ইনসিয়াহ ভাহানভ্যাটি
মিটিংয়ের জন্য গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলাম। গাড়িতে রেডিও চ্যানেলগুলো বদলাতে বদলাতে লক্ষ করলাম, নয়টির মধ্যে চারটিই অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধনের জয়গান করছে। যে রাস্তা দিয়ে দিল্লি আর গুরগাঁও (গুরুগ্রাম) সংযুক্ত, সেই রাস্তায় মোড় নিতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল গেরুয়া রঙের তীব্রতায়।
রাস্তার পাশে দীর্ঘকাল ধরে দখল করে বসে থাকা বেআইনি দখলদারেরা এখন গেরুয়া রঙের পতাকা বিক্রির কাজে নেমেছেন। রাস্তার ধারে ধারে বিশাল বিশাল পোস্টারে ধনুর্বাণ হাতে রামের ছবি দাপটে দাঁড়িয়ে আছে। পথের ফেরিওয়ালারা দারুণ উৎসাহ নিয়ে রামের মুখমণ্ডিত ছোট পতাকা বিক্রি করছেন।
রাস্তার প্রতিটি মোড়ে দেবতাদের ছবি। চারপাশে ছড়ানো রামের কাট আউট, যেন গোটা শহর এখন এক উৎসবমুখর দেবালয়ে পরিণত হয়েছে। হাউজিং সোসাইটির নিরাপত্তারক্ষীকে মাথা নাড়িয়ে অভিবাদন জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘জয় শ্রী রাম।’ বাতাসে ভাসছিল ধর্মীয় উৎসবের উন্মাদনা; দৈনন্দিন ব্যস্ততা বা কাজের গন্ধ কোথাও ছিল না।
হাউজিং সোসাইটির গ্রুপে চাচার উৎসাহী হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ থেকে জানতে পারলাম, সিনেমা চেইন আইনক্স ও আজতক টিভি চ্যানেল মিলে রামমন্দিরের উদ্বোধন অনুষ্ঠান ১৬০টি সিনেমা হলে এবং ভারতের ৭০টির বেশি শহরে লাইভ দেখানোর বন্দোবস্ত করেছে। দর্শকদের বিনা মূল্যে পপকর্নও দেওয়া হবে!
নিউজ অ্যাপে চোখ রাখতেই দেখলাম, ভারতের বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টে ছুটি ঘোষণার জন্য ভারতের প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন জানিয়েছেন। উদ্দেশ্য, এই ‘রামমন্দির উদ্বোধনের সাংস্কৃতিক ও জাতীয় গুরুত্ব স্বীকার করা’।
এরপরই পড়লাম আরও অদ্ভুত এক খবর। ইন্ডিগো বিমানের ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টরা রাম, লক্ষ্মণ, সীতা ও হনুমান সেজে যাত্রীদের গেটে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। বোর্ডিংয়ের ঘোষণাও দিচ্ছেন একজন ‘লর্ড রাম’।
একজন সত্যিকারের ধার্মিক হিন্দু কীভাবে ভাবছেন তা ভাবতে বিস্ময় লাগে, যখন তাঁদের প্রিয় দেবতাকে একটি বিমানবন্দরে সস্তা পোশাকের সংগ্রহে পরিণত করা হয় বা ধর্মকে এমনভাবে রাজনীতিকীকরণ করা হয়, যা প্রকৃত ভক্তির সঙ্গে খুব কমই সম্পর্কিত! একদিকে এটি হিন্দুধর্মের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি অসম্মানজনক। অন্যদিকে এটি ধর্মকে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করে, যা সমাজকে বিভাজন ও সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
বুঝতে পারি, নব্বইয়ের দশকে বড় হওয়া একজন ভারতীয় মুসলমান হিসেবে আমার কাছে এই সবকিছুই অদ্ভুত। আমার দৃষ্টিতে, মন্দির বা মসজিদের গুরুত্ব মূলত ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও প্রার্থনার জন্য। আর যা-ই হোক, সেগুলোকে ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশে জাতীয় গর্বের রাজনৈতিক প্রতীকে রূপান্তরিত করা উচিত নয়।
বুঝতে পারি, রামমন্দিরের যে ‘সাংস্কৃতিক গুরুত্ব’ দাবি করা হচ্ছে, তা আমাদের মেরুকরণের ঢেউয়ের অস্বচ্ছ জলের মধ্যে ডুবে গেছে। একসময় প্রত্যেক রাজনীতিবিদ ধর্মনিরপেক্ষতাকে গর্বের সঙ্গে ধারণ করতেন। এটাকে তাঁরা সযত্নে লালন ও রক্ষা করতেন। এখন মনে হয় গেরুয়া সাম্প্রদায়িকতার পাহাড়ের নিচে এত গভীরে এই ধর্মনিরপেক্ষতা চাপা পড়েছে যে আমার ভয়, হয়তো আর কখনোই এটা উদ্ধার করা যাবে না।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ভারত একটি নানা ধর্মের, নানা জাতিগোষ্ঠীর দেশ। সবার ধর্মীয় বিশ্বাসকে সম্মান করা এবং ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার না করাই হোক আমাদের লক্ষ্য। তবেই রামমন্দিরের নির্মাণকে সাম্প্রদায়িকতা ও বিভাজনের হাতিয়ার না করে ঐক্য ও সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে দেখা যাবে।
আমাদের প্রজন্ম এই দৃশ্য কখনো দেখেনি, রাষ্ট্র কখনো এমনভাবে ধর্মের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে নতিস্বীকার করেছে। এর পাশাপাশি, ভারতীয় মুসলমানদের সম্পূর্ণভাবে অদৃশ্যকরণও চোখে পড়ে। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আজ ক্ষমতাসীন দলে (বিজেপি) কোনো মুসলিম মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বা এমপি নেই। এ অবস্থা নিশ্চিতভাবেই উদ্বেগজনক। ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতের গণতন্ত্রের একটি মূলনীতি। নাগরিকের ধর্মীয় পরিচয় যা-ই হোক না কেন, তাঁদের সমান অধিকার ও প্রতিনিধিত্ব পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
একটা সময়ে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে অধিষ্ঠিত একজন প্রধানমন্ত্রীর একটি মন্দির উদ্বোধন করাকে অপ্রয়োজনীয় ও অনুপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হতো। ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতাকে একটি মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করে। এর অর্থ হলো, সরকারের প্রত্যেক নাগরিকের ধর্মীয় বিশ্বাসকে সম্মান করা উচিত এবং ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। এই নীতির ভিত্তিতে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে একজন প্রধানমন্ত্রীকে একটি মন্দির উদ্বোধন করা অপ্রয়োজনীয় এবং অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হতো। কারণ, এটি ধর্মের প্রতি সরকারের পক্ষপাতের ইঙ্গিত দেবে।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে ধর্মীয় মেরুকরণের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা দেখা গেছে। এই প্রবণতার ফলে সরকার ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। রামমন্দির নির্মাণের উদ্বোধন এই প্রবণতার একটি উদাহরণ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। তিনি মন্দিরের উদ্বোধনকে একটি জাতীয় উৎসবে পরিণত করেছেন। এটি ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতিকে হুমকির মুখে ফেলছে। এই উদ্যাপনের মধ্যে অনুপস্থিত রয়েছে সেই রক্তাক্ত অতীতের স্বীকারোক্তি, যা আমাদের এই মুহূর্তে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। ভারতের মুসলমানদের জন্য এই উদ্যাপন সংখ্যাগরিষ্ঠের দাপট ও মেরুকরণের বেদনাদায়ক প্রদর্শন।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা এখনো একটি দুঃখজনক ও ক্ষতিকর স্মৃতি। আমরা অনেকেই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে সংঘটিত দাঙ্গায় নিহতদের মনে রাখি। রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও মসজিদটি কখনো পুনর্নির্মাণ করা হয়নি। আর এখন তার ধ্বংসাবশেষের ওপরে একটি মন্দির নির্মাণ করা হচ্ছে, যা আদতে হিন্দু আধিপত্যের একটি স্মৃতিস্তম্ভ।
সকালে টুইটার (বর্তমানে এক্স) ঘাঁটতে গিয়ে আমার চোখে পড়ল একজন মুসলিম ইনফ্লুয়েন্সারের টুইট। ভারতের মুসলমানদের উদ্দেশ্যে তিনি আবেদন জানালেন সহনশীলতা অবলম্বন করার। বাড়িতে থাকার এবং অবমাননাকর বার্তা ও দৃশ্য দেখে উত্তেজিত না হওয়ার। তাঁর এই টুইটের পরেই ঝড়ের গতিতে এল ঠিক তেমনই আক্রমণাত্মক বার্তা, যার ব্যাপারে তিনি সতর্ক করেছিলেন। এ ঘটনাটি ভারতে ধর্মীয় সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে মুসলমানদের অবস্থার একটি নমুনা। একদিকে উত্তেজনা আর মেরুকরণ, অন্যদিকে সহনশীলতা বজায় রাখার আহ্বান। এটা নিশ্চিতভাবেই দুঃখজনক ও মন খারাপ করে এমন বাস্তবতা।
বিদেশে বসবাসকারীদের মধ্যে কেউ কেউ সম্ভাব্য সহিংসতার ভয়ে তাঁদের ভারত ভ্রমণ বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অন্যরা যাঁরা অযোধ্যায় বসবাস করছেন, তাঁরা তাঁদের প্রিয়জনদের কিছুদিনের জন্য শহর থেকে সরিয়ে নেওয়ার কথা বলছেন। অনেক বিয়ের অনুষ্ঠান স্থগিত বা সংক্ষেপ করা হয়েছে। শুক্রবার স্থানীয় মুসলমানরা তাঁদের বাড়িতে নামাজ আদায় করেছেন বলে মসজিদগুলো কেমন যেন নিস্তব্ধ ছিল। তবে মিডিয়া চ্যানেলগুলো একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, বেশির ভাগ মুসলমান রামমন্দির নির্মাণে ‘খুশি’ ও ‘আবেগপ্রবণ’।
ভারতীয় সাংবাদিক বেতওয়া শর্মা বলেছিলেন: ‘যখন অন্য কেউ কষ্ট পাচ্ছে, তখন আপনি যদি উদ্যাপন করেন, তাহলে বুঝতে হবে সমাজে কিছু একটা ভেঙে গেছে।’ তবুও শান্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং তা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করা হয়। যখন কিছু সহ্য করা খুব বেদনাদায়ক হয়, তখন কেউ কেবল তা থেকে উত্তরণের অপেক্ষা করে। ভারতীয় মুসলমানরা এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
শীতকাল দীর্ঘ ও ভয়ংকর।
লেখক: ইনসিয়াহ ভাহানভ্যাটি
ভারতীয় সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার
(আল জাজিরায় প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)
মিটিংয়ের জন্য গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলাম। গাড়িতে রেডিও চ্যানেলগুলো বদলাতে বদলাতে লক্ষ করলাম, নয়টির মধ্যে চারটিই অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধনের জয়গান করছে। যে রাস্তা দিয়ে দিল্লি আর গুরগাঁও (গুরুগ্রাম) সংযুক্ত, সেই রাস্তায় মোড় নিতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল গেরুয়া রঙের তীব্রতায়।
রাস্তার পাশে দীর্ঘকাল ধরে দখল করে বসে থাকা বেআইনি দখলদারেরা এখন গেরুয়া রঙের পতাকা বিক্রির কাজে নেমেছেন। রাস্তার ধারে ধারে বিশাল বিশাল পোস্টারে ধনুর্বাণ হাতে রামের ছবি দাপটে দাঁড়িয়ে আছে। পথের ফেরিওয়ালারা দারুণ উৎসাহ নিয়ে রামের মুখমণ্ডিত ছোট পতাকা বিক্রি করছেন।
রাস্তার প্রতিটি মোড়ে দেবতাদের ছবি। চারপাশে ছড়ানো রামের কাট আউট, যেন গোটা শহর এখন এক উৎসবমুখর দেবালয়ে পরিণত হয়েছে। হাউজিং সোসাইটির নিরাপত্তারক্ষীকে মাথা নাড়িয়ে অভিবাদন জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘জয় শ্রী রাম।’ বাতাসে ভাসছিল ধর্মীয় উৎসবের উন্মাদনা; দৈনন্দিন ব্যস্ততা বা কাজের গন্ধ কোথাও ছিল না।
হাউজিং সোসাইটির গ্রুপে চাচার উৎসাহী হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ থেকে জানতে পারলাম, সিনেমা চেইন আইনক্স ও আজতক টিভি চ্যানেল মিলে রামমন্দিরের উদ্বোধন অনুষ্ঠান ১৬০টি সিনেমা হলে এবং ভারতের ৭০টির বেশি শহরে লাইভ দেখানোর বন্দোবস্ত করেছে। দর্শকদের বিনা মূল্যে পপকর্নও দেওয়া হবে!
নিউজ অ্যাপে চোখ রাখতেই দেখলাম, ভারতের বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টে ছুটি ঘোষণার জন্য ভারতের প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন জানিয়েছেন। উদ্দেশ্য, এই ‘রামমন্দির উদ্বোধনের সাংস্কৃতিক ও জাতীয় গুরুত্ব স্বীকার করা’।
এরপরই পড়লাম আরও অদ্ভুত এক খবর। ইন্ডিগো বিমানের ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টরা রাম, লক্ষ্মণ, সীতা ও হনুমান সেজে যাত্রীদের গেটে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। বোর্ডিংয়ের ঘোষণাও দিচ্ছেন একজন ‘লর্ড রাম’।
একজন সত্যিকারের ধার্মিক হিন্দু কীভাবে ভাবছেন তা ভাবতে বিস্ময় লাগে, যখন তাঁদের প্রিয় দেবতাকে একটি বিমানবন্দরে সস্তা পোশাকের সংগ্রহে পরিণত করা হয় বা ধর্মকে এমনভাবে রাজনীতিকীকরণ করা হয়, যা প্রকৃত ভক্তির সঙ্গে খুব কমই সম্পর্কিত! একদিকে এটি হিন্দুধর্মের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি অসম্মানজনক। অন্যদিকে এটি ধর্মকে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করে, যা সমাজকে বিভাজন ও সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
বুঝতে পারি, নব্বইয়ের দশকে বড় হওয়া একজন ভারতীয় মুসলমান হিসেবে আমার কাছে এই সবকিছুই অদ্ভুত। আমার দৃষ্টিতে, মন্দির বা মসজিদের গুরুত্ব মূলত ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও প্রার্থনার জন্য। আর যা-ই হোক, সেগুলোকে ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশে জাতীয় গর্বের রাজনৈতিক প্রতীকে রূপান্তরিত করা উচিত নয়।
বুঝতে পারি, রামমন্দিরের যে ‘সাংস্কৃতিক গুরুত্ব’ দাবি করা হচ্ছে, তা আমাদের মেরুকরণের ঢেউয়ের অস্বচ্ছ জলের মধ্যে ডুবে গেছে। একসময় প্রত্যেক রাজনীতিবিদ ধর্মনিরপেক্ষতাকে গর্বের সঙ্গে ধারণ করতেন। এটাকে তাঁরা সযত্নে লালন ও রক্ষা করতেন। এখন মনে হয় গেরুয়া সাম্প্রদায়িকতার পাহাড়ের নিচে এত গভীরে এই ধর্মনিরপেক্ষতা চাপা পড়েছে যে আমার ভয়, হয়তো আর কখনোই এটা উদ্ধার করা যাবে না।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ভারত একটি নানা ধর্মের, নানা জাতিগোষ্ঠীর দেশ। সবার ধর্মীয় বিশ্বাসকে সম্মান করা এবং ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার না করাই হোক আমাদের লক্ষ্য। তবেই রামমন্দিরের নির্মাণকে সাম্প্রদায়িকতা ও বিভাজনের হাতিয়ার না করে ঐক্য ও সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে দেখা যাবে।
আমাদের প্রজন্ম এই দৃশ্য কখনো দেখেনি, রাষ্ট্র কখনো এমনভাবে ধর্মের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে নতিস্বীকার করেছে। এর পাশাপাশি, ভারতীয় মুসলমানদের সম্পূর্ণভাবে অদৃশ্যকরণও চোখে পড়ে। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আজ ক্ষমতাসীন দলে (বিজেপি) কোনো মুসলিম মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বা এমপি নেই। এ অবস্থা নিশ্চিতভাবেই উদ্বেগজনক। ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতের গণতন্ত্রের একটি মূলনীতি। নাগরিকের ধর্মীয় পরিচয় যা-ই হোক না কেন, তাঁদের সমান অধিকার ও প্রতিনিধিত্ব পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
একটা সময়ে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে অধিষ্ঠিত একজন প্রধানমন্ত্রীর একটি মন্দির উদ্বোধন করাকে অপ্রয়োজনীয় ও অনুপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হতো। ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতাকে একটি মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করে। এর অর্থ হলো, সরকারের প্রত্যেক নাগরিকের ধর্মীয় বিশ্বাসকে সম্মান করা উচিত এবং ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। এই নীতির ভিত্তিতে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে একজন প্রধানমন্ত্রীকে একটি মন্দির উদ্বোধন করা অপ্রয়োজনীয় এবং অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হতো। কারণ, এটি ধর্মের প্রতি সরকারের পক্ষপাতের ইঙ্গিত দেবে।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে ধর্মীয় মেরুকরণের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা দেখা গেছে। এই প্রবণতার ফলে সরকার ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। রামমন্দির নির্মাণের উদ্বোধন এই প্রবণতার একটি উদাহরণ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। তিনি মন্দিরের উদ্বোধনকে একটি জাতীয় উৎসবে পরিণত করেছেন। এটি ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতিকে হুমকির মুখে ফেলছে। এই উদ্যাপনের মধ্যে অনুপস্থিত রয়েছে সেই রক্তাক্ত অতীতের স্বীকারোক্তি, যা আমাদের এই মুহূর্তে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। ভারতের মুসলমানদের জন্য এই উদ্যাপন সংখ্যাগরিষ্ঠের দাপট ও মেরুকরণের বেদনাদায়ক প্রদর্শন।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা এখনো একটি দুঃখজনক ও ক্ষতিকর স্মৃতি। আমরা অনেকেই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে সংঘটিত দাঙ্গায় নিহতদের মনে রাখি। রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও মসজিদটি কখনো পুনর্নির্মাণ করা হয়নি। আর এখন তার ধ্বংসাবশেষের ওপরে একটি মন্দির নির্মাণ করা হচ্ছে, যা আদতে হিন্দু আধিপত্যের একটি স্মৃতিস্তম্ভ।
সকালে টুইটার (বর্তমানে এক্স) ঘাঁটতে গিয়ে আমার চোখে পড়ল একজন মুসলিম ইনফ্লুয়েন্সারের টুইট। ভারতের মুসলমানদের উদ্দেশ্যে তিনি আবেদন জানালেন সহনশীলতা অবলম্বন করার। বাড়িতে থাকার এবং অবমাননাকর বার্তা ও দৃশ্য দেখে উত্তেজিত না হওয়ার। তাঁর এই টুইটের পরেই ঝড়ের গতিতে এল ঠিক তেমনই আক্রমণাত্মক বার্তা, যার ব্যাপারে তিনি সতর্ক করেছিলেন। এ ঘটনাটি ভারতে ধর্মীয় সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে মুসলমানদের অবস্থার একটি নমুনা। একদিকে উত্তেজনা আর মেরুকরণ, অন্যদিকে সহনশীলতা বজায় রাখার আহ্বান। এটা নিশ্চিতভাবেই দুঃখজনক ও মন খারাপ করে এমন বাস্তবতা।
বিদেশে বসবাসকারীদের মধ্যে কেউ কেউ সম্ভাব্য সহিংসতার ভয়ে তাঁদের ভারত ভ্রমণ বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অন্যরা যাঁরা অযোধ্যায় বসবাস করছেন, তাঁরা তাঁদের প্রিয়জনদের কিছুদিনের জন্য শহর থেকে সরিয়ে নেওয়ার কথা বলছেন। অনেক বিয়ের অনুষ্ঠান স্থগিত বা সংক্ষেপ করা হয়েছে। শুক্রবার স্থানীয় মুসলমানরা তাঁদের বাড়িতে নামাজ আদায় করেছেন বলে মসজিদগুলো কেমন যেন নিস্তব্ধ ছিল। তবে মিডিয়া চ্যানেলগুলো একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, বেশির ভাগ মুসলমান রামমন্দির নির্মাণে ‘খুশি’ ও ‘আবেগপ্রবণ’।
ভারতীয় সাংবাদিক বেতওয়া শর্মা বলেছিলেন: ‘যখন অন্য কেউ কষ্ট পাচ্ছে, তখন আপনি যদি উদ্যাপন করেন, তাহলে বুঝতে হবে সমাজে কিছু একটা ভেঙে গেছে।’ তবুও শান্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং তা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করা হয়। যখন কিছু সহ্য করা খুব বেদনাদায়ক হয়, তখন কেউ কেবল তা থেকে উত্তরণের অপেক্ষা করে। ভারতীয় মুসলমানরা এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
শীতকাল দীর্ঘ ও ভয়ংকর।
লেখক: ইনসিয়াহ ভাহানভ্যাটি
ভারতীয় সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার
(আল জাজিরায় প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে