এম আবদুল আলীম
ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের মহিমায় দীপ্ত ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা আবেগে ভারাক্রান্ত হই। নানা আনুষ্ঠানিকতায় পালন করি ‘শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। পুষ্পের ডালি সাজিয়ে শ্রদ্ধা-ভালোবাসার অর্ঘ্য নিবেদন করতে হাজির হই শহীদ মিনারে। শুধু তাই নয়, আলোচনা সভার আয়োজনসহ নানা আনুষ্ঠানিকতায় দিনটি অতিবাহিত করি। এতৎসত্ত্বেও ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ সময় পরে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে—একুশের চেতনা লালন, বাঙালি সংস্কৃতির বিস্তার, বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে আমরা কতটুকু সফল হয়েছি? এমন প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক ও সংগত। কারণ, একুশকে আমরা আনুষ্ঠানিকতায় যতটা পরিণত করতে পেরেছি, ততটা এর চেতনা বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারিনি। বিশেষ করে জ্ঞান সৃষ্টি, সংরক্ষণ ও বিতরণের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ ক্ষেত্রে যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
একুশে ফেব্রুয়ারি এলে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গতানুগতিক রেওয়াজ অনুসারে শহীদদের স্মরণে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন করা হয়। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনা সভা ও সেমিনারের আয়োজন করা হয়। কিন্তু সেগুলো বেশির ভাগই থাকে অনুষ্ঠানসর্বস্ব, তাতে বেশির ভাগ শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীর অংশগ্রহণ থাকে না। এ তো গেল একুশের দিনের চিত্র। সারা বছর কী হয়? ভাষা আন্দোলন সংগঠনের মূলে ছিল বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে হটিয়ে উর্দু-আরবি মিশেলে তথাকথিত ইসলামি তমদ্দুন তথা পাকিস্তানি সংস্কৃতি প্রচলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদের মর্মমূল থেকে যে চেতনা উৎসারিত হয়েছিল, তাতে সব ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বিকশিত হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। বাংলা ভাষা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদালাভ তো করেছিলই, একই সঙ্গে ভাষা-সংস্কৃতিভিত্তিক নতুন জাতীয়তাবোধেরও উন্মেষ ঘটেছিল, যার সূত্র ধরে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চূড়ান্ত ধাপে জন্ম নিয়েছিল ভাষা-সংস্কৃতিভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ।
একুশের চেতনার বিশেষ লক্ষ্য ছিল সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন এবং বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির সর্বব্যাপী চর্চা ও বিকাশের পথ প্রশস্ত করা। বর্তমানে আমরা তার বাস্তবায়নে যে চিত্র দেখি তা হতাশাব্যঞ্জক। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন বুলিসর্বস্বই রয়ে গেছে, আজও তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। আইন-আদালত, ব্যবসায়-বাণিজ্য, সরকারি অফিস—সর্বত্রই ইংরেজির জয়জয়কার। হ্যাঁ, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে সেটার প্রয়োজন অস্বীকার করার উপায় নেই, তবে সমানতালে বাংলা ভাষা ব্যবহারের উদ্যোগ চোখে পড়ে না।
একুশের চেতনা লালন ও বাংলা ভাষার উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করার কথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। কারণ, সেখানে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা, পঠন-পাঠন ও গবেষণার পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে। সেই বিবেচনায় অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু করে এর পঠন-পাঠন ও গবেষণা করা হচ্ছে। বহুসংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতিবছরই এ বিষয়ে ডিগ্রি নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে এ কারণে যে, বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলা ভাষার উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী ভূমিকা পালন করছে? বাস্তবে তেমন কিছু চোখে পড়ছে না। ডিগ্রি প্রদানের জন্য দু-চারটি প্রথাগত গবেষণাকর্ম ও সেমিনার ছাড়া আর কি কিছু করা হচ্ছে?
এই যেমন বিশ্বের শক্তিশালী ভাষাগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য বাংলা ভাষার যে টেকনিক্যাল উন্নতি বিধান দরকার, তা কতটুকু করতে পারছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো? এ ভাষায় নিত্যনতুন গবেষণা এবং গবেষণালব্ধ সেই জ্ঞান বিস্তারই-বা কতটুকু সম্ভাবিত হচ্ছে? কর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন ভাষাগত দক্ষতায় তাদের কতটুকু দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। বাস্তবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একুশের চেতনা লালন, বাঙালি সংস্কৃতির বিস্তার এবং বাংলা ভাষার উন্নয়নে কার্যকর তেমন কিছুই করা হচ্ছে না। কিন্তু ভাষা আন্দোলন এবং একুশের চেতনা লালন ও বিস্তারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রেখেছেন সবচেয়ে বেশি অবদান।
একে একে দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেতে পারে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর ভাষা আন্দোলনের একেবারে শুরুতে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠায় এ ভাষার গৌরব, শক্তি ও ঐশ্বর্যের কথা সর্বপ্রথম যৌক্তিকভাবে যাঁরা তুলে ধরেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, আবুল কাশেম, এ এস এম নূরুল হক ভূঁইয়া, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, তা ইতিহাসে গৌরবময় স্থান দখল করে আছে। ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন, তাঁদের একজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবুল বরকত। ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত থাকায় গ্রেপ্তার ও কারা নির্যাতনের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, মুজফ্ফর আহমদ চৌধুরী এবং পৃথ্বীশচন্দ্র চক্রবর্তী। এ ছাড়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্র পুলিশি হয়রানি ও হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন।
বায়ান্ন-পরবর্তীকালে কারাগারে বসেই একুশের প্রথম নাটক ‘কবর’ রচনা করেছিলেন মুনীর চৌধুরী। ভাষা আন্দোলনের প্রথম বর্ষপূর্তি উদ্যাপন এবং একুশের প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ প্রকাশে অবদান রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। বাংলা বানান সংস্কার, বাংলা ভাষায় পুস্তক প্রণয়ন, বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা, সর্বোপরি ষাটের দশকে একুশের চেতনা প্রসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবদান সবচেয়ে বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উদ্যোগে স্মারকলিপি প্রদান, সাংস্কৃতিক সপ্তাহ উদ্যাপন, রবীন্দ্রবিরোধী ষড়যন্ত্র মোকাবিলা—পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এসব ছিল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী কাজ। তারই ধারাবাহিকতায় বাঙালির জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ অর্জনেও অগণিত শিক্ষক-শিক্ষার্থী আত্মাহুতি দিয়েছেন।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন আর সেই আবেগ এবং একুশের চেতনার প্রাণস্পন্দন অনুভব করা যায় না। এবারের অমর একুশের স্মৃতিবিজড়িত ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের একুশের আয়োজন বলতে ওই শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন এবং সীমিত পরিসরের আলোচনা সভা চোখে পড়েছে। মাস কিংবা সপ্তাহব্যাপী সাংস্কৃতিক উৎসব, সেমিনার কিংবা কর্মশালা আয়োজন, বাংলা ভাষার উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ-পরিকল্পনা গ্রহণ কিছুই চোখে পড়েনি। বাংলা ভাষাকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে তুলে ধরার মতো গবেষণাকর্ম কিংবা সময়োপযোগী টেকনিক উদ্ভাবনেরও কোনো প্রয়াস লক্ষ করা যায়নি। বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রেও নেই কোনো কর্মপন্থা। না আছে বই, না আছে তা রচনার প্রচেষ্টা। তাহলে উচ্চশিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন হবে কীভাবে? এটা তো ভাষা আন্দোলন কিংবা একুশের চেতনার লক্ষ্য ছিল না।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দায়িত্ব নিতে হবে। বাংলা ভাষার উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা নির্ধারণ করে সেই মোতাবেক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে গবেষণালব্ধ জ্ঞান সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। বাংলা ভাষাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে যে ধরনের দক্ষ মানবসম্পদ প্রয়োজন, তাও গড়ে তুলতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। জ্ঞান সৃষ্টি, জ্ঞান বিতরণ এবং জ্ঞান সংরক্ষণের প্রাণকেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়েই যদি বাংলা ভাষা উপেক্ষিত হয়; তবে এ ভাষার উন্নয়ন ও বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপযোগী করে টিকে থাকার উপায় নির্ধারণ হবে সুদূর পরাহত। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা ভাষার গবেষণা ও পঠন-পাঠনে বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে এ ভাষায় মানসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, নতুন নতুন পরিভাষা সৃষ্টি ও প্রয়োগের ক্ষেত্র নির্ধারণসহ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ ভাষা যাতে এগিয়ে যেতে পারে, সেই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের মহিমায় দীপ্ত একুশে ফেব্রুয়ারি বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা লাভ করেছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলনের গৌরব সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। বাংলা ভাষার শক্তি ও সম্ভাবনার পথ প্রশস্ত করে এ ভাষার উন্নয়ন ও প্রসারে কাজ করে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে প্রণয়ন করতে হবে সময়োপযোগী ভাষা পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের কর্মপন্থা।
লেখক: অধ্যাপক, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের মহিমায় দীপ্ত ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা আবেগে ভারাক্রান্ত হই। নানা আনুষ্ঠানিকতায় পালন করি ‘শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। পুষ্পের ডালি সাজিয়ে শ্রদ্ধা-ভালোবাসার অর্ঘ্য নিবেদন করতে হাজির হই শহীদ মিনারে। শুধু তাই নয়, আলোচনা সভার আয়োজনসহ নানা আনুষ্ঠানিকতায় দিনটি অতিবাহিত করি। এতৎসত্ত্বেও ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ সময় পরে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে—একুশের চেতনা লালন, বাঙালি সংস্কৃতির বিস্তার, বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে আমরা কতটুকু সফল হয়েছি? এমন প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক ও সংগত। কারণ, একুশকে আমরা আনুষ্ঠানিকতায় যতটা পরিণত করতে পেরেছি, ততটা এর চেতনা বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারিনি। বিশেষ করে জ্ঞান সৃষ্টি, সংরক্ষণ ও বিতরণের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ ক্ষেত্রে যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
একুশে ফেব্রুয়ারি এলে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গতানুগতিক রেওয়াজ অনুসারে শহীদদের স্মরণে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন করা হয়। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনা সভা ও সেমিনারের আয়োজন করা হয়। কিন্তু সেগুলো বেশির ভাগই থাকে অনুষ্ঠানসর্বস্ব, তাতে বেশির ভাগ শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীর অংশগ্রহণ থাকে না। এ তো গেল একুশের দিনের চিত্র। সারা বছর কী হয়? ভাষা আন্দোলন সংগঠনের মূলে ছিল বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে হটিয়ে উর্দু-আরবি মিশেলে তথাকথিত ইসলামি তমদ্দুন তথা পাকিস্তানি সংস্কৃতি প্রচলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদের মর্মমূল থেকে যে চেতনা উৎসারিত হয়েছিল, তাতে সব ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বিকশিত হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। বাংলা ভাষা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদালাভ তো করেছিলই, একই সঙ্গে ভাষা-সংস্কৃতিভিত্তিক নতুন জাতীয়তাবোধেরও উন্মেষ ঘটেছিল, যার সূত্র ধরে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চূড়ান্ত ধাপে জন্ম নিয়েছিল ভাষা-সংস্কৃতিভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ।
একুশের চেতনার বিশেষ লক্ষ্য ছিল সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন এবং বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির সর্বব্যাপী চর্চা ও বিকাশের পথ প্রশস্ত করা। বর্তমানে আমরা তার বাস্তবায়নে যে চিত্র দেখি তা হতাশাব্যঞ্জক। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন বুলিসর্বস্বই রয়ে গেছে, আজও তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। আইন-আদালত, ব্যবসায়-বাণিজ্য, সরকারি অফিস—সর্বত্রই ইংরেজির জয়জয়কার। হ্যাঁ, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে সেটার প্রয়োজন অস্বীকার করার উপায় নেই, তবে সমানতালে বাংলা ভাষা ব্যবহারের উদ্যোগ চোখে পড়ে না।
একুশের চেতনা লালন ও বাংলা ভাষার উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করার কথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। কারণ, সেখানে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা, পঠন-পাঠন ও গবেষণার পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে। সেই বিবেচনায় অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু করে এর পঠন-পাঠন ও গবেষণা করা হচ্ছে। বহুসংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতিবছরই এ বিষয়ে ডিগ্রি নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে এ কারণে যে, বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলা ভাষার উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী ভূমিকা পালন করছে? বাস্তবে তেমন কিছু চোখে পড়ছে না। ডিগ্রি প্রদানের জন্য দু-চারটি প্রথাগত গবেষণাকর্ম ও সেমিনার ছাড়া আর কি কিছু করা হচ্ছে?
এই যেমন বিশ্বের শক্তিশালী ভাষাগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য বাংলা ভাষার যে টেকনিক্যাল উন্নতি বিধান দরকার, তা কতটুকু করতে পারছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো? এ ভাষায় নিত্যনতুন গবেষণা এবং গবেষণালব্ধ সেই জ্ঞান বিস্তারই-বা কতটুকু সম্ভাবিত হচ্ছে? কর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন ভাষাগত দক্ষতায় তাদের কতটুকু দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। বাস্তবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একুশের চেতনা লালন, বাঙালি সংস্কৃতির বিস্তার এবং বাংলা ভাষার উন্নয়নে কার্যকর তেমন কিছুই করা হচ্ছে না। কিন্তু ভাষা আন্দোলন এবং একুশের চেতনা লালন ও বিস্তারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রেখেছেন সবচেয়ে বেশি অবদান।
একে একে দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেতে পারে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর ভাষা আন্দোলনের একেবারে শুরুতে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠায় এ ভাষার গৌরব, শক্তি ও ঐশ্বর্যের কথা সর্বপ্রথম যৌক্তিকভাবে যাঁরা তুলে ধরেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, আবুল কাশেম, এ এস এম নূরুল হক ভূঁইয়া, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, তা ইতিহাসে গৌরবময় স্থান দখল করে আছে। ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন, তাঁদের একজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবুল বরকত। ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত থাকায় গ্রেপ্তার ও কারা নির্যাতনের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, মুজফ্ফর আহমদ চৌধুরী এবং পৃথ্বীশচন্দ্র চক্রবর্তী। এ ছাড়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্র পুলিশি হয়রানি ও হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন।
বায়ান্ন-পরবর্তীকালে কারাগারে বসেই একুশের প্রথম নাটক ‘কবর’ রচনা করেছিলেন মুনীর চৌধুরী। ভাষা আন্দোলনের প্রথম বর্ষপূর্তি উদ্যাপন এবং একুশের প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ প্রকাশে অবদান রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। বাংলা বানান সংস্কার, বাংলা ভাষায় পুস্তক প্রণয়ন, বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা, সর্বোপরি ষাটের দশকে একুশের চেতনা প্রসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবদান সবচেয়ে বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উদ্যোগে স্মারকলিপি প্রদান, সাংস্কৃতিক সপ্তাহ উদ্যাপন, রবীন্দ্রবিরোধী ষড়যন্ত্র মোকাবিলা—পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এসব ছিল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী কাজ। তারই ধারাবাহিকতায় বাঙালির জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ অর্জনেও অগণিত শিক্ষক-শিক্ষার্থী আত্মাহুতি দিয়েছেন।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন আর সেই আবেগ এবং একুশের চেতনার প্রাণস্পন্দন অনুভব করা যায় না। এবারের অমর একুশের স্মৃতিবিজড়িত ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের একুশের আয়োজন বলতে ওই শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন এবং সীমিত পরিসরের আলোচনা সভা চোখে পড়েছে। মাস কিংবা সপ্তাহব্যাপী সাংস্কৃতিক উৎসব, সেমিনার কিংবা কর্মশালা আয়োজন, বাংলা ভাষার উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ-পরিকল্পনা গ্রহণ কিছুই চোখে পড়েনি। বাংলা ভাষাকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে তুলে ধরার মতো গবেষণাকর্ম কিংবা সময়োপযোগী টেকনিক উদ্ভাবনেরও কোনো প্রয়াস লক্ষ করা যায়নি। বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রেও নেই কোনো কর্মপন্থা। না আছে বই, না আছে তা রচনার প্রচেষ্টা। তাহলে উচ্চশিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন হবে কীভাবে? এটা তো ভাষা আন্দোলন কিংবা একুশের চেতনার লক্ষ্য ছিল না।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দায়িত্ব নিতে হবে। বাংলা ভাষার উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা নির্ধারণ করে সেই মোতাবেক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে গবেষণালব্ধ জ্ঞান সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। বাংলা ভাষাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে যে ধরনের দক্ষ মানবসম্পদ প্রয়োজন, তাও গড়ে তুলতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। জ্ঞান সৃষ্টি, জ্ঞান বিতরণ এবং জ্ঞান সংরক্ষণের প্রাণকেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়েই যদি বাংলা ভাষা উপেক্ষিত হয়; তবে এ ভাষার উন্নয়ন ও বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপযোগী করে টিকে থাকার উপায় নির্ধারণ হবে সুদূর পরাহত। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা ভাষার গবেষণা ও পঠন-পাঠনে বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে এ ভাষায় মানসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, নতুন নতুন পরিভাষা সৃষ্টি ও প্রয়োগের ক্ষেত্র নির্ধারণসহ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ ভাষা যাতে এগিয়ে যেতে পারে, সেই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের মহিমায় দীপ্ত একুশে ফেব্রুয়ারি বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা লাভ করেছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলনের গৌরব সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। বাংলা ভাষার শক্তি ও সম্ভাবনার পথ প্রশস্ত করে এ ভাষার উন্নয়ন ও প্রসারে কাজ করে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে প্রণয়ন করতে হবে সময়োপযোগী ভাষা পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের কর্মপন্থা।
লেখক: অধ্যাপক, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
পর্দার নায়িকারা নিজেদের বয়স আড়ালে রাখা পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আজমেরী হক বাঁধন। প্রতিবছর নিজের জন্মদিনে জানান দেন তাঁর বয়স। গতকাল ছিল বাঁধনের ৪১তম জন্মদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই জানালেন এই তথ্য।
২ দিন আগে১০ বছরের বেশি সময় ধরে শোবিজে কাজ করছেন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। নাটকের পাশাপাশি ওটিটিতে দেখা গেছে তাঁকে। সরকারি অনুদানের ‘দেবী’ নামের একটি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। প্রশংসিত হলেও সিনেমায় আর দেখা মেলেনি তাঁর। ছোট পর্দাতেও অনেক দিন ধরে অনিয়মিত তিনি। এবার শবনম ফারিয়া হাজির হচ্ছেন নতুন পরিচয়ে। কমেডি রিয়েলিটি
২ দিন আগেআমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য যাত্রাপালা। গণমানুষের সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত এই যাত্রাপালা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করছে ‘যাত্রা উৎসব-২০২৪’। আগামী ১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে শুরু হবে ৭ দিনব্যাপী এই উৎসব।
২ দিন আগে‘বঙ্গবন্ধু’ পদবি বিলীন হবে না। হতে পারে না। যেমনটি ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশের পদবি বিলীন হয়নি। ইতিহাসে এসব পদবি অম্লান ও অক্ষয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ। আপনজনকে তো অবশ্যই, শত্রুপক্ষের লোকেরাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপদের
২ দিন আগে