শাইখ সিরাজ
পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে জনবহুল দেশ বাংলাদেশ। আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা এত বেশি যে ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য, তাদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা এবং সুপেয় পানির চিন্তা সারাক্ষণই উদ্বিগ্ন করছে নীতিনির্ধারকদের। কৃষিনির্ভর ও নদীমাতৃক এই বাংলাদেশে সময়ের প্রয়োজনেই বিকাশ লাভ করছে শিল্প।
আর তৈরি পোশাকশিল্প আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও কর্মসংস্থানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প খাত, এতে সন্দেহ নেই। এই পোশাকশিল্পের সঙ্গেই যুক্ত রয়েছে আরও একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। যেমন ডাইং কারখানা, কম্পোজিট কারখানা, স্পিনিং মিল ইত্যাদি ইত্যাদি। পোশাকশিল্প বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই এর সঙ্গে সম্পর্কিত ও সম্পর্কের বাইরে বহু ছোট, বড় ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এ দেশের বহু মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করছে। একেকটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ও পশ্চাৎপদ এলাকাকে অগ্রসর করে তুলছে।
আমাদের দেশে প্রচুর পরিত্যক্ত ও শিল্প স্থাপন উপযোগী বিশেষায়িত কোনো ভূমি নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে নদীর পাড়ে, সেখানেই বসতিরও আধিক্য ঘটছে। একেকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ঘিরে একে একে বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তিন ফসলি কৃষিজমি, মানুষের ঘরবাড়ি—সবই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে গিয়ে ঢুকেছে।
এতে মানুষ প্রাথমিকভাবে দারুণ উপকৃত হয়েছে। কারণ তার আবাদি জমিটি সে বেশি দামে বিক্রি করতে পেরেছে। উপরন্তু সে তার পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বদৌলতে এভাবে বদলে গেছে ছোট্ট দেশটির অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদ।
বহু মানুষ শিল্প বিকাশের সুবাতাসে বাপ-দাদার পুরোনো পেশা হালচাষ ছেড়ে একজন বেতনধারী শ্রমজীবী হতে পেরেছেন। ঘরে-বাইরে কিছু পরিবর্তনও আনতে পেরেছেন। আর শিল্পের কল্যাণে বদলে যাওয়া মানুষের স্বস্তির নিশ্বাস গিয়ে পড়েছে শিল্পমালিকদের মাঝে, যা তাঁদের কল্যাণকেও বোধ করি ত্বরান্বিত করেছে।
এখন দেশের অনেক এলাকা শিল্পপ্রধান অঞ্চল হিসেবে প্রসিদ্ধি পেয়ে গেছে। সেখানে শিল্প বিকশিত হয়েই চলেছে, যা গোটা দেশবাসীকেই উৎফুল্ল করার কথা। কিন্তু সেই উৎফুল্ল হওয়ার দিন যেন শেষ হয়ে এসেছে। গত ১০ বছরে পরিকল্পনার অভাবে এখন শিল্প বিকশিত এলাকাগুলোকে পরিণত করেছে বিষাক্ত এক অঞ্চলে। যেখানকার মাটি, পানি, বাতাস সবই দূষিত। সবই মারাত্মক বিষক্রিয়ার শিকার।
ঢাকা থেকে কোন দিকে যাবেন আপনি? টঙ্গী হয়ে গাজীপুর-টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ অথবা নারায়ণগঞ্জ-মুন্সিগঞ্জ-নরসিংদী—যেদিকেই যান না কেন, যান্ত্রিক এই নগরী ছেড়ে আপনাকে পাড়ি দিতে হবে শিল্পবর্জ্যের বিশাল এক ভাগাড়। বুড়িগঙ্গা কিংবা তুরাগের পানি বহু আগেই পরিণত হয়েছে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থে। মিলিয়ন, বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন লিটার বর্জ্য প্রতিদিন হজম করছে এই নদের পানি। যার প্রবাহ ছড়িয়ে যাচ্ছে মেঘনা-ব্রহ্মপুত্রেও।
প্রতিদিন লাখ লাখ লিটার তরল বর্জ্য পড়ছে তুরাগে। তুরাগের বুকে এখনো বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী ও যাত্রীবাহী নৌকা চলাচল করে। এসব নৌকায় দূর-দূরান্তের তুরাগপারের মানুষ যাতায়াত করে। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, তুরাগের পাড়েই এখন আর দুর্গন্ধে দাঁড়ানো যায় না।
নৌকায় বসে থাকা খুবই কঠিন। ভুরভুর দুর্গন্ধ ছড়ায় পানি থেকে। পানির মধ্যে নৌকার বইঠা দিয়ে খোঁচা দিলে বোঝা যায় কী পরিমাণ বিষ এই পানিতে। রীতিমতো গ্যাস উঠতে থাকে, যা নাক-তালু জ্বালিয়ে দেয়। তুরাগপারের মানুষেরা এই অবস্থার মধ্যেই বেঁচে আছে। এই পানি দিয়েই তাঁরা কৃষিকাজ করছেন। বছরখানেক আগে তুরাগপারের পাগারের খ্রিষ্টানপাড়ায় গিয়ে রীতিমতো আঁতকে উঠেছিলাম। তুরাগের পানি শ্যালো মেশিন দিয়ে তুলে শাকসবজির খেতে দেওয়া হচ্ছে।
খেতেই ছড়িয়ে পড়ছে গন্ধ। দুর্গন্ধময় ওই তরলকে আসলে পানি বলা যায় না। পানির মধ্যে যে প্রাকৃতিক উপাদান থাকার কথা তা তো নেই-ই; বরং তার বদলে রয়েছে ভয়ানক ও ক্ষতিকর উপাদান। তুরাগের ওই পানিতে মাছ দূরের কথা, কোনো পানিপোকাও নেই। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ এতই কম যে এর ভেতরে কোনোভাবেই কোনো প্রাণী বাঁচতে পারছে না। তা ছাড়া, এই পানিতে রয়েছে ক্যাডমিয়াম, সিসাসহ বিভিন্ন ধাতব ও রাসায়নিক পদার্থের সাংঘাতিক রকমের উচ্চমাত্রা, যা মাটি, পানি, বাতাস সবকিছুর জন্যই ক্ষতিকর। মানবদেহের জন্য তো বটেই।
এমন শিল্পবর্জ্যের বিষে দেশের যে অঞ্চলগুলোর কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ থেকে শুরু করে সব ধরনের জীববৈচিত্র্য চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে, এর মধ্যে গাজীপুর রয়েছে এক নম্বরে। এই জেলার শিল্পকারখানার সংখ্যা সঠিক করে জানা নেই কারও। এর মধ্যে ডাইং কারখানাই রয়েছে কয়েক শ।
একটি কারখানা প্রতিদিন ১০ লাখ লিটার হিসাবে মাসে ৩ কোটি লিটার বর্জ্য ঢালছে নদী, খাল, নালায়; যা মাটির ওপরে জমতে জমতে তৈরি হচ্ছে কয়েক ফুটের এক ভয়াবহ আস্তরণ। যেন কৃষিজমি ঢাকা পড়ে যাচ্ছে সর্বনাশের কালো চাদরে। টঙ্গীর বিভিন্ন এলাকায় কঠিন বর্জ্যের আস্তরণ দেখে আতঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। গোটা শ্রীপুর, টঙ্গীসহ গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় বর্জ্যের খনির অভাব নেই। প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে এমন অভিশাপের ক্ষেত্র।
কয়েক বছর ধরে কৃষি ও কৃষকের এই মৃত্যুফাঁদ তৈরি হয়েছে গাজীপুরের চার উপজেলার ৪০টি কৃষি ব্লকেই। এমনই তথ্য দিয়েছিলেন গাজীপুর মহিলা কলেজের শিক্ষক ও গবেষক ড. ফরিদ আহমেদ। তিনি বলেছিলেন, ‘গাজীপুরের সব এলাকার মাটি, পানি সবই ভয়ানকভাবে দূষিত। একসময় ধানসহ সব ফসল উৎপাদন ও প্রাকৃতিক মাছের খনি ছিল গাজীপুরের বাইদ এলাকা। অথচ দিনের পর দিন ধরে কৃষি আর এই এলাকায় অবশিষ্ট নেই। এখান থেকে কৃষি বিদায় নিয়েছে। কোনো নদী-নালা জলাশয়েই আর প্রাকৃতিক মাছ নেই।
স্থানীয় পুকুরের মাছও মরে যাচ্ছে বিষক্রিয়ায়। সে সময় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ড. হাবিব মোহাম্মদ নাসেরসহ আরও কয়েকজন বিজ্ঞানী শিল্পবর্জ্য এলাকার মাটির হেভি মেটাল পরীক্ষা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, শিল্প এলাকা শুধু নয়, এর আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকার মাটি ভয়াবহভাবে আক্রান্ত বিভিন্ন হেভি মেটালে।
ওই মাটিতে উৎপাদিত যেকোনো ফসল জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। মাটিতে হেভি মেটালের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এ শুধু মুখের কথা নয়; এর বাস্তবতা এতই ভয়াবহ যে এই মাটি এখন কঠিন বিষে আক্রান্ত। বিষয়টি আরও খোলাসা করার স্বার্থেই সে সময় একটি পানির বোতলে পুরে আনি কিছু পরিমাণ কালো বর্জ্যের মাটি।
পাশেই বর্জ্যের একটি খেতে ধান কাটা হচ্ছিল। জমির মালিক বললেন, আগে যে তিন একর জমি থেকে ১৩০ থেকে ১৩৫ মণ ধান পাওয়া যেত। গত বছর সেই জমি থেকে পাওয়া গেছে মাত্র ৫৪ কেজি ধান। আর ধান ভাগের পর ঘরে তোলা গেছে মাত্র ১৮ কেজি। এবার হবে তার চেয়েও কম। দেখলাম, ওই জমিসংলগ্ন মোটা নালা দিয়ে যাচ্ছে গাঢ় রঙের বর্জ্যমিশ্রিত দুর্গন্ধ পানি। পাঁচ-ছয়জন কৃষক কোমরসমান বর্জ্যে নেমে কাটছেন ধান।
কাঁচি দিয়ে শরীর চুলকাচ্ছেন। দ্রুত ধান কেটে ওপরে ওঠার পর শ্রমিকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পায়ে কেরোসিন মাখতে। জমির মালিকেরা বললেন, এমন বর্জ্যের ভেতর ধান রোপণ কিংবা কাটতে কোনো শ্রমিকই পাওয়া যায় না। যা-ও পাওয়া যায়, তার মজুরি অনেক বেশি।
কৃষি শ্রমিকেরা বললেন, এই পাগারে ধান কাটতে নামা মানে ছয় মাসের জন্য চুলকানি বাঁধানো। ধান কেটে উঠেই তাঁরা দেখালেন শরীরে নানা রকমের জীবাণুর আক্রমণ। আমরা ওই বর্জ্যের ভেতর উৎপাদিত ধানও সংগ্রহ করলাম। তারপর ওই বর্জ্য মাটি পরীক্ষার জন্য দিই মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে আর ধান দিলাম বাংলাদেশ সায়েন্স ল্যাবরেটরি বা বিসিএসআইআরে।
দুদিন বাদেই পেলাম ভয়াবহ সেই রিপোর্ট। মাটি ও ধান পরীক্ষার ফলাফল একেবারে সুনির্দিষ্ট করেই বলে দিল কী আছে ওই মাটিতে, আর ধানেই বা আছে কী? মাটি পরীক্ষার ফলাফল জানিয়েছিলেন মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. নাজমুল হাসান। মাটির মধ্যকার ছয় রকমের ভারী ধাতব পদার্থ (বা হেভি মেটাল) পরীক্ষা করে তিনি জানালেন, ওই এলাকার মাটি যা হারিয়েছে আর ধারণ করেছে তা থেকে সুস্থ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
অপরিশোধিত শিল্পবর্জ্য নিষ্কাশন বন্ধ করা না গেলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এসব হেভি মেটালের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে।
মানুষ জেনে না-জেনে আক্রান্ত হচ্ছে নানা রোগব্যাধিতে। সায়েন্স ল্যাবরেটরির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. ইমামুল হক বলেছিলেন, বর্জ্য মাটিতে উৎপাদিত ধানের খোসা ও খড় গবাদিপশুর জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। বিজ্ঞানীদের এ কথার প্রমাণও আমি হাতে হাতে পেয়েছি গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে। গোয়ালের গরু মারা গেছে—এমন অনেক কৃষকের সঙ্গেও কথা হয়েছে। আবার ধানের খড় কিংবা বর্জ্য মাটিতে উৎপাদিত ঘাস খেয়ে নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছে—এমন গবাদিপশুও দেখেছি।
সত্যিই প্রশ্ন জাগে, কোথায় আছি আমরা? আমরা নিজেরাই নিজেদের বাসযোগ্য পরিবেশকে করে তুলেছি বসবাসের অযোগ্য। চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছি বিষ। এই একবিংশ শতকের বাংলাদেশে আমরা অনেক রকম উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছি, কিন্তু আজকের এই মানুষসৃষ্ট বিপর্যয় আমাদের সত্যিই আতঙ্কিত করে তুলছে। আমাদের অবশ্যই শিল্পোন্নয়ন প্রয়োজন, কিন্তু সে ক্ষেত্রে যে অনিয়ম, পরিকল্পনার অভাব ও উদাসীনতা জমা হয়েছে, এরই ফলাফল আজকের এই ভয়াবহ প্রেক্ষাপট।
একইভাবে দূষণের শিকার বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এবং কার্পজাতীয় মাছের প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য হালদা নদীও। ভয়াবহ দূষণের কারণে নরসিংদী এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদ এখন ভরাট হয়ে যাওয়া বর্জ্যের এক ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। সব মিলিয়ে শিল্পবর্জ্য আমাদের পানি, মাটি ও বাতাসকে যেভাবে দূষিত করে চলেছে, তা এখনই এবং এই মুহূর্তে বন্ধ হওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে যেমন সরকারি কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন, একইভাবে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই
পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে জনবহুল দেশ বাংলাদেশ। আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা এত বেশি যে ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য, তাদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা এবং সুপেয় পানির চিন্তা সারাক্ষণই উদ্বিগ্ন করছে নীতিনির্ধারকদের। কৃষিনির্ভর ও নদীমাতৃক এই বাংলাদেশে সময়ের প্রয়োজনেই বিকাশ লাভ করছে শিল্প।
আর তৈরি পোশাকশিল্প আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও কর্মসংস্থানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প খাত, এতে সন্দেহ নেই। এই পোশাকশিল্পের সঙ্গেই যুক্ত রয়েছে আরও একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। যেমন ডাইং কারখানা, কম্পোজিট কারখানা, স্পিনিং মিল ইত্যাদি ইত্যাদি। পোশাকশিল্প বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই এর সঙ্গে সম্পর্কিত ও সম্পর্কের বাইরে বহু ছোট, বড় ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এ দেশের বহু মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করছে। একেকটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ও পশ্চাৎপদ এলাকাকে অগ্রসর করে তুলছে।
আমাদের দেশে প্রচুর পরিত্যক্ত ও শিল্প স্থাপন উপযোগী বিশেষায়িত কোনো ভূমি নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে নদীর পাড়ে, সেখানেই বসতিরও আধিক্য ঘটছে। একেকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ঘিরে একে একে বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তিন ফসলি কৃষিজমি, মানুষের ঘরবাড়ি—সবই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে গিয়ে ঢুকেছে।
