বাজেট বাস্তবায়নে করণীয় ৪টি কাজ

আব্দুর রাজ্জাক
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৪, ০৭: ৪৪

এবার বাজেটে রিজার্ভ স্থিতিকরণের একটি বাস্তবধর্মী প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে। একটি কথা মনে রাখতে হবে, আমাদের রিজার্ভ একসময় ৪৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল, মতান্তরে সেই রিজার্ভ এখন দাঁড়িয়েছে ২০ বিলিয়ন ডলারে। আপাতত এই রিজার্ভে কোনো অসুবিধা না হলেও সবার মনেই উৎকণ্ঠা ও শঙ্কা আছে।

এই উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিয়েছে বিভিন্ন মুখরোচক কথা। ব্যাংকে এলসি খুলতে গেলে আসলেই সহজে এখন আর সেটা সম্ভব হচ্ছে না।বিদেশে চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্য দুই বছর আগেও যেভাবে সহজে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় করা বা বহন করা যেত, এখন তা অনেকটাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। এই সংকট ধীরে ধীরে ঘনীভূত হচ্ছে, সামনে আরও তীব্রতর হবে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। গত এক বছরের প্রাক্কলন দেখলে এই ভীতি যে অমূলক নয়, তার বাস্তব চিত্র বোঝা যাবে। রিজার্ভ স্থিত করতে যে কয়টি কাজ করা উচিত, সেগুলো বিশ্লেষণ করছি।

ক. দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ব্যক্তি যাঁরা বিদেশে কর্মরত আছেন, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যসহ মালয়েশিয়া, ইতালি, সিঙ্গাপুর, গ্রেট ব্রিটেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, তাঁরা প্রতি মাসেই দেশে টাকা পাঠান। এই টাকার উৎস সম্পর্কে একটি ধারণা নিতে হবে। প্রতিটি গ্রাম, ইউনিয়ন ও থানা পর্যায়ে কতজন লোক বিদেশ থেকে প্রতি মাসে টাকা পাঠান, এই টাকা যদি ব্যাংকিং চ্যানেলে বিদেশি মুদ্রায় আসে, তাঁদের একধরনের তালিকা তৈরি করতে হবে। যদি সেই টাকা স্থানীয় ব্যাংক থেকে সরাসরি বা কোনো গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে আসে, তাহলে বুঝতে হবে সেটি হুন্ডি হচ্ছে। তাদেরও একটি তালিকা তৈরি করতে হবে। পরে যাঁরা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছেন, তাঁদের সতর্ক করতে হবে অথবা বোঝাতে হবে যে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানো লাভজনক, নিজের জন্য ও দেশের জন্য।

এখানে একটি কথা বলতেই হবে। স্থানীয় পর্যায়ে কোনো রকম আতঙ্ক সৃষ্টি করা যাবে না। তাহলে স্থানীয় ‘টাউট’ শ্রেণির মানুষ ও স্থানীয় কিছু সরকারি কর্মচারী এই উদ্যোগের অপব্যবহার করে মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করবে। আর একটা দিক লক্ষ রাখতে হবে, প্রতিবছর টাকার অবমূল্যায়ন করে ডলারের দাম বাড়িয়ে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সরকার যদি ৫ টাকা বাড়ায়, হুন্ডি ব্যবসায়ীরা ৬ টাকা বাড়িয়ে দেবে, এটা চলতেই থাকবে সরকারি রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। এখানে জনসচেতনতা ও স্থানীয় প্রশাসনের মোটিভেশনাল যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করতে হবে।

খ. আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন ও অতিমূল্যায়ন রোধ করতেই হবে। আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রেই অবমূল্যায়ন হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র দুভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে অঙ্কের টাকা অবমূল্যায়ন হয়, সেই টাকার বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে ক্রয় করা হয়। হুন্ডির মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা হলে সরকার বৈদেশিক মুদ্রা এবং রাজস্ব হারায়। রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে অতিমূল্যায়ন হয়। এ ক্ষেত্রে অতিমূল্য দেখিয়ে রপ্তানি করে, সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়; বিশেষ করে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির ক্ষেত্রে উচ্চমূল্য দেখিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়।

যেসব পণ্যের শুল্ক হার শূন্য অথবা শূন্যের কাছাকাছি, ১ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে, এসব পণ্যের ক্ষেত্রেও উচ্চমূল্য দেখিয়ে পণ্য আমদানি করা হয়। বন্ডের মাধ্যমে আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে উচ্চমূল্য দেখানো হয়। এখানে রাষ্ট্রের তিন ধরনের ক্ষতি হয়। প্রথমত, বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়। দ্বিতীয়ত, সরকার রাজস্ব হারায়। তৃতীয়ত, স্থানীয় শিল্প রুগ্‌ণ হতে থাকে। উল্লিখিত ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ ভূমিকা নিতে পারে। শুধু দরকার সদিচ্ছা ও সঠিক মনিটরিং।
 
২. দ্বিতীয় যে কাজটি করতে হবে তা হলো, ব্যাংকের তারল্যসংকট দূর করা। বর্তমানে ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু হওয়ার দরুন কালোটাকা ব্যাংকে রাখা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। সাধারণত ঘুষের টাকা, দুর্নীতির টাকা, ট্যাক্স ফাঁকির টাকা, চাঁদাবাজির টাকা, অর্থাৎ অবৈধ কালোটাকা এখন আর কেউ ব্যাংকে রাখতে সাহস পাচ্ছে না। কালোটাকারমালিকেরা টাকা রাখে সিন্দুকে। অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের সিন্দুক-তত্ত্ব এখানে প্রযোজ্য। সিন্দুক-তত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে এই টাকা কোথায় রাখে, কীভাবে রাখে, সেটা বোঝা যাবে।

২০২৩ সালে কয়েক হাজার কোটি টাকার নোট ছাপা হয়েছিল। বর্তমান বাজারে নতুন টাকার নোট নেই বললেই চলে। নতুন নোট নেই, অর্থাৎ সব টাকা চলে গেছে সিন্দুকে! এই টাকা সিন্দুক থেকে ব্যাংকে এবং বাজারব্যবস্থায় নিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ঘুষ-বাণিজ্য বন্ধ করলে আপাতত মানুষ সিন্দুকে টাকা রাখবে না। কিন্তু যে পরিমাণ টাকা সিন্দুকে আছে, সেটা নিয়ে আসতে হলে অবশ্যই কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগ করতে হবে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে একযোগে কয়েক শ বাড়িতে অভিযান চালালে হয়তো কিছু টাকা বেরিয়ে আসবে।

প্রণোদনা দিয়ে কালোটাকা সাদা করার প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে আসতে হবে। অতীতে দেখা গেছে, কিছু ট্যাক্স দিয়ে কালোটাকা সাদা করার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ভেস্তে গেছে। তিন বছর আগের ৭ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে বিদেশ থেকে অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া একেবারে বিফলে গেছে। ১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে যদি কালোটাকা সাদা করার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে, তাহলে ঘুষ-দুর্নীতি আরও বেড়ে যাবে। দুর্নীতিবাজেরা এখন যেখানে ১০০ টাকা ঘুষ দাবি করে, সেখানে আগামীতে ১১৫ টাকা দাবি করবে। তবে যদি টাকার উৎস ঠিক থাকে, শুধু কোনো কারণে ট্যাক্স দিতে বিলম্ব হয়েছে, সে ক্ষেত্রে ট্যাক্স দিয়ে কালোটাকা সাদা করা যায়। পিপিপির মাধ্যমে কোনো সরকারি উন্নয়ন খাতে, অর্থাৎ দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, চিকিৎসাসেবা অথবা অতিপ্রয়োজনীয় কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে কালোটাকা ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে।

৩. ঋণখেলাপিদের ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। ২ শতাংশ দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে আসতে হবে। দেখা গেছে, বছর শেষে যাঁর ১০ কোটি টাকার কিস্তি দেওয়ার কথা, তিনি স্বীকৃতভাবে ২ শতাংশ কিস্তি দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল করে, আবার ২০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এই প্রক্রিয়া থেকে বের না হতে পারলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, অনেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে পড়বে।  

৪. আমাদের পুঁজিবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আছেন ৩০ থেকে ৪০ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। গত ১০ বছরে পুঁজিবাজারের অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বেশির ভাগ শেয়ারের কোনো দাম বাড়েনি। এসব কোম্পানির ডিভিডেন্টের হার মুদ্রাস্ফীতির ৪ ভাগের ১ ভাগও না; অর্থাৎ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা প্রতিদিন তাঁদের পুঁজি হারাচ্ছেন। এ রকম পুঁজি হারানোর কারণ হলো, যেসব প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে এসেছে তা অতিমূল্যায়িত হয়ে এসেছে। অতিমূল্যায়নের পরে আবার প্রিমিয়াম যোগ করে বাজারে এসেছে। বাজারে আসার পরে ছলেবলে কৌশলে প্রথম দুই বছর ১০ শতাংশ ডিভিডেন্ট দিয়ে অতিমূল্যায়িত করা হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারমূল্য। যখন প্লেসমেন্ট শেয়ার ও উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার বিক্রি হয়ে গেছে, তখন ধস নেমেছে ওই সব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারমূল্য। কয়েকজন ব্যক্তি এখান থেকে শত শত কোটি টাকার ব্যবসা করলেও কয়েক লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী পথে বসে গেছেন। পুঁজিবাজারের এ অবস্থা থেকে অবশ্যই বের হয়ে আসতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠানের ফেস ভ্যালু যেন কোনোক্রমেই অতিমূল্যায়িত না হয়, সেদিকে এখন থেকেই নজর দিতে হবে।

উল্লিখিত চারটি কাজের প্রক্রিয়া এই বাজেটের প্রথম দিন থেকেই কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আগামী বছর থেকে বৈদেশিক ঋণের সুদ শোধ করার প্রক্রিয়া শুরু হবে কঠোরভাবে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে এ চারটি প্রক্রিয়া শুরু করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ খোলা থাকবে না।

লেখক: প্রকৌশলী

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত