ফারুক মেহেদী
প্রধানমন্ত্রী এ জন্যই বারবার সতর্ক করছেন যে সবাই যেন ধান-চাল, শাকসবজি উৎপাদনে মনোযোগী হয়। এক ইঞ্চি জমিও যেন খালি পড়ে না থাকে। সবাই যদি নিজ নিজ খালি জায়গায় ধান-চাল, শাকসবজি, ফলমূলের আবাদ করে, তাহলে আমদানিনির্ভরতা কমবে।
দুর্ভিক্ষ আসছে! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে উদ্বেগের সঙ্গেই এ রকম কথা বলছেন। তিনি সম্প্রতি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করে এসেছেন। ভ্রমণের সময় বিশ্বের বহু নেতা ও রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরাই নাকি তাঁকে আসছে ২০২৩ সালে মন্দা ও দুর্ভিক্ষের আভাস দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এডিবি, আঙ্কটাডসহ বিশ্বখ্যাত গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও দাতাসংস্থাগুলোর পূর্বাভাস তুলে ধরেও খাদ্যসংকট ও দুর্ভিক্ষের শঙ্কার কথা বলছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন বারবার একই রকম সতর্কতামূলক বার্তা দিচ্ছেন? তাঁর বক্তব্য কতটা উদ্বেগের? আসলেই কি দুর্ভিক্ষ আসছে? খাদ্যসংকট কতটা তীব্র হবে? বিশ্বমন্দা হলে বা খাদ্যসংকট হলে তা বাংলাদেশকেই বা কতটা ভোগাবে? এসব প্রশ্নের জবাব কী?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য এবং উদ্বেগের বিষয়টি একটু অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে যে আসলেই বাংলাদেশ কতটা ঝুঁকিতে রয়েছে। আদৌ ঝুঁকি আছে কি না? আমার মনে হয়, তিনি বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যপণ্যের ঘাটতি, জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি, অস্বাভাবিকভাবে ডলারের দর বাড়ার ফলে দেশে যে টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এটা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছেন; এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে এর প্রভাব কেমন হতে পারে, তারও একটা হোমওয়ার্ক করেছেন।
তারই আলোকে তিনি বারবার মানুষকে সতর্ক করছেন এবং সময় থাকতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছেন। আমি মনে করি, এটা খুবই ইতিবাচক যে প্রধানমন্ত্রী এটা নিয়ে আগেভাগেই ভেবেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব সংকটের আভাসের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা আগাম সতর্ক হতে দেখেছি। সবশেষ যদি কোভিড-১৯ আঘাত করার সময়টাতে ফিরে যাই আমরা দেখব, কোভিডের আঘাতের ফলে অর্থনীতি যাতে বসে না যায়, সে জন্য তিনি ত্বরিত পদক্ষেপ নিয়ে কয়েক লাখ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেন। তৈরি পোশাক রপ্তানিসহ শিল্পোৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয়, কৃষি উৎপাদন যাতে স্বাভাবিক থাকে, সে জন্য বেশ কিছু সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ফলে আমরা দেখেছি, কোভিডের কারণে সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও বাংলাদেশ ততটা আক্রান্ত হয়নি। ফসল উৎপাদন স্বাভাবিক থাকায় খাদ্যসংকট হয়নি।
তবে করোনা কিছুটা সহনীয় হয়ে আসার পর বিশ্বব্যাপী পণ্য সরবরাহব্যবস্থায় ব্যাপক টান পড়ে। দেশে দেশে চাহিদা বাড়তে থাকায় পণ্য পরিবহনের খরচ বাড়ে। এতে পণ্য উৎপাদন ও বিপণনব্যবস্থা ব্যয়বহুল হতে থাকে। এতে আকস্মিকই ঘি ঢালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় বিশ্বব্যাপী এর নেতিবাচক ধাক্কা লাগে। বাংলাদেশও এর নিরপরাধ শিকারে পরিণত হয়। মাত্র ১৩ মাসে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উঠে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে আসে ৩৬ বিলিয়ন ডলারে। এটা ক্রমেই কমছে। বলা যায় পুরো ঝুঁকিতে রিজার্ভ।
ডলার আয়ের সবচেয়ে বড় খাত রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। গত মাসে দুটোই কমেছে। কমার ধারা বন্ধ হচ্ছে না; বরং বেগবান হচ্ছে দিন দিন। কারণ, নানান কড়াকড়িতে আমদানির পরিমাণ কমিয়ে আনা গেলেও বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে দায় শোধের হার বেড়েছে। এর সঙ্গে ডলারের দরও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়তে থাকায় কম আমদানি করেও বেশি ডলার খরচ করতে হচ্ছে।
এখন ইউরোপ-আমেরিকায় মন্দার আঁচ লাগতে শুরু করেছে। রেকর্ড মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে। মূল্যস্ফীতির পারদ নামাতে দেশে দেশে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নীতি সুদহার বাড়িয়ে চলেছে। এতে ঋণ ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে, বাজারে মুদ্রাপ্রবাহ কমে যাচ্ছে। এর প্রভাবে প্রবৃদ্ধি কমে আসছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এরই মধ্যে নীতি সুদ বাড়তে থাকায়, সামনে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পূর্বাভাস জানিয়ে দিয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির গতি স্থবির হলে, মন্দা গভীর হলে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতিই বেশি আক্রান্ত হবে। এর প্রভাবে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ওপরে ধাক্কা আসবে। দেশগুলোর অর্থনৈতিক স্থবিরতায় বাংলাদেশের প্রবাসীদের আয় কমবে, অনেকে মজুরি হারাবে। ফলে তা রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সব মিলিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ আরও সংকুচিত হবে। তখন রিজার্ভ তো বাড়বেই না; বরং আরও কমবে।
একদিকে রিজার্ভে টান পড়বে, অন্যদিকে বিশ্ববাজার থেকে বেশি ডলার খরচ করে জ্বালানি তেলসহ খাদ্যপণ্য আমদানি করতে গেলে, এর দায় শোধ করতে গিয়ে রিজার্ভ আরও নাজুক পরিস্থিতির দিকে যেতে পারে। তখন রপ্তানি কমলে, প্রবাসী আয় ঠিকমতো না এলে, শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হলে, সেবা খাতে স্থবিরতা দেখা দিলে, বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হলে—এর পুরো আঘাত পড়বে মানুষের আয় ও কর্মসংস্থানে। এমনিতেই সীমিত আয়ের মানুষ উচ্চমূল্যস্ফীতির চড়া মাশুল গুনতে গুনতে বিপন্নপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। নতুন করে মন্দা আর দুর্ভিক্ষের প্রভাব পড়লে, তখন সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা কেমন জটিল আকার ধারণ করবে, এটা সহজেই অনুমেয়।
বিশ্ববাজার থেকে বেশি দাম দিয়ে খাদ্যদ্রব্য আমদানি করে রিজার্ভ যাতে আরও নাজুক পরিস্থিতির দিকে না যায়, অর্থনীতি যাতে সচল থাকে, কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের গতিধারা যাতে স্বাভাবিক থাকে, এরই মধ্যে নেওয়া বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণ যাতে যথাসময়ে মজুত ডলার দিয়ে পরিশোধ করা যায়—এসব কারণেই প্রধানমন্ত্রী সতর্কতামূলক বার্তা জারি রেখেছেন। দুর্ভিক্ষ আর মন্দার ধাক্কা এলেও যাতে করোনা মোকাবিলার মতো তা সামলে ওঠা যায়, এ জন্যই তিনি সবাইকে খরচ কমানো, খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো এবং সঞ্চয়ী হওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন।
সার্বিকভাবে বাংলাদেশ ধান, সবজি, মাছ, মাংস, খাদ্য উৎপাদনে বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে–এটা আমরা জানি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ধানের কাঙ্ক্ষিত ফলন হয়নি। শুল্ক কমিয়েও চাল আমদানি করা যাচ্ছে না। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বোরোতে ১৩ লাখ ও আউশে সাড়ে ৬ লাখ টন কম উৎপাদন হয়েছে এবং আমনে প্রায় ১০ লাখ টন উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে, সাড়ে ৬ লাখ টন বোরো ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও সংগ্রহ করা গেছে পৌনে ৩ লাখ টনের মতো। তার মানে ধান-চালের উৎপাদন ও মজুত পরিস্থিতি খুব স্বস্তিদায়ক অবস্থায় নেই। এরই মধ্যে সরকার নিজেও কয়েক লাখ টন চাল আমদানির কার্যাদেশ দিয়েছে। বেসরকারি খাতেও এরই মধ্যে ১০ লাখ টন আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। অথচ সবশেষ ১ লাখ টনের মতো আমদানি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী এ জন্যই বারবার সতর্ক করছেন যে সবাই যেন ধান-চাল, শাকসবজি উৎপাদনে মনোযোগী হয়। এক ইঞ্চি জমিও যেন খালি পড়ে না থাকে। সবাই যদি নিজ নিজ খালি জায়গায় ধান-চাল, শাকসবজি, ফলমূলের আবাদ করে, তাহলে আমদানিনির্ভরতা কমবে। মানুষ নিজের চাহিদা নিজের উৎপাদিত ফসল দিয়েই পূরণ করতে পারবে।
ফলে আমদানির দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। এতে দুটি লাভ হবে। প্রথমত, বেশি দাম দিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করে ডলার খরচ করতে হবে না। অন্যদিকে, আমদানি কমে যাওয়ার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখা যাবে; যা দিয়ে জ্বালানি তেল, অপরিহার্য শিল্পের কাঁচামালসহ আপৎকালীন জরুরি আমদানি দায় এবং বিদেশি ঋণের কিস্তি শোধ করা যাবে।
এরই মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ও ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়িয়ে এর আমদানি অর্ধেক কমিয়ে আনতে চায়। এতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমবে। এরই মধ্যে পেঁয়াজের স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানোর ফলে আমদানিনির্ভরতা কমেছে। মাছের উৎপাদন সন্তোষজনক।
শাকসবজি, পোলট্রি, দেশি ফলমূলও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উৎপাদন হচ্ছে। এটাকে বেগবান করলে এ খাতে স্বয়ম্ভরতা আসবে, তাতে আমদানিতে খরচের প্রয়োজন হবে না।
সুতরাং, বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিশ্বখ্যাত গবেষণা সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস আমলে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে মন্দা ও দুর্ভিক্ষের আভাস দিয়েছেন, আমি মনে করি এটা যথার্থ।
এখন দরকার প্রধানমন্ত্রীর সতর্কতামূলক বার্তাটি গ্রহণ করে আগাম প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া; বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও বিশ্বখ্যাত গবেষণা সংস্থাগুলোর পূর্বাভাসের আলোকে সরকারের দপ্তরগুলোর এখনই হোমওয়ার্ক করা দরকার। কীভাবে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো ও আমদানিনির্ভরতা কমানো যায়, তার কার্যকর প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রয়োজনে কৃষককে সার ও কৃষি উপকরণে ভর্তুকি দেওয়া, কৃষিঋণ সহজ করা, প্রযুক্তি সহায়তা দেওয়া, এসএমই শিল্পকে আরও সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া, ব্যবসা ও শিল্প খাত যাতে বসে না যায়, অর্থনীতিতে চাহিদা ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা, মানুষের আয় যাতে সংকুচিত না হয়, সে জন্য বেসরকারি খাতকে চাঙা রাখার কর্মসূচি নেওয়া, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড গতিশীল করে কাজের ক্ষেত্র উন্মুক্ত রাখা, অভ্যন্তরীণ ব্যয় মেটাতে সরকারের আয় বাড়ানোর পথ সুগম করা, বিশেষ করে কর ফাঁকি কমিয়ে, সক্ষম করদাতাদের করজালের মধ্যে এনে রাজস্ব আয় বেগবান করাসহ মোটাদাগে অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে যা যা করণীয়, এখনই এসবের রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে।
না হলে প্রধানমন্ত্রীর সতর্কবার্তার সুফল মিলবে না। পরিণামে সবাইকে সামনে বিশ্বমন্দা ও দুর্ভিক্ষের জন্য চড়া মূল্য দিতে হতে পারে।
লেখক: ফারুক মেহেদী, উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
প্রধানমন্ত্রী এ জন্যই বারবার সতর্ক করছেন যে সবাই যেন ধান-চাল, শাকসবজি উৎপাদনে মনোযোগী হয়। এক ইঞ্চি জমিও যেন খালি পড়ে না থাকে। সবাই যদি নিজ নিজ খালি জায়গায় ধান-চাল, শাকসবজি, ফলমূলের আবাদ করে, তাহলে আমদানিনির্ভরতা কমবে।
দুর্ভিক্ষ আসছে! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে উদ্বেগের সঙ্গেই এ রকম কথা বলছেন। তিনি সম্প্রতি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করে এসেছেন। ভ্রমণের সময় বিশ্বের বহু নেতা ও রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরাই নাকি তাঁকে আসছে ২০২৩ সালে মন্দা ও দুর্ভিক্ষের আভাস দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এডিবি, আঙ্কটাডসহ বিশ্বখ্যাত গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও দাতাসংস্থাগুলোর পূর্বাভাস তুলে ধরেও খাদ্যসংকট ও দুর্ভিক্ষের শঙ্কার কথা বলছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন বারবার একই রকম সতর্কতামূলক বার্তা দিচ্ছেন? তাঁর বক্তব্য কতটা উদ্বেগের? আসলেই কি দুর্ভিক্ষ আসছে? খাদ্যসংকট কতটা তীব্র হবে? বিশ্বমন্দা হলে বা খাদ্যসংকট হলে তা বাংলাদেশকেই বা কতটা ভোগাবে? এসব প্রশ্নের জবাব কী?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য এবং উদ্বেগের বিষয়টি একটু অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে যে আসলেই বাংলাদেশ কতটা ঝুঁকিতে রয়েছে। আদৌ ঝুঁকি আছে কি না? আমার মনে হয়, তিনি বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যপণ্যের ঘাটতি, জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি, অস্বাভাবিকভাবে ডলারের দর বাড়ার ফলে দেশে যে টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এটা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছেন; এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে এর প্রভাব কেমন হতে পারে, তারও একটা হোমওয়ার্ক করেছেন।
তারই আলোকে তিনি বারবার মানুষকে সতর্ক করছেন এবং সময় থাকতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছেন। আমি মনে করি, এটা খুবই ইতিবাচক যে প্রধানমন্ত্রী এটা নিয়ে আগেভাগেই ভেবেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব সংকটের আভাসের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা আগাম সতর্ক হতে দেখেছি। সবশেষ যদি কোভিড-১৯ আঘাত করার সময়টাতে ফিরে যাই আমরা দেখব, কোভিডের আঘাতের ফলে অর্থনীতি যাতে বসে না যায়, সে জন্য তিনি ত্বরিত পদক্ষেপ নিয়ে কয়েক লাখ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেন। তৈরি পোশাক রপ্তানিসহ শিল্পোৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয়, কৃষি উৎপাদন যাতে স্বাভাবিক থাকে, সে জন্য বেশ কিছু সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ফলে আমরা দেখেছি, কোভিডের কারণে সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও বাংলাদেশ ততটা আক্রান্ত হয়নি। ফসল উৎপাদন স্বাভাবিক থাকায় খাদ্যসংকট হয়নি।
তবে করোনা কিছুটা সহনীয় হয়ে আসার পর বিশ্বব্যাপী পণ্য সরবরাহব্যবস্থায় ব্যাপক টান পড়ে। দেশে দেশে চাহিদা বাড়তে থাকায় পণ্য পরিবহনের খরচ বাড়ে। এতে পণ্য উৎপাদন ও বিপণনব্যবস্থা ব্যয়বহুল হতে থাকে। এতে আকস্মিকই ঘি ঢালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় বিশ্বব্যাপী এর নেতিবাচক ধাক্কা লাগে। বাংলাদেশও এর নিরপরাধ শিকারে পরিণত হয়। মাত্র ১৩ মাসে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উঠে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে আসে ৩৬ বিলিয়ন ডলারে। এটা ক্রমেই কমছে। বলা যায় পুরো ঝুঁকিতে রিজার্ভ।
ডলার আয়ের সবচেয়ে বড় খাত রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। গত মাসে দুটোই কমেছে। কমার ধারা বন্ধ হচ্ছে না; বরং বেগবান হচ্ছে দিন দিন। কারণ, নানান কড়াকড়িতে আমদানির পরিমাণ কমিয়ে আনা গেলেও বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে দায় শোধের হার বেড়েছে। এর সঙ্গে ডলারের দরও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়তে থাকায় কম আমদানি করেও বেশি ডলার খরচ করতে হচ্ছে।
এখন ইউরোপ-আমেরিকায় মন্দার আঁচ লাগতে শুরু করেছে। রেকর্ড মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে। মূল্যস্ফীতির পারদ নামাতে দেশে দেশে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নীতি সুদহার বাড়িয়ে চলেছে। এতে ঋণ ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে, বাজারে মুদ্রাপ্রবাহ কমে যাচ্ছে। এর প্রভাবে প্রবৃদ্ধি কমে আসছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এরই মধ্যে নীতি সুদ বাড়তে থাকায়, সামনে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পূর্বাভাস জানিয়ে দিয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির গতি স্থবির হলে, মন্দা গভীর হলে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতিই বেশি আক্রান্ত হবে। এর প্রভাবে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ওপরে ধাক্কা আসবে। দেশগুলোর অর্থনৈতিক স্থবিরতায় বাংলাদেশের প্রবাসীদের আয় কমবে, অনেকে মজুরি হারাবে। ফলে তা রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সব মিলিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ আরও সংকুচিত হবে। তখন রিজার্ভ তো বাড়বেই না; বরং আরও কমবে।
একদিকে রিজার্ভে টান পড়বে, অন্যদিকে বিশ্ববাজার থেকে বেশি ডলার খরচ করে জ্বালানি তেলসহ খাদ্যপণ্য আমদানি করতে গেলে, এর দায় শোধ করতে গিয়ে রিজার্ভ আরও নাজুক পরিস্থিতির দিকে যেতে পারে। তখন রপ্তানি কমলে, প্রবাসী আয় ঠিকমতো না এলে, শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হলে, সেবা খাতে স্থবিরতা দেখা দিলে, বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হলে—এর পুরো আঘাত পড়বে মানুষের আয় ও কর্মসংস্থানে। এমনিতেই সীমিত আয়ের মানুষ উচ্চমূল্যস্ফীতির চড়া মাশুল গুনতে গুনতে বিপন্নপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। নতুন করে মন্দা আর দুর্ভিক্ষের প্রভাব পড়লে, তখন সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা কেমন জটিল আকার ধারণ করবে, এটা সহজেই অনুমেয়।
বিশ্ববাজার থেকে বেশি দাম দিয়ে খাদ্যদ্রব্য আমদানি করে রিজার্ভ যাতে আরও নাজুক পরিস্থিতির দিকে না যায়, অর্থনীতি যাতে সচল থাকে, কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের গতিধারা যাতে স্বাভাবিক থাকে, এরই মধ্যে নেওয়া বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণ যাতে যথাসময়ে মজুত ডলার দিয়ে পরিশোধ করা যায়—এসব কারণেই প্রধানমন্ত্রী সতর্কতামূলক বার্তা জারি রেখেছেন। দুর্ভিক্ষ আর মন্দার ধাক্কা এলেও যাতে করোনা মোকাবিলার মতো তা সামলে ওঠা যায়, এ জন্যই তিনি সবাইকে খরচ কমানো, খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো এবং সঞ্চয়ী হওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন।
সার্বিকভাবে বাংলাদেশ ধান, সবজি, মাছ, মাংস, খাদ্য উৎপাদনে বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে–এটা আমরা জানি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ধানের কাঙ্ক্ষিত ফলন হয়নি। শুল্ক কমিয়েও চাল আমদানি করা যাচ্ছে না। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বোরোতে ১৩ লাখ ও আউশে সাড়ে ৬ লাখ টন কম উৎপাদন হয়েছে এবং আমনে প্রায় ১০ লাখ টন উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে, সাড়ে ৬ লাখ টন বোরো ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও সংগ্রহ করা গেছে পৌনে ৩ লাখ টনের মতো। তার মানে ধান-চালের উৎপাদন ও মজুত পরিস্থিতি খুব স্বস্তিদায়ক অবস্থায় নেই। এরই মধ্যে সরকার নিজেও কয়েক লাখ টন চাল আমদানির কার্যাদেশ দিয়েছে। বেসরকারি খাতেও এরই মধ্যে ১০ লাখ টন আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। অথচ সবশেষ ১ লাখ টনের মতো আমদানি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী এ জন্যই বারবার সতর্ক করছেন যে সবাই যেন ধান-চাল, শাকসবজি উৎপাদনে মনোযোগী হয়। এক ইঞ্চি জমিও যেন খালি পড়ে না থাকে। সবাই যদি নিজ নিজ খালি জায়গায় ধান-চাল, শাকসবজি, ফলমূলের আবাদ করে, তাহলে আমদানিনির্ভরতা কমবে। মানুষ নিজের চাহিদা নিজের উৎপাদিত ফসল দিয়েই পূরণ করতে পারবে।
ফলে আমদানির দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। এতে দুটি লাভ হবে। প্রথমত, বেশি দাম দিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করে ডলার খরচ করতে হবে না। অন্যদিকে, আমদানি কমে যাওয়ার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখা যাবে; যা দিয়ে জ্বালানি তেল, অপরিহার্য শিল্পের কাঁচামালসহ আপৎকালীন জরুরি আমদানি দায় এবং বিদেশি ঋণের কিস্তি শোধ করা যাবে।
এরই মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ও ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়িয়ে এর আমদানি অর্ধেক কমিয়ে আনতে চায়। এতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমবে। এরই মধ্যে পেঁয়াজের স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানোর ফলে আমদানিনির্ভরতা কমেছে। মাছের উৎপাদন সন্তোষজনক।
শাকসবজি, পোলট্রি, দেশি ফলমূলও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উৎপাদন হচ্ছে। এটাকে বেগবান করলে এ খাতে স্বয়ম্ভরতা আসবে, তাতে আমদানিতে খরচের প্রয়োজন হবে না।
সুতরাং, বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিশ্বখ্যাত গবেষণা সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস আমলে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে মন্দা ও দুর্ভিক্ষের আভাস দিয়েছেন, আমি মনে করি এটা যথার্থ।
এখন দরকার প্রধানমন্ত্রীর সতর্কতামূলক বার্তাটি গ্রহণ করে আগাম প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া; বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও বিশ্বখ্যাত গবেষণা সংস্থাগুলোর পূর্বাভাসের আলোকে সরকারের দপ্তরগুলোর এখনই হোমওয়ার্ক করা দরকার। কীভাবে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো ও আমদানিনির্ভরতা কমানো যায়, তার কার্যকর প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রয়োজনে কৃষককে সার ও কৃষি উপকরণে ভর্তুকি দেওয়া, কৃষিঋণ সহজ করা, প্রযুক্তি সহায়তা দেওয়া, এসএমই শিল্পকে আরও সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া, ব্যবসা ও শিল্প খাত যাতে বসে না যায়, অর্থনীতিতে চাহিদা ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা, মানুষের আয় যাতে সংকুচিত না হয়, সে জন্য বেসরকারি খাতকে চাঙা রাখার কর্মসূচি নেওয়া, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড গতিশীল করে কাজের ক্ষেত্র উন্মুক্ত রাখা, অভ্যন্তরীণ ব্যয় মেটাতে সরকারের আয় বাড়ানোর পথ সুগম করা, বিশেষ করে কর ফাঁকি কমিয়ে, সক্ষম করদাতাদের করজালের মধ্যে এনে রাজস্ব আয় বেগবান করাসহ মোটাদাগে অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে যা যা করণীয়, এখনই এসবের রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে।
না হলে প্রধানমন্ত্রীর সতর্কবার্তার সুফল মিলবে না। পরিণামে সবাইকে সামনে বিশ্বমন্দা ও দুর্ভিক্ষের জন্য চড়া মূল্য দিতে হতে পারে।
লেখক: ফারুক মেহেদী, উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৪ দিন আগে