মমতাজউদ্দিন পাটোয়ারী
শোকাবহ মাস আগস্টের পাদপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রক্তাক্ত ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডকে বেদনাহত চিত্তে স্মরণ করছি। সেই থেকে বাংলাদেশে যা কিছু ঘটে গেছে বা ঘটে চলছে, তা রাষ্ট্র, সমাজ, মানুষের জীবনবোধ ও সামগ্রিকতার ওপর যেসব অভিঘাত সৃষ্টি করেছে, তা আমরা যেন কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছি না। বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতাসহ যাঁদের হারিয়ে আমরা রাজনৈতিক নেতৃত্বের শূন্যতায় পড়েছি, আগস্ট মাস এলেই তাঁদের জন্য আমরা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি। আমরা যাঁদের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছি, তাঁদের হত্যা করে কী অর্জন করেছি, আর কী হারিয়েছি—মৌলিক এ দুই প্রশ্নের মুখোমুখি আমরা কজনই বা হই? যদি তা হতাম, তাহলে হয়তো আমরা তাদের মতো যোগ্য নেতৃত্ব আবার পেতে পারতাম। কিন্তু সেই গভীর চিন্তা ও উপলব্ধির অভাব আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সম্ভাবনার অনেক কিছুই আমাদের বেহাত হয়ে গেছে। গোটা রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় ভর করেছে নানা অপশক্তি, অপরাজনীতি, অপসংস্কৃতি। এসবের প্রভাব ও কর্তৃত্ব আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজজীবনকে ৫০ বছরে বিপন্ন এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
বস্তুত, যে রাষ্ট্র আমরা এত ত্যাগ, ক্ষয়ক্ষতি ও মানুষের জীবনের বিনিময়ে অর্জন করেছি, সেই রাষ্ট্র বিনির্মাণের শুরুর দিকেই কাউকে কাউকে সাধারণ মানুষ ও তরুণদের বিভ্রান্ত করার টানাটানিতে নেমে পড়তে দেখা গেছে। বিশেষত, রাষ্ট্র নিয়ে তখন যাঁরা রাজনীতিতে নানা পদ আর মতের বিভ্রান্তি ছড়াতে তরুণদের ওপর ভর করেছিলেন, তাঁদের কজনই বা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের রাষ্ট্র বিনির্মাণের নীতি-কৌশল সম্পর্কে যথেষ্ট রাজনৈতিক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক, সমাজতাত্ত্বিক ও বৈশ্বিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন? রাজনীতিতে অনেক হেমিলিনের বংশীবাদককে দেখা গেছে, যাঁরা সেই সময় বিপ্লব, সমাজতন্ত্র, পুরোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে নতুন রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন হাজির করেছিলেন তরুণদের সামনে। তাতে বিশালসংখ্যক তরুণ-তরুণী আপ্লুত হয়ে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু এক দশকের মধ্যেই রাষ্ট্র ও রাজনীতির নানা বিপর্যয়ের ঝড়ে সবকিছু যেন উড়ে গেল। হারিয়ে গেলেন অনেক বিপ্লবী নেতা এবং খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেল তাঁদের অনেক সংগঠন। বাংলাদেশ চলে গেল ’৭৫ ও ’৭১-এর ঘাতকদের হাতে, যারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌল চিন্তাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। আমাদের লাখ লাখ স্বপ্নচারী তরুণ তখন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশটাকে আর খুঁজে পাচ্ছিল না। সমাজবিপ্লব ও রাষ্ট্রবিপ্লবের অনেক নায়কই তখন প্রতিনায়কে পরিণত হলেন। মুক্তিযুদ্ধের ভেতর নিয়ে বেড়ে ওঠা একটি বিশাল প্রজন্ম এসব প্রতিনায়কের খপ্পরে পড়ে অনেকটা ধ্বংসই হয়ে গেল। ওই শূন্যতারই সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের অভ্যন্তরে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্লোগান নিয়ে একাত্তরের পরাজিত শক্তির একটি বড় অংশ শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে স্থান করে নিতে থাকে।
একসময়ের বৈজ্ঞানিক সমাজ ও রাষ্ট্রবিপ্লবের ধ্বনি যখন ক্ষীণ হতে থাকে, তখনই আওয়াজ উঠতে শুরু করে ইসলামি রাষ্ট্রবিপ্লবের। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা বাস্তবতায় এই স্লোগান কাউকে আকৃষ্ট করেছে, কেউ থমকে গেছে, কিন্তু এখানেও রাষ্ট্রকে নিয়ে আবার বিভ্রান্তির টানাটানির ছড়াছড়ি শুরু হয়ে গেল। এর ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিনির্মাণের অভিযাত্রা সম্পূর্ণরূপে লক্ষ্যচ্যুত হওয়ার উপক্রম হয়ে গেল। কিন্তু বিপর্যয়কর অবস্থা থেকে রাষ্ট্রকে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্রে পরিণত করার রাজনৈতিক শক্তি তত দিনে বিভাজিত হয়ে গেল, শিক্ষাব্যবস্থায় বহুমাত্রিক ধারা ও উপধারা যুক্ত হলো, ইতিহাস বিকৃত হয়ে গেল, রাজনীতিতে আদর্শের চর্চা অনেকটাই যেন পেছনে পড়ে গেল। ভোগবাদিতা, সুবিধাবাদিতা ও আদর্শহীনতা ক্রমেই বিস্তৃত হতে থাকে। ফলে সমাজের শিশু, কিশোর ও তরুণেরা চারপাশের বাস্তবতা দেখে রাষ্ট্র নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ দেখানোর প্রয়োজনীয় উপাদান দেখতে পায়নি। পাকিস্তানকালে ছাত্ররা ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মাতৃভাষাকে রক্ষার মাধ্যমে জাতিসত্তার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটাতে, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলনে ছাত্ররা বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। ৬ দফার আন্দোলন শিক্ষার্থী ও তরুণদের নিজ জাতির উত্থানের সম্ভাবনা বুঝতে শিখিয়েছিল। সে কারণেই ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-তরুণেরা ৬ দফার পাশাপাশি ১১ দফা নিয়ে হাজির হতে সক্ষম হয়। মূলত একটি স্বাধীন জাতিসত্তার আবির্ভাব উপলব্ধি করতে পেরেছিল। ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধু ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব গোটা জাতির সামনে একটি স্বাধীন সত্তার আলোর মশাল যেন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। সেই মশালের আলো পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্ধকার ভেদ করে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র লাভের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখিয়েছিল।
সদ্য স্বাধীন দেশে তরুণদের নিয়ে বিভ্রান্তির যে চোরাবালি তৈরি করা হয়েছিল, তাতে বিনষ্ট হয়েছে আমাদের সম্ভাবনাময় তরুণ প্রাণশক্তি, যাঁদের হারিয়ে যাওয়া শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকেও নেতৃত্বশূন্যতায় নিক্ষেপ করেছে। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে নানা বিয়োগান্ত ঘটনা শুধু নেতৃত্বশূন্যতাই তৈরি করেনি; বাংলাদেশকে একটি আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক, উদারবাদী রাষ্ট্রচিন্তায় বেড়ে ওঠার সম্ভাবনার জায়গা থেকেও সরিয়ে নিয়েছে। আমাদের জাতীয় জীবনে ১৯৯০-৯১তে এসে কিছুটা আলোর রেখা ধরা দিলেও সেই আলো খুব বেশি রাষ্ট্র, সমাজ ও জনগণকে আলোকিত করতে পারেনি। আমরা তিন জোটের রূপরেখার কথা শুনেছি। সেই রূপরেখাও হারিয়ে গেছে, ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ফলে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে গণতান্ত্রিকতার প্রতিশ্রুতি পেছনে পড়ে গেছে, আলোর মুখ দেখতে পায়নি। রাজনীতিতে আবারও বিরোধ ও দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলেন। তত দিনে বিরোধপূর্ণ রাজনীতির রাষ্ট্রীয় অবস্থানগত চিত্র সংসদ ও এর বাইরে দৃশ্যমান হতে থাকে। বাংলাদেশ পরস্পরবিরোধী দুটি ধারায় বিভক্ত হওয়ার বিষয়টিও