মহিউদ্দিন খান মোহন
১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান ও মহত্তর অর্জনের দিন। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের পরিণতিতে এ দিনটি এসেছিল আমাদের জন্য নতুন সওগাত নিয়ে। সেই সওগাত স্বাধীনতা। আমরা হয়েছিলাম পরাধীনতা থেকে শৃঙ্খলমুক্ত। পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন একটি দেশ জায়গা করে নিয়েছিল—বাংলাদেশ। প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন এবং ২৩ বছরের পাকিস্তানি শোষণের কবল থেকে আমরা মুক্তি অর্জন করেছিলাম এই দিনে। প্রখ্যাত গীতিকার ও সুরকার আবদুল লতিফের লেখা ও গণশিল্পী ফকির আলমগীরের গাওয়া গানে সে কথাই মূর্ত হয়ে উঠেছে, ‘আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারোর দানে পাওয়া নয়, আমি দাম দিছি প্রাণ লক্ষকোটি জানা আছে জগৎময়...’।
গানের কথায় ইতিহাসের যে সত্য প্রতিভাত হয়ে উঠেছে, তাকে অস্বীকার করার সাধ্য কারও নেই। কেননা, ১৯৭১ সালে এই ভূখণ্ডে যে ঘটনা ঘটেছে, তার সাক্ষী বিশ্ববাসী। সে দিন বিশ্ব অবাক চোখে দেখেছে স্বাধীনতার জন্য একটি জাতি কী কঠিন যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে! দেখেছে একটি নতুন সূর্যোদয়ের জন্য একটি জাতি কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারে! আর সে জন্যই বিশ্ব ইতিহাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দখল করে আছে এক অনন্য স্থান। সেই অবস্থান সংগত কারণেই আমাদের মনে অহংবোধের জন্ম দেয়।
প্রতিবছর বিজয় দিবস এলেই আমি নস্টালজিক হয়ে পড়ি। মনের পর্দায় ভেসে ওঠে সে দিনের অনির্বচনীয় আনন্দের স্মৃতি। আমি নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান মনে করি এ জন্য যে, আমি আমার প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। আজ যাঁদের বয়স ৬০ বছরের ওপরে, তাঁরা সবাই তা প্রত্যক্ষ করেছেন। কারও স্মৃতিতে তা জ্বলজ্বল করছে, কারও স্মৃতিতে হয়তো পড়েছে ধূলির আস্তরণ। ১৯৭১ সালে আমি ছিলাম সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। ‘রাজনীতির পাঠশালায়’ তখনো ভর্তি হইনি। তবে উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে বড় ভাইদের সঙ্গে মিছিলে শামিল হয়েছিলাম। দেশপ্রেম ও রাজনীতি-বোধের প্রথম পাঠ সেখানেই।
ফলে সত্তরের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার টালবাহানার খবর রাখতাম। বড়দের কাছে শুনতাম, ওরা আমাদের কাছে ক্ষমতা দেবে না। কী হবে তাহলে? আমার বড় ভাই ছিলেন পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি বলতেন, একমাত্র সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে এ দেশের মানুষের মুক্তি অর্জন সম্ভব। অবশ্য তাঁদের সশস্ত্র বিপ্লব ছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, যা ছিল তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় অসম্ভব। কিন্তু পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেল, শেষ পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগকেও সশস্ত্র যুদ্ধের পথে হাঁটতে হলো।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ একদিকে যেমন ছিল অসহযোগ আন্দোলনের ডাক, একই সঙ্গে তা ছিল স্বাধীনতার জন্য যেকোনো মুহূর্তে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইঙ্গিত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর সশস্ত্র যুদ্ধ ছাড়া বাঙালির মুক্তির আর কোনো পথই খোলা ছিল না। সেই যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বরোচিত হামলা শুরু হলো। তারপর যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না। শুরু হলো সর্বাত্মক স্বাধীনতাযুদ্ধ।সেই যুদ্ধে বাংলাদেশের ছাত্র, যুবক, শ্রমিক ও কৃষক দলে দলে অংশ নিতে থাকলেন।
আমাদের এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এসেছিল ৯ মে। এসেই পরদিন ওরা মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর বাজারের আশপাশের বেশ কয়েকটি হিন্দু বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। মিলিটারি আসার খবর পেয়ে ওই সব বাড়ির নারী-পুরুষ-শিশুরা আগেই সরে পড়েছিল।
সেই যাত্রায় পাকিস্তানি সৈন্যরা কয়েক দিন থেকে আবার ঢাকায় চলে যায়। ওরা আবার আসে জুলাই মাসে। ক্যাম্প করে শ্রীনগর ডাকবাংলা ও সংলগ্ন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর তিনটি যুদ্ধ হয়েছিল আমাদের এলাকায়। একটি আগস্ট মাসের মাঝামাঝি লৌহজং উপজেলার গোয়ালিমান্দ্রা হাটে। দ্বিতীয় যুদ্ধটি হয়েছিল ১৭ নভেম্বর। সে দিন শ্রীনগর ডাকবাংলার ক্যাম্প গুটিয়ে হানাদার বাহিনী চলে যাচ্ছিল লৌহজংয়ের দিকে। শ্রীনগর-লৌহজং খালের পূর্ব পাড় ধরে ওরা হেঁটে যাচ্ছিল।
আমাদের গ্রামের মাঝামাঝি জায়গায় মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করে। বেধে যায় প্রচণ্ড যুদ্ধ। সারা দিন চলে সেই যুদ্ধ। সে দিন হানাদার বাহিনীর ৬০ জনের ১ জনও জীবন নিয়ে ফিরতে পারেনি। মুক্ত হয় শ্রীনগর। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী কয়েক দিন পরে আবার চেষ্টা করে শ্রীনগরে ঢুকতে। কিন্তু সিরাজদিখান উপজেলার সৈয়দপুরে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে ওরা পিছু হটে। টানা তিন দিন চলেছিল সেই যুদ্ধ। সেই যুদ্ধকে উপজীব্য করে প্রখ্যাত কবি ও সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘শ্রীনগরে যুদ্ধ’।
এরপর থেকেই একের পর এক মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের খবর আসতে থাকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে আমরা সেসব খবর পাই, আর আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠি।
৫ ডিসেম্বর ভারত স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে। যুদ্ধ ধারণ করে ভয়াবহ রূপ। পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ হয়ে ওঠে সময়ের ব্যাপার। অবশেষে আসে পরমকাঙ্ক্ষিত দিন। ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বিবিসির খবরে জানতে পারলাম, ওই দিন বিকেলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। সোল্লাসে ফেটে পড়লাম আমরা। বড় ভাই গিয়াসউদ্দিন খান বাদল, ছোট ভাই মেজবাহ, চাচাতো ভাই রুহুল আমিন, রমজান, আসলাম, আমরা সবাই হারিকেন হাতে বেরিয়ে পড়লাম ঘর ছেড়ে। বাড়ির সামনের ছোট্ট মাঠে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে স্লোগান তুললাম ‘জয় বাংলা’, ‘স্বাধীন হলো স্বাধীন হলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হলো’। মুহূর্তে প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠল পুরো গ্রাম। বিভিন্ন বাড়ি থেকে কেউ হারিকেন, কেউ টর্চ হাতে বেরিয়ে এসে শামিল হলো সেই মিছিলে। পৌষের প্রচণ্ড ঠান্ডা তখন আমাদের কাছে পরাজিত। অপার আনন্দে নেচে নেচে পুরো গ্রাম ঘুরেছিলাম আমরা। চারদিক থেকে ভেসে আসছিল বিজয়োল্লাসের আনন্দধ্বনি।সে দিনের সে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
পরদিন সকালে চলে গেলাম আমাদের থানা সদর শ্রীনগরে। দলে দলে মানুষ আসছিল বিভিন্ন দিক থেকে। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের হাতের অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি ছুড়ছিলেন আকাশের দিকে, আর সমবেত জনতা চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করছিল। এই কদিন আগে যে গুলির আওয়াজ শুনলে মানুষের হৃৎকম্প শুরু হয়ে যেত, আজ সেই গুলির আওয়াজে তারা প্রকাশ করছে উল্লাস! মিছিলের পর মিছিল এসে শ্রীনগর বাজারকে আক্ষরিক অর্থেই পরিণত করল জনসমুদ্রে। সেই জনসমুদ্রের কয়েকটি তরঙ্গের সঙ্গে দেখা হলো দীর্ঘ প্রায় নয় মাস পরে। তারা আমার সহপাঠী। মোতালেব, মোশাররফ, শফিকুল, মহসীন, মদন দাশ, কৃষ্ণদাশ, বাদল ঘোষ, জীবন মণ্ডল, যার সঙ্গে দেখা হয় জড়িয়ে ধরে একই কথা-বন্ধু আমরা মুক্ত, আমরা স্বাধীন। সবার চাখে আনন্দাশ্রু। সেই সঙ্গে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখার পর্ব শুরু হলো।আমাদের কেউ আর শোষণ করতে পারবে না, নির্যাতন নিষ্পেষণ, বঞ্চিত করতে পারবে না।
আজ ৫২ বছর পরে যখন পেছন ফিরে তাকাই, হতাশা বুকের মধ্যেই দম আটকে দেয়। দৃশ্যত আমরা ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করেছি। কিন্তু যে স্বপ্ন একাত্তরে আমাদের চোখে বাসা বেঁধেছিল, সেই স্বপ্ন অনেকাংশেই পূরণ হয়নি। কেন হয়নি সেই বিতর্ক এখানে অবতারণা করতে চাই না। শুধু একটি কথাই বলতে চাই, স্বাধীনতার উষালগ্নের সে স্বপ্ন পূরণ করতে হলে যে কর্তব্যনিষ্ঠা, দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দেওয়া উচিত ছিল, আমরা তা দিতে পারিনি। আমাদের এ ব্যর্থতা পরবর্তী প্রজন্ম ক্ষমা করতে পারবে কি না, তা জানি না?
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান ও মহত্তর অর্জনের দিন। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের পরিণতিতে এ দিনটি এসেছিল আমাদের জন্য নতুন সওগাত নিয়ে। সেই সওগাত স্বাধীনতা। আমরা হয়েছিলাম পরাধীনতা থেকে শৃঙ্খলমুক্ত। পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন একটি দেশ জায়গা করে নিয়েছিল—বাংলাদেশ। প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন এবং ২৩ বছরের পাকিস্তানি শোষণের কবল থেকে আমরা মুক্তি অর্জন করেছিলাম এই দিনে। প্রখ্যাত গীতিকার ও সুরকার আবদুল লতিফের লেখা ও গণশিল্পী ফকির আলমগীরের গাওয়া গানে সে কথাই মূর্ত হয়ে উঠেছে, ‘আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারোর দানে পাওয়া নয়, আমি দাম দিছি প্রাণ লক্ষকোটি জানা আছে জগৎময়...’।
গানের কথায় ইতিহাসের যে সত্য প্রতিভাত হয়ে উঠেছে, তাকে অস্বীকার করার সাধ্য কারও নেই। কেননা, ১৯৭১ সালে এই ভূখণ্ডে যে ঘটনা ঘটেছে, তার সাক্ষী বিশ্ববাসী। সে দিন বিশ্ব অবাক চোখে দেখেছে স্বাধীনতার জন্য একটি জাতি কী কঠিন যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে! দেখেছে একটি নতুন সূর্যোদয়ের জন্য একটি জাতি কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারে! আর সে জন্যই বিশ্ব ইতিহাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দখল করে আছে এক অনন্য স্থান। সেই অবস্থান সংগত কারণেই আমাদের মনে অহংবোধের জন্ম দেয়।
প্রতিবছর বিজয় দিবস এলেই আমি নস্টালজিক হয়ে পড়ি। মনের পর্দায় ভেসে ওঠে সে দিনের অনির্বচনীয় আনন্দের স্মৃতি। আমি নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান মনে করি এ জন্য যে, আমি আমার প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। আজ যাঁদের বয়স ৬০ বছরের ওপরে, তাঁরা সবাই তা প্রত্যক্ষ করেছেন। কারও স্মৃতিতে তা জ্বলজ্বল করছে, কারও স্মৃতিতে হয়তো পড়েছে ধূলির আস্তরণ। ১৯৭১ সালে আমি ছিলাম সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। ‘রাজনীতির পাঠশালায়’ তখনো ভর্তি হইনি। তবে উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে বড় ভাইদের সঙ্গে মিছিলে শামিল হয়েছিলাম। দেশপ্রেম ও রাজনীতি-বোধের প্রথম পাঠ সেখানেই।
ফলে সত্তরের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার টালবাহানার খবর রাখতাম। বড়দের কাছে শুনতাম, ওরা আমাদের কাছে ক্ষমতা দেবে না। কী হবে তাহলে? আমার বড় ভাই ছিলেন পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি বলতেন, একমাত্র সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে এ দেশের মানুষের মুক্তি অর্জন সম্ভব। অবশ্য তাঁদের সশস্ত্র বিপ্লব ছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, যা ছিল তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় অসম্ভব। কিন্তু পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেল, শেষ পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগকেও সশস্ত্র যুদ্ধের পথে হাঁটতে হলো।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ একদিকে যেমন ছিল অসহযোগ আন্দোলনের ডাক, একই সঙ্গে তা ছিল স্বাধীনতার জন্য যেকোনো মুহূর্তে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইঙ্গিত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর সশস্ত্র যুদ্ধ ছাড়া বাঙালির মুক্তির আর কোনো পথই খোলা ছিল না। সেই যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বরোচিত হামলা শুরু হলো। তারপর যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না। শুরু হলো সর্বাত্মক স্বাধীনতাযুদ্ধ।সেই যুদ্ধে বাংলাদেশের ছাত্র, যুবক, শ্রমিক ও কৃষক দলে দলে অংশ নিতে থাকলেন।
আমাদের এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এসেছিল ৯ মে। এসেই পরদিন ওরা মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর বাজারের আশপাশের বেশ কয়েকটি হিন্দু বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। মিলিটারি আসার খবর পেয়ে ওই সব বাড়ির নারী-পুরুষ-শিশুরা আগেই সরে পড়েছিল।
সেই যাত্রায় পাকিস্তানি সৈন্যরা কয়েক দিন থেকে আবার ঢাকায় চলে যায়। ওরা আবার আসে জুলাই মাসে। ক্যাম্প করে শ্রীনগর ডাকবাংলা ও সংলগ্ন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর তিনটি যুদ্ধ হয়েছিল আমাদের এলাকায়। একটি আগস্ট মাসের মাঝামাঝি লৌহজং উপজেলার গোয়ালিমান্দ্রা হাটে। দ্বিতীয় যুদ্ধটি হয়েছিল ১৭ নভেম্বর। সে দিন শ্রীনগর ডাকবাংলার ক্যাম্প গুটিয়ে হানাদার বাহিনী চলে যাচ্ছিল লৌহজংয়ের দিকে। শ্রীনগর-লৌহজং খালের পূর্ব পাড় ধরে ওরা হেঁটে যাচ্ছিল।
আমাদের গ্রামের মাঝামাঝি জায়গায় মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করে। বেধে যায় প্রচণ্ড যুদ্ধ। সারা দিন চলে সেই যুদ্ধ। সে দিন হানাদার বাহিনীর ৬০ জনের ১ জনও জীবন নিয়ে ফিরতে পারেনি। মুক্ত হয় শ্রীনগর। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী কয়েক দিন পরে আবার চেষ্টা করে শ্রীনগরে ঢুকতে। কিন্তু সিরাজদিখান উপজেলার সৈয়দপুরে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে ওরা পিছু হটে। টানা তিন দিন চলেছিল সেই যুদ্ধ। সেই যুদ্ধকে উপজীব্য করে প্রখ্যাত কবি ও সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘শ্রীনগরে যুদ্ধ’।
এরপর থেকেই একের পর এক মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের খবর আসতে থাকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে আমরা সেসব খবর পাই, আর আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠি।
৫ ডিসেম্বর ভারত স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে। যুদ্ধ ধারণ করে ভয়াবহ রূপ। পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ হয়ে ওঠে সময়ের ব্যাপার। অবশেষে আসে পরমকাঙ্ক্ষিত দিন। ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বিবিসির খবরে জানতে পারলাম, ওই দিন বিকেলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। সোল্লাসে ফেটে পড়লাম আমরা। বড় ভাই গিয়াসউদ্দিন খান বাদল, ছোট ভাই মেজবাহ, চাচাতো ভাই রুহুল আমিন, রমজান, আসলাম, আমরা সবাই হারিকেন হাতে বেরিয়ে পড়লাম ঘর ছেড়ে। বাড়ির সামনের ছোট্ট মাঠে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে স্লোগান তুললাম ‘জয় বাংলা’, ‘স্বাধীন হলো স্বাধীন হলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হলো’। মুহূর্তে প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠল পুরো গ্রাম। বিভিন্ন বাড়ি থেকে কেউ হারিকেন, কেউ টর্চ হাতে বেরিয়ে এসে শামিল হলো সেই মিছিলে। পৌষের প্রচণ্ড ঠান্ডা তখন আমাদের কাছে পরাজিত। অপার আনন্দে নেচে নেচে পুরো গ্রাম ঘুরেছিলাম আমরা। চারদিক থেকে ভেসে আসছিল বিজয়োল্লাসের আনন্দধ্বনি।সে দিনের সে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
পরদিন সকালে চলে গেলাম আমাদের থানা সদর শ্রীনগরে। দলে দলে মানুষ আসছিল বিভিন্ন দিক থেকে। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের হাতের অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি ছুড়ছিলেন আকাশের দিকে, আর সমবেত জনতা চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করছিল। এই কদিন আগে যে গুলির আওয়াজ শুনলে মানুষের হৃৎকম্প শুরু হয়ে যেত, আজ সেই গুলির আওয়াজে তারা প্রকাশ করছে উল্লাস! মিছিলের পর মিছিল এসে শ্রীনগর বাজারকে আক্ষরিক অর্থেই পরিণত করল জনসমুদ্রে। সেই জনসমুদ্রের কয়েকটি তরঙ্গের সঙ্গে দেখা হলো দীর্ঘ প্রায় নয় মাস পরে। তারা আমার সহপাঠী। মোতালেব, মোশাররফ, শফিকুল, মহসীন, মদন দাশ, কৃষ্ণদাশ, বাদল ঘোষ, জীবন মণ্ডল, যার সঙ্গে দেখা হয় জড়িয়ে ধরে একই কথা-বন্ধু আমরা মুক্ত, আমরা স্বাধীন। সবার চাখে আনন্দাশ্রু। সেই সঙ্গে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখার পর্ব শুরু হলো।আমাদের কেউ আর শোষণ করতে পারবে না, নির্যাতন নিষ্পেষণ, বঞ্চিত করতে পারবে না।
আজ ৫২ বছর পরে যখন পেছন ফিরে তাকাই, হতাশা বুকের মধ্যেই দম আটকে দেয়। দৃশ্যত আমরা ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করেছি। কিন্তু যে স্বপ্ন একাত্তরে আমাদের চোখে বাসা বেঁধেছিল, সেই স্বপ্ন অনেকাংশেই পূরণ হয়নি। কেন হয়নি সেই বিতর্ক এখানে অবতারণা করতে চাই না। শুধু একটি কথাই বলতে চাই, স্বাধীনতার উষালগ্নের সে স্বপ্ন পূরণ করতে হলে যে কর্তব্যনিষ্ঠা, দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দেওয়া উচিত ছিল, আমরা তা দিতে পারিনি। আমাদের এ ব্যর্থতা পরবর্তী প্রজন্ম ক্ষমা করতে পারবে কি না, তা জানি না?
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
পর্দার নায়িকারা নিজেদের বয়স আড়ালে রাখা পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আজমেরী হক বাঁধন। প্রতিবছর নিজের জন্মদিনে জানান দেন তাঁর বয়স। গতকাল ছিল বাঁধনের ৪১তম জন্মদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই জানালেন এই তথ্য।
২ দিন আগে১০ বছরের বেশি সময় ধরে শোবিজে কাজ করছেন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। নাটকের পাশাপাশি ওটিটিতে দেখা গেছে তাঁকে। সরকারি অনুদানের ‘দেবী’ নামের একটি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। প্রশংসিত হলেও সিনেমায় আর দেখা মেলেনি তাঁর। ছোট পর্দাতেও অনেক দিন ধরে অনিয়মিত তিনি। এবার শবনম ফারিয়া হাজির হচ্ছেন নতুন পরিচয়ে। কমেডি রিয়েলিটি
২ দিন আগেআমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য যাত্রাপালা। গণমানুষের সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত এই যাত্রাপালা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করছে ‘যাত্রা উৎসব-২০২৪’। আগামী ১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে শুরু হবে ৭ দিনব্যাপী এই উৎসব।
২ দিন আগে‘বঙ্গবন্ধু’ পদবি বিলীন হবে না। হতে পারে না। যেমনটি ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশের পদবি বিলীন হয়নি। ইতিহাসে এসব পদবি অম্লান ও অক্ষয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ। আপনজনকে তো অবশ্যই, শত্রুপক্ষের লোকেরাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপদের
২ দিন আগে