এতে মানুষ প্রাথমিকভাবে দারুণ উপকৃত হয়েছে। কারণ তার আবাদি জমিটি সে বেশি দামে বিক্রি করতে পেরেছে। উপরন্তু সে তার পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বদৌলতে এভাবে বদলে গেছে ছোট্ট দেশটির অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদ।
বহু মানুষ শিল্প বিকাশের সুবাতাসে বাপ-দাদার পুরোনো পেশা হালচাষ ছেড়ে একজন বেতনধারী শ্রমজীবী হতে পেরেছেন। ঘরে-বাইরে কিছু পরিবর্তনও আনতে পেরেছেন। আর শিল্পের কল্যাণে বদলে যাওয়া মানুষের স্বস্তির নিশ্বাস গিয়ে পড়েছে শিল্পমালিকদের মাঝে, যা তাঁদের কল্যাণকেও বোধ করি ত্বরান্বিত করেছে।
এখন দেশের অনেক এলাকা শিল্পপ্রধান অঞ্চল হিসেবে প্রসিদ্ধি পেয়ে গেছে। সেখানে শিল্প বিকশিত হয়েই চলেছে, যা গোটা দেশবাসীকেই উৎফুল্ল করার কথা। কিন্তু সেই উৎফুল্ল হওয়ার দিন যেন শেষ হয়ে এসেছে। গত ১০ বছরে পরিকল্পনার অভাবে এখন শিল্প বিকশিত এলাকাগুলোকে পরিণত করেছে বিষাক্ত এক অঞ্চলে। যেখানকার মাটি, পানি, বাতাস সবই দূষিত। সবই মারাত্মক বিষক্রিয়ার শিকার।
ঢাকা থেকে কোন দিকে যাবেন আপনি? টঙ্গী হয়ে গাজীপুর-টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ অথবা নারায়ণগঞ্জ-মুন্সিগঞ্জ-নরসিংদী—যেদিকেই যান না কেন, যান্ত্রিক এই নগরী ছেড়ে আপনাকে পাড়ি দিতে হবে শিল্পবর্জ্যের বিশাল এক ভাগাড়। বুড়িগঙ্গা কিংবা তুরাগের পানি বহু আগেই পরিণত হয়েছে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থে। মিলিয়ন, বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন লিটার বর্জ্য প্রতিদিন হজম করছে এই নদের পানি। যার প্রবাহ ছড়িয়ে যাচ্ছে মেঘনা-ব্রহ্মপুত্রেও।
প্রতিদিন লাখ লাখ লিটার তরল বর্জ্য পড়ছে তুরাগে। তুরাগের বুকে এখনো বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী ও যাত্রীবাহী নৌকা চলাচল করে। এসব নৌকায় দূর-দূরান্তের তুরাগপারের মানুষ যাতায়াত করে। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, তুরাগের পাড়েই এখন আর দুর্গন্ধে দাঁড়ানো যায় না।
নৌকায় বসে থাকা খুবই কঠিন। ভুরভুর দুর্গন্ধ ছড়ায় পানি থেকে। পানির মধ্যে নৌকার বইঠা দিয়ে খোঁচা দিলে বোঝা যায় কী পরিমাণ বিষ এই পানিতে। রীতিমতো গ্যাস উঠতে থাকে, যা নাক-তালু জ্বালিয়ে দেয়। তুরাগপারের মানুষেরা এই অবস্থার মধ্যেই বেঁচে আছে। এই পানি দিয়েই তাঁরা কৃষিকাজ করছেন। বছরখানেক আগে তুরাগপারের পাগারের খ্রিষ্টানপাড়ায় গিয়ে রীতিমতো আঁতকে উঠেছিলাম। তুরাগের পানি শ্যালো মেশিন দিয়ে তুলে শাকসবজির খেতে দেওয়া হচ্ছে।
খেতেই ছড়িয়ে পড়ছে গন্ধ। দুর্গন্ধময় ওই তরলকে আসলে পানি বলা যায় না। পানির মধ্যে যে প্রাকৃতিক উপাদান থাকার কথা তা তো নেই-ই; বরং তার বদলে রয়েছে ভয়ানক ও ক্ষতিকর উপাদান। তুরাগের ওই পানিতে মাছ দূরের কথা, কোনো পানিপোকাও নেই। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ এতই কম যে এর ভেতরে কোনোভাবেই কোনো প্রাণী বাঁচতে পারছে না। তা ছাড়া, এই পানিতে রয়েছে ক্যাডমিয়াম, সিসাসহ বিভিন্ন ধাতব ও রাসায়নিক পদার্থের সাংঘাতিক রকমের উচ্চমাত্রা, যা মাটি, পানি, বাতাস সবকিছুর জন্যই ক্ষতিকর। মানবদেহের জন্য তো বটেই।
এমন শিল্পবর্জ্যের বিষে দেশের যে অঞ্চলগুলোর কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ থেকে শুরু করে সব ধরনের জীববৈচিত্র্য চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে, এর মধ্যে গাজীপুর রয়েছে এক নম্বরে। এই জেলার শিল্পকারখানার সংখ্যা সঠিক করে জানা নেই কারও। এর মধ্যে ডাইং কারখানাই রয়েছে কয়েক শ।
একটি কারখানা প্রতিদিন ১০ লাখ লিটার হিসাবে মাসে ৩ কোটি লিটার বর্জ্য ঢালছে নদী, খাল, নালায়; যা মাটির ওপরে জমতে জমতে তৈরি হচ্ছে কয়েক ফুটের এক ভয়াবহ আস্তরণ। যেন কৃষিজমি ঢাকা পড়ে যাচ্ছে সর্বনাশের কালো চাদরে। টঙ্গীর বিভিন্ন এলাকায় কঠিন বর্জ্যের আস্তরণ দেখে আতঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। গোটা শ্রীপুর, টঙ্গীসহ গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় বর্জ্যের খনির অভাব নেই। প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে এমন অভিশাপের ক্ষেত্র।
কয়েক বছর ধরে কৃষি ও কৃষকের এই মৃত্যুফাঁদ তৈরি হয়েছে গাজীপুরের চার উপজেলার ৪০টি কৃষি ব্লকেই। এমনই তথ্য দিয়েছিলেন গাজীপুর মহিলা কলেজের শিক্ষক ও গবেষক ড. ফরিদ আহমেদ। তিনি বলেছিলেন, ‘গাজীপুরের সব এলাকার মাটি, পানি সবই ভয়ানকভাবে দূষিত। একসময় ধানসহ সব ফসল উৎপাদন ও প্রাকৃতিক মাছের খনি ছিল গাজীপুরের বাইদ এলাকা। অথচ দিনের পর দিন ধরে কৃষি আর এই এলাকায় অবশিষ্ট নেই। এখান থেকে কৃষি বিদায় নিয়েছে। কোনো নদী-নালা জলাশয়েই আর প্রাকৃতিক মাছ নেই।
স্থানীয় পুকুরের মাছও মরে যাচ্ছে বিষক্রিয়ায়। সে সময় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ড. হাবিব মোহাম্মদ নাসেরসহ আরও কয়েকজন বিজ্ঞানী শিল্পবর্জ্য এলাকার মাটির হেভি মেটাল পরীক্ষা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, শিল্প এলাকা শুধু নয়, এর আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকার মাটি ভয়াবহভাবে আক্রান্ত বিভিন্ন হেভি মেটালে।
ওই মাটিতে উৎপাদিত যেকোনো ফসল জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। মাটিতে হেভি মেটালের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এ শুধু মুখের কথা নয়; এর বাস্তবতা এতই ভয়াবহ যে এই মাটি এখন কঠিন বিষে আক্রান্ত। বিষয়টি আরও খোলাসা করার স্বার্থেই সে সময় একটি পানির বোতলে পুরে আনি কিছু পরিমাণ কালো বর্জ্যের মাটি।
পাশেই বর্জ্যের একটি খেতে ধান কাটা হচ্ছিল। জমির মালিক বললেন, আগে যে তিন একর জমি থেকে ১৩০ থেকে ১৩৫ মণ ধান পাওয়া যেত। গত বছর সেই জমি থেকে পাওয়া গেছে মাত্র ৫৪ কেজি ধান। আর ধান ভাগের পর ঘরে তোলা গেছে মাত্র ১৮ কেজি। এবার হবে তার চেয়েও কম। দেখলাম, ওই জমিসংলগ্ন মোটা নালা দিয়ে যাচ্ছে গাঢ় রঙের বর্জ্যমিশ্রিত দুর্গন্ধ পানি। পাঁচ-ছয়জন কৃষক কোমরসমান বর্জ্যে নেমে কাটছেন ধান।
কাঁচি দিয়ে শরীর চুলকাচ্ছেন। দ্রুত ধান কেটে ওপরে ওঠার পর শ্রমিকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পায়ে কেরোসিন মাখতে। জমির মালিকেরা বললেন, এমন বর্জ্যের ভেতর ধান রোপণ কিংবা কাটতে কোনো শ্রমিকই পাওয়া যায় না। যা-ও পাওয়া যায়, তার মজুরি অনেক বেশি।
কৃষি শ্রমিকেরা বললেন, এই পাগারে ধান কাটতে নামা মানে ছয় মাসের জন্য চুলকানি বাঁধানো। ধান কেটে উঠেই তাঁরা দেখালেন শরীরে নানা রকমের জীবাণুর আক্রমণ। আমরা ওই বর্জ্যের ভেতর উৎপাদিত ধানও সংগ্রহ করলাম। তারপর ওই বর্জ্য মাটি পরীক্ষার জন্য দিই মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে আর ধান দিলাম বাংলাদেশ সায়েন্স ল্যাবরেটরি বা বিসিএসআইআরে।
দুদিন বাদেই পেলাম ভয়াবহ সেই রিপোর্ট। মাটি ও ধান পরীক্ষার ফলাফল একেবারে সুনির্দিষ্ট করেই বলে দিল কী আছে ওই মাটিতে, আর ধানেই বা আছে কী? মাটি পরীক্ষার ফলাফল জানিয়েছিলেন মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. নাজমুল হাসান। মাটির মধ্যকার ছয় রকমের ভারী ধাতব পদার্থ (বা হেভি মেটাল) পরীক্ষা করে তিনি জানালেন, ওই এলাকার মাটি যা হারিয়েছে আর ধারণ করেছে তা থেকে সুস্থ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
অপরিশোধিত শিল্পবর্জ্য নিষ্কাশন বন্ধ করা না গেলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এসব হেভি মেটালের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে।
মানুষ জেনে না-জেনে আক্রান্ত হচ্ছে নানা রোগব্যাধিতে। সায়েন্স ল্যাবরেটরির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. ইমামুল হক বলেছিলেন, বর্জ্য মাটিতে উৎপাদিত ধানের খোসা ও খড় গবাদিপশুর জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। বিজ্ঞানীদের এ কথার প্রমাণও আমি হাতে হাতে পেয়েছি গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে। গোয়ালের গরু মারা গেছে—এমন অনেক কৃষকের সঙ্গেও কথা হয়েছে। আবার ধানের খড় কিংবা বর্জ্য মাটিতে উৎপাদিত ঘাস খেয়ে নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছে—এমন গবাদিপশুও দেখেছি।
সত্যিই প্রশ্ন জাগে, কোথায় আছি আমরা? আমরা নিজেরাই নিজেদের বাসযোগ্য পরিবেশকে করে তুলেছি বসবাসের অযোগ্য। চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছি বিষ। এই একবিংশ শতকের বাংলাদেশে আমরা অনেক রকম উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছি, কিন্তু আজকের এই মানুষসৃষ্ট বিপর্যয় আমাদের সত্যিই আতঙ্কিত করে তুলছে। আমাদের অবশ্যই শিল্পোন্নয়ন প্রয়োজন, কিন্তু সে ক্ষেত্রে যে অনিয়ম, পরিকল্পনার অভাব ও উদাসীনতা জমা হয়েছে, এরই ফলাফল আজকের এই ভয়াবহ প্রেক্ষাপট।
একইভাবে দূষণের শিকার বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এবং কার্পজাতীয় মাছের প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য হালদা নদীও। ভয়াবহ দূষণের কারণে নরসিংদী এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদ এখন ভরাট হয়ে যাওয়া বর্জ্যের এক ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। সব মিলিয়ে শিল্পবর্জ্য আমাদের পানি, মাটি ও বাতাসকে যেভাবে দূষিত করে চলেছে, তা এখনই এবং এই মুহূর্তে বন্ধ হওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে যেমন সরকারি কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন, একইভাবে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে