জাহীদ রেজা নূর
এই তো কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক থিসিস চুরির অভিযোগে পদাবনতি পেলেন। তিনি তাঁর থিসিসের প্রায় পুরোটাই ঝেড়ে দিয়েছেন অন্যের লেখা থেকে। প্রমাণিত এই সত্য এতটাই ভয়াবহ যে পুরো শিক্ষক সমাজকেই তা লজ্জার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমাদের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড এখন যে ধীরে ধীরে পড়াশোনা ছাড়া আর সব ব্যাপারেই বিখ্যাত হয়ে উঠছে, সেটাও তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রকাশিত খবর থেকেই টের পাওয়া যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের থিসিস চুরির ঘটনা এটাই প্রথম নয়। বেশ কয়েকবার এ রকম অভিযোগ উঠেছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, অভিযোগ সত্য। এ রকম এক বিপন্ন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছেন শিক্ষকেরা।
আমি কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে তাঁদের লিখতে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু পত্রিকায় সরাসরি এ বিষয়ে লেখার ব্যাপারে হয়তো সেলফ-সেন্সরশিপ কাজ করে। কিংবা এমনও হতে পারে, কাক কাকের মাংস খায় না। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হয়তো ভয়। কোথায় কী কথা বলতে গিয়ে সামাজিকভাবে হেয় হতে হবে, ক্ষমতা বা পেশিশক্তির খপ্পরে পড়ে মান-সম্মান যাবে—সেটাও হয়তো ভেবেছেন তাঁরা। কে আর সেই ঝুঁকি নিতে চাইবে? শিক্ষকদের এই নীরবতার একটা সামাজিক কারণ আছে। সমাজ সত্যকে কতটা মূল্য দিচ্ছে, সেটাই মূল আলোচনার বিষয় হতে পারে।
দুই
আমরা এখনই বলতে শুরু করতে পারি, এই শিক্ষকের জন্য শাস্তিটা কম হয়ে গেছে। আরও বড় শাস্তি পাওয়া উচিত ছিল তাঁর। যিনি ওপরে ওঠার সিঁড়ির খোঁজ করতে গিয়ে বেছে নেন অন্ধকার শর্টকাট রাস্তা, তিনি তো শিক্ষক হওয়ারই উপযুক্ত নন। শিক্ষার্থীরা তাঁদের চোখের সামনে একজন ‘চোর’কে দেখতে পাবে। তাঁর প্রতি কি সত্যিই সম্মান রাখতে পারবে তারা? একজন ছিঁচকে চোরের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য কোথায়? শিক্ষা নিয়ে চুরির ঘটনা তো বুঝিয়ে দেয়, সমাজের জন্য ছিঁচকে চোরের চেয়ে এই চোর অনেক বেশি অপকারী।
এ কথাগুলো বলার সময় আমরা একটা দিকে খেয়াল রাখি না। আমরা যে ছবিটি হতাশ চোখে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকিয়ে দেখছি, সে ছবিটি কিন্তু এককভাবে শিক্ষকদের ছবি নয়। দৃষ্টি একটু প্রসারিত করলে দেখা যাবে, সমাজের সর্বত্রই এই ধস নেমেছে। আমাদের মূল্যবোধ, চেতনা, নৈতিকতাসহ গর্ব করার মতো বিষয়গুলো থেকে ক্রমেই আমরা সরে যাচ্ছি। যে সেক্টরের দিকেই চোখ দিই না কেন, দেখতে পাব ভাটার টানে সব ভেসে যাচ্ছে সাগরে। পাড়ে পড়ে থাকছে শুধুই আবর্জনা। তাই সাংবাদিক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, চিকিৎসক, ব্যাংকার, উদ্যোক্তা, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনীতিবিদ, সরকারি চাকরিজীবী—তালিকা বাড়ানো যাবে যেমন ইচ্ছে, সবাই সেই ধস ‘উপভোগ’ করছেন। কখনো কখনো একেকটি সেক্টরে পচা দুর্গন্ধময় সংবাদের জন্ম হলেই আমরা কেবল বুঝতে পারি, সর্বনাশের শিকড়টা কত গভীরে পোঁতা আছে।
তিন
শিক্ষকের চৌর্যবৃত্তি নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, তখন আলোচনা শুধু শিক্ষকতা পেশাতেই সীমাবদ্ধ রাখা যাক। একটু আগেই বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরেই চুরি, ঘুষ, পেশিশক্তির মর্যাদা বাড়ছে। যেহেতু বিনে পয়সায় এই কুরুচিপূর্ণ কাজগুলো করা যায় অনায়াসে, জীবন থেকে হটিয়ে দেওয়া যায় সুরুচি, মূল্যবোধ আর নৈতিকতাকে এবং তার বিনিময়ে সামাজিকভাবে ঘৃণিত হওয়ারও আশঙ্কা থাকে না, তাই ওই নষ্ট পচা গলা পথেই পা বাড়াচ্ছে মানুষ। ফলে ঘৃণিত কাজগুলোও আপগ্রেডেড হয়ে সম্মান পাচ্ছে।এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে শিক্ষকদের শিক্ষা-চুরির বিষয়টি দেখতে হবে।স্কুলশিক্ষক, কলেজশিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কেমন হবেন, কীভাবে পড়াবেন,
সেই পড়াশোনার আলো থেকে শিক্ষার্থী কীভাবে বেছে নেবে তার ভবিষ্যৎ চলার পথ, তা আমরা কমবেশি জানি। সবচেয়ে বড় কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হবেন উন্নত আদর্শের মানুষ। আমরা ৭৩-এর অধ্যাদেশের বিশদ বর্ণনা না করেও বলতে পারি, সেখানে শিক্ষকদের যে মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল, তার প্রতি সম্মান থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পিএইচডি থিসিস চুরির দিকে যেতেন না। বিষয়ের একটু গভীরে গেলেই দেখা যাবে, ছাত্রজীবন থেকে আদর্শহীনভাবে গড়ে উঠলে, কেবল নম্বরকেই শিক্ষক হওয়ার মূল বিষয় মনে করা হলে, শিক্ষক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ‘মেধাবী ছাত্র’টি সহজেই অনৈতিকতার পথ বেছে নিতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যে রিস্ট্রাকচারিং সিস্টেমটা গড়ে উঠেছে, তার মধ্যেও রয়েছে অসৎ হওয়ার মন্ত্র। ডিপার্টমেন্টে অধ্যাপক পদ নেই। পদ না থাকলেও কিছু ক্রাইটেরিয়া পূরণ করলে পদোন্নতি দিয়ে দেওয়া হয়। এই ক্রাইটেরিয়ার মধ্যে একটা হলো ডিগ্রি। ফলে যেকোনোভাবে ডিগ্রি লাভের প্রতিযোগিতায় যখন একজন শিক্ষক নামেন, তখন তিনি চুরি করছেন নাকি ডাকাতি করছেন, সেটা তাঁর মনে থাকে না। পড়ানো এবং গবেষণা তো তখন লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য হলো পদ। পদোন্নতি পাওয়া মানে জাতে ওঠা। ব্যস! সেই জাতে উঠতে গিয়েই বিনা আয়াসে প্রভাষক হন সহকারী অধ্যাপক, সহকারী হন সহযোগী, সহযোগী হন পূর্ণাঙ্গ অধ্যাপক!
চার
আচ্ছা, পিএইচডি পাওয়ার ব্যাপার যদি এমন হয়? আমি কোনো পিএইচডি ছাত্রের সুপারভাইজার। দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার দুজন শিক্ষক বন্ধু আছেন, যাদের আমি বললাম, ‘বন্ধুরা, আমার ছাত্রটা তো পিএইচডি থিসিস লিখে শেষ করেছে। যা-ই লিখে থাকুক না, তোমরা এক্সটারনাল হয়ে এসো। আমরা তিনজন মিলে ওকে এই খেয়া পার করিয়ে দিই।’ পিএইচডি থিসিসগুলো মানসম্মত হচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন করায় একজন অধ্যাপক এ চিত্রটি তুলে ধরলেন। পরিষ্কার হলো কিছু বিষয়। এটা অবশ্য সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু ঘটছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কত কথাই না শোনা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ যেন দিনে দিনে পরিহাসে পরিণত হচ্ছে। দলীয়করণ-প্রক্রিয়া এখন এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে একজন বশংবদ উপাচার্য না হলে আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চলছে না। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একজন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কয়েক দফা সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। বেশ কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন সেক্টরের শিক্ষকেরা চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে বসেন, তাঁর কথা শোনেন, তিনি পাঠদানে সক্ষম কি না, সেগুলো বিবেচনা করেন। কিন্তু আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে কী ধরনের ঘটনা ঘটে, তার প্রকাশ তো পত্রিকায় দেখা যায়। সরকারের আশীর্বাদে উপাচার্য নিয়োগ হওয়ায় সরকারের প্রতি তো একটা দায় থাকে তাঁর। সেই দায় পূরণ করতে গিয়ে এবং দলবাজির চাপে পড়ে আমাদের উপাচার্যরা শিক্ষার পরিবেশ কতটা রক্ষা করতে পারেন, সে তো সাদা চোখেই দেখা যাচ্ছে।
পাঁচ
শিক্ষকদের রাজনীতিপ্রীতি এই অধঃপতনের একটা বড় কারণ। কোনো মানুষই রাজনীতির বাইরে নয়। কিন্তু শিক্ষকেরা যদি সরাসরি দলীয় রাজনীতি করেন, তাহলে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে তিনি কথা বলতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে ভুল হোক, শুদ্ধ হোক, দলীয় পতাকা বহন করেই তাঁকে চলতে হয়। আমাদের দেশে নীল, সাদা, গোলাপি নানা রঙে নিজেকে রাঙিয়ে দিয়ে শিক্ষক যখন নির্বাচনের প্রচারণার মাঠে নামেন, তখনই বোঝা যায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণার এতটা দূরত্ব সৃষ্টি হলো কেন, ক্লাসরুমের চেয়ে ক্লাব বা প্রশাসনিক পদ শিক্ষকের এত প্রিয় হয়ে উঠল কেন।
শিক্ষকের মূল কাজ জ্ঞানদান ও জ্ঞান সৃষ্টি করা, সে কথা আমরা ভুলতে বসেছি। অনেকেই যেমন শর্টকাটে কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছেন, কোনো জবাবদিহির ধার ধারছেন না, তেমনি শিক্ষকেরা তাঁদের মতো হয়ে নেপোর মতো ‘দই’ মারবেন না, তা হবে কেন? তিনি তো দেখতেই পাচ্ছেন, একজন ব্যাংক কর্মকর্তা কোনো রহস্যজনক কোম্পানিকে হাজার কোটি টাকার ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে ফ্ল্যাটের মালিক বনে যাচ্ছেন, একজন সম্রাট ক্যাসিনো ব্যবসা করে কোটিপতি হয়ে যাচ্ছেন, হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়ার খবর প্রকাশিত হচ্ছে পত্রিকায়, কিন্তু এই পাচারকারীদের ধরা যাচ্ছে না, ছোঁয়া যাচ্ছে না—তখন নিজেকে নৈতিকভাবে ঠিক রাখা কতটা কঠিন, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ছয়
মাথা পচে গেলে শরীর পচতে কতক্ষণ? আমাদের মাথার অসুখ সারাতে হলে সর্বদিকে নজর দিতে হবে। অনৈতিকতার প্রভুত্ব থেকে মুক্ত হতে হবে। সামগ্রিক এই পতন ঠেকাতে হবে সম্মিলিতভাবে। কিন্তু যে লোভ, যে সুবিধাবাদ আমাদের সমাজকে প্রায় গিলে খেয়েছে, সেই লোভ ও সুবিধাবাদকে এড়িয়ে নৈতিকতার জয় ঘোষণা করার মতো মনোবল ও আত্মিক শক্তি কি অবশিষ্ট আছে আমাদের?
অন্তত ধর্মীয় অবমাননার নাম করে সমাজে অরাজকতা সৃষ্টি, ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা লোপাটের ফন্দি, ভোগবাদী মানসিকতায় নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া, দেশপ্রেমহীন রাজনৈতিক পরিচয়ে নিজেকে সবল করা, পড়াশোনার ক্ষেত্রে শর্টকাট পথ বেছে নেওয়া, সংস্কৃতিজগতের মাফিয়া হওয়া ইত্যাদি ঘটনার দিকে তাকালে মনে হয় না, এই অরাজকতা থেকে আশু মুক্তি সম্ভব।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের কথা ইচ্ছে করেই সামনে আনলাম না। যা বলা হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করলে সরকার, রাজনৈতিক দল এবং উপাচার্য মিলে যে অশুভ ত্রিভুজ তৈরি হয়েছে, তা প্রকাশ পাবে। আর সেটা আমি না বললেও কারও জানতে বাকি নেই।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
এই তো কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক থিসিস চুরির অভিযোগে পদাবনতি পেলেন। তিনি তাঁর থিসিসের প্রায় পুরোটাই ঝেড়ে দিয়েছেন অন্যের লেখা থেকে। প্রমাণিত এই সত্য এতটাই ভয়াবহ যে পুরো শিক্ষক সমাজকেই তা লজ্জার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমাদের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড এখন যে ধীরে ধীরে পড়াশোনা ছাড়া আর সব ব্যাপারেই বিখ্যাত হয়ে উঠছে, সেটাও তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রকাশিত খবর থেকেই টের পাওয়া যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের থিসিস চুরির ঘটনা এটাই প্রথম নয়। বেশ কয়েকবার এ রকম অভিযোগ উঠেছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, অভিযোগ সত্য। এ রকম এক বিপন্ন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছেন শিক্ষকেরা।
আমি কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে তাঁদের লিখতে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু পত্রিকায় সরাসরি এ বিষয়ে লেখার ব্যাপারে হয়তো সেলফ-সেন্সরশিপ কাজ করে। কিংবা এমনও হতে পারে, কাক কাকের মাংস খায় না। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হয়তো ভয়। কোথায় কী কথা বলতে গিয়ে সামাজিকভাবে হেয় হতে হবে, ক্ষমতা বা পেশিশক্তির খপ্পরে পড়ে মান-সম্মান যাবে—সেটাও হয়তো ভেবেছেন তাঁরা। কে আর সেই ঝুঁকি নিতে চাইবে? শিক্ষকদের এই নীরবতার একটা সামাজিক কারণ আছে। সমাজ সত্যকে কতটা মূল্য দিচ্ছে, সেটাই মূল আলোচনার বিষয় হতে পারে।
দুই
আমরা এখনই বলতে শুরু করতে পারি, এই শিক্ষকের জন্য শাস্তিটা কম হয়ে গেছে। আরও বড় শাস্তি পাওয়া উচিত ছিল তাঁর। যিনি ওপরে ওঠার সিঁড়ির খোঁজ করতে গিয়ে বেছে নেন অন্ধকার শর্টকাট রাস্তা, তিনি তো শিক্ষক হওয়ারই উপযুক্ত নন। শিক্ষার্থীরা তাঁদের চোখের সামনে একজন ‘চোর’কে দেখতে পাবে। তাঁর প্রতি কি সত্যিই সম্মান রাখতে পারবে তারা? একজন ছিঁচকে চোরের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য কোথায়? শিক্ষা নিয়ে চুরির ঘটনা তো বুঝিয়ে দেয়, সমাজের জন্য ছিঁচকে চোরের চেয়ে এই চোর অনেক বেশি অপকারী।
এ কথাগুলো বলার সময় আমরা একটা দিকে খেয়াল রাখি না। আমরা যে ছবিটি হতাশ চোখে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকিয়ে দেখছি, সে ছবিটি কিন্তু এককভাবে শিক্ষকদের ছবি নয়। দৃষ্টি একটু প্রসারিত করলে দেখা যাবে, সমাজের সর্বত্রই এই ধস নেমেছে। আমাদের মূল্যবোধ, চেতনা, নৈতিকতাসহ গর্ব করার মতো বিষয়গুলো থেকে ক্রমেই আমরা সরে যাচ্ছি। যে সেক্টরের দিকেই চোখ দিই না কেন, দেখতে পাব ভাটার টানে সব ভেসে যাচ্ছে সাগরে। পাড়ে পড়ে থাকছে শুধুই আবর্জনা। তাই সাংবাদিক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, চিকিৎসক, ব্যাংকার, উদ্যোক্তা, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনীতিবিদ, সরকারি চাকরিজীবী—তালিকা বাড়ানো যাবে যেমন ইচ্ছে, সবাই সেই ধস ‘উপভোগ’ করছেন। কখনো কখনো একেকটি সেক্টরে পচা দুর্গন্ধময় সংবাদের জন্ম হলেই আমরা কেবল বুঝতে পারি, সর্বনাশের শিকড়টা কত গভীরে পোঁতা আছে।
তিন
শিক্ষকের চৌর্যবৃত্তি নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, তখন আলোচনা শুধু শিক্ষকতা পেশাতেই সীমাবদ্ধ রাখা যাক। একটু আগেই বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরেই চুরি, ঘুষ, পেশিশক্তির মর্যাদা বাড়ছে। যেহেতু বিনে পয়সায় এই কুরুচিপূর্ণ কাজগুলো করা যায় অনায়াসে, জীবন থেকে হটিয়ে দেওয়া যায় সুরুচি, মূল্যবোধ আর নৈতিকতাকে এবং তার বিনিময়ে সামাজিকভাবে ঘৃণিত হওয়ারও আশঙ্কা থাকে না, তাই ওই নষ্ট পচা গলা পথেই পা বাড়াচ্ছে মানুষ। ফলে ঘৃণিত কাজগুলোও আপগ্রেডেড হয়ে সম্মান পাচ্ছে।এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে শিক্ষকদের শিক্ষা-চুরির বিষয়টি দেখতে হবে।স্কুলশিক্ষক, কলেজশিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কেমন হবেন, কীভাবে পড়াবেন,
সেই পড়াশোনার আলো থেকে শিক্ষার্থী কীভাবে বেছে নেবে তার ভবিষ্যৎ চলার পথ, তা আমরা কমবেশি জানি। সবচেয়ে বড় কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হবেন উন্নত আদর্শের মানুষ। আমরা ৭৩-এর অধ্যাদেশের বিশদ বর্ণনা না করেও বলতে পারি, সেখানে শিক্ষকদের যে মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল, তার প্রতি সম্মান থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পিএইচডি থিসিস চুরির দিকে যেতেন না। বিষয়ের একটু গভীরে গেলেই দেখা যাবে, ছাত্রজীবন থেকে আদর্শহীনভাবে গড়ে উঠলে, কেবল নম্বরকেই শিক্ষক হওয়ার মূল বিষয় মনে করা হলে, শিক্ষক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ‘মেধাবী ছাত্র’টি সহজেই অনৈতিকতার পথ বেছে নিতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যে রিস্ট্রাকচারিং সিস্টেমটা গড়ে উঠেছে, তার মধ্যেও রয়েছে অসৎ হওয়ার মন্ত্র। ডিপার্টমেন্টে অধ্যাপক পদ নেই। পদ না থাকলেও কিছু ক্রাইটেরিয়া পূরণ করলে পদোন্নতি দিয়ে দেওয়া হয়। এই ক্রাইটেরিয়ার মধ্যে একটা হলো ডিগ্রি। ফলে যেকোনোভাবে ডিগ্রি লাভের প্রতিযোগিতায় যখন একজন শিক্ষক নামেন, তখন তিনি চুরি করছেন নাকি ডাকাতি করছেন, সেটা তাঁর মনে থাকে না। পড়ানো এবং গবেষণা তো তখন লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য হলো পদ। পদোন্নতি পাওয়া মানে জাতে ওঠা। ব্যস! সেই জাতে উঠতে গিয়েই বিনা আয়াসে প্রভাষক হন সহকারী অধ্যাপক, সহকারী হন সহযোগী, সহযোগী হন পূর্ণাঙ্গ অধ্যাপক!
চার
আচ্ছা, পিএইচডি পাওয়ার ব্যাপার যদি এমন হয়? আমি কোনো পিএইচডি ছাত্রের সুপারভাইজার। দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার দুজন শিক্ষক বন্ধু আছেন, যাদের আমি বললাম, ‘বন্ধুরা, আমার ছাত্রটা তো পিএইচডি থিসিস লিখে শেষ করেছে। যা-ই লিখে থাকুক না, তোমরা এক্সটারনাল হয়ে এসো। আমরা তিনজন মিলে ওকে এই খেয়া পার করিয়ে দিই।’ পিএইচডি থিসিসগুলো মানসম্মত হচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন করায় একজন অধ্যাপক এ চিত্রটি তুলে ধরলেন। পরিষ্কার হলো কিছু বিষয়। এটা অবশ্য সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু ঘটছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কত কথাই না শোনা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ যেন দিনে দিনে পরিহাসে পরিণত হচ্ছে। দলীয়করণ-প্রক্রিয়া এখন এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে একজন বশংবদ উপাচার্য না হলে আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চলছে না। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একজন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কয়েক দফা সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। বেশ কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন সেক্টরের শিক্ষকেরা চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে বসেন, তাঁর কথা শোনেন, তিনি পাঠদানে সক্ষম কি না, সেগুলো বিবেচনা করেন। কিন্তু আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে কী ধরনের ঘটনা ঘটে, তার প্রকাশ তো পত্রিকায় দেখা যায়। সরকারের আশীর্বাদে উপাচার্য নিয়োগ হওয়ায় সরকারের প্রতি তো একটা দায় থাকে তাঁর। সেই দায় পূরণ করতে গিয়ে এবং দলবাজির চাপে পড়ে আমাদের উপাচার্যরা শিক্ষার পরিবেশ কতটা রক্ষা করতে পারেন, সে তো সাদা চোখেই দেখা যাচ্ছে।
পাঁচ
শিক্ষকদের রাজনীতিপ্রীতি এই অধঃপতনের একটা বড় কারণ। কোনো মানুষই রাজনীতির বাইরে নয়। কিন্তু শিক্ষকেরা যদি সরাসরি দলীয় রাজনীতি করেন, তাহলে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে তিনি কথা বলতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে ভুল হোক, শুদ্ধ হোক, দলীয় পতাকা বহন করেই তাঁকে চলতে হয়। আমাদের দেশে নীল, সাদা, গোলাপি নানা রঙে নিজেকে রাঙিয়ে দিয়ে শিক্ষক যখন নির্বাচনের প্রচারণার মাঠে নামেন, তখনই বোঝা যায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণার এতটা দূরত্ব সৃষ্টি হলো কেন, ক্লাসরুমের চেয়ে ক্লাব বা প্রশাসনিক পদ শিক্ষকের এত প্রিয় হয়ে উঠল কেন।
শিক্ষকের মূল কাজ জ্ঞানদান ও জ্ঞান সৃষ্টি করা, সে কথা আমরা ভুলতে বসেছি। অনেকেই যেমন শর্টকাটে কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছেন, কোনো জবাবদিহির ধার ধারছেন না, তেমনি শিক্ষকেরা তাঁদের মতো হয়ে নেপোর মতো ‘দই’ মারবেন না, তা হবে কেন? তিনি তো দেখতেই পাচ্ছেন, একজন ব্যাংক কর্মকর্তা কোনো রহস্যজনক কোম্পানিকে হাজার কোটি টাকার ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে ফ্ল্যাটের মালিক বনে যাচ্ছেন, একজন সম্রাট ক্যাসিনো ব্যবসা করে কোটিপতি হয়ে যাচ্ছেন, হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়ার খবর প্রকাশিত হচ্ছে পত্রিকায়, কিন্তু এই পাচারকারীদের ধরা যাচ্ছে না, ছোঁয়া যাচ্ছে না—তখন নিজেকে নৈতিকভাবে ঠিক রাখা কতটা কঠিন, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ছয়
মাথা পচে গেলে শরীর পচতে কতক্ষণ? আমাদের মাথার অসুখ সারাতে হলে সর্বদিকে নজর দিতে হবে। অনৈতিকতার প্রভুত্ব থেকে মুক্ত হতে হবে। সামগ্রিক এই পতন ঠেকাতে হবে সম্মিলিতভাবে। কিন্তু যে লোভ, যে সুবিধাবাদ আমাদের সমাজকে প্রায় গিলে খেয়েছে, সেই লোভ ও সুবিধাবাদকে এড়িয়ে নৈতিকতার জয় ঘোষণা করার মতো মনোবল ও আত্মিক শক্তি কি অবশিষ্ট আছে আমাদের?
অন্তত ধর্মীয় অবমাননার নাম করে সমাজে অরাজকতা সৃষ্টি, ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা লোপাটের ফন্দি, ভোগবাদী মানসিকতায় নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া, দেশপ্রেমহীন রাজনৈতিক পরিচয়ে নিজেকে সবল করা, পড়াশোনার ক্ষেত্রে শর্টকাট পথ বেছে নেওয়া, সংস্কৃতিজগতের মাফিয়া হওয়া ইত্যাদি ঘটনার দিকে তাকালে মনে হয় না, এই অরাজকতা থেকে আশু মুক্তি সম্ভব।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের কথা ইচ্ছে করেই সামনে আনলাম না। যা বলা হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করলে সরকার, রাজনৈতিক দল এবং উপাচার্য মিলে যে অশুভ ত্রিভুজ তৈরি হয়েছে, তা প্রকাশ পাবে। আর সেটা আমি না বললেও কারও জানতে বাকি নেই।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
৪ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৮ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৮ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৮ দিন আগে