অরুণাভ পোদ্দার
ঘড়িতে যখন কাঁটায় কাঁটায় ১০টা ৪৫, তখন ধানমন্ডির সাততলার ফ্ল্যাটে কলবেল টিপলাম। ওপাশ থেকে গৃহ-সহকারী দরজা খুলে বসার ঘরে বসতে বললেন। অল্প সময় পর নিজেই ওয়াকারের সাহায্যে হেঁটে এলেন আমাদের মিনু মাসি—আমাদের সবার সন্জীদা আপা, সন্জীদা খাতুন।
দীর্ঘদিন পর তাঁর বাড়িতে যাওয়া। কেন এত দিন যাওয়া হয়নি, তার অন্যতম কারণ ২০২০-এর করোনা মহামারি। শারীরিকভাবে বয়সের ছাপ পড়লেও কথাবার্তায় সেই তেজস্বী রূপ, ঋজুভাব আগের মতো। সন্জীদা খাতুনকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই।
পারস্পরিক কুশলাদি বিনিময়ের পর আপা জানতে চাইলেন, আমাদের শাখার (রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখা) পরিচিতজনেরা কে কেমন আছে।
শরীর একটু অসহযোগিতা করছে বোধ হয় কিন্তু কথা যখন বলছেন, মনে হচ্ছে সেই আপাকেই দেখছি, যাকে দেখে আসছি দীর্ঘকাল ধরে।
আপামর বাঙালির কাছেই তিনি বাঙালি সংস্কৃতির সেবক, ধারক-বাহক, অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাতিঘর ও আপসহীন ব্যক্তিত্ব হিসেবে সুপরিচিত। অধুনা প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনবৃত্ত’তে দেখি, আজীবন তিনি যে নির্ভীকতার পরিচয় দিয়ে এসেছেন, তার বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল শৈশবে, পারিবারিকভাবেই। উপমহাদেশখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ, বিখ্যাত দাবারু কাজী মোতাহার হোসেনের এগারো সন্তানের মাঝে একটি একান্নবর্তী ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই তাঁর বেড়ে ওঠা। মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন রক্তের সম্পর্কহীন মানুষকে হৃদয়ে ও গৃহে স্থান দেওয়ার শিক্ষা।
ছোটবেলায় বাবার নির্দিষ্ট আয়ের মধ্যেও এগারো ভাইবোনের মধ্যবিত্ত পরিবারেও গ্রামের আত্মীয়স্বজনের ভিড় লেগেই থাকত বাড়িতে। এই যে পরকে আপন করার শিক্ষা, সেটা বয়ে বেড়িয়েছেন সারা জীবন। কর্মজীবনেও অসংখ্য মানুষের ঠাঁই হয়েছে তাঁর গৃহে। তাঁদের অধিকাংশই এখন স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন বিশ্বপরিমণ্ডলে।
‘জীবনবৃত্ত’ বইটির এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘মায়ের সূত্রেই আজীবন এই শিক্ষা পেয়েছিলাম যে রক্তের সম্পর্ক দিয়েই শুধু আত্মীয়তা হয় না। মন-মানসিকতার মিল থাকলেই আত্মীয়তার বন্ধন তৈরি হওয়া সম্ভব।’
শৈশবে নারীশিক্ষা মন্দির, আনন্দময়ী স্কুলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি। তারপর ইডেন স্কুল, ইডেন কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে পাড়ি জমান কবিগুরুর বিশ্বভারতীতে। উচ্চশিক্ষা শেষ করে প্রথমেইডেন কলেজে ও পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। বর্ণিল কর্মজীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এলেও নিজের আদর্শ ও চিন্তাচেতনাকে সমুন্নত রেখেছেন আজীবন। খোদ পাকিস্তান আমলে আইয়ুবশাহি, মোনায়েম খানদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বিন্দুমাত্র আপস করেননি। তাই তো তাঁকে ১৯৬৯-৭০ সালে বদলি হতে হয় সুদূর রংপুরের কারমাইকেল কলেজে।
আচারসর্বস্ব ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতিতে তাঁর বিশ্বাস ছিল না কোনোকালেই। তাই তো তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের ঘোমটা পরার ও ছেলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলায় নিষেধাজ্ঞা তাঁর কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে। বাড়িতে তাঁর মায়ের কাছে শুনে বড় হয়েছেন, পর্দা হচ্ছে মনে। তাই বহিরাঙ্গে পর্দা করলাম, আর ভেতরে-ভেতরে যথেচ্ছাচার করে বেড়ালাম, এই দ্বৈত নীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না।
আরেকবার কারমাইকেল কলেজে পাকিস্তান সরকারের তদন্ত কমিটি তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করে যখন কিছুই পেল না, তখন তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হলো, ধর্মকর্ম ও রোজা-নামাজ একটু লোক দেখিয়ে করতে। কিন্তু লোক দেখানো ধর্মাচার তাঁর অপছন্দ। পাকিস্তান আমলের রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর বিরোধিতা থেকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে প্রতিরোধ আন্দোলনের সূচনা হয়, তা থেকে ক্রমে ছায়ানটের গোড়াপত্তন, রমনা বটমূলের নববর্ষের আরম্ভ—সবকিছুতেই সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। কখনোই কোনো সংগঠনের পদের পেছনে ছোটেননি। এই যে নিঃস্বার্থভাবে পদ-পদবিকে উপেক্ষা করে সাংস্কৃতিক আন্দোলন বেগবান করে তোলার ব্রত নিয়েছিলেন, তা থেকে বর্তমান প্রজন্মের অনেক কিছু শিক্ষণীয়।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড ও রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন তাঁকে ব্যথিত করে। সেই সঙ্গে সহযোদ্ধা জাহিদুর রহিমের অকাল প্রয়াণ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শূন্যতা সৃষ্টি করে। ১৯৭৯ সালে জাহিদুর রহিমের স্মৃতি রক্ষার্থে সন্জীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক, জামিল চৌধুরী, ডা. সারওয়ারআলী, মফিদুল হক প্রমুখ সহযোদ্ধা প্রথমে তৈরি করেন ‘জাহিদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ’, যা পরবর্তীকালে ‘জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ’-এ রূপান্তরিত হয়। ক্রমে ছায়ানটের সভাপতি, সম্মিলন পরিষদের গুরু দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ২০০১-এ রমনা বটমূলের বোমা হামলার পর ছায়ানটের কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করল, শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সংস্কৃতির পাঠও শিশুদের জন্য জরুরি। সেই আদর্শে ‘নালন্দা’ নামে একটি বিশেষ বিদ্যায়তনের কার্যক্রম শুরু হয়। এই সংস্কৃতিবান্ধব বিদ্যলয়ের সূচনা লগ্ন থেকেই সন্জীদা খাতুন ও তাঁর পরিবার যুক্ত ছিলেন। দুরারোগ্য ক্যানসারে অকাল প্রয়াত বড় কন্যা অপালা নভেদ্ পরিবারের দানকৃত জমিতে বর্তমানে কেরানীগঞ্জে বৃহত্তর পরিসরে ‘নালন্দা’র কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। দেশীয় শরীরচর্চা ও নৃত্যকে কেন্দ্র করে গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারীকে আবার ফিরিয়ে আনার প্রয়াসে গঠন করেছেন ব্রতচারী সংগঠন।
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ পিতার স্মৃতি রক্ষার্থে গঠন করেছেন ‘কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশন’। এ ছাড়া দেশের স্বনামধন্য আবৃত্তি সংগঠন ‘কণ্ঠশীলন’–এর ক্রান্তিকালে এর হাল ধরেছেন। এই নব্বই ছুঁইছুঁই বয়সেও ছায়ানট সংগীত বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি, জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ থেকে শুরু করে অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংগঠনের কার্যক্রম বেগবান করতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আর রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে লেখালেখি চলছেই। এবারের একুশের বইমেলায় ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ নামে দুই খণ্ডের বৃহৎ পরিসরের একটি বই বেরিয়েছে। রবীন্দ্রবিশারদ সন্জীদা খাতুনের রবীন্দ্রবিষয়ক অনুভব ও বিশ্লেষণের সংকলন ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’। এ ছাড়া তাঁর রবীন্দ্রবিষয়ক গ্রন্থের মাঝে আছে ‘রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ’, ‘রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে’, ‘তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে’, ‘রবীন্দ্রবিশ্বাসে মানব-অভ্যুদয়’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য’ প্রভৃতি।
রবীন্দ্রচর্চা ও বাঙালি সংস্কৃতি প্রসারে অবদানের জন্য পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র পুরস্কার, বিশ্বভারতীর প্রদত্ত ‘দেশিকোত্তম’ সম্মাননা, ভারত প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় ‘পদ্মশ্রী’ পদকসহ বহু পুরস্কার। এরই ফাঁকে ছায়ানটের রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষকদের নিবিড় প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা বিভিন্ন জায়গায় কর্মবীরের আখ্যান শুনি, কিন্তু আমাদের মাঝে একজন কিংবদন্তিতুল্য কর্মবীরের নীরব কর্মসম্পাদনার ইতিহাস কজনজানি?
আজ ৪ এপ্রিল, সেই অকুতোভয়, দৃঢ়চেতা, ঋজু ব্যক্তিত্বের অধিকারী, একজন আপাদমস্তক বাঙালি, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সন্জীদা খাতুনের ৯০তম জন্মদিন। তাঁর মানসিক ও শারীরিক সুস্বাস্থ্য কামনা করি। তাঁর এই নিরন্তর নিষ্কাম কর্মসাধনা যেন আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের আকাশকে কলুষমুক্ত করে তোলে, আমাদের পাথেয় হয়ে থাকে, হে আলোর পথযাত্রী।
লেখক: চিকিৎসক ও সংস্কৃতিকর্মী
ঘড়িতে যখন কাঁটায় কাঁটায় ১০টা ৪৫, তখন ধানমন্ডির সাততলার ফ্ল্যাটে কলবেল টিপলাম। ওপাশ থেকে গৃহ-সহকারী দরজা খুলে বসার ঘরে বসতে বললেন। অল্প সময় পর নিজেই ওয়াকারের সাহায্যে হেঁটে এলেন আমাদের মিনু মাসি—আমাদের সবার সন্জীদা আপা, সন্জীদা খাতুন।
দীর্ঘদিন পর তাঁর বাড়িতে যাওয়া। কেন এত দিন যাওয়া হয়নি, তার অন্যতম কারণ ২০২০-এর করোনা মহামারি। শারীরিকভাবে বয়সের ছাপ পড়লেও কথাবার্তায় সেই তেজস্বী রূপ, ঋজুভাব আগের মতো। সন্জীদা খাতুনকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই।
পারস্পরিক কুশলাদি বিনিময়ের পর আপা জানতে চাইলেন, আমাদের শাখার (রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখা) পরিচিতজনেরা কে কেমন আছে।
শরীর একটু অসহযোগিতা করছে বোধ হয় কিন্তু কথা যখন বলছেন, মনে হচ্ছে সেই আপাকেই দেখছি, যাকে দেখে আসছি দীর্ঘকাল ধরে।
আপামর বাঙালির কাছেই তিনি বাঙালি সংস্কৃতির সেবক, ধারক-বাহক, অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাতিঘর ও আপসহীন ব্যক্তিত্ব হিসেবে সুপরিচিত। অধুনা প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনবৃত্ত’তে দেখি, আজীবন তিনি যে নির্ভীকতার পরিচয় দিয়ে এসেছেন, তার বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল শৈশবে, পারিবারিকভাবেই। উপমহাদেশখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ, বিখ্যাত দাবারু কাজী মোতাহার হোসেনের এগারো সন্তানের মাঝে একটি একান্নবর্তী ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই তাঁর বেড়ে ওঠা। মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন রক্তের সম্পর্কহীন মানুষকে হৃদয়ে ও গৃহে স্থান দেওয়ার শিক্ষা।
ছোটবেলায় বাবার নির্দিষ্ট আয়ের মধ্যেও এগারো ভাইবোনের মধ্যবিত্ত পরিবারেও গ্রামের আত্মীয়স্বজনের ভিড় লেগেই থাকত বাড়িতে। এই যে পরকে আপন করার শিক্ষা, সেটা বয়ে বেড়িয়েছেন সারা জীবন। কর্মজীবনেও অসংখ্য মানুষের ঠাঁই হয়েছে তাঁর গৃহে। তাঁদের অধিকাংশই এখন স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন বিশ্বপরিমণ্ডলে।
‘জীবনবৃত্ত’ বইটির এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘মায়ের সূত্রেই আজীবন এই শিক্ষা পেয়েছিলাম যে রক্তের সম্পর্ক দিয়েই শুধু আত্মীয়তা হয় না। মন-মানসিকতার মিল থাকলেই আত্মীয়তার বন্ধন তৈরি হওয়া সম্ভব।’
শৈশবে নারীশিক্ষা মন্দির, আনন্দময়ী স্কুলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি। তারপর ইডেন স্কুল, ইডেন কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে পাড়ি জমান কবিগুরুর বিশ্বভারতীতে। উচ্চশিক্ষা শেষ করে প্রথমেইডেন কলেজে ও পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। বর্ণিল কর্মজীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এলেও নিজের আদর্শ ও চিন্তাচেতনাকে সমুন্নত রেখেছেন আজীবন। খোদ পাকিস্তান আমলে আইয়ুবশাহি, মোনায়েম খানদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বিন্দুমাত্র আপস করেননি। তাই তো তাঁকে ১৯৬৯-৭০ সালে বদলি হতে হয় সুদূর রংপুরের কারমাইকেল কলেজে।
আচারসর্বস্ব ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতিতে তাঁর বিশ্বাস ছিল না কোনোকালেই। তাই তো তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের ঘোমটা পরার ও ছেলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলায় নিষেধাজ্ঞা তাঁর কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে। বাড়িতে তাঁর মায়ের কাছে শুনে বড় হয়েছেন, পর্দা হচ্ছে মনে। তাই বহিরাঙ্গে পর্দা করলাম, আর ভেতরে-ভেতরে যথেচ্ছাচার করে বেড়ালাম, এই দ্বৈত নীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না।
আরেকবার কারমাইকেল কলেজে পাকিস্তান সরকারের তদন্ত কমিটি তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করে যখন কিছুই পেল না, তখন তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হলো, ধর্মকর্ম ও রোজা-নামাজ একটু লোক দেখিয়ে করতে। কিন্তু লোক দেখানো ধর্মাচার তাঁর অপছন্দ। পাকিস্তান আমলের রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর বিরোধিতা থেকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে প্রতিরোধ আন্দোলনের সূচনা হয়, তা থেকে ক্রমে ছায়ানটের গোড়াপত্তন, রমনা বটমূলের নববর্ষের আরম্ভ—সবকিছুতেই সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। কখনোই কোনো সংগঠনের পদের পেছনে ছোটেননি। এই যে নিঃস্বার্থভাবে পদ-পদবিকে উপেক্ষা করে সাংস্কৃতিক আন্দোলন বেগবান করে তোলার ব্রত নিয়েছিলেন, তা থেকে বর্তমান প্রজন্মের অনেক কিছু শিক্ষণীয়।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড ও রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন তাঁকে ব্যথিত করে। সেই সঙ্গে সহযোদ্ধা জাহিদুর রহিমের অকাল প্রয়াণ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শূন্যতা সৃষ্টি করে। ১৯৭৯ সালে জাহিদুর রহিমের স্মৃতি রক্ষার্থে সন্জীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক, জামিল চৌধুরী, ডা. সারওয়ারআলী, মফিদুল হক প্রমুখ সহযোদ্ধা প্রথমে তৈরি করেন ‘জাহিদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ’, যা পরবর্তীকালে ‘জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ’-এ রূপান্তরিত হয়। ক্রমে ছায়ানটের সভাপতি, সম্মিলন পরিষদের গুরু দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ২০০১-এ রমনা বটমূলের বোমা হামলার পর ছায়ানটের কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করল, শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সংস্কৃতির পাঠও শিশুদের জন্য জরুরি। সেই আদর্শে ‘নালন্দা’ নামে একটি বিশেষ বিদ্যায়তনের কার্যক্রম শুরু হয়। এই সংস্কৃতিবান্ধব বিদ্যলয়ের সূচনা লগ্ন থেকেই সন্জীদা খাতুন ও তাঁর পরিবার যুক্ত ছিলেন। দুরারোগ্য ক্যানসারে অকাল প্রয়াত বড় কন্যা অপালা নভেদ্ পরিবারের দানকৃত জমিতে বর্তমানে কেরানীগঞ্জে বৃহত্তর পরিসরে ‘নালন্দা’র কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। দেশীয় শরীরচর্চা ও নৃত্যকে কেন্দ্র করে গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারীকে আবার ফিরিয়ে আনার প্রয়াসে গঠন করেছেন ব্রতচারী সংগঠন।
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ পিতার স্মৃতি রক্ষার্থে গঠন করেছেন ‘কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশন’। এ ছাড়া দেশের স্বনামধন্য আবৃত্তি সংগঠন ‘কণ্ঠশীলন’–এর ক্রান্তিকালে এর হাল ধরেছেন। এই নব্বই ছুঁইছুঁই বয়সেও ছায়ানট সংগীত বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি, জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ থেকে শুরু করে অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংগঠনের কার্যক্রম বেগবান করতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আর রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে লেখালেখি চলছেই। এবারের একুশের বইমেলায় ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ নামে দুই খণ্ডের বৃহৎ পরিসরের একটি বই বেরিয়েছে। রবীন্দ্রবিশারদ সন্জীদা খাতুনের রবীন্দ্রবিষয়ক অনুভব ও বিশ্লেষণের সংকলন ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’। এ ছাড়া তাঁর রবীন্দ্রবিষয়ক গ্রন্থের মাঝে আছে ‘রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ’, ‘রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে’, ‘তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে’, ‘রবীন্দ্রবিশ্বাসে মানব-অভ্যুদয়’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য’ প্রভৃতি।
রবীন্দ্রচর্চা ও বাঙালি সংস্কৃতি প্রসারে অবদানের জন্য পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র পুরস্কার, বিশ্বভারতীর প্রদত্ত ‘দেশিকোত্তম’ সম্মাননা, ভারত প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় ‘পদ্মশ্রী’ পদকসহ বহু পুরস্কার। এরই ফাঁকে ছায়ানটের রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষকদের নিবিড় প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা বিভিন্ন জায়গায় কর্মবীরের আখ্যান শুনি, কিন্তু আমাদের মাঝে একজন কিংবদন্তিতুল্য কর্মবীরের নীরব কর্মসম্পাদনার ইতিহাস কজনজানি?
আজ ৪ এপ্রিল, সেই অকুতোভয়, দৃঢ়চেতা, ঋজু ব্যক্তিত্বের অধিকারী, একজন আপাদমস্তক বাঙালি, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সন্জীদা খাতুনের ৯০তম জন্মদিন। তাঁর মানসিক ও শারীরিক সুস্বাস্থ্য কামনা করি। তাঁর এই নিরন্তর নিষ্কাম কর্মসাধনা যেন আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের আকাশকে কলুষমুক্ত করে তোলে, আমাদের পাথেয় হয়ে থাকে, হে আলোর পথযাত্রী।
লেখক: চিকিৎসক ও সংস্কৃতিকর্মী
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
১ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৫ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৫ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ দিন আগে