ইশফাক ইলাহী চৌধুরী
বিজয়ের ৫১ বছর পূর্তি হলো। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছিল। আজকের দিনে তাই পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যাঁদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা একটি মুক্ত স্বাধীন দেশের নাগরিক হতে পেরেছি।
স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে এখন সময় এসেছে আমাদের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তিগুলোর নির্মোহ মূল্যায়ন করার। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে আমরা কী ধরনের বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলাম এবং অর্ধশতক পর আমরা কী পেয়েছি? ১৯৭১ সালে আমাদের স্বপ্নগুলো কী ছিল? সেই লক্ষ্যে আমরা কতদূর এগিয়েছি? জাতি হিসেবে বাংলাদেশের যেভাবে এগোনোর দরকার ছিল, সে তুলনায় আমরা কতদূর এগোলাম, কোথায় আমাদের সফলতা, আর ব্যর্থতাই-বা কোথায়।
একাত্তর সালে দেশটা যখন শত্রুমুক্ত হলো, আমরা এ দেশটার মালিক হলাম; তখন কিন্তু এ দেশ বিশ্বের অন্যতম দারিদ্র্যপীড়িত জাতি ছিল। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকে দোষারোপ করা হয় বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলার জন্য; কিন্তু সেই সময় তাঁর মতো অনেকেই ভেবেছিলেন, বাংলাদেশের পক্ষে রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকা কঠিন হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ একটি অতিদরিদ্র দেশ, যা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায়ই আক্রান্ত হয়ে থাকে, সেই দেশ যে স্বাবলম্বী হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে, এটা অনেকের কাছে অসম্ভব ব্যাপার ছিল।
আমরা যদি একাত্তর সালের দিকে ফিরে তাকাই এবং আজকের বাংলাদেশকে দেখি, তাহলে দেখব, আর্থসামাজিক মানদণ্ডের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে গেছে। বিশেষত, বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে চোখে পড়ার মতো। এক দশক ধরে বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার ৬-৭ শতাংশ হয়ে আসছে, যা বিশ্বের খুব কম দেশই দেখাতে পেরেছে। দারিদ্র্যের যে হার স্বাধীনতাকালে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ ছিল, এখন তা ২০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। শিশুমৃত্যুর হার ১৯৭১ সালে যেখানে ছিল প্রতি হাজারে ২১০, তা এখন নেমে এসেছে প্রতি হাজারে ২২ জনে। প্রসূতি মায়ের মৃত্যুর হার ২০০০ সালে যেখানে ছিল প্রতি হাজারে ৪৩, তা দুই দশকে কমে ২৩ দশমিক ৬ জনে এসে দাঁড়িয়েছে। মাথাপিছু ক্যালরি প্রাপ্তি ১৯৭২ সালে ছিল ১ হাজার ৮০০, তা বর্তমানে ২ হাজার ২০০ ক্যালরির ওপরে। বাংলাদেশে যেসব রোগ মহামারিরূপে প্রতিবছর দেখা দিত, যেমন কলেরা, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া ও গুটি বসন্ত; সেগুলো এখন সম্পূর্ণ অথবা প্রায় সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে গেছে। অতিসম্প্রতি কোভিড-১৯-এর বৈশ্বিক অতিমারিতে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশ কীভাবে এই দুর্যোগ সফলভাবে মোকাবিলা করেছে। স্বাস্থ্যমান বৃদ্ধির ফলে আমাদের গড় আয়ু বেড়ে এখন ৭২ দশমিক ৮৭ বছর, যা পাকিস্তান, ভারত বা নেপালের চেয়ে বেশি।
স্বাধীনতার সময় আমাদের শিল্পকারখানা বলতে কিছুই ছিল না, কিন্তু বিগত দুই দশকে দেশে শিল্পের বিস্তার হয়েছে ব্যাপকভাবে। বর্তমানে আমাদের মোট জিডিপির ৩৩ শতাংশ আসে শিল্পকারখানা থেকে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। গত বছর এই খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার, যা অতি শিগগির ৬০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যেতে পারে। যদিও মোট জিডিপিতে কৃষির অবদান কমে আসছে, কিন্তু কৃষি সেক্টরও দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষক ও কৃষিবিদেরা এ ক্ষেত্রে একটা বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন।
আগে যেমন উত্তরাঞ্চলে বার্ষিক ‘মঙ্গা’ লেগেই থাকত, তা থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি। অনেক ক্ষেত্রে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি, যদিও জনসংখ্যা প্রায় আড়াই বা তিন গুণ বেড়ে গেছে। আমাদের চাষযোগ্য কৃষিজমি কমে যাওয়া, স্বল্পতা থাকা সত্ত্বেও কৃষকেরা অধিক ফসল উৎপাদন করছেন। কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ও আধুনিকায়নের ফলে উৎপাদন বেড়েই চলছে। কৃষিনির্ভর শিল্প এখন জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখছে।
এরপর আমি নির্দিষ্ট করে যদি সশস্ত্র বাহিনীর কথা বলতে চাই, একাত্তর সালের শেষে বা ১৯৭২ সালে যখন বিভিন্ন বাহিনী গড়ে ওঠে, তখন সেনাবাহিনীতে মাত্র তিনটি ব্রিগেড ছিল। আমাদের কোনো ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল না, বিমানবাহিনীর ছিল না কোনো বিমান, নৌবাহিনীর ছিল না কোনো জাহাজ।
আজ আমাদের সেনাবাহিনীর আটটি ডিভিশন আছে, সেই সঙ্গে রয়েছে শতাধিক অত্যাধুনিক ট্যাংক, সাঁজোয়া যান ও গোলন্দাজ বাহিনী।বিমানবাহিনীতে যোগ হয়েছে অত্যাধুনিক জঙ্গিবিমান, পরিবহন বিমান ও হেলিকপ্টার। নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক মিসাইল সজ্জিত যুদ্ধজাহাজ, হেলিকপ্টার ও সাবমেরিন। সামরিক সক্ষমতার সাম্প্রতিক একটা উদাহরণ হলো, ৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে মহড়ার উদ্বোধন করলেন, সেখানে প্রায় ২৪টি দেশের নৌবাহিনী অংশগ্রহণ করেছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই মহড়ায় চীন, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মিয়ানমার, অস্ট্রেলিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশের নৌবাহিনী বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নেতৃত্বে মহড়া করেছে। বিভিন্ন বৈরী শক্তিকে বাংলাদেশ এক প্ল্যাটফর্মে সংযোজন করতে পারল, এটা একটা সাফল্য বৈকি।
আমাদের সশস্ত্র বাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে এবং সেই সঙ্গে দেশের জন্য বয়ে আনছে অনেক প্রশংসা ও সম্মান। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশে সামরিক বাহিনীগুলোর কোনো প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ছিল না। এখন সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীতে তাদের নিজস্ব প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান তো আছেই, উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য আমরা গড়ে তুলেছি স্টাফ কলেজ ও ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ। সেখানে শুধু বাংলাদেশের কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন না, আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশের কর্মকর্তারাও প্রশিক্ষিত হচ্ছেন। একই ট্রেনিং সেন্টারে পাকিস্তান, ভারত, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও অনেক দেশের কর্মকর্তারা ট্রেনিং নিচ্ছেন।
১৯৭২ সালে আমাদের দেশে মাত্র কয়েক শ কিলোমিটার পাকা রাস্তা ছিল। আর যাকে আমরা হাইওয়ে বলতাম, তা ছিল ১৮ বা ২০ ফুট চওড়া। এখন চার, ছয় লেনের হাইওয়ে হয়েছে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার। গত ২৫ জুন পদ্মা নদীর ওপর সেতু উদ্বোধন হলো, তা ছিল আমাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এখন আবার নতুন যমুনা রেলওয়ে সেতুর কাজ হচ্ছে। সেই সঙ্গে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগও এগিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলীর নিচ দিয়ে টানেল হচ্ছে। কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের কাজ হচ্ছে। সড়ক, রেল ও নৌ-যোগাযোগের মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারতের, সেইসঙ্গে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন বাংলাদেশের অর্থনীতি দৃঢ় হবে, একই সঙ্গে ভারতের ওই অঞ্চলগুলো বাংলাদেশের ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। ফলে আমাদের ভৌগোলিক গুরুত্ব আরও বাড়বে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে কিন্তু শিক্ষার মানের ব্যাপারে এখনো অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। আগামী পৃথিবী যেটা আসছে, সেটা এত বেশি প্রযুক্তিনির্ভর হবে যে আমরা যদি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারি, তাহলে আমরা এ চ্যালেঞ্জে টিকতে পারব না। এ জন্য দরকার শিক্ষার একটা আমূল পরিবর্তন।
বিভিন্ন প্রাপ্তির পাশাপাশি আমাদের অপ্রাপ্তির জায়গাগুলো অস্বীকার করলে চলবে না। প্রথমত, আমাদের স্বপ্ন ছিল একটা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, যেখানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য কমে আসবে। সেটা তো হয়ইনি বরং বছরের পর বছর বৈষম্য বেড়েই চলছে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমাদের গণতান্ত্রিক যে প্রতিষ্ঠানগুলো যতটুকু শক্তিশালী হওয়ার কথা ছিল, তা-ও হয়নি। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধ শতাব্দী পরেও আমাদের সংসদ, নির্বাচনব্যবস্থা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের ইমেজের সংকট দেখা দিচ্ছে। আমরা চেষ্টা করলে কিন্তু তা ফিরিয়ে আনতে পারি। কারণ, একাত্তর সালে বাঙালির মূল সংগ্রামই ছিল গণতান্ত্রিক পরিবেশ অর্জন।
অতিসম্প্রতি বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতির যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তাতে সাধারণ জনগণ এই খাতের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। এটা আমাদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুতরাং যেটাকে ইংরেজিতে ‘ক্রনি ক্যাপিটালিজম’ বলে অর্থাৎ আত্মীয়-স্বজন, পরিবার ও শুধু দলীয় লোকদের দিকে নজর না দিয়ে উন্নয়নে যাঁরা ভূমিকা রাখতে পারবেন, তাঁদেরই আর্থিক সহায়তাগুলো দেওয়া উচিত। যাঁরা নামে-বেনামে হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন, তাঁরা এবং এ ব্যাপারে যাঁরা দায়ী, তাঁদের শাস্তির আওতায় আনতে পারলে, ভবিষ্যতে কেউ এ পথে পা বাড়ানোর আগে দুইবার ভাববে। সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতির যে বিস্তার হয়েছে, তা রুখতে হবে কঠোর হাতে।
বাংলাদেশে দুঃখজনকভাবে বেড়েছে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার। ধর্মকে রাজনীতির একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার যে প্রবণতা বাড়ছে, এটা কিন্তু আমাদের কাম্য ছিল না। আমরা চেয়েছিলাম একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ গড়ে তুলতে।আমরা তা করতে পারিনি। যার প্রতিফলন ঘটছে ধর্মীয় উগ্রবাদ, ইসলামি জঙ্গিবাদ এবং বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার মাধ্যমে।এগুলোর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক ইন্ধন। বাংলাদেশের চিরন্তন সামাজিক সম্প্রীতি আজ সম্প্রদায়িক শক্তির আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। আমাদের লোকসংস্কৃতি, শিক্ষাব্যবস্থা, মনোজগত আজ সাম্প্রদায়িকতার আঘাতে জর্জরিত। সমাজ ও রাষ্ট্র এইসব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে না দাঁড়ালে আর্থসামাজিক উন্নয়ন ম্লান হয়ে যাবে।
বিজয় দিবসের উৎসব-আনন্দের মধ্যে আমাদের নতুন করে অঙ্গীকার করতে হবে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা যেন আমরা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারি। একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, যা সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবে—সে লক্ষ্যে আমাদের কাজ করতে হবে।
লেখক: এয়ার কমোডর (অব.)
বিজয়ের ৫১ বছর পূর্তি হলো। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছিল। আজকের দিনে তাই পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যাঁদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা একটি মুক্ত স্বাধীন দেশের নাগরিক হতে পেরেছি।
স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে এখন সময় এসেছে আমাদের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তিগুলোর নির্মোহ মূল্যায়ন করার। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে আমরা কী ধরনের বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলাম এবং অর্ধশতক পর আমরা কী পেয়েছি? ১৯৭১ সালে আমাদের স্বপ্নগুলো কী ছিল? সেই লক্ষ্যে আমরা কতদূর এগিয়েছি? জাতি হিসেবে বাংলাদেশের যেভাবে এগোনোর দরকার ছিল, সে তুলনায় আমরা কতদূর এগোলাম, কোথায় আমাদের সফলতা, আর ব্যর্থতাই-বা কোথায়।
একাত্তর সালে দেশটা যখন শত্রুমুক্ত হলো, আমরা এ দেশটার মালিক হলাম; তখন কিন্তু এ দেশ বিশ্বের অন্যতম দারিদ্র্যপীড়িত জাতি ছিল। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকে দোষারোপ করা হয় বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলার জন্য; কিন্তু সেই সময় তাঁর মতো অনেকেই ভেবেছিলেন, বাংলাদেশের পক্ষে রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকা কঠিন হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ একটি অতিদরিদ্র দেশ, যা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায়ই আক্রান্ত হয়ে থাকে, সেই দেশ যে স্বাবলম্বী হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে, এটা অনেকের কাছে অসম্ভব ব্যাপার ছিল।
আমরা যদি একাত্তর সালের দিকে ফিরে তাকাই এবং আজকের বাংলাদেশকে দেখি, তাহলে দেখব, আর্থসামাজিক মানদণ্ডের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে গেছে। বিশেষত, বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে চোখে পড়ার মতো। এক দশক ধরে বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার ৬-৭ শতাংশ হয়ে আসছে, যা বিশ্বের খুব কম দেশই দেখাতে পেরেছে। দারিদ্র্যের যে হার স্বাধীনতাকালে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ ছিল, এখন তা ২০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। শিশুমৃত্যুর হার ১৯৭১ সালে যেখানে ছিল প্রতি হাজারে ২১০, তা এখন নেমে এসেছে প্রতি হাজারে ২২ জনে। প্রসূতি মায়ের মৃত্যুর হার ২০০০ সালে যেখানে ছিল প্রতি হাজারে ৪৩, তা দুই দশকে কমে ২৩ দশমিক ৬ জনে এসে দাঁড়িয়েছে। মাথাপিছু ক্যালরি প্রাপ্তি ১৯৭২ সালে ছিল ১ হাজার ৮০০, তা বর্তমানে ২ হাজার ২০০ ক্যালরির ওপরে। বাংলাদেশে যেসব রোগ মহামারিরূপে প্রতিবছর দেখা দিত, যেমন কলেরা, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া ও গুটি বসন্ত; সেগুলো এখন সম্পূর্ণ অথবা প্রায় সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে গেছে। অতিসম্প্রতি কোভিড-১৯-এর বৈশ্বিক অতিমারিতে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশ কীভাবে এই দুর্যোগ সফলভাবে মোকাবিলা করেছে। স্বাস্থ্যমান বৃদ্ধির ফলে আমাদের গড় আয়ু বেড়ে এখন ৭২ দশমিক ৮৭ বছর, যা পাকিস্তান, ভারত বা নেপালের চেয়ে বেশি।
স্বাধীনতার সময় আমাদের শিল্পকারখানা বলতে কিছুই ছিল না, কিন্তু বিগত দুই দশকে দেশে শিল্পের বিস্তার হয়েছে ব্যাপকভাবে। বর্তমানে আমাদের মোট জিডিপির ৩৩ শতাংশ আসে শিল্পকারখানা থেকে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। গত বছর এই খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার, যা অতি শিগগির ৬০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যেতে পারে। যদিও মোট জিডিপিতে কৃষির অবদান কমে আসছে, কিন্তু কৃষি সেক্টরও দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষক ও কৃষিবিদেরা এ ক্ষেত্রে একটা বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন।
আগে যেমন উত্তরাঞ্চলে বার্ষিক ‘মঙ্গা’ লেগেই থাকত, তা থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি। অনেক ক্ষেত্রে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি, যদিও জনসংখ্যা প্রায় আড়াই বা তিন গুণ বেড়ে গেছে। আমাদের চাষযোগ্য কৃষিজমি কমে যাওয়া, স্বল্পতা থাকা সত্ত্বেও কৃষকেরা অধিক ফসল উৎপাদন করছেন। কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ও আধুনিকায়নের ফলে উৎপাদন বেড়েই চলছে। কৃষিনির্ভর শিল্প এখন জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখছে।
এরপর আমি নির্দিষ্ট করে যদি সশস্ত্র বাহিনীর কথা বলতে চাই, একাত্তর সালের শেষে বা ১৯৭২ সালে যখন বিভিন্ন বাহিনী গড়ে ওঠে, তখন সেনাবাহিনীতে মাত্র তিনটি ব্রিগেড ছিল। আমাদের কোনো ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল না, বিমানবাহিনীর ছিল না কোনো বিমান, নৌবাহিনীর ছিল না কোনো জাহাজ।
আজ আমাদের সেনাবাহিনীর আটটি ডিভিশন আছে, সেই সঙ্গে রয়েছে শতাধিক অত্যাধুনিক ট্যাংক, সাঁজোয়া যান ও গোলন্দাজ বাহিনী।বিমানবাহিনীতে যোগ হয়েছে অত্যাধুনিক জঙ্গিবিমান, পরিবহন বিমান ও হেলিকপ্টার। নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক মিসাইল সজ্জিত যুদ্ধজাহাজ, হেলিকপ্টার ও সাবমেরিন। সামরিক সক্ষমতার সাম্প্রতিক একটা উদাহরণ হলো, ৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে মহড়ার উদ্বোধন করলেন, সেখানে প্রায় ২৪টি দেশের নৌবাহিনী অংশগ্রহণ করেছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই মহড়ায় চীন, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মিয়ানমার, অস্ট্রেলিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশের নৌবাহিনী বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নেতৃত্বে মহড়া করেছে। বিভিন্ন বৈরী শক্তিকে বাংলাদেশ এক প্ল্যাটফর্মে সংযোজন করতে পারল, এটা একটা সাফল্য বৈকি।
আমাদের সশস্ত্র বাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে এবং সেই সঙ্গে দেশের জন্য বয়ে আনছে অনেক প্রশংসা ও সম্মান। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশে সামরিক বাহিনীগুলোর কোনো প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ছিল না। এখন সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীতে তাদের নিজস্ব প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান তো আছেই, উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য আমরা গড়ে তুলেছি স্টাফ কলেজ ও ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ। সেখানে শুধু বাংলাদেশের কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন না, আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশের কর্মকর্তারাও প্রশিক্ষিত হচ্ছেন। একই ট্রেনিং সেন্টারে পাকিস্তান, ভারত, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও অনেক দেশের কর্মকর্তারা ট্রেনিং নিচ্ছেন।
১৯৭২ সালে আমাদের দেশে মাত্র কয়েক শ কিলোমিটার পাকা রাস্তা ছিল। আর যাকে আমরা হাইওয়ে বলতাম, তা ছিল ১৮ বা ২০ ফুট চওড়া। এখন চার, ছয় লেনের হাইওয়ে হয়েছে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার। গত ২৫ জুন পদ্মা নদীর ওপর সেতু উদ্বোধন হলো, তা ছিল আমাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এখন আবার নতুন যমুনা রেলওয়ে সেতুর কাজ হচ্ছে। সেই সঙ্গে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগও এগিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলীর নিচ দিয়ে টানেল হচ্ছে। কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের কাজ হচ্ছে। সড়ক, রেল ও নৌ-যোগাযোগের মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারতের, সেইসঙ্গে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন বাংলাদেশের অর্থনীতি দৃঢ় হবে, একই সঙ্গে ভারতের ওই অঞ্চলগুলো বাংলাদেশের ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। ফলে আমাদের ভৌগোলিক গুরুত্ব আরও বাড়বে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে কিন্তু শিক্ষার মানের ব্যাপারে এখনো অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। আগামী পৃথিবী যেটা আসছে, সেটা এত বেশি প্রযুক্তিনির্ভর হবে যে আমরা যদি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারি, তাহলে আমরা এ চ্যালেঞ্জে টিকতে পারব না। এ জন্য দরকার শিক্ষার একটা আমূল পরিবর্তন।
বিভিন্ন প্রাপ্তির পাশাপাশি আমাদের অপ্রাপ্তির জায়গাগুলো অস্বীকার করলে চলবে না। প্রথমত, আমাদের স্বপ্ন ছিল একটা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, যেখানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য কমে আসবে। সেটা তো হয়ইনি বরং বছরের পর বছর বৈষম্য বেড়েই চলছে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমাদের গণতান্ত্রিক যে প্রতিষ্ঠানগুলো যতটুকু শক্তিশালী হওয়ার কথা ছিল, তা-ও হয়নি। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধ শতাব্দী পরেও আমাদের সংসদ, নির্বাচনব্যবস্থা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের ইমেজের সংকট দেখা দিচ্ছে। আমরা চেষ্টা করলে কিন্তু তা ফিরিয়ে আনতে পারি। কারণ, একাত্তর সালে বাঙালির মূল সংগ্রামই ছিল গণতান্ত্রিক পরিবেশ অর্জন।
অতিসম্প্রতি বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতির যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তাতে সাধারণ জনগণ এই খাতের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। এটা আমাদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুতরাং যেটাকে ইংরেজিতে ‘ক্রনি ক্যাপিটালিজম’ বলে অর্থাৎ আত্মীয়-স্বজন, পরিবার ও শুধু দলীয় লোকদের দিকে নজর না দিয়ে উন্নয়নে যাঁরা ভূমিকা রাখতে পারবেন, তাঁদেরই আর্থিক সহায়তাগুলো দেওয়া উচিত। যাঁরা নামে-বেনামে হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন, তাঁরা এবং এ ব্যাপারে যাঁরা দায়ী, তাঁদের শাস্তির আওতায় আনতে পারলে, ভবিষ্যতে কেউ এ পথে পা বাড়ানোর আগে দুইবার ভাববে। সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতির যে বিস্তার হয়েছে, তা রুখতে হবে কঠোর হাতে।
বাংলাদেশে দুঃখজনকভাবে বেড়েছে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার। ধর্মকে রাজনীতির একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার যে প্রবণতা বাড়ছে, এটা কিন্তু আমাদের কাম্য ছিল না। আমরা চেয়েছিলাম একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ গড়ে তুলতে।আমরা তা করতে পারিনি। যার প্রতিফলন ঘটছে ধর্মীয় উগ্রবাদ, ইসলামি জঙ্গিবাদ এবং বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার মাধ্যমে।এগুলোর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক ইন্ধন। বাংলাদেশের চিরন্তন সামাজিক সম্প্রীতি আজ সম্প্রদায়িক শক্তির আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। আমাদের লোকসংস্কৃতি, শিক্ষাব্যবস্থা, মনোজগত আজ সাম্প্রদায়িকতার আঘাতে জর্জরিত। সমাজ ও রাষ্ট্র এইসব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে না দাঁড়ালে আর্থসামাজিক উন্নয়ন ম্লান হয়ে যাবে।
বিজয় দিবসের উৎসব-আনন্দের মধ্যে আমাদের নতুন করে অঙ্গীকার করতে হবে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা যেন আমরা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারি। একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, যা সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবে—সে লক্ষ্যে আমাদের কাজ করতে হবে।
লেখক: এয়ার কমোডর (অব.)
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে