একাত্তরের ১ মার্চ ইয়াহিয়ার ফাঁদে পা দেননি বঙ্গবন্ধু

মমতাজউদ্দিন পাটোয়ারি
প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২৪, ০৮: ৫৩

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে মার্চ মাস অসংখ্য অগ্নিঝরা ঘটনাপ্রবাহে স্মরণীয় হয়ে আছে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ১ তারিখে পাকিস্তানের সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবে এক বেতার ভাষণে তাঁরই পূর্বঘোষিত ৩ মার্চের গণপরিষদ অধিবেশন স্থগিত করেন। অধিবেশন স্থগিত করার কারণ হিসেবে ভাষণে ইয়াহিয়া উল্লেখ করেছিলেন যে, পাকিস্তানের একটি প্রধান দল পিপলস পার্টি ও অন্য কয়েকটি দল ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইয়াহিয়ার ঘোষণা বেতারে প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই গোটা পূর্ববাংলা যেন প্রতিবাদে ফেটে পড়ে।

এমন দৃশ্য কেউ আগে দেখেনি, ভাবতেও পারেনি। রাস্তায় মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্লোগান দিতে দিতে নেমে আসে। ঢাকা স্টেডিয়ামে বিসিসিপি ও আন্তর্জাতিক একাদশের মধ্যে অনুষ্ঠানরত ক্রিকেট ম্যাচ ভন্ডুল হয়ে যায়। দর্শক স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে মিছিলে শরিক হন এবং স্লোগানে অংশ নেন।স্লোগান ছিল—‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘ছয় দফা নয় এক দফা, এক দফা, এক দফা’ ইত্যাদি। অধিবেশন স্থগিত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ঢাকায় বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা বিমানবন্দর এবং পিআইএর মতিঝিল অফিসের কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অফিস ছেড়ে চলে যান।

বিমানবন্দর থেকে বিভিন্ন রুটে ও আন্তদেশীয় রুটে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অধিকাংশ মিছিল স্লোগান দিতে দিতে মতিঝিলের হোটেল পূর্বাণীর দিকে যেতে থাকে। সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন। ৩ তারিখের অধিবেশনে ছয় দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করছিলেন। ঠিক সেই সময় ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণের কথা ছড়িয়ে পড়লে হোটেল পূর্বাণীতে সাংবাদিক এবং উপস্থিত জনতার উদ্দেশে দেওয়া এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার কঠোর প্রতিবাদ জানান। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঘোষিত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তিনি ২ মার্চ ঢাকা শহরে, ৩ মার্চ সারা বাংলায় হরতাল পালন এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভার ঘোষণা দেন। ৭ মার্চের জনসভায় বঙ্গবন্ধু সর্বাত্মক আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ কর্মপন্থা ঘোষণা করবেন বলে জানান।

নানা ঘটনায় বাঙালি পাকিস্তানের প্রতি চরম বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানের প্রতি একসময় যেটুকু বিশ্বাস অবশিষ্ট ছিল, তা-ও তখন পরিত্যাজ্য হয়ে যায়। কারণ পাকিস্তান রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং এর শাসক অধিকাংশ রাজনীতিক পূর্ব বাংলাকে কতখানি অবজ্ঞা-অবহেলা করছিল, তা মানুষকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী অবিসংবাদিত নেতারূপে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ষড়যন্ত্রের বিষয়টি মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। নানা অজুহাত আর তালবাহানা একের পর এক ঘটাতে থাকে পাকিস্তানের সামরিক শাসক এবং পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো ও মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।

৩ মার্চ তারিখে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার তালবাহানা করেছিলেন পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। ঢাকায় অনুষ্ঠিত অধিবেশনে যোগদান করলে নাকি তাঁদের হত্যা করা হবে এমন হুমকিও ভুট্টোর পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল।

ইয়াহিয়ার ঘোষিত সিদ্ধান্তের কথা শুনে বঙ্গবন্ধু উত্তেজিত হয়ে যদি কোনো হঠকারী কর্মসূচি ঘোষণা করতেন, তাহলে পাকিস্তান সরকার সেনাবাহিনী নামিয়ে তখনই সবকিছু গুঁড়িয়ে দিতে দেরি করত না। ইয়াহিয়া ও জুলফিকার আলী ভুট্টো এমন সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে রেখেছিলেন। ২২ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে অপারেশন সার্চলাইট নামে এক গণহত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলিকে অপারেশনের মূল পরিকল্পনা তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল এস এম আহসানকে পরিবর্তন করে লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও জিওসি করে পাঠানো হয়। সেই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু যদি জনগণের স্লোগান অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতেন, তাহলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী স্বাধীনতাকামী মানুষের ওপর ট্যাংক, বিমানসহ ঝাঁপিয়ে পড়ত। পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল দেশগুলো সেটিকেই সমর্থন করত। সে ক্ষেত্রে স্বাধীনতার প্রতি পূর্ব বাংলার জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি অঙ্কুরেই ধ্বংস করে দেওয়া হতো।

বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র ও রাজনীতির একজন অভিজ্ঞ পোড় খাওয়া নেতা হওয়ায় বুঝতে পেরেছিলেন যে ইয়াহিয়া, ভুট্টো কিংবা কাইয়ুম খানদের ফাঁদে পা দেওয়া ঠিক হবে না। স্বাধীনতার যে আকাঙ্ক্ষা মানুষ ব্যক্ত করেছে সেটিকে আরও প্রস্ফুটিত করার সময় নিতে বঙ্গবন্ধু ভুল করেননি। তিনি ২ মার্চ ঢাকায় হরতাল আহ্বান করে দেখতে চাইলেন জনগণ কীভাবে সাড়া দেয়। ২ মার্চ ঢাকায় অভূতপূর্ব হরতাল পালিত হলো। জনগণ রাস্তায় নেমে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকল। সমস্ত অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট বন্ধ ছিল। পরদিন ৩ মার্চ আহূত হরতালও একইভাবে ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করেছিল। ওই দিন ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ আয়োজিত পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে অসহযোগের ডাক দেন। তিনি জনগণকে সর্বাত্মক সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে আহ্বান জানান।

সেই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ডাকসুসহ সাধারণ ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক-কর্মচারীগণও বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত একটি পতাকাও উত্তোলন করা হয়। সারা দেশে ছাত্র-তরুণ, কৃষক-শ্রমিক, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ শুধু হরতালই পালন করেনি, সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকারের বাঙালিবিরোধী মানসিকতার তীব্র সমালোচনা করেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার আহ্বান জানান। পরদিন থেকে অসহযোগ আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। চারদিকে স্বাধীনতার আওয়াজ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। সমগ্র পূর্ব বাংলা তখন মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকে। ঘরে ঘরে তখন আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল পাকিস্তানিদের অন্য়ায়-অবিচার এবং বাঙালিদের অধিকার হরণের বিষয়াদি। কিশোর থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত নারী-পুরুষ সবাই পাকিস্তানের সঙ্গে আর থাকা যাবে না—এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে দিল।

স্বাধীনতার প্রশ্নে জাতীয় মহাঐক্য কতটা শাণিত হয়েছিল, তা ৭ তারিখের রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুসহ সব জাতীয় নেতৃবৃন্দ এবং আন্তর্জাতিক সব মহলই দেখতে পেয়েছিল। রেসকোর্স ময়দান ইতিপূর্বে কখনো এত বিশাল জনসমুদ্র দেখেনি। জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ইতিহাস গড়ার যে ভাষণটি প্রদান করেছিলেন, তার প্রতিটি শব্দ ও বাক্য পূর্ব বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের মন ও প্রাণকে স্বাধীনতার এক সুতায় বেঁধে ফেলেছিল। সেই ভাষণেই উচ্চারিত হলো—‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। উপস্থিত শ্রোতারা করতালির মাধ্যমে তা সমর্থন করলেন। বঙ্গবন্ধু বলতে ভুলে গেলেন না ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার, হুকুম দেওয়ার সুযোগ না পেলে সবাইকে অস্ত্র হাতে শত্রুর মোকাবিলা করার। বঙ্গবন্ধুর এই কালজয়ী ভাষণ পূর্ব বাংলার প্রত্যেক মানুষের আকাঙ্ক্ষারই প্রতিধ্বনি ছিল। সে কারণেই ২৫ মার্চ পাকিস্তানিরা অপারেশন সার্চলাইট নামিয়ে গণহত্যা শুরু করলে নিরস্ত্র বাঙালি এবং অন্যান্য নৃ জাতি-গোষ্ঠী পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ায়। সেখান থেকেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার অমর বাণীটি সর্বত্র উচ্চারিত হতে থাকে, প্রস্তুতি নিতে থাকে সবাই যার যার মতো। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আর কোনো বিকল্প ছিল না।

৯ মাস যুদ্ধ শেষে বিজয়ী জনগণ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতার পতাকা নিয়েই ১৬ ডিসেম্বর ঘরে ফিরেছেন। ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুও জনগণের মধ্যে ফিরে আসেন।

১ মার্চ ইয়াহিয়া খান হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্রের লালিত স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়ার ফাঁদে পা দেননি। তিনি স্বাধীনতার মহাসড়কে জাতিকে তুলে দিলেন। ১ মার্চ তাই আমাদের জাতীয় ইতিহাস বিনির্মাণের মাইলস্টোন, গোটা জাতিকে স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষায় একত্র করার দিকনির্দেশনা বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন।

লেখক: অধ্যাপক ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ধর্ম অবমাননা: একই স্ট্যাটাসের জন্য দ্বিতীয়বার অভিযুক্ত হৃদয়

আমিরাতে অবৈধদের সাধারণ ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ আর মাত্র দুদিন

৫ আগস্ট সশস্ত্র সংগ্রামের ভিডিও বার্তা দিয়ে রেখেছিলাম: উপদেষ্টা নাহিদ

ইসরায়েলের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে ইরানের সামরিক বাজেট তিনগুণ

রাজধানীতে চাঁদা আদায়ের প্রতিবাদ করায় লেগুনা চালককে ছুরিকাঘাতে হত্যা

আরও
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত