ড. মইনুল ইসলাম
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ কিংবা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে এখনো ‘সফট লোন’ পাওয়া গেলে আমরা নিতে আগ্রহী হই, কিন্তু আমাদের বৈদেশিক ঋণের সিংহভাগই এখন ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট’।
সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের অসুবিধা হলো জোগানদাতারা প্রকল্পের প্ল্যান্ট, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ঋণ হিসেবে দেওয়ার সময় প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজার দরের চেয়ে অনেক বেশি দাম ধরে ঋণের পরিমাণকে বাড়িয়ে দেয়। উপরন্তু সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের সুদের হারও সফট লোনের সুদের হারের চেয়ে বেশি, ঋণ পরিশোধের সময়সীমাও কম থাকে। আরও গুরুতর হলো, সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদারি ব্যবসায়ী ও আমলাদের ‘মার্জিনের হার’ অনেক বেশি হয়ে থাকে।
সে জন্য সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটকে লুটপাটের অর্থনীতির সবচেয়ে বহুল-ব্যবহৃত মেকানিজম অভিহিত করা হয়। বাংলাদেশে ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ক্রমেই জিডিপির শতাংশ হিসাবে সরকারের অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক ঋণ প্রতিবছর বাড়ানো হচ্ছে। ফলে ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরিসংখ্যান মোতাবেক যেখানে বাংলাদেশ সরকারের ঋণ-জিডিপির অনুপাত ছিল ২৮ দশমিক ৭, সেখানে ২০২৩ সালের এপ্রিলে তা বেড়ে জিডিপির ৪২ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছে গেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের মোট ঋণের বোঝা দাঁড়িয়েছে ১৬৭ বিলিয়ন ডলারে। ১ ডলারের দাম বাংলাদেশ ব্যাংক-নির্ধারিত ১০৯ দশমিক ৫০ টাকা ধরে হিসাব করলে টাকার অঙ্কে ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১৮ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা (৯৫ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার) অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত সরকারি ঋণ। আর ৭১ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার হলো সরকারের বৈদেশিক ঋণ। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি অস্বাভাবিক রকমের বেশি হয়ে গেছে।
ফলে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় ধরনের ঋণের কিস্তি এবং সুদ পরিশোধ অতিদ্রুত অর্থনীতির জন্য বোঝা হিসেবে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাবে বলে বিশেষজ্ঞ মহল আশঙ্কা প্রকাশ করছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সরকারি প্রশাসন খাতে ব্যয়-বরাদ্দের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ ব্যয়-বরাদ্দ রাখতে হয়েছিল সরকারি ঋণের সুদ পরিশোধ খাতে, মোট ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঋণের সুদ পরিশোধ খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছে ৯৪ হাজার কোটি টাকা। শুধু বৈদেশিক ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ ২০২২-২৩ অর্থবছরের ২ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে হয়তো ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের এহেন উচ্চ-প্রবৃদ্ধি ২০২৯ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। অতএব সরকারকে মাত্রাতিরিক্ত সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট নেওয়ার ব্যাপারে সাবধান করার জন্যই বক্ষ্যমাণ কলামটি লেখা।
বিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের ভেন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির পিএইচডি কোর্সে অধ্যয়নের সময় আমার দুটো ‘ফিল্ড অব স্পেশালাইজেশন’ ছিল—অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পাবলিক ফিন্যান্স। ১৯৮১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরার পর ৪২ বছর ধরে আমি উন্নয়ন অর্থনীতির সর্বশেষ প্রকাশিত গবেষণার সঙ্গে পরিচিত থাকার প্রয়াস জারি রেখেছি।
অতএব, আমি যখন অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় সহজবোধ্য বিশ্লেষণ উপস্থাপন করি, তখন এই ফিল্ডের উচ্চতর জ্ঞান আমাকে সারা জীবন সহায়তা করে চলেছে। ভেন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কোর্সের শিক্ষকেরা বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর শাসকেরা যে অহরহ সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের দিকে কেন ধাবিত হন, সে-সম্পর্কে আমাদের বারবার সাবধান করে দিতেন।
