অশান্ত সাগরে টহল কমের সুযোগ নিচ্ছে পাচারকারীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২২, ১৪: ১৪

বঙ্গোপসাগর থেকে আন্তর্দেশীয় যাত্রীবাহী কোনো জাহাজ চলাচল নেই। উপকূলে কিছু আন্তজেলা নৌযান চললেও সেগুলো সাগর, আকাশ আর মেঘের মেজাজ বুঝে চলে। শুধু মানব পাচারকারীরা সেসবের ধার ধারে না। সাগর অশান্ত থাকলে টহল কম থাকবে, এই ভাবনায় এবার হেমন্ত বিদায় নেওয়ার আগে তারা বেপরোয়াভাবে মাঠে নেমে পড়েছে। পাচারে ব্যবহার করা একটি ট্রলার ডুবে গত মঙ্গলবার কমপক্ষে চারজন মারা যাওয়া এবং কিছু লোক উদ্ধার হওয়ার পর বিষয়টি সবার সামনে আসে।

সাগরে টেকনাফের কাছাকাছি সংঘটিত এই ট্রলারডুবির পর গতকাল বুধবার পর্যন্ত চার বছরের এক শিশু ও তিন তরুণীর মরদেহ পাওয়া গেছে। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৪৫ নারী-পুরুষকে। উদ্ধার ব্যক্তিদের মধ্যে ৮ জন নারী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে দেওয়া উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের ভাষ্য অনুযায়ী, আরও ১০ জন নিখোঁজ রয়েছে।

মালয়েশিয়ায় পাঠানোর আশ্বাসে এসব নারী, পুরুষ ও শিশুকে কয়েক সপ্তাহের প্রস্তুতির পর কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকা থেকে প্রথমে নৌকায় এবং পরে ট্রলারে তুলে পাচার করা হচ্ছিল বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন। তাঁদের এবং পরিবারের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ন্যূনতম ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা। আবার কেউ কেউ এখানে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে মালয়েশিয়া পৌঁছার পর ৪ লাখ টাকা পরিশোধ করবেন— এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পাচারকারীদের।

ক্যাম্পগুলো থেকে এভাবে রোহিঙ্গাদের বিদেশে যাওয়ার চেষ্টাকে ‘বেপরোয়া যাত্রা’ বলে উল্লেখ করে অভিহিত করেছেন মানব পাচার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও রামরুর (রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট) চেয়ারপারসন অধ্যাপক তাসনিম আরেফা সিদ্দিকী। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, সাগর অশান্ত থাকলে মানব পাচার বন্ধ থাকে। এবার সাগর শান্ত হতে শুরু করার আগেই আবার পাচার শুরু হয়ে গেছে। এবারের পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের অনেকে নারী ও শিশু, এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে মানব পাচারের উৎস ও ট্রানজিট রুট হিসেবে বাংলাদেশকে প্রশ্নের মুখোমুখি করার ঝুঁকি আছে।

এদিকে মালয়েশিয়াগামী ট্রলারডুবির ঘটনায় পুলিশ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে আটক করেছে ৬ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানান টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কতুবজোম এলাকার আবদুর রশিদের ছেলে কোরবান আলী (৩২), করিম উল্লাহর ছেলে মো. সেলিম (৩২), ঈদগাঁর রশিদ আহমদের ছেলে মো. আব্দুল্লাহ (২১), টেকনাফ সাবরাংয়ের মৃত হাছান আলীর ছেলে শহিদ উল্লাহ (৩০) ও উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের মো. রশিদ ও মো. শরীফ।  নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, পুরো বিষয়টি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী কাজ করছে। 

কীভাবে ডুবল
উদ্ধার হওয়া ইয়াসির আরাফাতসহ অন্যরা আজকের পত্রিকাকে বলেন, দালালেরা তাদের দলটিকে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন পাহাড়ে ৩ থেকে ১০ দিন রাখে। পরে ছোট ছোট নৌকায় টেকনাফের কচ্ছপিয়া এলাকায় ছোট একটি ট্রলারে তাঁদের তুলে দেয়। প্রায় দুই ঘণ্টা চলার পর গভীর সাগরে একটি বড় মাছ ধরার ট্রলারে তোলা হয়।

ট্রলারটি ছিল লক্কড়ঝক্কড়। ভেতরে জায়গা হচ্ছিল না। এ সময় বরফ রাখার ঘরে সবাইকে নেওয়া হয়। দালালের লোকজন শাবল দিয়ে বরফ ভেঙে ফেলার সময় ট্রলারের তলা ফুটো হয়ে যায়। এতে ট্রলারটি ডুবে যেতে থাকে। এ সময় জীবন বাঁচাতে যে যেভাবে পারে সাগরে ঝাঁপ দেয়।

স্থানীয় বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন আজকের পত্রিকাকে জানান, উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য রয়েছে। তাদের সঙ্গে স্থানীয় কিছু মানুষও জড়িত।  

এর আগে, ২০২০ সালের এপ্রিলের শেষে অবৈধভাবে জাহাজে মালয়েশিয়া সীমান্তে পৌঁছালেও দেশটিতে প্রবেশ করতে না পেরে টেকনাফের বাহারছড়া সমুদ্রসৈকত থেকে ফিরে আসে রোহিঙ্গাদের একটি দল। তখন ৩৯৬ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছিল বাংলাদেশ কোস্টগার্ড। ওই দলের সঙ্গে থাকা অন্তত ৩০ রোহিঙ্গা খাদ্য ও পানির সংকটে মারা যায়। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত