স্বাতী চৌধুরী
ইরানের মেয়ে মাহশা আমিনির পুরো মাথা হিজাবে ঠিকমতো ঢাকা হয়নি। তাঁর কগাছি চুল দেখা যাচ্ছিল। সে জন্য সে দেশের নৈতিকতা পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে আর পুলিশি হেফাজতেই মেয়েটি কোমায় চলে গেল। অবশেষে তাঁর মৃত্যু হলো। মাহশার মৃত্যুতে ইরানে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে উঠেছে। সেই আগুনে হিজাব পুড়ছে, নারীরা তাদের চুল কেটে ফেলছে। সেই কাটা চুলের পতাকা বাতাসে উড়ছে। এসব দৃশ্য আর খবর শুরু থেকেই সারা বিশ্ব দেখছে। প্রতিদিন শহর থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়ছে বিক্ষোভের আগুন আর সরকারের বিক্ষোভ দমনে প্রাণ হারাচ্ছে তরুণীরা।
পুরো বিশ্ব চার দশকের বেশি সময় ধরে ইরানে প্রগতিশীলতার নামে নারীদের শ্বাসরুদ্ধকর জীবনের গল্প শুনছে এই আন্দোলনের মাধ্যমে। ফেসবুকের কল্যাণে ৪০-৫০ বছর আগের আর বর্তমান সময়ের ইরানি নারীর বেশভূষার ছবি দেখেছি। কিন্তু এত যে কাহিনি, জানা ছিল না!
গত ১০-২০ বছরে আমাদের দেশেও নারীদের পোশাকপরিচ্ছদও বদলে গেছে এবং কেবল পোশাকপরিচ্ছদ নয়, কিছু নারীর চিন্তাভাবনার গতিপথও যে দ্রুতগতিতে বদলে যাচ্ছে; সেই বদলের পরিচয় আমরা পেয়েছি সাম্প্রতিক সময়ে। দেখেছি, বাসে, রেলস্টেশনে এবং বিশ্ববিদ্যালয়েও কয়েকজন তরুণী কীভাবে হেনস্তার শিকার হলো। সোশ্যাল মিডিয়া, টেলি ও প্রিন্ট মিডিয়ায় এ নিয়ে যখন পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক হইচই চলছে, তখন মাহশা আমিনির সঙ্গে এই নিষ্ঠুরতার খবর ধরে ইরানের নিষ্ঠুরতার ইতিহাস উন্মোচিত হলো।
এর আগে এবং এখনো দেখছি, আমাদের দু-একজন পুরুষ লেখক তাঁদের লেখায় প্রশ্ন তুলেছেন, নারীর চুল কবে থেকে যৌনাঙ্গ হয়ে গেল, যা দেখলে পুরুষের একটা গোষ্ঠী সিডিউস হয়ে যায় এবং তারা যাতে তা না হয়, সে জন্য নারীকেই বস্তাবন্দী কেন হতে হবে! তাঁরা আরও প্রশ্ন তুলেছেন, যারা নারীর চুল দেখে সিডিউস হয়ে যায়, তারা যখন এটাও জানে যে বস্তার ভেতরেও নারীরাই থাকেন, তখন এই বস্তাবন্দীদের দেখেও কি তারা সিডিউস হবে না? নিশ্চিত তারা সেটা হয়ে থাকে, যে কারণে বস্তাবন্দী থাকা সত্ত্বেও বহু নারী ধর্ষণের শিকার হন। পুরুষ লেখকদের লেখায় যখন এ প্রশ্ন উঠে আসে, তখন হতাশা কেটে যায়।
মাহশা আমিনির সঙ্গে যে নিষ্ঠুরতা হলো, এটা জানার পর থেকে আমার কেবল ২৬ বছর আগের একটি ঘটনা মনে পড়ছে আর এখনো শিউরে উঠছি। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঈদের ছুটিতে ময়মনসিংহে বেড়াতে যাচ্ছিলাম। তখন সুনামগঞ্জ থেকে সরাসরি ময়মনসিংহের বাস ছিল না। সিলেট কদমতলী থেকে রাত ৮টায় আমাদের বাস ছাড়বে। আমার সঙ্গীও দুজন নারী। সন্ধ্যার আগে কিছু খাওয়ার জন্য কাউন্টারের আশপাশে ভালো রেস্টুরেন্টের খোঁজে হাঁটছিলাম। পাশেই কোথাও ওয়াজ মাহফিল হচ্ছে। মাইকে ওয়াজের সব কথা ভালো বোঝা যাচ্ছে না। পরে বুঝেছি ওখানে নারীদের গালাগাল করা হচ্ছিল। সঙ্গী হিন্দু বিধবা আর আমি অবিবাহিত তরুণী। আমাদের ঘোমটা বা মাথায় কাপড় দেওয়ার দরকার হয় না। আমাদের চুল খোলা। পেছন থেকে কেউ একজন মাথায় কাপড় দেওয়ার জন্য ধমকাচ্ছেন। সেই চুল খোলা বেআব্রু মাথা নিয়ে আমরা রেস্টুরেন্টে খাবারের ফরমাশ দিয়ে টেবিলে বসতে যাব, তখনই লম্বা চুল, লম্বা পাঞ্জাবি পরা একজন ব্যক্তি কয়েকজন চ্যালাচামুন্ডা সঙ্গে নিয়ে আমাদের গালাগাল করতে করতে এগিয়ে আসছে।
রেস্টুরেন্টে কত মানুষ, একজন পুলিশ সদস্যও ছিল। কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। আমার সঙ্গীরা ভয়ে কাঁপছে। আমি পুলিশ সদস্যকে নালিশ করলাম, কিন্তু তিনি পাল্টা আমাকেই গালাগাল করলেন। তাতে ওরা মারমুখী হয়ে আমাদের আক্রমণ করতে উদ্যত হলো। বলছে, আমাদের চুল ছিঁড়ে নেবে। কী করে যে ওদের পাশ কাটিয়ে প্রাণপণ দৌড়ে কাউন্টারে পৌঁছেছিলাম! সে কথা কাউকে বলিনি। তখন জানতাম, সবাই আমাদেরই বকবে। কেন আমরা কোনো পুরুষ মানুষ ছাড়া একা একা হাঁটছিলাম? কেন আমাদের চুল ছাড়া ছিল?
ছোটবেলায় চুল ছেড়ে রাখার জন্য অনেকের কাছ থেকে বকাঝকা শুনেছি। পাত্তা দিইনি। মনে হতো চুল আমার, সেটা আমি ছেড়ে না বেঁধে রাখব, সে সিদ্ধান্তও আমার। অবশ্য যাঁরা আমাকে বকতেন, তাঁরা সবাই আমার শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তাঁরা বলতেন, নির্জন দুপুর ও সন্ধ্যায় ভূত বসে থাকে গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে। গাছের নিচ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ভূত-পেতনি চুল ধরে গাছে তুলে নেবে! তারপর গোছা গোছা চুল টেনে ছিঁড়ে দেবে। মেয়েদের চুলের প্রতি ভূত-পেতনির এত আকর্ষণ কেন, আমি বুঝতে পারতাম না। নারীকে কেন লম্বা চুলই রাখতে হবে, আবার ঘোমটার আড়ালেই কেন সেটা ঢেকে রাখতে হবে, তা বুঝতে পারি যখন জেন্ডার ধারণা নিয়ে পড়াশোনা করলাম।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নারীর লম্বা চুলের সৌন্দর্য পুরুষের সম্পত্তি। তাঁর নিজস্ব পুরুষই কেবল তা উপভোগ করবে। আবার এই লম্বা চুল ধরে তাঁকে মারধর করতেও সুবিধা। লম্বা চুল দিয়ে নারীকে প্রমাণ করা যায় যে তুমি নারী। তোমার বাস ঘরের ভেতর। তোমার দেহের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো চুলও তোমার নয়। তাই পুরুষ বা পুরুষতন্ত্র ঠিক করবে তোমার চুল কখন খোলা ও ঢেকে রাখবে। কতটা লম্বা বা
ছেঁটে ফেলবে!
ছোটবেলায় গ্রামের দিদিমা-ঠাকুরমাদের দেখেছি, তাঁদের চুল পুরুষের মতো ছাঁটা। নারীর লম্বা চুল দেখে অভ্যস্ত আমাদের চোখে ছাঁটা চুলের বুড়ি ঠাকুরমাদের বিচ্ছিরি লাগত। বঙ্কিম-শরৎবাবুদের সাহিত্যে জেনেছি, অল্পবয়সী বিধবাদের চুল কেটে ন্যাড়া করে রাখা হতো, যাতে করে তাঁদের দেখতে বদখত লাগে। সে-ও ওই পুরুষদের সিডিউস হওয়ার ভয়েই তো। সুন্দরী তরুণী বিধবাদের রূপে মুগ্ধ পুরুষ বিপথগামী হবে! তাতে আবার জাতকুল যাবে কুলটা নারীর বংশের। তাই জাতকুল বাঁচাতে নারীকেই করো ন্যাড়া। তাঁকে আটকে রাখো নানা বিধিনিষেধের দড়ি দিয়ে। কিন্তু অন্ধ বধির পুরুষতন্ত্র এটা ভাবতেই পারে না যে ‘আমার হাত বান্ধিবি, পাও বান্ধিবি, মন বান্ধিবি কেমনে?’
মন কখনো বাঁধা যায়নি। তাই ৪৩ বছর ধরে হাত-পা বাঁধা ইরানি নারীদের মনকে, তাদের চেতনাকে অবরুদ্ধ করে রাখতে পারেনি সে দেশের মৌলবাদী সরকার ও তার আইন। মেয়েরা বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়। শৃঙ্খল ভাঙার জন্য তারা আত্মাহুতি দিয়েই চলেছে। তাদের এই আন্দোলনে আজ শুধু তরুণীরা নয়, যুক্ত হচ্ছে তাদের বাবা-মা, ভাই, বন্ধু, প্রেমিক এবং বিপুলসংখ্যক পুরুষ, যাদের মধ্যে আছে অনেক তরুণ এবং কিশোরও। অথচ ইরানের নারী আন্দোলনবিষয়ক একটা ফেসবুক পেজে দেখলাম, আমাদের দেশের অসংখ্য তরুণ তাদের মন্তব্যে ইরান সরকারেরই পক্ষ নিচ্ছে। নিঃসন্দেহে তারা সেসব তরুণের গোষ্ঠী, যারা কিছুদিন আগে মেয়েদের বস্তাবন্দী করার দাবিতে মানববন্ধন করেছিল।
নারীর রূপ, নারীর চুলের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হতেই পারে পুরুষ। সেই মুগ্ধতা মানবিক। কিন্তু কেবল পুরুষই কি নারীর চুল দেখে মুগ্ধ হয়? পুরুষের এত যে বাহারি কেশবিন্যাস, এর উদ্দেশ্য কি নারীকে মুগ্ধ করার জন্য নয়? এই মুগ্ধতার মাঝে কোনো পাপ নেই। এই সৌন্দর্য চেতনা মানুষের চিরন্তন। এখন মুগ্ধতা আর উত্তেজনাকে যদি কেউ গুলিয়ে ফেলে—তার দায় নারীকে কেন নিতে হবে?
মানুষ তখনই মানুষ হয়, যখন সে তার কামনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যারা সেটা পারে না, তারা তো মানুষ নয়। পশুর চেয়েও অধম। কারণ, পশুদেরও একটা সহজাত নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আছে। সে ক্ষুধা না থাকলে খায় না। সে সারাক্ষণ জৈবিক তাড়নায় উন্মাদ থাকে না।
যেসব পুরুষ নারীর মুখ-চুল দেখলেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তারা তো অহর্নিশ মননে-মগজে-শরীরে যৌন বাসনা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাদের তো মানুষের সঙ্গে বসবাস করার যোগ্যতাই নেই। সমাজকে নিষ্কলুষ রাখতে তাদের বনে-জঙ্গলে রেখে আসার পরিবর্তে নারীকেই বস্তাবন্দী করা বর্বরতা নয় কী? ইরানের নারীরা সেই বর্বরতার বিরুদ্ধে আন্দোলনের আগুন জ্বালিয়েছেন। সেই আগুনে প্রতিদিন তাঁরা আত্মাহুতি দিচ্ছেন। ইরানের আন্দোলনের এ আগুন ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বময়।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
ইরানের মেয়ে মাহশা আমিনির পুরো মাথা হিজাবে ঠিকমতো ঢাকা হয়নি। তাঁর কগাছি চুল দেখা যাচ্ছিল। সে জন্য সে দেশের নৈতিকতা পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে আর পুলিশি হেফাজতেই মেয়েটি কোমায় চলে গেল। অবশেষে তাঁর মৃত্যু হলো। মাহশার মৃত্যুতে ইরানে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে উঠেছে। সেই আগুনে হিজাব পুড়ছে, নারীরা তাদের চুল কেটে ফেলছে। সেই কাটা চুলের পতাকা বাতাসে উড়ছে। এসব দৃশ্য আর খবর শুরু থেকেই সারা বিশ্ব দেখছে। প্রতিদিন শহর থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়ছে বিক্ষোভের আগুন আর সরকারের বিক্ষোভ দমনে প্রাণ হারাচ্ছে তরুণীরা।
পুরো বিশ্ব চার দশকের বেশি সময় ধরে ইরানে প্রগতিশীলতার নামে নারীদের শ্বাসরুদ্ধকর জীবনের গল্প শুনছে এই আন্দোলনের মাধ্যমে। ফেসবুকের কল্যাণে ৪০-৫০ বছর আগের আর বর্তমান সময়ের ইরানি নারীর বেশভূষার ছবি দেখেছি। কিন্তু এত যে কাহিনি, জানা ছিল না!
গত ১০-২০ বছরে আমাদের দেশেও নারীদের পোশাকপরিচ্ছদও বদলে গেছে এবং কেবল পোশাকপরিচ্ছদ নয়, কিছু নারীর চিন্তাভাবনার গতিপথও যে দ্রুতগতিতে বদলে যাচ্ছে; সেই বদলের পরিচয় আমরা পেয়েছি সাম্প্রতিক সময়ে। দেখেছি, বাসে, রেলস্টেশনে এবং বিশ্ববিদ্যালয়েও কয়েকজন তরুণী কীভাবে হেনস্তার শিকার হলো। সোশ্যাল মিডিয়া, টেলি ও প্রিন্ট মিডিয়ায় এ নিয়ে যখন পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক হইচই চলছে, তখন মাহশা আমিনির সঙ্গে এই নিষ্ঠুরতার খবর ধরে ইরানের নিষ্ঠুরতার ইতিহাস উন্মোচিত হলো।
এর আগে এবং এখনো দেখছি, আমাদের দু-একজন পুরুষ লেখক তাঁদের লেখায় প্রশ্ন তুলেছেন, নারীর চুল কবে থেকে যৌনাঙ্গ হয়ে গেল, যা দেখলে পুরুষের একটা গোষ্ঠী সিডিউস হয়ে যায় এবং তারা যাতে তা না হয়, সে জন্য নারীকেই বস্তাবন্দী কেন হতে হবে! তাঁরা আরও প্রশ্ন তুলেছেন, যারা নারীর চুল দেখে সিডিউস হয়ে যায়, তারা যখন এটাও জানে যে বস্তার ভেতরেও নারীরাই থাকেন, তখন এই বস্তাবন্দীদের দেখেও কি তারা সিডিউস হবে না? নিশ্চিত তারা সেটা হয়ে থাকে, যে কারণে বস্তাবন্দী থাকা সত্ত্বেও বহু নারী ধর্ষণের শিকার হন। পুরুষ লেখকদের লেখায় যখন এ প্রশ্ন উঠে আসে, তখন হতাশা কেটে যায়।
মাহশা আমিনির সঙ্গে যে নিষ্ঠুরতা হলো, এটা জানার পর থেকে আমার কেবল ২৬ বছর আগের একটি ঘটনা মনে পড়ছে আর এখনো শিউরে উঠছি। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঈদের ছুটিতে ময়মনসিংহে বেড়াতে যাচ্ছিলাম। তখন সুনামগঞ্জ থেকে সরাসরি ময়মনসিংহের বাস ছিল না। সিলেট কদমতলী থেকে রাত ৮টায় আমাদের বাস ছাড়বে। আমার সঙ্গীও দুজন নারী। সন্ধ্যার আগে কিছু খাওয়ার জন্য কাউন্টারের আশপাশে ভালো রেস্টুরেন্টের খোঁজে হাঁটছিলাম। পাশেই কোথাও ওয়াজ মাহফিল হচ্ছে। মাইকে ওয়াজের সব কথা ভালো বোঝা যাচ্ছে না। পরে বুঝেছি ওখানে নারীদের গালাগাল করা হচ্ছিল। সঙ্গী হিন্দু বিধবা আর আমি অবিবাহিত তরুণী। আমাদের ঘোমটা বা মাথায় কাপড় দেওয়ার দরকার হয় না। আমাদের চুল খোলা। পেছন থেকে কেউ একজন মাথায় কাপড় দেওয়ার জন্য ধমকাচ্ছেন। সেই চুল খোলা বেআব্রু মাথা নিয়ে আমরা রেস্টুরেন্টে খাবারের ফরমাশ দিয়ে টেবিলে বসতে যাব, তখনই লম্বা চুল, লম্বা পাঞ্জাবি পরা একজন ব্যক্তি কয়েকজন চ্যালাচামুন্ডা সঙ্গে নিয়ে আমাদের গালাগাল করতে করতে এগিয়ে আসছে।
রেস্টুরেন্টে কত মানুষ, একজন পুলিশ সদস্যও ছিল। কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। আমার সঙ্গীরা ভয়ে কাঁপছে। আমি পুলিশ সদস্যকে নালিশ করলাম, কিন্তু তিনি পাল্টা আমাকেই গালাগাল করলেন। তাতে ওরা মারমুখী হয়ে আমাদের আক্রমণ করতে উদ্যত হলো। বলছে, আমাদের চুল ছিঁড়ে নেবে। কী করে যে ওদের পাশ কাটিয়ে প্রাণপণ দৌড়ে কাউন্টারে পৌঁছেছিলাম! সে কথা কাউকে বলিনি। তখন জানতাম, সবাই আমাদেরই বকবে। কেন আমরা কোনো পুরুষ মানুষ ছাড়া একা একা হাঁটছিলাম? কেন আমাদের চুল ছাড়া ছিল?
ছোটবেলায় চুল ছেড়ে রাখার জন্য অনেকের কাছ থেকে বকাঝকা শুনেছি। পাত্তা দিইনি। মনে হতো চুল আমার, সেটা আমি ছেড়ে না বেঁধে রাখব, সে সিদ্ধান্তও আমার। অবশ্য যাঁরা আমাকে বকতেন, তাঁরা সবাই আমার শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তাঁরা বলতেন, নির্জন দুপুর ও সন্ধ্যায় ভূত বসে থাকে গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে। গাছের নিচ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ভূত-পেতনি চুল ধরে গাছে তুলে নেবে! তারপর গোছা গোছা চুল টেনে ছিঁড়ে দেবে। মেয়েদের চুলের প্রতি ভূত-পেতনির এত আকর্ষণ কেন, আমি বুঝতে পারতাম না। নারীকে কেন লম্বা চুলই রাখতে হবে, আবার ঘোমটার আড়ালেই কেন সেটা ঢেকে রাখতে হবে, তা বুঝতে পারি যখন জেন্ডার ধারণা নিয়ে পড়াশোনা করলাম।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নারীর লম্বা চুলের সৌন্দর্য পুরুষের সম্পত্তি। তাঁর নিজস্ব পুরুষই কেবল তা উপভোগ করবে। আবার এই লম্বা চুল ধরে তাঁকে মারধর করতেও সুবিধা। লম্বা চুল দিয়ে নারীকে প্রমাণ করা যায় যে তুমি নারী। তোমার বাস ঘরের ভেতর। তোমার দেহের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো চুলও তোমার নয়। তাই পুরুষ বা পুরুষতন্ত্র ঠিক করবে তোমার চুল কখন খোলা ও ঢেকে রাখবে। কতটা লম্বা বা
ছেঁটে ফেলবে!
ছোটবেলায় গ্রামের দিদিমা-ঠাকুরমাদের দেখেছি, তাঁদের চুল পুরুষের মতো ছাঁটা। নারীর লম্বা চুল দেখে অভ্যস্ত আমাদের চোখে ছাঁটা চুলের বুড়ি ঠাকুরমাদের বিচ্ছিরি লাগত। বঙ্কিম-শরৎবাবুদের সাহিত্যে জেনেছি, অল্পবয়সী বিধবাদের চুল কেটে ন্যাড়া করে রাখা হতো, যাতে করে তাঁদের দেখতে বদখত লাগে। সে-ও ওই পুরুষদের সিডিউস হওয়ার ভয়েই তো। সুন্দরী তরুণী বিধবাদের রূপে মুগ্ধ পুরুষ বিপথগামী হবে! তাতে আবার জাতকুল যাবে কুলটা নারীর বংশের। তাই জাতকুল বাঁচাতে নারীকেই করো ন্যাড়া। তাঁকে আটকে রাখো নানা বিধিনিষেধের দড়ি দিয়ে। কিন্তু অন্ধ বধির পুরুষতন্ত্র এটা ভাবতেই পারে না যে ‘আমার হাত বান্ধিবি, পাও বান্ধিবি, মন বান্ধিবি কেমনে?’
মন কখনো বাঁধা যায়নি। তাই ৪৩ বছর ধরে হাত-পা বাঁধা ইরানি নারীদের মনকে, তাদের চেতনাকে অবরুদ্ধ করে রাখতে পারেনি সে দেশের মৌলবাদী সরকার ও তার আইন। মেয়েরা বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়। শৃঙ্খল ভাঙার জন্য তারা আত্মাহুতি দিয়েই চলেছে। তাদের এই আন্দোলনে আজ শুধু তরুণীরা নয়, যুক্ত হচ্ছে তাদের বাবা-মা, ভাই, বন্ধু, প্রেমিক এবং বিপুলসংখ্যক পুরুষ, যাদের মধ্যে আছে অনেক তরুণ এবং কিশোরও। অথচ ইরানের নারী আন্দোলনবিষয়ক একটা ফেসবুক পেজে দেখলাম, আমাদের দেশের অসংখ্য তরুণ তাদের মন্তব্যে ইরান সরকারেরই পক্ষ নিচ্ছে। নিঃসন্দেহে তারা সেসব তরুণের গোষ্ঠী, যারা কিছুদিন আগে মেয়েদের বস্তাবন্দী করার দাবিতে মানববন্ধন করেছিল।
নারীর রূপ, নারীর চুলের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হতেই পারে পুরুষ। সেই মুগ্ধতা মানবিক। কিন্তু কেবল পুরুষই কি নারীর চুল দেখে মুগ্ধ হয়? পুরুষের এত যে বাহারি কেশবিন্যাস, এর উদ্দেশ্য কি নারীকে মুগ্ধ করার জন্য নয়? এই মুগ্ধতার মাঝে কোনো পাপ নেই। এই সৌন্দর্য চেতনা মানুষের চিরন্তন। এখন মুগ্ধতা আর উত্তেজনাকে যদি কেউ গুলিয়ে ফেলে—তার দায় নারীকে কেন নিতে হবে?
মানুষ তখনই মানুষ হয়, যখন সে তার কামনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যারা সেটা পারে না, তারা তো মানুষ নয়। পশুর চেয়েও অধম। কারণ, পশুদেরও একটা সহজাত নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আছে। সে ক্ষুধা না থাকলে খায় না। সে সারাক্ষণ জৈবিক তাড়নায় উন্মাদ থাকে না।
যেসব পুরুষ নারীর মুখ-চুল দেখলেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তারা তো অহর্নিশ মননে-মগজে-শরীরে যৌন বাসনা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাদের তো মানুষের সঙ্গে বসবাস করার যোগ্যতাই নেই। সমাজকে নিষ্কলুষ রাখতে তাদের বনে-জঙ্গলে রেখে আসার পরিবর্তে নারীকেই বস্তাবন্দী করা বর্বরতা নয় কী? ইরানের নারীরা সেই বর্বরতার বিরুদ্ধে আন্দোলনের আগুন জ্বালিয়েছেন। সেই আগুনে প্রতিদিন তাঁরা আত্মাহুতি দিচ্ছেন। ইরানের আন্দোলনের এ আগুন ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বময়।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
পর্দার নায়িকারা নিজেদের বয়স আড়ালে রাখা পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আজমেরী হক বাঁধন। প্রতিবছর নিজের জন্মদিনে জানান দেন তাঁর বয়স। গতকাল ছিল বাঁধনের ৪১তম জন্মদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই জানালেন এই তথ্য।
২ দিন আগে১০ বছরের বেশি সময় ধরে শোবিজে কাজ করছেন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। নাটকের পাশাপাশি ওটিটিতে দেখা গেছে তাঁকে। সরকারি অনুদানের ‘দেবী’ নামের একটি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। প্রশংসিত হলেও সিনেমায় আর দেখা মেলেনি তাঁর। ছোট পর্দাতেও অনেক দিন ধরে অনিয়মিত তিনি। এবার শবনম ফারিয়া হাজির হচ্ছেন নতুন পরিচয়ে। কমেডি রিয়েলিটি
২ দিন আগেআমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য যাত্রাপালা। গণমানুষের সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত এই যাত্রাপালা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করছে ‘যাত্রা উৎসব-২০২৪’। আগামী ১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে শুরু হবে ৭ দিনব্যাপী এই উৎসব।
২ দিন আগে‘বঙ্গবন্ধু’ পদবি বিলীন হবে না। হতে পারে না। যেমনটি ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশের পদবি বিলীন হয়নি। ইতিহাসে এসব পদবি অম্লান ও অক্ষয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ। আপনজনকে তো অবশ্যই, শত্রুপক্ষের লোকেরাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপদের
২ দিন আগে