তখন পরিষ্কার হয়ে ওঠে। গোটা রাজনীতি, সমাজ, যুবসমাজ বড় আকারের দুটি রাজনৈতিক শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই বিভক্তির আড়ালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আদর্শিক চরিত্র নিয়ে যে দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব সৃষ্টি হয়, সেটি উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির দুর্বলতার সুযোগ নিতে পেরেছে সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রাষ্ট্র চরিত্রদানের শক্তিসমূহ সম্মিলিতভাবে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল নির্বাচনে জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে। দিন বদলের সনদ কর্মসূচি শেখ হাসিনার হাতে ছিল। তরুণসমাজ এই কর্মসূচিকে ব্যাপকভাবে সমর্থনও দিয়েছিল। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আয়োজনকেও তারাই সবচেয়ে বেশি সমর্থন জানিয়েছিল। কিন্তু রাজনীতির মাঠে যে সাম্প্রদায়িকতা, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে কর্ষিত হয়ে আসছিল, তা আস্তিকতা-নাস্তিকতার একটি বিভাজনের স্লোগান সামনে এনে গোটা সমাজকেই তখন ধন্দে ফেলে দেয়। শিক্ষা, রাজনীতি ও সংস্কৃতি এমন মিথ্যা, অপপ্রচার ও গুজবের মুখে যথোপযুক্ত শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে পারেনি, অনেক ক্ষেত্রেই আপসকামিতা ভর করেছে। কিন্তু জ্ঞান, বিজ্ঞান, গণমাধ্যম, রাজনীতি ও সংস্কৃতির সচেতন অংশ এককাট্টা হতে পারল না মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সংগত করার কাজে। প্রায় এক দশক এভাবেই কেটে গেল। করোনার অভিঘাতে বিশ্বব্যবস্থা পাল্টে গেল। অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকট জমা হলো। জীবন-জীবিকায় টানাপোড়েন সৃষ্টি হলো। রাজনীতিতে নানা শক্তির উত্থান ঘটতে থাকে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ঘটনাই বাংলাদেশের ওপর ভর করে। এমনি প্রেক্ষাপটে আচমকা চাকরিতে কোটার দাবি শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, অভিভাবকদের মধ্যেও নানা রকম প্রশ্ন সৃষ্টি করে। অথচ কোটার বিষয়টি ২০১৮ সালেই বাতিল হয়ে যায়, কিন্তু সেটি নিয়ে দেশে এমন আবেগ তৈরি করা যাবে, তা সচেতন মহল বুঝতে না পারলেও রাজনীতির নেপথ্যের শক্তি বুঝেশুনেই ইস্যুটিকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হলো। এখানেও নানা বিভ্রান্তি, অপপ্রচার ও অপরাজনীতি ভয়ানকভাবে যুক্ত হয়ে পড়ল। এর ফলে ১৬, ১৮ ও ১৯ জুলাই দেশে কোটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে সংঘাত ও সংঘর্ষের সৃষ্টি করা হয়। এতে প্রাণ গেল অনেকের। ধ্বংস হলো রাষ্ট্রের মহামূল্যবান জনগণের অর্থে
নির্মিত গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান।
প্রাণও সম্পদ দুটিই রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই ধ্বংস মোটেও মেনে নেওয়া যায় না। উপায় একটি খোলা আছে, তা হলো যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে বিচারের সম্মুখীন করা। কিন্তু স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, কারণ, ঘটনা-দুর্ঘটনা, হতাহত ও ধ্বংসযজ্ঞ উন্মোচনের ক্ষেত্রে আবারও দুই মেরুকরণকৃত রাজনৈতিক শিবিরের উপস্থিতি। স্পষ্টত এটিও পরস্পরবিরোধী দুই রাজনৈতিক শিবিরে দেশকে নিয়ে টানাটানি করার লক্ষণ। এই অবস্থার পরিণতি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতে না পারলে, উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে। সেদিকেই দেশকে টেনে নেওয়ার অপশক্তির অপচেষ্টা চলছে।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
শোকাবহ মাস আগস্টের পাদপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রক্তাক্ত ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডকে বেদনাহত চিত্তে স্মরণ করছি। সেই থেকে বাংলাদেশে যা কিছু ঘটে গেছে বা ঘটে চলছে, তা রাষ্ট্র, সমাজ, মানুষের জীবনবোধ ও সামগ্রিকতার ওপর যেসব অভিঘাত সৃষ্টি করেছে, তা আমরা যেন কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছি না। বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতাসহ যাঁদের হারিয়ে আমরা রাজনৈতিক নেতৃত্বের শূন্যতায় পড়েছি, আগস্ট মাস এলেই তাঁদের জন্য আমরা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি। আমরা যাঁদের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছি, তাঁদের হত্যা করে কী অর্জন করেছি, আর কী হারিয়েছি—মৌলিক এ দুই প্রশ্নের মুখোমুখি আমরা কজনই বা হই? যদি তা হতাম, তাহলে হয়তো আমরা তাদের মতো যোগ্য নেতৃত্ব আবার পেতে পারতাম। কিন্তু সেই গভীর চিন্তা ও উপলব্ধির অভাব আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সম্ভাবনার অনেক কিছুই আমাদের বেহাত হয়ে গেছে। গোটা রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় ভর করেছে নানা অপশক্তি, অপরাজনীতি, অপসংস্কৃতি। এসবের প্রভাব ও কর্তৃত্ব আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজজীবনকে ৫০ বছরে বিপন্ন এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
বস্তুত, যে রাষ্ট্র আমরা এত ত্যাগ, ক্ষয়ক্ষতি ও মানুষের জীবনের বিনিময়ে অর্জন করেছি, সেই রাষ্ট্র বিনির্মাণের শুরুর দিকেই কাউকে কাউকে সাধারণ মানুষ ও তরুণদের বিভ্রান্ত করার টানাটানিতে নেমে পড়তে দেখা গেছে। বিশেষত, রাষ্ট্র নিয়ে তখন যাঁরা রাজনীতিতে নানা পদ আর মতের বিভ্রান্তি ছড়াতে তরুণদের ওপর ভর করেছিলেন, তাঁদের কজনই বা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের রাষ্ট্র বিনির্মাণের নীতি-কৌশল সম্পর্কে যথেষ্ট রাজনৈতিক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক, সমাজতাত্ত্বিক ও বৈশ্বিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন? রাজনীতিতে অনেক হেমিলিনের বংশীবাদককে দেখা গেছে, যাঁরা সেই সময় বিপ্লব, সমাজতন্ত্র, পুরোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে নতুন রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন হাজির করেছিলেন তরুণদের সামনে। তাতে বিশালসংখ্যক তরুণ-তরুণী আপ্লুত হয়ে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু এক দশকের মধ্যেই রাষ্ট্র ও রাজনীতির নানা বিপর্যয়ের ঝড়ে সবকিছু যেন উড়ে গেল। হারিয়ে গেলেন অনেক বিপ্লবী নেতা এবং খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেল তাঁদের অনেক সংগঠন। বাংলাদেশ চলে গেল ’৭৫ ও ’৭১-এর ঘাতকদের হাতে, যারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌল চিন্তাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। আমাদের লাখ লাখ স্বপ্নচারী তরুণ তখন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশটাকে আর খুঁজে পাচ্ছিল না। সমাজবিপ্লব ও রাষ্ট্রবিপ্লবের অনেক নায়কই তখন প্রতিনায়কে পরিণত হলেন। মুক্তিযুদ্ধের ভেতর নিয়ে বেড়ে ওঠা একটি বিশাল প্রজন্ম এসব প্রতিনায়কের খপ্পরে পড়ে অনেকটা ধ্বংসই হয়ে গেল। ওই শূন্যতারই সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের অভ্যন্তরে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্লোগান নিয়ে একাত্তরের পরাজিত শক্তির একটি বড় অংশ শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে স্থান করে নিতে থাকে।
একসময়ের বৈজ্ঞানিক সমাজ ও রাষ্ট্রবিপ্লবের ধ্বনি যখন ক্ষীণ হতে থাকে, তখনই আওয়াজ উঠতে শুরু করে ইসলামি রাষ্ট্রবিপ্লবের। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা বাস্তবতায় এই স্লোগান কাউকে আকৃষ্ট করেছে, কেউ থমকে গেছে, কিন্তু এখানেও রাষ্ট্রকে নিয়ে আবার বিভ্রান্তির টানাটানির ছড়াছড়ি শুরু হয়ে গেল। এর ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিনির্মাণের অভিযাত্রা সম্পূর্ণরূপে লক্ষ্যচ্যুত হওয়ার উপক্রম হয়ে গেল। কিন্তু বিপর্যয়কর অবস্থা থেকে রাষ্ট্রকে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্রে পরিণত করার রাজনৈতিক শক্তি তত দিনে বিভাজিত হয়ে গেল, শিক্ষাব্যবস্থায় বহুমাত্রিক ধারা ও উপধারা যুক্ত হলো, ইতিহাস বিকৃত হয়ে গেল, রাজনীতিতে আদর্শের চর্চা অনেকটাই যেন পেছনে পড়ে গেল। ভোগবাদিতা, সুবিধাবাদিতা ও আদর্শহীনতা ক্রমেই বিস্তৃত হতে থাকে। ফলে সমাজের শিশু, কিশোর ও তরুণেরা চারপাশের বাস্তবতা দেখে রাষ্ট্র নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ দেখানোর প্রয়োজনীয় উপাদান দেখতে পায়নি। পাকিস্তানকালে ছাত্ররা ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মাতৃভাষাকে রক্ষার মাধ্যমে জাতিসত্তার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটাতে, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলনে ছাত্ররা বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। ৬ দফার আন্দোলন শিক্ষার্থী ও তরুণদের নিজ জাতির উত্থানের সম্ভাবনা বুঝতে শিখিয়েছিল। সে কারণেই ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-তরুণেরা ৬ দফার পাশাপাশি ১১ দফা নিয়ে হাজির হতে সক্ষম হয়। মূলত একটি স্বাধীন জাতিসত্তার আবির্ভাব উপলব্ধি করতে পেরেছিল। ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধু ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব গোটা জাতির সামনে একটি স্বাধীন সত্তার আলোর মশাল যেন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। সেই মশালের আলো পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্ধকার ভেদ করে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র লাভের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখিয়েছিল।
সদ্য স্বাধীন দেশে তরুণদের নিয়ে বিভ্রান্তির যে চোরাবালি তৈরি করা হয়েছিল, তাতে বিনষ্ট হয়েছে আমাদের সম্ভাবনাময় তরুণ প্রাণশক্তি, যাঁদের হারিয়ে যাওয়া শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকেও নেতৃত্বশূন্যতায় নিক্ষেপ করেছে। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে নানা বিয়োগান্ত ঘটনা শুধু নেতৃত্বশূন্যতাই তৈরি করেনি; বাংলাদেশকে একটি আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক, উদারবাদী রাষ্ট্রচিন্তায় বেড়ে ওঠার সম্ভাবনার জায়গা থেকেও সরিয়ে নিয়েছে। আমাদের জাতীয় জীবনে ১৯৯০-৯১তে এসে কিছুটা আলোর রেখা ধরা দিলেও সেই আলো খুব বেশি রাষ্ট্র, সমাজ ও জনগণকে আলোকিত করতে পারেনি। আমরা তিন জোটের রূপরেখার কথা শুনেছি। সেই রূপরেখাও হারিয়ে গেছে, ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ফলে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে গণতান্ত্রিকতার প্রতিশ্রুতি পেছনে পড়ে গেছে, আলোর মুখ দেখতে পায়নি। রাজনীতিতে আবারও বিরোধ ও দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলেন। তত দিনে বিরোধপূর্ণ রাজনীতির রাষ্ট্রীয় অবস্থানগত চিত্র সংসদ ও এর বাইরে দৃশ্যমান হতে থাকে। বাংলাদেশ পরস্পরবিরোধী দুটি ধারায় বিভক্ত হওয়ার বিষয়টিও তখন পরিষ্কার হয়ে ওঠে। গোটা রাজনীতি, সমাজ, যুবসমাজ বড় আকারের দুটি রাজনৈতিক শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই বিভক্তির আড়ালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আদর্শিক চরিত্র নিয়ে যে দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব সৃষ্টি হয়, সেটি উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির দুর্বলতার সুযোগ নিতে পেরেছে সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রাষ্ট্র চরিত্রদানের শক্তিসমূহ সম্মিলিতভাবে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল নির্বাচনে জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে। দিন বদলের সনদ কর্মসূচি শেখ হাসিনার হাতে ছিল। তরুণসমাজ এই কর্মসূচিকে ব্যাপকভাবে সমর্থনও দিয়েছিল। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আয়োজনকেও তারাই সবচেয়ে বেশি সমর্থন জানিয়েছিল। কিন্তু রাজনীতির মাঠে যে সাম্প্রদায়িকতা, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে কর্ষিত হয়ে আসছিল, তা আস্তিকতা-নাস্তিকতার একটি বিভাজনের স্লোগান সামনে এনে গোটা সমাজকেই তখন ধন্দে ফেলে দেয়। শিক্ষা, রাজনীতি ও সংস্কৃতি এমন মিথ্যা, অপপ্রচার ও গুজবের মুখে যথোপযুক্ত শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে পারেনি, অনেক ক্ষেত্রেই আপসকামিতা ভর করেছে। কিন্তু জ্ঞান, বিজ্ঞান, গণমাধ্যম, রাজনীতি ও সংস্কৃতির সচেতন অংশ এককাট্টা হতে পারল না মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সংগত করার কাজে। প্রায় এক দশক এভাবেই কেটে গেল। করোনার অভিঘাতে বিশ্বব্যবস্থা পাল্টে গেল। অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকট জমা হলো। জীবন-জীবিকায় টানাপোড়েন সৃষ্টি হলো। রাজনীতিতে নানা শক্তির উত্থান ঘটতে থাকে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ঘটনাই বাংলাদেশের ওপর ভর করে। এমনি প্রেক্ষাপটে আচমকা চাকরিতে কোটার দাবি শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, অভিভাবকদের মধ্যেও নানা রকম প্রশ্ন সৃষ্টি করে। অথচ কোটার বিষয়টি ২০১৮ সালেই বাতিল হয়ে যায়, কিন্তু সেটি নিয়ে দেশে এমন আবেগ তৈরি করা যাবে, তা সচেতন মহল বুঝতে না পারলেও রাজনীতির নেপথ্যের শক্তি বুঝেশুনেই ইস্যুটিকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হলো। এখানেও নানা বিভ্রান্তি, অপপ্রচার ও অপরাজনীতি ভয়ানকভাবে যুক্ত হয়ে পড়ল। এর ফলে ১৬, ১৮ ও ১৯ জুলাই দেশে কোটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে সংঘাত ও সংঘর্ষের সৃষ্টি করা হয়। এতে প্রাণ গেল অনেকের। ধ্বংস হলো রাষ্ট্রের মহামূল্যবান জনগণের অর্থে
নির্মিত গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান।
প্রাণও সম্পদ দুটিই রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই ধ্বংস মোটেও মেনে নেওয়া যায় না। উপায় একটি খোলা আছে, তা হলো যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে বিচারের সম্মুখীন করা। কিন্তু স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, কারণ, ঘটনা-দুর্ঘটনা, হতাহত ও ধ্বংসযজ্ঞ উন্মোচনের ক্ষেত্রে আবারও দুই মেরুকরণকৃত রাজনৈতিক শিবিরের উপস্থিতি। স্পষ্টত এটিও পরস্পরবিরোধী দুই রাজনৈতিক শিবিরে দেশকে নিয়ে টানাটানি করার লক্ষণ। এই অবস্থার পরিণতি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতে না পারলে, উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে। সেদিকেই দেশকে টেনে নেওয়ার অপশক্তির অপচেষ্টা চলছে।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে