমেল চাকমাকে। এই ধারা নিয়মিত চলছে। আর দেশের মানুষের একটা বড় অংশ এখনো পাহাড়ে দমন-পীড়নকে অন্ধ সমর্থন দিয়ে চলেছে তথাকথিত দেশপ্রেম আর উগ্র জাতীয়তাবাদের মোহে অন্ধ হয়ে।
দীর্ঘ তিন দশক ধরে পাহাড়ের সমস্যাকে জিইয়ে রাখা হয়েছে। এই ধারা থেকে বের হয়ে আসার পথ-পদ্ধতি অবিলম্বে খুঁজে বের করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখা দরকার যে পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে না পারলে দেশের শান্তিও বিনষ্ট হবে।
পর্দার নায়িকারা নিজেদের বয়স আড়ালে রাখা পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আজমেরী হক বাঁধন। প্রতিবছর নিজের জন্মদিনে জানান দেন তাঁর বয়স। গতকাল ছিল বাঁধনের ৪১তম জন্মদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই জানালেন এই তথ্য।
২ দিন আগে১০ বছরের বেশি সময় ধরে শোবিজে কাজ করছেন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। নাটকের পাশাপাশি ওটিটিতে দেখা গেছে তাঁকে। সরকারি অনুদানের ‘দেবী’ নামের একটি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। প্রশংসিত হলেও সিনেমায় আর দেখা মেলেনি তাঁর। ছোট পর্দাতেও অনেক দিন ধরে অনিয়মিত তিনি। এবার শবনম ফারিয়া হাজির হচ্ছেন নতুন পরিচয়ে। কমেডি রিয়েলিটি
২ দিন আগেআমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য যাত্রাপালা। গণমানুষের সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত এই যাত্রাপালা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করছে ‘যাত্রা উৎসব-২০২৪’। আগামী ১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে শুরু হবে ৭ দিনব্যাপী এই উৎসব।
২ দিন আগে‘বঙ্গবন্ধু’ পদবি বিলীন হবে না। হতে পারে না। যেমনটি ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশের পদবি বিলীন হয়নি। ইতিহাসে এসব পদবি অম্লান ও অক্ষয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ। আপনজনকে তো অবশ্যই, শত্রুপক্ষের লোকেরাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপদের
২ দিন আগে