মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। বিদায়ী মন্ত্রিসভায় যেসব মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা ছিল, সেই সব মন্ত্রণালয়ে নতুন মুখ আনা হয়েছে। এতে বোঝা যায় এই মেয়াদে তিনি অর্থ, বাণিজ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার দায়িত্ব দিয়েছেন। এ ছাড়া দুর্নীতি, সুশাসনকেও বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। নির্বাচনের আগে প্রকাশিত দলীয় ইশতেহারেও ১১টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এই মেয়াদে সরকার পরিবর্তন আনতে চাইছে, সেটি তখনই বোঝা গিয়েছিল।
ইশতেহারে ১১টি জনগুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, কর্মযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন, লাভজনক কৃষির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষিব্যবস্থা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, দৃশ্যমান অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে শিল্পের প্রসার ঘটানো, ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা, সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থায় সবাইকে যুক্ত করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ, সাম্প্রদায়িকতা ও সব ধরনের সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ রোধ করা এবং সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসার ঘটানো।
দ্রব্যমূল্য গত দুই বছর লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। বাজারে সব পণ্যেই সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়েছিল। সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তখন দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এ নিয়ে জনমনে ক্ষোভ ছিল। সরকার স্বল্প আয়ের মানুষদের কষ্ট লাঘবের জন্য টিসিবিকে সক্রিয় করে এক বছর ন্যায্যমূল্যে কিছু পণ্য ক্রয় করার সুযোগ করে দিয়েছিল। ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ কিছুটা হলেও উপকৃত হয়েছে। তবে সবাইকে এর আওতায় আনা সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, ডলার-সংকট এবং একচেটিয়া কারবারিদের কারসাজিতে আমদানি করা পণ্যসামগ্রীর দাম বাজারে নিয়ন্ত্রণহীন ছিল। দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত ধান, চাল, শাকসবজি, তরিতরকারি, ডিম, মাছ, মাংস নিয়েও চলেছে মজুতদারি ও নানা ধরনের কারসাজি। ফলে ভোক্তা অধিকার সংস্থা দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খাচ্ছিল, নিরুপায় হয়ে পড়েছিল। বিষয়টি সরকারের জন্য খুবই বিব্রতকর ছিল। সরকার এবার এটি হালকাভাবে দেখছে না বলে মনে হচ্ছে। নির্বাচনের পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রব্যমূল্য নিয়ে কথা বলেছেন।
মন্ত্রিপরিষদের প্রথম বৈঠকেও তিনি দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে তাঁর কনসার্ন ব্যক্ত করেছেন। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী হিসেবে এই মেয়াদে তিনি আহসানুল ইসলাম টিটুকে দায়িত্ব দিয়েছেন। প্রতিমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ করে বাজারে সিন্ডিকেট থাকবে না বলে শক্ত কথা বলেছেন। অথচ নির্বাচনের পর থেকেই বাজারে চালের দাম ভরা মৌসুম থাকা সত্ত্বেও কেজিপ্রতি ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়ে গেছে। কিছুদিন আগে গরুর মাংসের দাম ৬৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেটি আবার ৭০০ হয়েছে।
দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী দুইভাবে বাজারে আসে—প্রথমটি বিদেশ থেকে আমদানি করা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী। বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যসামগ্রী নিয়ে একচেটিয়া কারবারিদের কারসাজি যেমন রয়েছে, আবার দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী উৎপাদকের হাত থেকে বাজারে আনা পর্যন্ত নানা মধ্যস্বত্বভোগীর হাত হয়ে খুচরা ব্যবসায়ীর কাছে আসার কারণে উৎপাদক এবং ভোক্তা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমরা আশা করব, নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী অল্প সময়ের মধ্যেই বাজারব্যবস্থায় যেসব অনিয়ম, কারসাজি, সিন্ডিকেট, মজুতদারি রয়েছে, সেসব নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা উদ্ভাবন করবেন, যাতে বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ে উৎপাদক এবং ভোক্তাদের এভাবে হয়রানির শিকার না হতে হয়।
এ ব্যাপারে ভারতে চমৎকার একটি ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে একটি বিশেষ কমিশন বহু বছর থেকে ভারতব্যাপী পণ্যসামগ্রীর চাহিদা, সরবরাহ এবং মূল্য নিয়ে কাজ করছে। ভারতে দ্রব্যমূল্য ওঠানামার ক্ষেত্রে কমিশনই ভূমিকা রেখে থাকে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দাম নিয়ে সরকারকে সমালোচনার মুখেও পড়তে হয় না, বিব্রতবোধও করতে হয় না। ভারতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা যেতে পারে। বাজারে যে ধরনের দুর্বৃত্তায়িত অবস্থা বিরাজ করছে, এর অবসান আমাদের করতেই হবে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে নীতি-নৈতিকতা, আইন ও বিধিবিধান মেনে চলার সংস্কৃতিতে আনতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বিগত বছরগুলোতে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। তবে অনেক জায়গায় প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশি রয়েছে। বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই মানসম্মত পাঠদান হচ্ছে না। এ কারণে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ৭১ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। এখানে একদিকে যেমন শিশু-কিশোরদের গড়ে ওঠার সুযোগ নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে সরকার এবং অভিভাবকদেরও অর্থের অপচয় হচ্ছে। বৃত্তিমূলক এবং কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গত কয়েক বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে। এগুলোর মান নিয়ে যথেষ্ট অভিযোগ রয়েছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসা লাখ লাখ তরুণ দক্ষতার অভাবের কারণে চাকরি খুঁজে পাচ্ছেন না। অথচ দেশের অভ্যন্তরে যেমন শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, প্রবাসেও বাংলাদেশ থেকে দক্ষ প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন জনসম্পদের চাহিদা রয়েছে। গোটা শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে শৃঙ্খলা, ব্যবস্থাপনা, দক্ষ ও মেধাবী প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগের কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের কৃষিব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে বহুমুখী ফসল উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণনব্যবস্থা, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং আধুনিক যান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রয়োগ সাধন ব্যতীত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। সে কারণে সমগ্র কৃষিব্যবস্থাকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে বাজারব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কাজটি এখনই করতে হবে।
বিশ্ব অর্থনীতি এক জটিল অবস্থার ভেতর দিয়ে চলছে। এর অভিঘাত আমাদের ওপরেও পড়ছে। নতুন অর্থমন্ত্রী দেশের অর্থব্যবস্থার সবলতা, দুর্বলতাগুলো অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্ণয় এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন। আমাদের ব্যাংকিং খাতে নানা অনিয়ম, খেলাপি ঋণ, অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে। এসব অনিয়ম বন্ধ করা এবং ব্যাংকব্যবস্থায় অন্যতম সেরা সেবা খাত হিসেবে গড়ে তোলা এই মেয়াদে সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে। ব্যাংক খাত গোটা দেশে হৃৎপিণ্ডের মতো কাজ করে। সুতরাং সেখানে নিয়মশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশে অর্থনীতি স্বাস্থ্য-সবল রাখার উপায় বের করতে হবে। বাংলাদেশকে শুধু তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর নির্ভরশীল না থেকে শিল্পের বহুমুখীকরণের দিকে এখনই গুরুত্ব দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক জোন তৈরি করেছেন। সেগুলোকে কীভাবে কাজে লাগানো, বিদেশি উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করা ও বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা যায়, সে বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় অংশীজনদের সঙ্গে কাজ করবে, সেটি প্রত্যাশিত। আমাদের দেশে পশুর চামড়ার প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং এ-সংক্রান্ত শিল্প-কলকারখানা তৈরিতে বিদেশি এবং দেশি পার্টনারশিপের ব্যবস্থা করা খুবই জরুরি। আমরা আমাদের চামড়াশিল্পকে এখনো চরমভাবে অবহেলা করতে দেখছি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ খাতে নজর দিলে অর্থনীতিতে বিরাট আয় আসতে পারে।
দুর্নীতি মারাত্মক ব্যাধির মতো সমাজ, প্রশাসনসহ সর্বত্র বিরাজ করছে। প্রধানমন্ত্রীও এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতির কথা ঘোষণা করেছেন। তাঁর এই ঘোষণার যথাযথ বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। আমাদের সমাজে দুর্নীতি নানাভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তদবির-সংস্কৃতির ফলে সমাজে যোগ্য মেধাবী, দক্ষ ও অভিজ্ঞরা ভূমিকা রাখার সুযোগ পান না। সব ধরনের প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, সেবা, পরিষেবায় মধ্যস্বত্বভোগী দালাল শ্রেণি, ঘুষ-দুর্নীতি প্রভাব বিস্তার করে আসছে। রাজনীতিতেও এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। দলে অনেকেই দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে অনেক কিছু করছেন। দলকেও জনগণের কাছে প্রশ্নের মুখে ফেলছেন। সরকারের সাধারণ কোনো অনুদান হতদরিদ্র কিংবা জনকল্যাণে ব্যয় করার চেষ্টা করা হলেও তাতেও দেখা যায় নানা ধরনের দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়। এমপি-মন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজন নানাভাবে অবৈধ সুযোগ-সুবিধালাভের চেষ্টা করে থাকেন। সরকারের যত সব উন্নয়ন প্রকল্প কার্যকর রয়েছে, সেগুলো যাতে দুর্নীতিমুক্তভাবে সম্পন্ন হয়, সেদিকে সরকারকে নজর দিতে হবে।
২০২৪-২৯ মেয়াদের শেখ হাসিনার সরকার যদি আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে নিয়ম, নীতি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে পারে, বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে পারে, বেকার বাহিনীকে কাজে যুক্ত করতে পারে এবং নিকট ভবিষ্যতে শিক্ষাব্যবস্থায় দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে মেয়াদ শেষে সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অভিযোগ করার বিশেষ
কিছু থাকবে না। শেখ হাসিনা গত তিন মেয়াদে যে পরিবর্তন বাংলাদেশে ঘটাতে পেরেছেন, তা একসময় ছিল অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয়।
সেই তুলনায় এই মেয়াদে যে ১১টি খাতকে চিহ্নিত করে পরিবর্তন আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে, সেটি করা খুব বেশি জটিল হবে বলে মনে হয় না।
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। বিদায়ী মন্ত্রিসভায় যেসব মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা ছিল, সেই সব মন্ত্রণালয়ে নতুন মুখ আনা হয়েছে। এতে বোঝা যায় এই মেয়াদে তিনি অর্থ, বাণিজ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার দায়িত্ব দিয়েছেন। এ ছাড়া দুর্নীতি, সুশাসনকেও বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। নির্বাচনের আগে প্রকাশিত দলীয় ইশতেহারেও ১১টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এই মেয়াদে সরকার পরিবর্তন আনতে চাইছে, সেটি তখনই বোঝা গিয়েছিল।
ইশতেহারে ১১টি জনগুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, কর্মযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন, লাভজনক কৃষির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষিব্যবস্থা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, দৃশ্যমান অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে শিল্পের প্রসার ঘটানো, ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা, সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থায় সবাইকে যুক্ত করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ, সাম্প্রদায়িকতা ও সব ধরনের সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ রোধ করা এবং সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসার ঘটানো।
দ্রব্যমূল্য গত দুই বছর লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। বাজারে সব পণ্যেই সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়েছিল। সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তখন দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এ নিয়ে জনমনে ক্ষোভ ছিল। সরকার স্বল্প আয়ের মানুষদের কষ্ট লাঘবের জন্য টিসিবিকে সক্রিয় করে এক বছর ন্যায্যমূল্যে কিছু পণ্য ক্রয় করার সুযোগ করে দিয়েছিল। ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ কিছুটা হলেও উপকৃত হয়েছে। তবে সবাইকে এর আওতায় আনা সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, ডলার-সংকট এবং একচেটিয়া কারবারিদের কারসাজিতে আমদানি করা পণ্যসামগ্রীর দাম বাজারে নিয়ন্ত্রণহীন ছিল। দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত ধান, চাল, শাকসবজি, তরিতরকারি, ডিম, মাছ, মাংস নিয়েও চলেছে মজুতদারি ও নানা ধরনের কারসাজি। ফলে ভোক্তা অধিকার সংস্থা দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খাচ্ছিল, নিরুপায় হয়ে পড়েছিল। বিষয়টি সরকারের জন্য খুবই বিব্রতকর ছিল। সরকার এবার এটি হালকাভাবে দেখছে না বলে মনে হচ্ছে। নির্বাচনের পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রব্যমূল্য নিয়ে কথা বলেছেন।
মন্ত্রিপরিষদের প্রথম বৈঠকেও তিনি দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে তাঁর কনসার্ন ব্যক্ত করেছেন। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী হিসেবে এই মেয়াদে তিনি আহসানুল ইসলাম টিটুকে দায়িত্ব দিয়েছেন। প্রতিমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ করে বাজারে সিন্ডিকেট থাকবে না বলে শক্ত কথা বলেছেন। অথচ নির্বাচনের পর থেকেই বাজারে চালের দাম ভরা মৌসুম থাকা সত্ত্বেও কেজিপ্রতি ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়ে গেছে। কিছুদিন আগে গরুর মাংসের দাম ৬৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেটি আবার ৭০০ হয়েছে।
দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী দুইভাবে বাজারে আসে—প্রথমটি বিদেশ থেকে আমদানি করা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী। বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যসামগ্রী নিয়ে একচেটিয়া কারবারিদের কারসাজি যেমন রয়েছে, আবার দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী উৎপাদকের হাত থেকে বাজারে আনা পর্যন্ত নানা মধ্যস্বত্বভোগীর হাত হয়ে খুচরা ব্যবসায়ীর কাছে আসার কারণে উৎপাদক এবং ভোক্তা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমরা আশা করব, নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী অল্প সময়ের মধ্যেই বাজারব্যবস্থায় যেসব অনিয়ম, কারসাজি, সিন্ডিকেট, মজুতদারি রয়েছে, সেসব নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা উদ্ভাবন করবেন, যাতে বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ে উৎপাদক এবং ভোক্তাদের এভাবে হয়রানির শিকার না হতে হয়।
এ ব্যাপারে ভারতে চমৎকার একটি ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে একটি বিশেষ কমিশন বহু বছর থেকে ভারতব্যাপী পণ্যসামগ্রীর চাহিদা, সরবরাহ এবং মূল্য নিয়ে কাজ করছে। ভারতে দ্রব্যমূল্য ওঠানামার ক্ষেত্রে কমিশনই ভূমিকা রেখে থাকে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দাম নিয়ে সরকারকে সমালোচনার মুখেও পড়তে হয় না, বিব্রতবোধও করতে হয় না। ভারতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা যেতে পারে। বাজারে যে ধরনের দুর্বৃত্তায়িত অবস্থা বিরাজ করছে, এর অবসান আমাদের করতেই হবে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে নীতি-নৈতিকতা, আইন ও বিধিবিধান মেনে চলার সংস্কৃতিতে আনতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বিগত বছরগুলোতে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। তবে অনেক জায়গায় প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশি রয়েছে। বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই মানসম্মত পাঠদান হচ্ছে না। এ কারণে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ৭১ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। এখানে একদিকে যেমন শিশু-কিশোরদের গড়ে ওঠার সুযোগ নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে সরকার এবং অভিভাবকদেরও অর্থের অপচয় হচ্ছে। বৃত্তিমূলক এবং কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গত কয়েক বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে। এগুলোর মান নিয়ে যথেষ্ট অভিযোগ রয়েছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসা লাখ লাখ তরুণ দক্ষতার অভাবের কারণে চাকরি খুঁজে পাচ্ছেন না। অথচ দেশের অভ্যন্তরে যেমন শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, প্রবাসেও বাংলাদেশ থেকে দক্ষ প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন জনসম্পদের চাহিদা রয়েছে। গোটা শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে শৃঙ্খলা, ব্যবস্থাপনা, দক্ষ ও মেধাবী প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগের কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের কৃষিব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে বহুমুখী ফসল উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণনব্যবস্থা, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং আধুনিক যান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রয়োগ সাধন ব্যতীত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। সে কারণে সমগ্র কৃষিব্যবস্থাকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে বাজারব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কাজটি এখনই করতে হবে।
বিশ্ব অর্থনীতি এক জটিল অবস্থার ভেতর দিয়ে চলছে। এর অভিঘাত আমাদের ওপরেও পড়ছে। নতুন অর্থমন্ত্রী দেশের অর্থব্যবস্থার সবলতা, দুর্বলতাগুলো অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্ণয় এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন। আমাদের ব্যাংকিং খাতে নানা অনিয়ম, খেলাপি ঋণ, অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে। এসব অনিয়ম বন্ধ করা এবং ব্যাংকব্যবস্থায় অন্যতম সেরা সেবা খাত হিসেবে গড়ে তোলা এই মেয়াদে সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে। ব্যাংক খাত গোটা দেশে হৃৎপিণ্ডের মতো কাজ করে। সুতরাং সেখানে নিয়মশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশে অর্থনীতি স্বাস্থ্য-সবল রাখার উপায় বের করতে হবে। বাংলাদেশকে শুধু তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর নির্ভরশীল না থেকে শিল্পের বহুমুখীকরণের দিকে এখনই গুরুত্ব দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক জোন তৈরি করেছেন। সেগুলোকে কীভাবে কাজে লাগানো, বিদেশি উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করা ও বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা যায়, সে বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় অংশীজনদের সঙ্গে কাজ করবে, সেটি প্রত্যাশিত। আমাদের দেশে পশুর চামড়ার প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং এ-সংক্রান্ত শিল্প-কলকারখানা তৈরিতে বিদেশি এবং দেশি পার্টনারশিপের ব্যবস্থা করা খুবই জরুরি। আমরা আমাদের চামড়াশিল্পকে এখনো চরমভাবে অবহেলা করতে দেখছি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ খাতে নজর দিলে অর্থনীতিতে বিরাট আয় আসতে পারে।
দুর্নীতি মারাত্মক ব্যাধির মতো সমাজ, প্রশাসনসহ সর্বত্র বিরাজ করছে। প্রধানমন্ত্রীও এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতির কথা ঘোষণা করেছেন। তাঁর এই ঘোষণার যথাযথ বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। আমাদের সমাজে দুর্নীতি নানাভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তদবির-সংস্কৃতির ফলে সমাজে যোগ্য মেধাবী, দক্ষ ও অভিজ্ঞরা ভূমিকা রাখার সুযোগ পান না। সব ধরনের প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, সেবা, পরিষেবায় মধ্যস্বত্বভোগী দালাল শ্রেণি, ঘুষ-দুর্নীতি প্রভাব বিস্তার করে আসছে। রাজনীতিতেও এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। দলে অনেকেই দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে অনেক কিছু করছেন। দলকেও জনগণের কাছে প্রশ্নের মুখে ফেলছেন। সরকারের সাধারণ কোনো অনুদান হতদরিদ্র কিংবা জনকল্যাণে ব্যয় করার চেষ্টা করা হলেও তাতেও দেখা যায় নানা ধরনের দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়। এমপি-মন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজন নানাভাবে অবৈধ সুযোগ-সুবিধালাভের চেষ্টা করে থাকেন। সরকারের যত সব উন্নয়ন প্রকল্প কার্যকর রয়েছে, সেগুলো যাতে দুর্নীতিমুক্তভাবে সম্পন্ন হয়, সেদিকে সরকারকে নজর দিতে হবে।
২০২৪-২৯ মেয়াদের শেখ হাসিনার সরকার যদি আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে নিয়ম, নীতি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে পারে, বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে পারে, বেকার বাহিনীকে কাজে যুক্ত করতে পারে এবং নিকট ভবিষ্যতে শিক্ষাব্যবস্থায় দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে মেয়াদ শেষে সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অভিযোগ করার বিশেষ
কিছু থাকবে না। শেখ হাসিনা গত তিন মেয়াদে যে পরিবর্তন বাংলাদেশে ঘটাতে পেরেছেন, তা একসময় ছিল অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয়।
সেই তুলনায় এই মেয়াদে যে ১১টি খাতকে চিহ্নিত করে পরিবর্তন আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে, সেটি করা খুব বেশি জটিল হবে বলে মনে হয় না।
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
১১ ঘণ্টা আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগে