আসিফ
একটা সময় সৌরজগৎকেই বিশ্বজগতের অংশ হিসেবে জানতাম। তবে পরবর্তীকালে হাজার বছরের সংগ্রামে সৃষ্টিশীল মানবমন উন্মোচন করে—শুধু সূর্য আর সৌরজগৎ নিয়েই এ মহাবিশ্ব নয়। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই সৌরজগতের মতো ১৩ হাজার কোটি গ্রহমণ্ডল রয়েছে। আরও কোটি কোটি গ্যালাক্সি তো হিসাবের বাইরেই রয়ে গেছে। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, স্বল্প কিছু মানবমনের অন্তহীন সংগ্রামে এই যে আমরা এত কিছু জানতে পেরেছি, সেই মন যে মানবসম্প্রদায়ের সঙ্গে গড়ে উঠেছে, যাকে আমরা সমাজ বলি, তার কতটুকু পরিবর্তন ঘটেছে? সৌরজগৎ সম্পর্কে কয়েক হাজার বছরের প্রচেষ্টায় অর্জিত সব ধারণায় যে বিকেন্দ্রীকরণের ইঙ্গিত রয়েছে, তা কি সমাজ নিতে পেরেছে?
বিকেন্দ্রীকরণ তো মানবিক পথের প্রতিফলন, সবার একজন হয়ে বাঁচা, সবার সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়া। যদি নিত, তাহলে একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীজুড়ে যে রাষ্ট্রপ্রধানদের স্বৈরাচারী ও একনায়কতান্ত্রিক আচরণ এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য এত যুদ্ধংদেহী মনোভাব, এত ভয়ংকর হয়ে ওঠার কথা ছিল না। তাহলে কেন বিশ্বের কিছু প্রভাবশালী দেশের মধ্যে এবং ক্ষমতাবান কিছু ব্যক্তির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রবণতা এত প্রবল হয়ে উঠছে? যেমন বছরখানেক আগে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ সময় ১২ জুলাই রাত ৩টায় জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তোলা প্রথম ছবি আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। এ ঘটনা পৃথিবীব্যাপী সাড়া ফেলে দিয়েছিল। বিজ্ঞান মানেই হচ্ছে ক্রম অগ্রগতির প্রক্রিয়া; পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ, যুক্তিতর্কে গাণিতিকভাবে সাজানো, হঠাৎ করেই কিছু পাওয়ার বিষয় নয়। এর ফলেই অতীত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান নিয়ে আমরা মানুষেরা আরও গভীর চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হতে পেরেছি। যদিও সেদিন মার্কিন প্রেসিডেন্টের জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তোলা ছবি উন্মোচনের ঘোষণার মধ্যে ছিল রাজনীতি, ছিল কর্তৃত্ববাদী আচরণ।
এমন একটা ব্যাপার ১৯৬৯ সালে চন্দ্রাভিযানে ঘটেছিল। চাঁদে পদার্পণটা মানবজাতির অগ্রগতি ছিল না। শুধু ছিল যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই। আসলে মানুষের চাঁদে যাওয়ার আয়োজনের উদ্যোগটায় ছিল শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই। যদিও নিল আর্মস্ট্রংয়ের বক্তব্যে মানবজাতির পক্ষে হওয়ার রেশ ছিল।
যদি ওয়েব টেলিস্কোপ বা চাঁদে অভিযানের তথ্য ও অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান পদ্ধতিগতভাবে ঘটত, তাহলে সমাজগুলো বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠত। ধারণাগুলো আত্তীকরণে মানুষ সচেষ্ট হয়ে উঠত, বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটত, বর্তমানে চাঁদে অভিযানগুলোর ধারাবাহিক হিসাব প্রকাশ হতো। কিন্তু তা ঘটেনি, প্রতিটি বৈজ্ঞানিক প্রাপ্তি নিজেদের একক অগ্রগতি হিসেবে দেখানো বা দেখা হচ্ছে। কোনো বৈজ্ঞানিক নিয়ম একক রাষ্ট্রের সীমানা থেকে আসেনি; সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন সময় উদ্ভূত হয়েছে। সেই প্রাকৃতিক নিয়ম বা মৌলিক পদ্ধতিগুলোরও একটা ধারাবাহিক বিকাশ রয়েছে। তাকে তো রাষ্ট্রের সীমানা দিয়ে আটকে রাখা যায় না। ফলে শুধু মহাকাশ অভিযানে নয়, পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিতে এসব সংকীর্ণ আচরণে, প্রতিবিপরীত তথ্য ও ধারণার জালে আমরা এমনভাবে আটকা পড়ে গেছি, আমাদের বৌদ্ধিক জায়গায় বিষয়টা প্রভাব ফেলছে না। ফলে আমাদের বৈজ্ঞানিক ধারণা ও প্রাযুক্তিক অগ্রগতির সঙ্গে মানসিক সংস্কৃতির প্রবল ফারাক তৈরি হয়ে গেছে।
সম্প্রতি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ‘সৌরজগৎ: দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ইতিহাস’ শিরোনামের আলোচনার বক্তৃতায় এ প্রশ্নগুলোই আমাকে আলোড়িত করেছিল। রজগতের রহস্য উন্মোচনে মানুষ কীভাবে চিন্তা করেছিল? প্রাচীন মানবের অনেকে ভাবত, পৃথিবী আকারে চ্যাপ্টা চাকতির মতো বা একটু উত্তল, কিছু একটার ওপর ভর করে আছে। প্রাচীন ভারতের লোকেরা ভাবত, পৃথিবী একটা গোলার্ধ্ব, ভর দিয়ে আছে চারটি দিগ্হস্তীর ওপর, আর দিগ্হস্তীগুলো দাঁড়িয়ে থাকে বিরাট একটা কাছিমের ওপর। কাছিমটি আছে জলের ওপর। আবার রুশদের ধারণা ছিল, পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে তিমিদের ওপর। তিমিগুলো লেজ নাড়ালেই ভূমিকম্প। তিমিগুলো থাকে জলে। কিন্তু জল কিসের ওপর আছে ভাবলেই এক অন্তহীন প্রশ্নের সূচনা হবে। তবে মানুষের এসব উদ্ভট কল্পনা পৃথিবীকে কেন্দ্রস্থলে রাখতে চেয়েছে। পরবর্তীকালে অ্যারিস্টটল, টলেমির প্রকল্পেও তাই দেখি। এসব বিশৃঙ্খল ধারণার মধ্য দিয়ে মানুষ সুশৃঙ্খল ধারণায় পৌঁছাতে পেরেছিল, নিজেকে রাখতে চেয়েছিল থালার পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে।
সেই সুশৃঙ্খল ধারণায় কয়েকজনের মধ্যে পিথাগোরাসের নাম এমনিই চলে আসে। জর্জ সার্টনের ভাষায়, ‘তিনি হলেন ধর্ম ও গণিতের সব যুগের অভিভাবক। ২ হাজার ৫০০ বছর আগে পিথাগোরাস প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন পৃথিবী গোল; চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদের ওপর পৃথিবীর বক্রছায়া পড়ার কারণে, অথবা জাহাজ স্যামস দ্বীপ থেকে দূরে সরে গিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ‘পৃথিবী হলো গোল’। আমি বহু শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করে দেখেছি, পৃথিবী যে গোল তা কীভাবে বোঝা যায়? তারা সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছে, ‘বই পড়ে।’ কথা হলো, আমাদের চারপাশের কোনো কিছু থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না। কারণ ঢাকা শহরের কোনো জায়গা থেকে তো সম্ভবই নয়; যেখানে ভালোভাবে আকাশ দেখা যায় না প্রশস্ত খালি জায়গার অভাবে। এমনকি কংক্রিটের উঁচু ভবনের ছাদে দাঁড়িয়েও দিগন্তকে দেখা যায় না, তাহলে কীভাবে সম্ভব?
২ হাজার ৫০০ বছর আগে আয়োনীয় গণিতজ্ঞ পিথাগোরাস প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন পৃথিবী গোল। তারপর খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দে ইরাতোস্থেনিস পৃথিবী যে গোল তা হাতে-কলমে দেখিয়ে দিলেন, পৃথিবীর পরিধি মাপতে সক্ষম হলেন। তারপরও হাজার বছর সময় লেগে গিয়েছিল মানুষকে তা স্বীকার করতে। এর একটা কারণ হচ্ছে, গড়িয়ে পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল। কেননা, আটকে থাকার মহাকর্ষের ধারণা তখন ছিল না। তবে ইরোতোস্থেনিসের পৃথিবী যে গোল তা মানুষকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী। পৃথিবীর সর্বত্র একই রকম। বসবাসের যোগ্য এক আবাসভূমি। এই ধারণা মানুষকে পৃথিবী প্রদক্ষিণের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এতে অনেকে সাড়া দিয়েছিলেন।
তাঁদের মধ্যে পর্তুগিজ নাবিক ফার্দিনান্দ মাগেল্লানের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি জীবনের বিনিময়ে পৃথিবীটাকে ঘুরেই দেখিয়েছিলেন। দেখিয়েছিলেন তার বাস্তব প্রমাণ—পৃথিবী যে সত্যিকার অর্থেই গোল। ১৫১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ২৩৯ জনের বেশি নাবিক নিয়ে তিনি স্পেনের সেভিল বন্দর থেকে যাত্রা করেন। স্পেনের সেভিল বন্দর থেকে আরম্ভ করে লোহিতসাগর হয়ে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের বাঁক ঘুরে আটলান্টিক হয়ে, প্রশান্ত সাগর হয়ে ভূমধ্যসাগরের মধ্য দিয়ে মাগেল্লানের জাহাজ ফিরে এসেছিল মাত্র ১৮ জন নিয়ে। এই মহা ভ্রমণে তিন বছর সময় লেগেছিল।
২২১ জন নাবিকের জীবনের বিনিময়ে বোঝা গেল পৃথিবী গোল, পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের বসবাস। প্রকৃতিতে উঁচু-নিচু বলে কিছু নেই। তবে পাঠ্যবইগুলো এই ঘটনাগুলোকে সেই অর্থে সামাজিকীকরণ না করলেও এই ধারণা যোগাযোগের জাল বিস্তারে লাভ-ক্ষতির প্রবল প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ করল। আমরা ক্রমেই সাংস্কৃতিক সংঘাতের পথে এগোতে থাকলাম।
ভূকেন্দ্রিক মতবাদের মূল কথা হচ্ছে, পৃথিবীকে স্থির ও কেন্দ্রে রেখে বিশ্বজগৎকে দেখা। এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মানুষের বিক্ষিপ্ত ভাবনা, অসংলগ্ন ধারণাগুলো পেছনে রেখে একটা যৌক্তিক বিন্যাস তৈরি করার প্রচেষ্টা। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বা শুধু আমার অঞ্চলটিকে সর্বোৎকৃষ্ট ভাবার প্রবণতারও উৎস এটা।
পৃথিবী এখন নিউটন, ডারউইন, ম্যান্ডেল, রিম্যান, আইনস্টাইন, ফ্রিডম্যান হয়ে ওয়েব টেলিস্কোপে বিশ্বজগৎ পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। দুই হাজার বছর পার হয়ে গেছে। আমরা আধুনিক ধারণা থেকে দেখেছি কেন্দ্র আর প্রান্তের ভীষণ ঐক্য। অথচ কী আশ্চর্য, বিশ্ব মারামারি করে চলেছে—আমিই উঁচুতে, আমারটাই শ্রেষ্ঠ, আমিই শ্রেষ্ঠ জাতির অংশ, আমিই কেন্দ্র—ধর্মগুলোও তা-ই।
লেখক: বিজ্ঞান বক্তা ও সম্পাদক, মহাবৃত্ত
একটা সময় সৌরজগৎকেই বিশ্বজগতের অংশ হিসেবে জানতাম। তবে পরবর্তীকালে হাজার বছরের সংগ্রামে সৃষ্টিশীল মানবমন উন্মোচন করে—শুধু সূর্য আর সৌরজগৎ নিয়েই এ মহাবিশ্ব নয়। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই সৌরজগতের মতো ১৩ হাজার কোটি গ্রহমণ্ডল রয়েছে। আরও কোটি কোটি গ্যালাক্সি তো হিসাবের বাইরেই রয়ে গেছে। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, স্বল্প কিছু মানবমনের অন্তহীন সংগ্রামে এই যে আমরা এত কিছু জানতে পেরেছি, সেই মন যে মানবসম্প্রদায়ের সঙ্গে গড়ে উঠেছে, যাকে আমরা সমাজ বলি, তার কতটুকু পরিবর্তন ঘটেছে? সৌরজগৎ সম্পর্কে কয়েক হাজার বছরের প্রচেষ্টায় অর্জিত সব ধারণায় যে বিকেন্দ্রীকরণের ইঙ্গিত রয়েছে, তা কি সমাজ নিতে পেরেছে?
বিকেন্দ্রীকরণ তো মানবিক পথের প্রতিফলন, সবার একজন হয়ে বাঁচা, সবার সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়া। যদি নিত, তাহলে একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীজুড়ে যে রাষ্ট্রপ্রধানদের স্বৈরাচারী ও একনায়কতান্ত্রিক আচরণ এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য এত যুদ্ধংদেহী মনোভাব, এত ভয়ংকর হয়ে ওঠার কথা ছিল না। তাহলে কেন বিশ্বের কিছু প্রভাবশালী দেশের মধ্যে এবং ক্ষমতাবান কিছু ব্যক্তির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রবণতা এত প্রবল হয়ে উঠছে? যেমন বছরখানেক আগে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ সময় ১২ জুলাই রাত ৩টায় জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তোলা প্রথম ছবি আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। এ ঘটনা পৃথিবীব্যাপী সাড়া ফেলে দিয়েছিল। বিজ্ঞান মানেই হচ্ছে ক্রম অগ্রগতির প্রক্রিয়া; পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ, যুক্তিতর্কে গাণিতিকভাবে সাজানো, হঠাৎ করেই কিছু পাওয়ার বিষয় নয়। এর ফলেই অতীত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান নিয়ে আমরা মানুষেরা আরও গভীর চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হতে পেরেছি। যদিও সেদিন মার্কিন প্রেসিডেন্টের জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তোলা ছবি উন্মোচনের ঘোষণার মধ্যে ছিল রাজনীতি, ছিল কর্তৃত্ববাদী আচরণ।
এমন একটা ব্যাপার ১৯৬৯ সালে চন্দ্রাভিযানে ঘটেছিল। চাঁদে পদার্পণটা মানবজাতির অগ্রগতি ছিল না। শুধু ছিল যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই। আসলে মানুষের চাঁদে যাওয়ার আয়োজনের উদ্যোগটায় ছিল শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই। যদিও নিল আর্মস্ট্রংয়ের বক্তব্যে মানবজাতির পক্ষে হওয়ার রেশ ছিল।
যদি ওয়েব টেলিস্কোপ বা চাঁদে অভিযানের তথ্য ও অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান পদ্ধতিগতভাবে ঘটত, তাহলে সমাজগুলো বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠত। ধারণাগুলো আত্তীকরণে মানুষ সচেষ্ট হয়ে উঠত, বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটত, বর্তমানে চাঁদে অভিযানগুলোর ধারাবাহিক হিসাব প্রকাশ হতো। কিন্তু তা ঘটেনি, প্রতিটি বৈজ্ঞানিক প্রাপ্তি নিজেদের একক অগ্রগতি হিসেবে দেখানো বা দেখা হচ্ছে। কোনো বৈজ্ঞানিক নিয়ম একক রাষ্ট্রের সীমানা থেকে আসেনি; সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন সময় উদ্ভূত হয়েছে। সেই প্রাকৃতিক নিয়ম বা মৌলিক পদ্ধতিগুলোরও একটা ধারাবাহিক বিকাশ রয়েছে। তাকে তো রাষ্ট্রের সীমানা দিয়ে আটকে রাখা যায় না। ফলে শুধু মহাকাশ অভিযানে নয়, পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিতে এসব সংকীর্ণ আচরণে, প্রতিবিপরীত তথ্য ও ধারণার জালে আমরা এমনভাবে আটকা পড়ে গেছি, আমাদের বৌদ্ধিক জায়গায় বিষয়টা প্রভাব ফেলছে না। ফলে আমাদের বৈজ্ঞানিক ধারণা ও প্রাযুক্তিক অগ্রগতির সঙ্গে মানসিক সংস্কৃতির প্রবল ফারাক তৈরি হয়ে গেছে।
সম্প্রতি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ‘সৌরজগৎ: দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ইতিহাস’ শিরোনামের আলোচনার বক্তৃতায় এ প্রশ্নগুলোই আমাকে আলোড়িত করেছিল। রজগতের রহস্য উন্মোচনে মানুষ কীভাবে চিন্তা করেছিল? প্রাচীন মানবের অনেকে ভাবত, পৃথিবী আকারে চ্যাপ্টা চাকতির মতো বা একটু উত্তল, কিছু একটার ওপর ভর করে আছে। প্রাচীন ভারতের লোকেরা ভাবত, পৃথিবী একটা গোলার্ধ্ব, ভর দিয়ে আছে চারটি দিগ্হস্তীর ওপর, আর দিগ্হস্তীগুলো দাঁড়িয়ে থাকে বিরাট একটা কাছিমের ওপর। কাছিমটি আছে জলের ওপর। আবার রুশদের ধারণা ছিল, পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে তিমিদের ওপর। তিমিগুলো লেজ নাড়ালেই ভূমিকম্প। তিমিগুলো থাকে জলে। কিন্তু জল কিসের ওপর আছে ভাবলেই এক অন্তহীন প্রশ্নের সূচনা হবে। তবে মানুষের এসব উদ্ভট কল্পনা পৃথিবীকে কেন্দ্রস্থলে রাখতে চেয়েছে। পরবর্তীকালে অ্যারিস্টটল, টলেমির প্রকল্পেও তাই দেখি। এসব বিশৃঙ্খল ধারণার মধ্য দিয়ে মানুষ সুশৃঙ্খল ধারণায় পৌঁছাতে পেরেছিল, নিজেকে রাখতে চেয়েছিল থালার পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে।
সেই সুশৃঙ্খল ধারণায় কয়েকজনের মধ্যে পিথাগোরাসের নাম এমনিই চলে আসে। জর্জ সার্টনের ভাষায়, ‘তিনি হলেন ধর্ম ও গণিতের সব যুগের অভিভাবক। ২ হাজার ৫০০ বছর আগে পিথাগোরাস প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন পৃথিবী গোল; চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদের ওপর পৃথিবীর বক্রছায়া পড়ার কারণে, অথবা জাহাজ স্যামস দ্বীপ থেকে দূরে সরে গিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ‘পৃথিবী হলো গোল’। আমি বহু শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করে দেখেছি, পৃথিবী যে গোল তা কীভাবে বোঝা যায়? তারা সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছে, ‘বই পড়ে।’ কথা হলো, আমাদের চারপাশের কোনো কিছু থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না। কারণ ঢাকা শহরের কোনো জায়গা থেকে তো সম্ভবই নয়; যেখানে ভালোভাবে আকাশ দেখা যায় না প্রশস্ত খালি জায়গার অভাবে। এমনকি কংক্রিটের উঁচু ভবনের ছাদে দাঁড়িয়েও দিগন্তকে দেখা যায় না, তাহলে কীভাবে সম্ভব?
২ হাজার ৫০০ বছর আগে আয়োনীয় গণিতজ্ঞ পিথাগোরাস প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন পৃথিবী গোল। তারপর খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দে ইরাতোস্থেনিস পৃথিবী যে গোল তা হাতে-কলমে দেখিয়ে দিলেন, পৃথিবীর পরিধি মাপতে সক্ষম হলেন। তারপরও হাজার বছর সময় লেগে গিয়েছিল মানুষকে তা স্বীকার করতে। এর একটা কারণ হচ্ছে, গড়িয়ে পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল। কেননা, আটকে থাকার মহাকর্ষের ধারণা তখন ছিল না। তবে ইরোতোস্থেনিসের পৃথিবী যে গোল তা মানুষকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী। পৃথিবীর সর্বত্র একই রকম। বসবাসের যোগ্য এক আবাসভূমি। এই ধারণা মানুষকে পৃথিবী প্রদক্ষিণের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এতে অনেকে সাড়া দিয়েছিলেন।
তাঁদের মধ্যে পর্তুগিজ নাবিক ফার্দিনান্দ মাগেল্লানের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি জীবনের বিনিময়ে পৃথিবীটাকে ঘুরেই দেখিয়েছিলেন। দেখিয়েছিলেন তার বাস্তব প্রমাণ—পৃথিবী যে সত্যিকার অর্থেই গোল। ১৫১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ২৩৯ জনের বেশি নাবিক নিয়ে তিনি স্পেনের সেভিল বন্দর থেকে যাত্রা করেন। স্পেনের সেভিল বন্দর থেকে আরম্ভ করে লোহিতসাগর হয়ে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের বাঁক ঘুরে আটলান্টিক হয়ে, প্রশান্ত সাগর হয়ে ভূমধ্যসাগরের মধ্য দিয়ে মাগেল্লানের জাহাজ ফিরে এসেছিল মাত্র ১৮ জন নিয়ে। এই মহা ভ্রমণে তিন বছর সময় লেগেছিল।
২২১ জন নাবিকের জীবনের বিনিময়ে বোঝা গেল পৃথিবী গোল, পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের বসবাস। প্রকৃতিতে উঁচু-নিচু বলে কিছু নেই। তবে পাঠ্যবইগুলো এই ঘটনাগুলোকে সেই অর্থে সামাজিকীকরণ না করলেও এই ধারণা যোগাযোগের জাল বিস্তারে লাভ-ক্ষতির প্রবল প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ করল। আমরা ক্রমেই সাংস্কৃতিক সংঘাতের পথে এগোতে থাকলাম।
ভূকেন্দ্রিক মতবাদের মূল কথা হচ্ছে, পৃথিবীকে স্থির ও কেন্দ্রে রেখে বিশ্বজগৎকে দেখা। এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মানুষের বিক্ষিপ্ত ভাবনা, অসংলগ্ন ধারণাগুলো পেছনে রেখে একটা যৌক্তিক বিন্যাস তৈরি করার প্রচেষ্টা। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বা শুধু আমার অঞ্চলটিকে সর্বোৎকৃষ্ট ভাবার প্রবণতারও উৎস এটা।
পৃথিবী এখন নিউটন, ডারউইন, ম্যান্ডেল, রিম্যান, আইনস্টাইন, ফ্রিডম্যান হয়ে ওয়েব টেলিস্কোপে বিশ্বজগৎ পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। দুই হাজার বছর পার হয়ে গেছে। আমরা আধুনিক ধারণা থেকে দেখেছি কেন্দ্র আর প্রান্তের ভীষণ ঐক্য। অথচ কী আশ্চর্য, বিশ্ব মারামারি করে চলেছে—আমিই উঁচুতে, আমারটাই শ্রেষ্ঠ, আমিই শ্রেষ্ঠ জাতির অংশ, আমিই কেন্দ্র—ধর্মগুলোও তা-ই।
লেখক: বিজ্ঞান বক্তা ও সম্পাদক, মহাবৃত্ত
পর্দার নায়িকারা নিজেদের বয়স আড়ালে রাখা পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আজমেরী হক বাঁধন। প্রতিবছর নিজের জন্মদিনে জানান দেন তাঁর বয়স। গতকাল ছিল বাঁধনের ৪১তম জন্মদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই জানালেন এই তথ্য।
২ দিন আগে১০ বছরের বেশি সময় ধরে শোবিজে কাজ করছেন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। নাটকের পাশাপাশি ওটিটিতে দেখা গেছে তাঁকে। সরকারি অনুদানের ‘দেবী’ নামের একটি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। প্রশংসিত হলেও সিনেমায় আর দেখা মেলেনি তাঁর। ছোট পর্দাতেও অনেক দিন ধরে অনিয়মিত তিনি। এবার শবনম ফারিয়া হাজির হচ্ছেন নতুন পরিচয়ে। কমেডি রিয়েলিটি
২ দিন আগেআমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য যাত্রাপালা। গণমানুষের সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত এই যাত্রাপালা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করছে ‘যাত্রা উৎসব-২০২৪’। আগামী ১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে শুরু হবে ৭ দিনব্যাপী এই উৎসব।
২ দিন আগে‘বঙ্গবন্ধু’ পদবি বিলীন হবে না। হতে পারে না। যেমনটি ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশের পদবি বিলীন হয়নি। ইতিহাসে এসব পদবি অম্লান ও অক্ষয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ। আপনজনকে তো অবশ্যই, শত্রুপক্ষের লোকেরাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপদের
২ দিন আগে