ড. মইনুল ইসলাম
৩ এপ্রিল পত্রপত্রিকায় দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী রূপপুরে দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণের জন্য রাশিয়ার রোসাটমের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যেখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে সরে এসে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর এহেন আসক্তি খুবই দুঃখজনক। তিনি এ ব্যাপারে বারবার বঙ্গবন্ধুর আগ্রহের কথা জানিয়ে থাকেন, কিন্তু সোলার পাওয়ারের কথা জানা থাকলে নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধু এই পরিবেশবান্ধব ও ঝুঁকিমুক্ত প্রযুক্তি গ্রহণকে অগ্রাধিকার দিতেন বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। বাংলাদেশে এক দশকে অনেক মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হয়েছে, কিংবা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে, যেগুলোর কয়েকটিকে স্বল্পপ্রয়োজনীয় অথবা অপ্রয়োজনীয় বলা চলে। চলমান প্রকল্পের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর এবং পায়রাবন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প, ঢাকা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাস্তবায়নাধীন বিআরটি প্রকল্প এবং চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প ‘সাদা হাতি’ প্রকল্পের নিকৃষ্ট উদাহরণ। রাশিয়ার ১২ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণসহ মোট ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে নির্মাণাধীন রূপপুর প্রকল্প থেকে ২০২৫ সালে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে বলে বলা হচ্ছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, রাশিয়া ভারতে ২ হাজার মেগাওয়াট ক্যাপাসিটির পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করে দিয়েছে মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে। অতএব, প্রশ্ন করা যৌক্তিক যে বাংলাদেশ কেন এত বেশি বৈদেশিক ঋণ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের জন্য চুক্তি করেছে?
বর্তমান সরকার যে জনগণের কাছে জবাবদিহির ধার ধারে না, এর উদাহরণ এই রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প। ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প প্রযুক্তি বিশ্বে রয়েছে, যেখানে রূপপুর প্রকল্পের অর্ধেক ব্যয়ে ওই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। এই মহাবিপজ্জনক পারমাণবিক প্রযুক্তি বাংলাদেশের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশের মাঝখানে স্থাপনকে আমি সমর্থন করিনি। সোলার পাওয়ার প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিলে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ব্যয় রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের মোট ব্যয়ের অর্ধেকও হতো না। অথচ, সৌরবিদ্যুৎ সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব এবং ঝুঁকিমুক্ত প্রযুক্তি। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত, এক ইউনিট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ইতিমধ্যেই গণচীন, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে বাংলাদেশি ১০ টাকার নিচে নেমে এসেছে। ১৭ নভেম্বর ২০২৩ একটি দৈনিকে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, ব্লুমবার্গের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে ২০২৫ সালের পর সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন খরচ অন্য সব বিকল্পের তুলনায় বাংলাদেশেও কমে আসবে। ২০৩০ সালে এক মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন খরচ হবে মাত্র ৪২ ডলার, যেখানে এলএনজিচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে পড়বে ৯৪ ডলার এবং কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১১৮ ডলার।
তাহলে এত ব্যয়বহুল ‘সাদা হাতি’ প্রকল্প আমরা কেন নিলাম? এই ঋণ পরিশোধে ২০ বছর সময় লাগবে বলে সরকারিভাবেই জানানো হচ্ছে, কিন্তু ২০২৫ সাল থেকে প্রতি কিস্তিতে বাংলাদেশকে সুদাসলে প্রতিবছর ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। (২০২৩ সাল থেকে রাশিয়ান ঋণের ৩৩০ মিলিয়ন ডলার সুদ পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে)। এহেন ‘সাদা হাতি’ প্রকল্পগুলো যে ইতিমধ্যেই দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধকে বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে গেছে, সেটা ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নয়। এখন যদি রূপপুর দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প গৃহীত হয়, তাহলে আরও কয়েক বিলিয়ন ডলার যুক্ত হবে দেশের বৈদেশিক ঋণে।
গাজীপুরের সাবেক মেয়র ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব জাহাঙ্গীর আলম চলমান বিআরটি প্রকল্পটি যে ৫০ বছর ধরে গাজীপুরের জনগণের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করবে, সে সত্য কথাটি উচ্চারণ করেছেন, এ জন্য তাঁকে আমি সাধুবাদ জানাচ্ছি। আসলেই এই বিআরটি প্রকল্প ঢাকা বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিস্তৃত সম্ভাব্য একটি আট লেনের মহাসড়ককে মারাত্মকভাবে পঙ্গু করে দিয়েছে, জাতি যার কুফল ভোগ করবে যুগের পর যুগ ধরে। বিমানবন্দর পর্যন্ত এয়ারপোর্ট রোডটি আট লেনের মহাসড়ক, কিন্তু এরপর বিআরটি প্রকল্পের জন্য এই সড়কের তিন থেকে চারটি লেনকে মহাসড়ক থেকে আলাদা করে ফেলা হয়েছে। আবার মাঝে মাঝে অনেক ফ্লাইওভারও নির্মাণ করা হয়েছে প্রকল্পের অধীনে। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি মহাসড়কের মাঝখানের সবচেয়ে বেশি ব্যবহারোপযোগী তিন-চারটি লেনকে বিআরটি প্রকল্পে ‘স্পেশাল বাস’ ছাড়া অন্যান্য যানবাহনের জন্য নিষিদ্ধ জোনে পরিণত করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, ওই সব স্পেশাল বাসে কতজন মানুষ চলাচল করবে আর প্রকল্পের কারণে বাদ হয়ে যাওয়া তিন-চার লেনে এর কত গুণ মানুষ চলাচল করতে পারত! এই প্রকল্পের ব্যয় হওয়ার কথা ছিল ৪ হাজার কোটি টাকা, কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রকল্পের খরচ ১৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কার উর্বর মস্তিষ্ক থেকে বিআরটি প্রকল্পের ধারণা বেরিয়ে এসেছিল, জানি না।
একই সঙ্গে যে দুটি রেলপথ প্রকল্পের কথা উল্লেখ করা হলো, সেগুলোও অনেকখানি অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প। ওয়াকিবহাল মহল সহজেই বুঝবে যে পদ্মা সেতুর সড়কপথ চালু হওয়ার পর ওই সেতুর মাধ্যমে ঢাকা-যশোর-পায়রা পর্যন্ত নির্মীয়মাণ রেলপথের অর্থনৈতিক ‘ফিজিবিলিটি’ ভবিষ্যতে খুব বেশি আকর্ষণীয় হওয়ার তেমন সুযোগ থাকে না, কারণ রেলপথটি মালামাল পরিবহনের তুলনামূলক খরচের বিবেচনায় সড়কপথের সঙ্গে কখনোই প্রতিযোগিতামূলক বিবেচিত হবে না। ফলে ভবিষ্যতেও এ রেলপথটি ‘আন্ডার-ইউটিলাইজড’ থেকে যাবে। দিনে চার-পাঁচটি ট্রেন হয়তো চলবে এই পথে। অতএব, ওই প্রকল্পের সম্ভাব্য আয় দিয়ে ২১ হাজার কোটি টাকা চৈনিক ঋণের অর্থে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ করা অসম্ভব প্রমাণিত হবে। এমনকি, ভারতকে এই রেলপথ ব্যবহার করতে দিলেও অদূর ভবিষ্যতে প্রকল্পটি ‘সাদা হাতি’ প্রকল্পই থেকে যাবে।
একই আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে, চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেলপথ প্রকল্প নিয়ে। ‘কুনমিং ইনিশিয়েটিভ’ আঞ্চলিক সহযোগিতা কর্মসূচির অধীন ‘বিসিআইএম ইকোনমিক করিডর’ যখন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তোড়জোড় চালু ছিল, তখন বাংলাদেশকে মিয়ানমার হয়ে চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিং নগরীর সঙ্গে যুক্ত করার উদ্দেশ্যে এ রেলপথটি নির্মাণের পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু ভারতে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারত ‘বিসিআইএম ইকোনমিক করিডর’ প্রতিষ্ঠার চুক্তি থেকে সরে গেছে। অতএব, এখন রেলপথটি কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে। এই রেলপথটিও অদূর ভবিষ্যতে ‘আন্ডার-ইউটিলাইজড’ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এই রেলপথের আয় দিয়ে কখনোই এই প্রকল্পের ঋণের কিস্তি শোধ করা যাবে না। এ চারটি প্রকল্পই ‘ইকোনমিক ফিজিবিলিটি’র দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে না।
প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের পরিবর্তে যদি এহেন চটকদার ও স্বল্পপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গৃহীত হয়, তাহলে শ্রীলঙ্কার মতো ঋণগ্রস্ততার ফাঁদে বাংলাদেশও পড়তে পারে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। সরকারের কর-জিডিপির অনুপাত যেখানে ৮ শতাংশে নেমে গেছে, সেখানে ঋণ পরিশোধের জন্য দ্রুত বর্ধমান বাজেট-বরাদ্দ অশনিসংকেতের শামিল। ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের এপ্রিলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আইএমএফের বিপিএম-৬ হিসাবপদ্ধতি অনুযায়ী, ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বৈদেশিক ঋণের সুদাসল পরিশোধ খাতে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তার চেয়ে এ বছর প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বেশি খরচ হবে এ খাতে। মেগা প্রজেক্টগুলোর ঋণ পরিশোধের ‘গ্রেস-পিরিয়ড’ শেষ হলে আগামী অর্থবছরগুলোতে এ খাতে বরাদ্দ আরও অনেক দ্রুতগতিতে বাড়বে ২০৩০ সাল পর্যন্ত। একই সঙ্গে বলা প্রয়োজন, বাংলাদেশের অর্থনীতি পোশাক রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। বর্তমান অর্থবছরের রপ্তানি খাতের চলমান প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক হলেও তা অর্থনীতির চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। কারণ, রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে গেছে। এই প্রবণতাগুলো গেড়ে বসলে আমাদের অর্থনীতি মহাসংকটে পড়তে পারে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
৩ এপ্রিল পত্রপত্রিকায় দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী রূপপুরে দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণের জন্য রাশিয়ার রোসাটমের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যেখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে সরে এসে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর এহেন আসক্তি খুবই দুঃখজনক। তিনি এ ব্যাপারে বারবার বঙ্গবন্ধুর আগ্রহের কথা জানিয়ে থাকেন, কিন্তু সোলার পাওয়ারের কথা জানা থাকলে নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধু এই পরিবেশবান্ধব ও ঝুঁকিমুক্ত প্রযুক্তি গ্রহণকে অগ্রাধিকার দিতেন বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। বাংলাদেশে এক দশকে অনেক মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হয়েছে, কিংবা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে, যেগুলোর কয়েকটিকে স্বল্পপ্রয়োজনীয় অথবা অপ্রয়োজনীয় বলা চলে। চলমান প্রকল্পের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর এবং পায়রাবন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প, ঢাকা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাস্তবায়নাধীন বিআরটি প্রকল্প এবং চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প ‘সাদা হাতি’ প্রকল্পের নিকৃষ্ট উদাহরণ। রাশিয়ার ১২ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণসহ মোট ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে নির্মাণাধীন রূপপুর প্রকল্প থেকে ২০২৫ সালে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে বলে বলা হচ্ছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, রাশিয়া ভারতে ২ হাজার মেগাওয়াট ক্যাপাসিটির পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করে দিয়েছে মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে। অতএব, প্রশ্ন করা যৌক্তিক যে বাংলাদেশ কেন এত বেশি বৈদেশিক ঋণ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের জন্য চুক্তি করেছে?
বর্তমান সরকার যে জনগণের কাছে জবাবদিহির ধার ধারে না, এর উদাহরণ এই রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প। ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প প্রযুক্তি বিশ্বে রয়েছে, যেখানে রূপপুর প্রকল্পের অর্ধেক ব্যয়ে ওই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। এই মহাবিপজ্জনক পারমাণবিক প্রযুক্তি বাংলাদেশের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশের মাঝখানে স্থাপনকে আমি সমর্থন করিনি। সোলার পাওয়ার প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিলে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ব্যয় রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের মোট ব্যয়ের অর্ধেকও হতো না। অথচ, সৌরবিদ্যুৎ সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব এবং ঝুঁকিমুক্ত প্রযুক্তি। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত, এক ইউনিট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ইতিমধ্যেই গণচীন, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে বাংলাদেশি ১০ টাকার নিচে নেমে এসেছে। ১৭ নভেম্বর ২০২৩ একটি দৈনিকে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, ব্লুমবার্গের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে ২০২৫ সালের পর সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন খরচ অন্য সব বিকল্পের তুলনায় বাংলাদেশেও কমে আসবে। ২০৩০ সালে এক মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন খরচ হবে মাত্র ৪২ ডলার, যেখানে এলএনজিচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে পড়বে ৯৪ ডলার এবং কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১১৮ ডলার।
তাহলে এত ব্যয়বহুল ‘সাদা হাতি’ প্রকল্প আমরা কেন নিলাম? এই ঋণ পরিশোধে ২০ বছর সময় লাগবে বলে সরকারিভাবেই জানানো হচ্ছে, কিন্তু ২০২৫ সাল থেকে প্রতি কিস্তিতে বাংলাদেশকে সুদাসলে প্রতিবছর ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। (২০২৩ সাল থেকে রাশিয়ান ঋণের ৩৩০ মিলিয়ন ডলার সুদ পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে)। এহেন ‘সাদা হাতি’ প্রকল্পগুলো যে ইতিমধ্যেই দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধকে বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে গেছে, সেটা ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নয়। এখন যদি রূপপুর দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প গৃহীত হয়, তাহলে আরও কয়েক বিলিয়ন ডলার যুক্ত হবে দেশের বৈদেশিক ঋণে।
গাজীপুরের সাবেক মেয়র ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব জাহাঙ্গীর আলম চলমান বিআরটি প্রকল্পটি যে ৫০ বছর ধরে গাজীপুরের জনগণের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করবে, সে সত্য কথাটি উচ্চারণ করেছেন, এ জন্য তাঁকে আমি সাধুবাদ জানাচ্ছি। আসলেই এই বিআরটি প্রকল্প ঢাকা বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিস্তৃত সম্ভাব্য একটি আট লেনের মহাসড়ককে মারাত্মকভাবে পঙ্গু করে দিয়েছে, জাতি যার কুফল ভোগ করবে যুগের পর যুগ ধরে। বিমানবন্দর পর্যন্ত এয়ারপোর্ট রোডটি আট লেনের মহাসড়ক, কিন্তু এরপর বিআরটি প্রকল্পের জন্য এই সড়কের তিন থেকে চারটি লেনকে মহাসড়ক থেকে আলাদা করে ফেলা হয়েছে। আবার মাঝে মাঝে অনেক ফ্লাইওভারও নির্মাণ করা হয়েছে প্রকল্পের অধীনে। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি মহাসড়কের মাঝখানের সবচেয়ে বেশি ব্যবহারোপযোগী তিন-চারটি লেনকে বিআরটি প্রকল্পে ‘স্পেশাল বাস’ ছাড়া অন্যান্য যানবাহনের জন্য নিষিদ্ধ জোনে পরিণত করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, ওই সব স্পেশাল বাসে কতজন মানুষ চলাচল করবে আর প্রকল্পের কারণে বাদ হয়ে যাওয়া তিন-চার লেনে এর কত গুণ মানুষ চলাচল করতে পারত! এই প্রকল্পের ব্যয় হওয়ার কথা ছিল ৪ হাজার কোটি টাকা, কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রকল্পের খরচ ১৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কার উর্বর মস্তিষ্ক থেকে বিআরটি প্রকল্পের ধারণা বেরিয়ে এসেছিল, জানি না।
একই সঙ্গে যে দুটি রেলপথ প্রকল্পের কথা উল্লেখ করা হলো, সেগুলোও অনেকখানি অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প। ওয়াকিবহাল মহল সহজেই বুঝবে যে পদ্মা সেতুর সড়কপথ চালু হওয়ার পর ওই সেতুর মাধ্যমে ঢাকা-যশোর-পায়রা পর্যন্ত নির্মীয়মাণ রেলপথের অর্থনৈতিক ‘ফিজিবিলিটি’ ভবিষ্যতে খুব বেশি আকর্ষণীয় হওয়ার তেমন সুযোগ থাকে না, কারণ রেলপথটি মালামাল পরিবহনের তুলনামূলক খরচের বিবেচনায় সড়কপথের সঙ্গে কখনোই প্রতিযোগিতামূলক বিবেচিত হবে না। ফলে ভবিষ্যতেও এ রেলপথটি ‘আন্ডার-ইউটিলাইজড’ থেকে যাবে। দিনে চার-পাঁচটি ট্রেন হয়তো চলবে এই পথে। অতএব, ওই প্রকল্পের সম্ভাব্য আয় দিয়ে ২১ হাজার কোটি টাকা চৈনিক ঋণের অর্থে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ করা অসম্ভব প্রমাণিত হবে। এমনকি, ভারতকে এই রেলপথ ব্যবহার করতে দিলেও অদূর ভবিষ্যতে প্রকল্পটি ‘সাদা হাতি’ প্রকল্পই থেকে যাবে।
একই আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে, চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেলপথ প্রকল্প নিয়ে। ‘কুনমিং ইনিশিয়েটিভ’ আঞ্চলিক সহযোগিতা কর্মসূচির অধীন ‘বিসিআইএম ইকোনমিক করিডর’ যখন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তোড়জোড় চালু ছিল, তখন বাংলাদেশকে মিয়ানমার হয়ে চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিং নগরীর সঙ্গে যুক্ত করার উদ্দেশ্যে এ রেলপথটি নির্মাণের পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু ভারতে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারত ‘বিসিআইএম ইকোনমিক করিডর’ প্রতিষ্ঠার চুক্তি থেকে সরে গেছে। অতএব, এখন রেলপথটি কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে। এই রেলপথটিও অদূর ভবিষ্যতে ‘আন্ডার-ইউটিলাইজড’ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এই রেলপথের আয় দিয়ে কখনোই এই প্রকল্পের ঋণের কিস্তি শোধ করা যাবে না। এ চারটি প্রকল্পই ‘ইকোনমিক ফিজিবিলিটি’র দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে না।
প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের পরিবর্তে যদি এহেন চটকদার ও স্বল্পপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গৃহীত হয়, তাহলে শ্রীলঙ্কার মতো ঋণগ্রস্ততার ফাঁদে বাংলাদেশও পড়তে পারে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। সরকারের কর-জিডিপির অনুপাত যেখানে ৮ শতাংশে নেমে গেছে, সেখানে ঋণ পরিশোধের জন্য দ্রুত বর্ধমান বাজেট-বরাদ্দ অশনিসংকেতের শামিল। ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের এপ্রিলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আইএমএফের বিপিএম-৬ হিসাবপদ্ধতি অনুযায়ী, ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বৈদেশিক ঋণের সুদাসল পরিশোধ খাতে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তার চেয়ে এ বছর প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বেশি খরচ হবে এ খাতে। মেগা প্রজেক্টগুলোর ঋণ পরিশোধের ‘গ্রেস-পিরিয়ড’ শেষ হলে আগামী অর্থবছরগুলোতে এ খাতে বরাদ্দ আরও অনেক দ্রুতগতিতে বাড়বে ২০৩০ সাল পর্যন্ত। একই সঙ্গে বলা প্রয়োজন, বাংলাদেশের অর্থনীতি পোশাক রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। বর্তমান অর্থবছরের রপ্তানি খাতের চলমান প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক হলেও তা অর্থনীতির চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। কারণ, রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে গেছে। এই প্রবণতাগুলো গেড়ে বসলে আমাদের অর্থনীতি মহাসংকটে পড়তে পারে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে