মযহারুল ইসলাম বাবলা
আমাদের দেশে জ্ঞানী-পণ্ডিতের সংখ্যা নিতান্ত স্বল্প না হলেও, সমাজে জ্ঞানীর পাশাপাশি বিবেকবান, নীতিনিষ্ঠ পণ্ডিতজনের বড়ই অভাব। হাতে গোনা যে দু-চারজন আছেন, তাঁদেরই একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় আহমদ রফিক। যিনি আমাদের ক্ষমতার রাজনীতির কেনা-বেচার হাটে পার্থিব লোভ-লালসায় নিজেকে কখনো বিকিয়ে দেননি।
বিপরীতে আমাদের শাসকগোষ্ঠীর অগণতান্ত্রিক-স্বেচ্ছাচারী এবং ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বরাবর সোচ্চার থেকেছেন। জনগণের কাতারে এসে শামিল হয়েছেন প্রতিবাদে। আহমদ রফিক—যিনি কারও রফিক স্যার, কারও রফিক ভাই; যাঁকে আমরা জাতীয় নানা দুঃসময়ে কাছে পাই। যিনি মতাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অটল থাকতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেন।
তখন দেশভাগের অন্তিম সময়। দেশভাগ ও বাংলাভাগ প্রায় চূড়ান্ত। বাংলাভাগে উত্তাল পূর্ব বাংলার সব অঞ্চল-জনপদ। গ্রামের যুবকেরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে মিছিল, সভা-সমাবেশ করে মুসলমানের পৃথক রাষ্ট্রের যৌক্তিকতা তুলে ধরে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছেন।
স্লোগানে-স্লোগানে মুখর ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আনন্দ-উল্লাস ধ্বনি চারদিকে। তখন যুবক আহমদ রফিককে দেশভাগ-পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা মোটেও উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। সেই জনস্রোতের ভাবনার বিপরীত ভাবনাই তাঁকে ঘিরে ধরেছিল। সেই ভাবনার কেন্দ্রে ছিল মর্মান্তিক বাংলাভাগের অশুভ পরিণতির উপলব্ধি। দেশভাগে উচ্ছেদ, বিচ্ছেদ এবং উৎপাটনের শঙ্কায় তিনি উদ্বিগ্ন। পরিণতি আঁচ করতে পেরে শঙ্কিত। তিনি দেশভাগের উন্মাদনার কালেই দেশভাগ মেনে নিতে পারেননি। ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মতো তাঁর সেই চেতনা কতটা বাস্তবসম্মত ছিল, বাস্তবে সেটা ক্রমেই প্রকাশ পেয়েছে। পরিণত বয়সে তিনি নানা মাত্রার গবেষণার ফাঁকে লিখেছেন অসামান্য গ্রন্থ ‘দেশবিভাগ: ফিরে দেখা’। তাঁর চিন্তার অগ্রসরতা নানাভাবে, নানা ক্ষেত্রে প্রকাশ পেয়েছে। সনাতনী ধ্যানধারণার বিপরীতে তাঁর জনমুক্তির ভাবনা একইভাবে আমরা দেখে আসছি।
রফিক ভাই ছাত্র হিসেবে ছিলেন খুবই মেধাবী। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে মেধাতালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সংগত কারণে পরিবারের ইচ্ছায় তাঁকে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হতে হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র আহমদ রফিক জড়িয়ে পড়েন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। ভাষা আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরূপে তিনি মেডিকেল কলেজের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ও নেতৃত্বে ছিলেন এবং ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ যুক্ততার কারণে ভাষা মতিনকে বন্দী করা হয় এবং মেডিকেল কলেজের ছাত্র আহমদ রফিকের ওপর হুলিয়া জারি হলে বাধ্য হয়ে তাঁকে আত্মগোপনে যেতে হয়। প্রায় দুই বছর ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পুলিশি নজর এড়িয়ে গোপনে বসবাস করেন। সেই সময়ে চরম আর্থিক অনটনে খেয়ে-না খেয়ে জীবন কাটাতে হয়েছে। যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেও ছাত্রত্ব ফিরে পাননি। ওদিকে পরিবারের মেধাবী ছেলেটি আর ডাক্তার হতে পারল না—এমন শঙ্কায় পরিবারটির মধ্যেও তীব্র হতাশা নেমে আসে। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে হুলিয়া প্রত্যাহারের পর আবার তিনি মেডিকেল কলেজের ছাত্রত্ব ফিরে পান এবং ইচ্ছাশক্তির কঠিন দৃঢ়তায় এমবিবিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। লক্ষ্য বাস্তবায়নে তাঁর একরোখা একাগ্রতাই এতে প্রমাণ করেছে।
ডাক্তার হয়েও ডাক্তারি পেশায় তিনি যুক্ত হননি। করেননি সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগের চাকরি এবং প্রাইভেট প্র্যাকটিস। ওষুধশিল্পের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। পরে কজন মিলে ওষুধশিল্পও গড়ে তোলেন। কিন্তু সেখানে অংশীদারদের সঙ্গে নীতিগত বিরোধের কারণে শূন্য হাতে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন।
সম্পূর্ণ ভিন্নতর পেশায় থেকেও তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি, গবেষণা এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন থাকেননি। নাগরিক নামের পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন অনেককাল। ভাষা আন্দোলন নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং নানামুখী গবেষণামূলক রচনা লিখেছেন। লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ-গবেষণা গ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর গবেষণা গ্রন্থগুলো কেবল দেশে নয়, ভারতেও সমান জনপ্রিয়।
ভারতের টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট তাঁকে রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য উপাধি দিয়েছে। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে রবীন্দ্রজীবনীর একটি খণ্ড তিনি লিখেছেন। লেখক-গবেষক হিসেবে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, রাষ্ট্রীয় একুশে পদকসহ অসংখ্য পদক-সম্মাননা তিনি পেয়েছেন।
কিশোর বয়সেই তাঁর চিন্তা-মনন ও দৃষ্টিভঙ্গির উজ্জ্বল চেতনা গড়ে উঠেছিল। সমাজের ধনবৈষম্য, শ্রেণি বিভক্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনাচার এসব দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন বটে, তবে হতাশাগ্রস্ত হননি; বরং অনাচারী-ব্যবস্থা থেকে মুক্তির উপায়টি তিনি সঠিকভাবে বুঝতে পেরে ক্রমেই মার্ক্সবাদী হয়ে ওঠেন। যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। পার্টির সদস্যপদও লাভ করেন। কিন্তু অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির ওপর ক্রুশ্চেভের সংশোধনবাদী সোভিয়েত ইউনিয়নের মাত্রাতিরিক্ত খবরদারি-হস্তক্ষেপ তিনি মেনে নিতে পারেননি। আমাদের পরিপ্রেক্ষিতকে এড়িয়ে আন্দোলনে সোভিয়েত নির্দেশ পালনে এবং কমিউনিস্ট পার্টির স্বাতন্ত্র্য ক্রমাগত ক্ষুণ্ন হওয়ার কারণে তিনি পার্টি ত্যাগে বাধ্য হন। তবে পার্টি ত্যাগ করলেও বিলোপবাদী হননি। আজীবন মার্ক্সীয় মতাদর্শকে বহন করে চলেছেন। যার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর লেখায় এবং বহুবিধ কর্মকাণ্ডে।
কর্মজীবনের ব্যস্ততা-সীমাবদ্ধতা এমনকি পারিবারিক সীমা পর্যন্ত অতিক্রম করে তিনি মার্ক্সবাদী চেতনায় অবিচল থাকার দৃষ্টান্ত রেখে এসেছেন। নিয়মিত গবেষণা ও জ্ঞান বিতরণে আমাদের ঋদ্ধ করে যাচ্ছেন। তাঁর জ্ঞান বিতরণের মাধ্যম হচ্ছে লেখালেখি, যেটি এখনো অবিরাম সচল রেখেছেন। সময় অপচয় না করে প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগিয়ে নিজে যেমন আলোকিত হয়েছেন, তেমনি সেই আলো ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছেন সমাজে। এমন অসামান্য মানুষ আমাদের সমাজে সত্যিই বিরল।
তরুণদের প্রতি তাঁর যেমন ভালোবাসা, তেমনি আকর্ষণও। তরুণদের প্রতিই সর্বাধিক আস্থা-ভরসা রাখেন। তরুণেরাই সমষ্টিগত মুক্তির অধরাকে ধরায় পরিণত করতে পারবে বলে তিনি মনে করেন। তরুণদের সঙ্গে তাঁর নৈকট্য সর্বাধিক। সময় সচেতনতায় অসামান্য দৃষ্টান্ত রফিক ভাই। ঘড়ির কাঁটা ধরে চলেন। সময়জ্ঞানের শিক্ষাটা তরুণদের দিতে ভোলেন না। ব্যতিক্রম হলে কাউকে ছাড়ও তিনি দেন না। রফিক ভাইয়ের সঙ্গে সময় নিয়ে আমরা বরাবরই শঙ্কায় থাকি। সময়ের হেরফেরে স্নেহপূর্ণ তিরস্কার শুনতে হয়।
রফিক ভাই কোনো মার্ক্সবাদী দলভুক্ত না হয়েও আজীবন মার্ক্সবাদী চর্চার মধ্যেই জীবন কাটিয়ে এসেছেন।তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল একজন মানুষ। যেমন মানবিক, তেমনি স্নেহপ্রবণ। তাঁর অতিসাধারণ জীবনযাপন আমাদের জন্য অনুকরণীয়। পার্থিব লোভ-লালসা, অর্থবিত্তের মোহ তাঁকে কখনো পথভ্রষ্ট-আদর্শচ্যুত করতে পারেনি। প্রায় আড়াই যুগ আগে স্ত্রী মারা গেছেন। নিঃসন্তান রফিক ভাইকে আগলে রেখেছেন দুজন নারী-পুরুষ। তাঁরাই তাঁকে দেখভাল করেন। স্ত্রীর জীবদ্দশা থেকে তাঁরা দুজন তাঁদের পরিবারে যুক্ত হয়ে আছেন।ওই দুজনকে নিয়েই রফিক ভাই নিউ ইস্কাটনের ভাড়াবাসায় একটি সমতার পরিবারে বসবাস করছেন।
কিশোর বয়স থেকেই রফিক ভাই অত্যন্ত নিয়মানুবর্তিতায় জীবনযাপন করে এসেছেন। খাদ্যাভ্যাস থেকে প্রতিটি ক্ষেত্রে খুবই পরিমিত তাঁর জীবনাচার। পরিণত বয়সেও তারুণ্যে ভাটা পড়েনি। বার্ধক্যজনিত রোগ-ভোগ পোহাতে হয়। কিন্তু এতে তাঁর কর্মস্পৃহা কখনো থেমে থাকেনি। নিয়মিত লিখছেন, পড়ছেন, করছেন গবেষণা। জাতীয় ক্রান্তিলগ্নে প্রতিবাদীদের সমর্থন দিয়ে প্রতিবাদে শামিল হচ্ছেন।
আমাদের সবার অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রিয় রফিক ভাই আজ ১২ সেপ্টেম্বর ৯৫ বছরে পা রাখছেন। তাঁর জন্মদিনে জানাই প্রণতি ও শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
আমাদের দেশে জ্ঞানী-পণ্ডিতের সংখ্যা নিতান্ত স্বল্প না হলেও, সমাজে জ্ঞানীর পাশাপাশি বিবেকবান, নীতিনিষ্ঠ পণ্ডিতজনের বড়ই অভাব। হাতে গোনা যে দু-চারজন আছেন, তাঁদেরই একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় আহমদ রফিক। যিনি আমাদের ক্ষমতার রাজনীতির কেনা-বেচার হাটে পার্থিব লোভ-লালসায় নিজেকে কখনো বিকিয়ে দেননি।
বিপরীতে আমাদের শাসকগোষ্ঠীর অগণতান্ত্রিক-স্বেচ্ছাচারী এবং ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বরাবর সোচ্চার থেকেছেন। জনগণের কাতারে এসে শামিল হয়েছেন প্রতিবাদে। আহমদ রফিক—যিনি কারও রফিক স্যার, কারও রফিক ভাই; যাঁকে আমরা জাতীয় নানা দুঃসময়ে কাছে পাই। যিনি মতাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অটল থাকতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেন।
তখন দেশভাগের অন্তিম সময়। দেশভাগ ও বাংলাভাগ প্রায় চূড়ান্ত। বাংলাভাগে উত্তাল পূর্ব বাংলার সব অঞ্চল-জনপদ। গ্রামের যুবকেরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে মিছিল, সভা-সমাবেশ করে মুসলমানের পৃথক রাষ্ট্রের যৌক্তিকতা তুলে ধরে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছেন।
স্লোগানে-স্লোগানে মুখর ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আনন্দ-উল্লাস ধ্বনি চারদিকে। তখন যুবক আহমদ রফিককে দেশভাগ-পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা মোটেও উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। সেই জনস্রোতের ভাবনার বিপরীত ভাবনাই তাঁকে ঘিরে ধরেছিল। সেই ভাবনার কেন্দ্রে ছিল মর্মান্তিক বাংলাভাগের অশুভ পরিণতির উপলব্ধি। দেশভাগে উচ্ছেদ, বিচ্ছেদ এবং উৎপাটনের শঙ্কায় তিনি উদ্বিগ্ন। পরিণতি আঁচ করতে পেরে শঙ্কিত। তিনি দেশভাগের উন্মাদনার কালেই দেশভাগ মেনে নিতে পারেননি। ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মতো তাঁর সেই চেতনা কতটা বাস্তবসম্মত ছিল, বাস্তবে সেটা ক্রমেই প্রকাশ পেয়েছে। পরিণত বয়সে তিনি নানা মাত্রার গবেষণার ফাঁকে লিখেছেন অসামান্য গ্রন্থ ‘দেশবিভাগ: ফিরে দেখা’। তাঁর চিন্তার অগ্রসরতা নানাভাবে, নানা ক্ষেত্রে প্রকাশ পেয়েছে। সনাতনী ধ্যানধারণার বিপরীতে তাঁর জনমুক্তির ভাবনা একইভাবে আমরা দেখে আসছি।
রফিক ভাই ছাত্র হিসেবে ছিলেন খুবই মেধাবী। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে মেধাতালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সংগত কারণে পরিবারের ইচ্ছায় তাঁকে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হতে হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র আহমদ রফিক জড়িয়ে পড়েন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। ভাষা আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরূপে তিনি মেডিকেল কলেজের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ও নেতৃত্বে ছিলেন এবং ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ যুক্ততার কারণে ভাষা মতিনকে বন্দী করা হয় এবং মেডিকেল কলেজের ছাত্র আহমদ রফিকের ওপর হুলিয়া জারি হলে বাধ্য হয়ে তাঁকে আত্মগোপনে যেতে হয়। প্রায় দুই বছর ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পুলিশি নজর এড়িয়ে গোপনে বসবাস করেন। সেই সময়ে চরম আর্থিক অনটনে খেয়ে-না খেয়ে জীবন কাটাতে হয়েছে। যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেও ছাত্রত্ব ফিরে পাননি। ওদিকে পরিবারের মেধাবী ছেলেটি আর ডাক্তার হতে পারল না—এমন শঙ্কায় পরিবারটির মধ্যেও তীব্র হতাশা নেমে আসে। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে হুলিয়া প্রত্যাহারের পর আবার তিনি মেডিকেল কলেজের ছাত্রত্ব ফিরে পান এবং ইচ্ছাশক্তির কঠিন দৃঢ়তায় এমবিবিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। লক্ষ্য বাস্তবায়নে তাঁর একরোখা একাগ্রতাই এতে প্রমাণ করেছে।
ডাক্তার হয়েও ডাক্তারি পেশায় তিনি যুক্ত হননি। করেননি সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগের চাকরি এবং প্রাইভেট প্র্যাকটিস। ওষুধশিল্পের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। পরে কজন মিলে ওষুধশিল্পও গড়ে তোলেন। কিন্তু সেখানে অংশীদারদের সঙ্গে নীতিগত বিরোধের কারণে শূন্য হাতে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন।
সম্পূর্ণ ভিন্নতর পেশায় থেকেও তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি, গবেষণা এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন থাকেননি। নাগরিক নামের পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন অনেককাল। ভাষা আন্দোলন নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং নানামুখী গবেষণামূলক রচনা লিখেছেন। লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ-গবেষণা গ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর গবেষণা গ্রন্থগুলো কেবল দেশে নয়, ভারতেও সমান জনপ্রিয়।
ভারতের টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট তাঁকে রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য উপাধি দিয়েছে। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে রবীন্দ্রজীবনীর একটি খণ্ড তিনি লিখেছেন। লেখক-গবেষক হিসেবে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, রাষ্ট্রীয় একুশে পদকসহ অসংখ্য পদক-সম্মাননা তিনি পেয়েছেন।
কিশোর বয়সেই তাঁর চিন্তা-মনন ও দৃষ্টিভঙ্গির উজ্জ্বল চেতনা গড়ে উঠেছিল। সমাজের ধনবৈষম্য, শ্রেণি বিভক্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনাচার এসব দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন বটে, তবে হতাশাগ্রস্ত হননি; বরং অনাচারী-ব্যবস্থা থেকে মুক্তির উপায়টি তিনি সঠিকভাবে বুঝতে পেরে ক্রমেই মার্ক্সবাদী হয়ে ওঠেন। যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। পার্টির সদস্যপদও লাভ করেন। কিন্তু অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির ওপর ক্রুশ্চেভের সংশোধনবাদী সোভিয়েত ইউনিয়নের মাত্রাতিরিক্ত খবরদারি-হস্তক্ষেপ তিনি মেনে নিতে পারেননি। আমাদের পরিপ্রেক্ষিতকে এড়িয়ে আন্দোলনে সোভিয়েত নির্দেশ পালনে এবং কমিউনিস্ট পার্টির স্বাতন্ত্র্য ক্রমাগত ক্ষুণ্ন হওয়ার কারণে তিনি পার্টি ত্যাগে বাধ্য হন। তবে পার্টি ত্যাগ করলেও বিলোপবাদী হননি। আজীবন মার্ক্সীয় মতাদর্শকে বহন করে চলেছেন। যার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর লেখায় এবং বহুবিধ কর্মকাণ্ডে।
কর্মজীবনের ব্যস্ততা-সীমাবদ্ধতা এমনকি পারিবারিক সীমা পর্যন্ত অতিক্রম করে তিনি মার্ক্সবাদী চেতনায় অবিচল থাকার দৃষ্টান্ত রেখে এসেছেন। নিয়মিত গবেষণা ও জ্ঞান বিতরণে আমাদের ঋদ্ধ করে যাচ্ছেন। তাঁর জ্ঞান বিতরণের মাধ্যম হচ্ছে লেখালেখি, যেটি এখনো অবিরাম সচল রেখেছেন। সময় অপচয় না করে প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগিয়ে নিজে যেমন আলোকিত হয়েছেন, তেমনি সেই আলো ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছেন সমাজে। এমন অসামান্য মানুষ আমাদের সমাজে সত্যিই বিরল।
তরুণদের প্রতি তাঁর যেমন ভালোবাসা, তেমনি আকর্ষণও। তরুণদের প্রতিই সর্বাধিক আস্থা-ভরসা রাখেন। তরুণেরাই সমষ্টিগত মুক্তির অধরাকে ধরায় পরিণত করতে পারবে বলে তিনি মনে করেন। তরুণদের সঙ্গে তাঁর নৈকট্য সর্বাধিক। সময় সচেতনতায় অসামান্য দৃষ্টান্ত রফিক ভাই। ঘড়ির কাঁটা ধরে চলেন। সময়জ্ঞানের শিক্ষাটা তরুণদের দিতে ভোলেন না। ব্যতিক্রম হলে কাউকে ছাড়ও তিনি দেন না। রফিক ভাইয়ের সঙ্গে সময় নিয়ে আমরা বরাবরই শঙ্কায় থাকি। সময়ের হেরফেরে স্নেহপূর্ণ তিরস্কার শুনতে হয়।
রফিক ভাই কোনো মার্ক্সবাদী দলভুক্ত না হয়েও আজীবন মার্ক্সবাদী চর্চার মধ্যেই জীবন কাটিয়ে এসেছেন।তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল একজন মানুষ। যেমন মানবিক, তেমনি স্নেহপ্রবণ। তাঁর অতিসাধারণ জীবনযাপন আমাদের জন্য অনুকরণীয়। পার্থিব লোভ-লালসা, অর্থবিত্তের মোহ তাঁকে কখনো পথভ্রষ্ট-আদর্শচ্যুত করতে পারেনি। প্রায় আড়াই যুগ আগে স্ত্রী মারা গেছেন। নিঃসন্তান রফিক ভাইকে আগলে রেখেছেন দুজন নারী-পুরুষ। তাঁরাই তাঁকে দেখভাল করেন। স্ত্রীর জীবদ্দশা থেকে তাঁরা দুজন তাঁদের পরিবারে যুক্ত হয়ে আছেন।ওই দুজনকে নিয়েই রফিক ভাই নিউ ইস্কাটনের ভাড়াবাসায় একটি সমতার পরিবারে বসবাস করছেন।
কিশোর বয়স থেকেই রফিক ভাই অত্যন্ত নিয়মানুবর্তিতায় জীবনযাপন করে এসেছেন। খাদ্যাভ্যাস থেকে প্রতিটি ক্ষেত্রে খুবই পরিমিত তাঁর জীবনাচার। পরিণত বয়সেও তারুণ্যে ভাটা পড়েনি। বার্ধক্যজনিত রোগ-ভোগ পোহাতে হয়। কিন্তু এতে তাঁর কর্মস্পৃহা কখনো থেমে থাকেনি। নিয়মিত লিখছেন, পড়ছেন, করছেন গবেষণা। জাতীয় ক্রান্তিলগ্নে প্রতিবাদীদের সমর্থন দিয়ে প্রতিবাদে শামিল হচ্ছেন।
আমাদের সবার অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রিয় রফিক ভাই আজ ১২ সেপ্টেম্বর ৯৫ বছরে পা রাখছেন। তাঁর জন্মদিনে জানাই প্রণতি ও শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
১ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৫ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৫ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ দিন আগে