কারণ সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের মাধ্যমে অর্থায়িত প্রকল্পগুলো প্রায়ই শাসকদের দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনকে লালন করার সবচেয়ে লোভনীয় ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। দুঃখজনকভাবে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশেও এ প্রক্রিয়াটি শাসক মহলের দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের সবচেয়ে মারাত্মক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। সে জন্য বাংলাদেশের মেগা প্রজেক্টগুলোর ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক ধরা হচ্ছে। কারণ এসব প্রকল্প থেকে পুঁজি লুণ্ঠন এখন শাসক দলের নেতা ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীদের লোভনীয় ধান্দা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নসংক্রান্ত প্রকল্পগুলোতে ঋণ দেওয়া আন্তর্জাতিক ঋণদান সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে হলে যেহেতু তাদের অনেক কঠিন শর্ত পরিপালনে শাসকেরা জটিলতার সম্মুখীন হন, তাই বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সরকার প্রধানত সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়েছে; বিশেষ করে ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণ বাতিলের পর থেকে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব যেন জেদের বশেই নানা স্বল্প-প্রয়োজনীয় প্রকল্পে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট গ্রহণে অত্যাগ্রহী হয়ে উঠেছেন!
চীন যেহেতু এখন তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উদারভাবে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট দেওয়ার নীতি বাস্তবায়নে তৎপর রয়েছে, তাই দেড় দশক ধরে চীনের সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট পাওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে। সমালোচকেরা চীনের এই উদার ঋণনীতিকে ‘ঋণের ফাঁদ’ হিসেবে অভিহিত করে চলেছেন। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, লাওস এবং আফ্রিকার কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যেই এই ‘চীনা ঋণের ফাঁদে’ আটকা পড়েছে বলে গত কয়েক বছরে উন্নয়ন-চিন্তকদের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত চীন থেকে ১ হাজার ৮৫৪ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে।
এর মধ্যে ১০ বছরে বাংলাদেশ চীন থেকে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট নিয়ে ১২টি প্রকল্প বাস্তবায়িত করে চলেছে। অতএব, নির্দ্বিধায় বলা চলে যে বর্তমান সরকার চীনের সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের প্রতি অতিমাত্রায় অনুরাগ প্রদর্শন করে চলেছে। এসব প্রকল্প-ঋণের শর্তাবলি বা সুদের হার সম্পর্কে সরকার যেহেতু একধরনের গোপনীয়তা রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর, তাই এগুলোকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার জন্য খুব বেশি তথ্য আমাদের হাতে নেই। তবে এটা বলতেই হবে, এই মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি অর্থনীতির জন্য মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়।
চীনা সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটে যেসব মেগা প্রকল্প এ দেশে বাস্তবায়িত হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে, সেগুলো হলো পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোর-পায়রা রেলপথ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প এবং ঢাকা-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প। জাপানের জাইকার সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটে অর্থায়িত যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে, সেগুলো হলো ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল, যমুনা রেলসেতু এবং চট্টগ্রাম আউটার রিং রোড। ঢাকা-যশোর রেলপথ এবং ঢাকা-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প নিঃসন্দেহে নিকৃষ্ট প্রকল্প।
বাংলাদেশের নিকৃষ্টতম ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট প্রকল্প’ ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে নির্মীয়মাণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এটি আক্ষরিকভাবেই ‘সাদা হাতি প্রকল্প’। দুই ইউনিটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের প্রাক্কলিত ব্যয় হবে ১ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার। ইউনিট দুটোর কাজ শেষ হতে সময় লাগবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। এই দুটো ইউনিট থেকে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রাক্কলিত নির্মাণ ব্যয় ১ হাজার ৩৫০ কোটি ডলারের মধ্যে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার ঋণ দেবে রাশিয়া, বাকি দেড় শ কোটি ডলার বাংলাদেশ ব্যয় করবে। রাশিয়ার ঋণের সুদের হার হবে ৪ শতাংশ, যা ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২৮ বছরে বাংলাদেশকে সুদাসলে পরিশোধ করতে হবে। রাশিয়ার রোসাটম নামের যে প্রতিষ্ঠানটি এই প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি করেছে, তারা প্রতিবেদনে দাবি করেছে যে আনুমানিক ৬০ বছর আয়ু হবে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের। নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর এক বছর রোসাটম প্ল্যান্টটি পরিচালনা করবে।
অনেকেরই জানা নেই যে মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে ভারতের তামিলনাড়ুর কুদান কুলামে ২ হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপিত হয়েছে কয়েক বছর আগে। অথচ আমাদের ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের জন্য ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণ নিতে হচ্ছে কেন? এত বেশি ‘ইনফ্লেটেড প্রজেক্ট কস্ট’ দেখিয়ে রাশিয়া কি বাংলাদেশের বন্ধুর পরিচয় দিয়েছে? বাংলাদেশ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের উচ্চ-মার্জিন কি এই উচ্চ ব্যয়ের জন্য দায়ী?
খুবই উদ্বেগজনক হলো, ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার যখন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট প্রকল্প গ্রহণের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তখন এর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩০০ কোটি থেকে ৪০০ কোটি ডলার। প্রথম থেকেই আমার সন্দেহ হচ্ছিল যে ১ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার খরচ করে প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তা দেশের জন্য একটা ‘মহা অপচয়ের সাদা হাতি’ হতে চলেছে। কোনো পারমাণবিক দুর্ঘটনা হলে দেশের জনগণের জন্য এই প্ল্যান্ট মহাবিপর্যয়করও হতে পারে। ২০২৫ সাল থেকে ২৮ বছর ধরে প্রতিবছর ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার করে এই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে যেতে হবে আমাদের।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ কিংবা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে এখনো ‘সফট লোন’ পাওয়া গেলে আমরা নিতে আগ্রহী হই, কিন্তু আমাদের বৈদেশিক ঋণের সিংহভাগই এখন ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট’।
সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের অসুবিধা হলো জোগানদাতারা প্রকল্পের প্ল্যান্ট, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ঋণ হিসেবে দেওয়ার সময় প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজার দরের চেয়ে অনেক বেশি দাম ধরে ঋণের পরিমাণকে বাড়িয়ে দেয়। উপরন্তু সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের সুদের হারও সফট লোনের সুদের হারের চেয়ে বেশি, ঋণ পরিশোধের সময়সীমাও কম থাকে। আরও গুরুতর হলো, সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদারি ব্যবসায়ী ও আমলাদের ‘মার্জিনের হার’ অনেক বেশি হয়ে থাকে।
সে জন্য সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটকে লুটপাটের অর্থনীতির সবচেয়ে বহুল-ব্যবহৃত মেকানিজম অভিহিত করা হয়। বাংলাদেশে ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ক্রমেই জিডিপির শতাংশ হিসাবে সরকারের অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক ঋণ প্রতিবছর বাড়ানো হচ্ছে। ফলে ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরিসংখ্যান মোতাবেক যেখানে বাংলাদেশ সরকারের ঋণ-জিডিপির অনুপাত ছিল ২৮ দশমিক ৭, সেখানে ২০২৩ সালের এপ্রিলে তা বেড়ে জিডিপির ৪২ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছে গেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের মোট ঋণের বোঝা দাঁড়িয়েছে ১৬৭ বিলিয়ন ডলারে। ১ ডলারের দাম বাংলাদেশ ব্যাংক-নির্ধারিত ১০৯ দশমিক ৫০ টাকা ধরে হিসাব করলে টাকার অঙ্কে ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১৮ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা (৯৫ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার) অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত সরকারি ঋণ। আর ৭১ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার হলো সরকারের বৈদেশিক ঋণ। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি অস্বাভাবিক রকমের বেশি হয়ে গেছে।
ফলে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় ধরনের ঋণের কিস্তি এবং সুদ পরিশোধ অতিদ্রুত অর্থনীতির জন্য বোঝা হিসেবে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাবে বলে বিশেষজ্ঞ মহল আশঙ্কা প্রকাশ করছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সরকারি প্রশাসন খাতে ব্যয়-বরাদ্দের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ ব্যয়-বরাদ্দ রাখতে হয়েছিল সরকারি ঋণের সুদ পরিশোধ খাতে, মোট ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঋণের সুদ পরিশোধ খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছে ৯৪ হাজার কোটি টাকা। শুধু বৈদেশিক ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ ২০২২-২৩ অর্থবছরের ২ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে হয়তো ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের এহেন উচ্চ-প্রবৃদ্ধি ২০২৯ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। অতএব সরকারকে মাত্রাতিরিক্ত সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট নেওয়ার ব্যাপারে সাবধান করার জন্যই বক্ষ্যমাণ কলামটি লেখা।
বিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের ভেন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির পিএইচডি কোর্সে অধ্যয়নের সময় আমার দুটো ‘ফিল্ড অব স্পেশালাইজেশন’ ছিল—অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পাবলিক ফিন্যান্স। ১৯৮১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরার পর ৪২ বছর ধরে আমি উন্নয়ন অর্থনীতির সর্বশেষ প্রকাশিত গবেষণার সঙ্গে পরিচিত থাকার প্রয়াস জারি রেখেছি।
অতএব, আমি যখন অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় সহজবোধ্য বিশ্লেষণ উপস্থাপন করি, তখন এই ফিল্ডের উচ্চতর জ্ঞান আমাকে সারা জীবন সহায়তা করে চলেছে। ভেন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কোর্সের শিক্ষকেরা বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর শাসকেরা যে অহরহ সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের দিকে কেন ধাবিত হন, সে-সম্পর্কে আমাদের বারবার সাবধান করে দিতেন।
কারণ সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের মাধ্যমে অর্থায়িত প্রকল্পগুলো প্রায়ই শাসকদের দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনকে লালন করার সবচেয়ে লোভনীয় ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। দুঃখজনকভাবে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশেও এ প্রক্রিয়াটি শাসক মহলের দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের সবচেয়ে মারাত্মক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। সে জন্য বাংলাদেশের মেগা প্রজেক্টগুলোর ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক ধরা হচ্ছে। কারণ এসব প্রকল্প থেকে পুঁজি লুণ্ঠন এখন শাসক দলের নেতা ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীদের লোভনীয় ধান্দা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নসংক্রান্ত প্রকল্পগুলোতে ঋণ দেওয়া আন্তর্জাতিক ঋণদান সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে হলে যেহেতু তাদের অনেক কঠিন শর্ত পরিপালনে শাসকেরা জটিলতার সম্মুখীন হন, তাই বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সরকার প্রধানত সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়েছে; বিশেষ করে ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণ বাতিলের পর থেকে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব যেন জেদের বশেই নানা স্বল্প-প্রয়োজনীয় প্রকল্পে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট গ্রহণে অত্যাগ্রহী হয়ে উঠেছেন!
চীন যেহেতু এখন তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উদারভাবে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট দেওয়ার নীতি বাস্তবায়নে তৎপর রয়েছে, তাই দেড় দশক ধরে চীনের সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট পাওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে। সমালোচকেরা চীনের এই উদার ঋণনীতিকে ‘ঋণের ফাঁদ’ হিসেবে অভিহিত করে চলেছেন। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, লাওস এবং আফ্রিকার কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যেই এই ‘চীনা ঋণের ফাঁদে’ আটকা পড়েছে বলে গত কয়েক বছরে উন্নয়ন-চিন্তকদের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত চীন থেকে ১ হাজার ৮৫৪ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে।
এর মধ্যে ১০ বছরে বাংলাদেশ চীন থেকে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট নিয়ে ১২টি প্রকল্প বাস্তবায়িত করে চলেছে। অতএব, নির্দ্বিধায় বলা চলে যে বর্তমান সরকার চীনের সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের প্রতি অতিমাত্রায় অনুরাগ প্রদর্শন করে চলেছে। এসব প্রকল্প-ঋণের শর্তাবলি বা সুদের হার সম্পর্কে সরকার যেহেতু একধরনের গোপনীয়তা রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর, তাই এগুলোকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার জন্য খুব বেশি তথ্য আমাদের হাতে নেই। তবে এটা বলতেই হবে, এই মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি অর্থনীতির জন্য মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়।
চীনা সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটে যেসব মেগা প্রকল্প এ দেশে বাস্তবায়িত হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে, সেগুলো হলো পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোর-পায়রা রেলপথ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প এবং ঢাকা-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প। জাপানের জাইকার সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটে অর্থায়িত যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে, সেগুলো হলো ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল, যমুনা রেলসেতু এবং চট্টগ্রাম আউটার রিং রোড। ঢাকা-যশোর রেলপথ এবং ঢাকা-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প নিঃসন্দেহে নিকৃষ্ট প্রকল্প।
বাংলাদেশের নিকৃষ্টতম ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট প্রকল্প’ ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে নির্মীয়মাণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এটি আক্ষরিকভাবেই ‘সাদা হাতি প্রকল্প’। দুই ইউনিটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের প্রাক্কলিত ব্যয় হবে ১ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার। ইউনিট দুটোর কাজ শেষ হতে সময় লাগবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। এই দুটো ইউনিট থেকে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রাক্কলিত নির্মাণ ব্যয় ১ হাজার ৩৫০ কোটি ডলারের মধ্যে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার ঋণ দেবে রাশিয়া, বাকি দেড় শ কোটি ডলার বাংলাদেশ ব্যয় করবে। রাশিয়ার ঋণের সুদের হার হবে ৪ শতাংশ, যা ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২৮ বছরে বাংলাদেশকে সুদাসলে পরিশোধ করতে হবে। রাশিয়ার রোসাটম নামের যে প্রতিষ্ঠানটি এই প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি করেছে, তারা প্রতিবেদনে দাবি করেছে যে আনুমানিক ৬০ বছর আয়ু হবে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের। নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর এক বছর রোসাটম প্ল্যান্টটি পরিচালনা করবে।
অনেকেরই জানা নেই যে মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে ভারতের তামিলনাড়ুর কুদান কুলামে ২ হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপিত হয়েছে কয়েক বছর আগে। অথচ আমাদের ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের জন্য ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণ নিতে হচ্ছে কেন? এত বেশি ‘ইনফ্লেটেড প্রজেক্ট কস্ট’ দেখিয়ে রাশিয়া কি বাংলাদেশের বন্ধুর পরিচয় দিয়েছে? বাংলাদেশ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের উচ্চ-মার্জিন কি এই উচ্চ ব্যয়ের জন্য দায়ী?
খুবই উদ্বেগজনক হলো, ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার যখন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট প্রকল্প গ্রহণের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তখন এর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩০০ কোটি থেকে ৪০০ কোটি ডলার। প্রথম থেকেই আমার সন্দেহ হচ্ছিল যে ১ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার খরচ করে প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তা দেশের জন্য একটা ‘মহা অপচয়ের সাদা হাতি’ হতে চলেছে। কোনো পারমাণবিক দুর্ঘটনা হলে দেশের জনগণের জন্য এই প্ল্যান্ট মহাবিপর্যয়করও হতে পারে। ২০২৫ সাল থেকে ২৮ বছর ধরে প্রতিবছর ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার করে এই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে যেতে হবে আমাদের।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে