জন্মজয়ন্তীতে নজরুল: বিক্ষিপ্ত ভাবনা

মামুনুর রশীদ
প্রকাশ : ২৫ মে ২০২৩, ০৯: ১৪

আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ। এই দিনে ১৩০৬ বঙ্গাব্দে আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে জন্মেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ইংরেজি ১৮৯৯ সালে জন্মে মাত্র কুড়ি বছর বয়সেই সাহিত্যে তাঁর আগমনের বার্তা ধ্বনিত হয়েছিল। এর দুই বছর পরেই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে তাঁর দিগ্‌বিজয় ঘোষিত হয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতায় তাঁর জ্ঞানের পরিধি পরিমাপ করতে গিয়ে তখনকার পাঠক-সমালোচকেরা অবাক বিস্ময়ে এক অলৌকিক প্রতিভার সন্ধান পান।

কালক্রমে চুরুলিয়ার সেই লেটো গানের দলের শিশু নজরুল গোটা বাংলা সাহিত্যে এক বিশাল আবহের সৃষ্টি করেছেন। তিনি কাব্যে, উপন্যাসে, ছোটগল্পে, প্রবন্ধে, অনুবাদে এবং সর্বোপরি সংগীতের এক অনন্য প্রতিভা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। যখন ‘ওমর খৈয়াম’ অনুবাদ করেন, তখন প্রশ্ন উঠেছিল নজরুল কতটা ফারসি জানেন। সৈয়দ মুজতবা আলী এর একটা জবাবও দিয়েছিলেন। যখন কোনো কবি অন্য কবির কবিতা অনুবাদ করেন, ভিন্ন ভাষী হওয়া সত্ত্বেও তিনি তা বুঝতে পারেন। বিদ্রোহী কবিতা রচনার আগে ওই বয়সে এতগুলো ধর্মগ্রন্থ, এতগুলো মিথ তিনি কী করে জানলেন, এটাও একটা বিস্ময়ের ব্যাপার। 

সাহিত্য সাধনা এবং সংগীতেই তিনি শুধু থেমে থাকেননি। পরাধীন ভারতবর্ষে লুটেরা ব্রিটিশদের এ দেশ থেকে তাড়াতে সক্রিয় রাজনীতিতেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেখানে তিনি খুব সফল না হলেও আন্তরিকভাবে সেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। পত্রিকা সম্পাদনার কাজ তিনি বারবার গ্রহণ করেছেন। কিন্তু শেষ জীবনে এসে তাঁর প্রধান কর্মক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল সংগীত। এটাও বিস্ময়ের ব্যাপার যে ওই বয়সে তিনি ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীতের সঙ্গে কীভাবে এত গভীরভাবে মিশে গেলেন এবং তা আত্মস্থ করলেন! তাঁর অসংখ্য রাগাশ্রয়ী গান প্রমাণ করে যে তিনি সংগীতের নানা দিক গভীরভাবে বুঝতেন, চর্চা করতেন এবং লেখা ও সুর সৃষ্টিতেও আত্মনিয়োগ করতেন। তিনিই প্রথম পঞ্চগীতি কবিদের মধ্যে সংগীতের একাধিপত্যে বিশ্বাস করতেন না। তাঁর গান অন্য সুরকারেরাও সুর দিতেন। সেই গানগুলো প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে জনপ্রিয় হয়েছে এবং শ্রোতার হৃদয়ের গভীরে তা স্পর্শ করেছে। 

অনেকেই বলেন, বিশেষ করে অধ্যাপক ও গবেষকেরা নিম্নবর্গের মানুষদের শিল্পের অধিকার নিয়ে কথা বলেন। তাঁরা বর্তমানের কোনো অর্ধশিক্ষিত এবং অশ্লীল শিল্পচর্চাকে নিম্নবর্গের শিল্পীদের অধিকার বলে মনে করেন। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামের কথা তাঁরা সহসাই ভুলে যান, ভুলে যান লালন সাঁইজির কথাও। কাজী নজরুল ইসলাম কি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন? তাঁর জন্য স্কুল-কলেজের দ্বার উন্মুক্ত ছিল না, মক্তবে পড়া অবস্থাতেই তাঁকে যেতে হয়েছিল লেটো গানের দলে। শিক্ষার প্রতি এক দুর্নিবার আগ্রহে তিনি শহর থেকে শহরে ঘুরেছেন। তারপরও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর ভাগ্যে তেমন জোটেনি। সম্ভবত এটাই তাঁর সৌভাগ্য। যেমন রবীন্দ্রনাথও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দিকে কখনো যাননি। তিনি যে কতটা অধ্যয়ন করেছেন এবং নিজেকে তৈরি করার জন্য বিশ্বের তাবৎ সাহিত্যের কাছে যেতে চাইতেন। এটা ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে! অনেক ধর্মগ্রন্থ এবং পাশাপাশি মহাভারত, রামায়ণ এবং উপনিষদও তিনি পড়েছেন গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে।

তাঁর জীবনে রয়েছে অনেক বঞ্চনা, অনেক গ্লানি এবং সেই সঙ্গে অবহেলা। একদিকে ভারতবর্ষের নিরন্ন অনাহারী মানুষ, অন্যদিকে বিশাল কাব্যসম্ভার সংগীতের মহাসমুদ্রে নিপতিত ভারতবর্ষ। দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে তিনি শিল্পের অকূল সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। মাত্র বাইশ বছরের সৃজনশীল জীবনে সাহিত্যের এতগুলো ক্ষেত্রে তাঁর পদচারণ এবং সেই সঙ্গে সংগীতের এক নতুন দিগন্ত আবিষ্কার করা কেবল নজরুলের পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল। 

১৯২৯ সালে কলকাতার আলবার্ট হলে তাঁর সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল যখন, তাঁর বয়স তখন মাত্র একত্রিশ। সেই সভায় বাঙালির অনেক বড় বড় নেতা, কবি এবং সুধীজনের উপস্থিত থাকার কথা ছিল। অনেকই আসেননি। তারপরও সেখানে উপস্থিত ছিলেন নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু। নেতাজি তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আমাদের রণসংগীত ছিল না, নজরুল আমাদের রণসংগীত দিয়েছেন। আমরা যখন যুদ্ধে যাব, নজরুলের গান গাইতে গাইতে যাব। নজরুল আমাদের কারাগারের গান দিয়েছেন। আমরা যখন কারাগারে থাকব, তখন নজরুলের গান গাইতে গাইতে আমরা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখব।’ গণসংগীত শব্দটি বলার সঙ্গে সঙ্গে যে মুখটি ভেসে ওঠে, সেটি কিন্তু নজরুলের। 

নজরুল মুক্তির গান খুঁজতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সংগীতের অনুবাদও করেছেন। তাহলে বোঝা যায় যে নজরুল আন্তর্জাতিক বিপ্লবের একটা কালের কেন্দ্রে অবস্থান করতেন। তাই তো করাচিতে বসেই তিনি রাশিয়ার বলশেভিক পার্টি ও আন্দোলনের কথা, বিজয়ের কথা জেনেছিলেন। মানুষের মুক্তির প্রতি যে আকাঙ্ক্ষা দেখা যাচ্ছে, সতেরো-আঠারো বছর বয়সেই সেটা তাঁর মধ্যে স্থান পেয়েছিল। তিনি তাঁর সাহিত্যচর্চার শুরুতে নামের সঙ্গে হাবিলদার যুক্ত করেছিলেন। জীবনাচরণের ক্ষেত্রেও তিনি একজন সৈনিকের আচারকে গ্রহণ করেছিলেন। সেই সময়ে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের একটি সম্মেলনে তিনি স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্বে ছিলেন। এই দায়িত্ব পালনকালে তিনি ফিল্ড মার্শালের পোশাক পরেছিলেন।

নজরুলের গানের যে বিচিত্র বিস্তার তা আজ পর্যন্ত অন্য গীতিকবিদের মধ্যে দেখা যায়নি। বিষয়বস্তুর দিক থেকেও তিনি বহুগামী। প্রকৃতি, প্রেম, ধর্মীয় সংগীত সেই সঙ্গে দুই ধর্মের সংগীত, উদ্দীপনামূলক গণসংগীত, রণসংগীত, আবার বাংলার আবহমান কালের সুরও তিনি ধারণ করেছিলেন। আপাদমস্তক এবং রক্তের প্রতিটি কণায় তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করতেন। এতে কোনো কোনো সমাজ ক্ষুব্ধ হতো, তীব্র সমালোচনা ও কুৎসা তাঁকে বিদ্ধ করেছে। কিন্তু একমুহূর্তের জন্যও তিনি আদর্শচ্যুত হননি।

তাঁর জীবনটা ছিল আবেগে ভরা মানবিক। বসন্ত রোগে বুলবুল যখন মারা যায়, তখন তিনি প্রায় কপর্দকহীন। বুলবুল গাড়িতে চড়তে ভালোবাসত, তাই তার মরদেহ গোরস্থানে গাড়িতে করেই নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু বসন্ত রোগীকে কেউ তখন গাড়িতে তুলতে রাজি হয়নি। তখন তাঁর এক পরিচিত স্বজন এসে সহায় হন। শেষে এক সদাশয় চালক বুলবুলের মৃতদেহটি গোরস্থানে নিয়ে আসেন। তারপর খুব অল্প লোকের সাহায্যে বুলবুলকে সমাধিস্থ করা হয়। এমনি দারিদ্র্যের মধ্যে তিনি জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। স্ত্রী প্রমীলা অসুস্থ, ঘরে খাবার নেই, নজরুল কলকাতার বাইরে থেকে জ্বর নিয়ে ফিরেছেন। গৃহের এই অবস্থায় তিনি একটি ট্যাক্সি করে গ্রামোফোন কোম্পানিতে চলে আসেন। গান রচনা করেন, সুর করেন এবং কোম্পানির কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভাড়া পরিশোধ করে সামান্য কিছু টাকা নিয়ে ঘরে ফেরেন। সেই গান অবশ্য পরবর্তীকালে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। তাঁর অসুস্থতা নিয়েও নানা বিভ্রান্তি চারদিকে ছড়িয়েছে কিন্তু প্রখ্যাত চিকিৎসক বিধান চন্দ্র রায় প্রথমেই বলেছিলেন এটি সিফিলিস নয়, কোনো ধরনের স্নায়বিক রোগ। তাঁর এক ভক্ত, অস্ট্রিয়াপ্রবাসী বাঙালি ডাক্তার নজরুলকে ভিয়েনায় নিয়ে যান। সেখানে এবং পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডে প্রমাণিত হলো এটি মস্তিষ্কের রোগ নয়, সিফিলিসও নয়—এটি একটি জটিল স্নায়বিক ব্যাধি, যার চিকিৎসা তখনো বের হয়নি।

তবে নজরুলের প্রতি অবহেলারও শেষ ছিল না। পাকিস্তান সরকার তাঁর জন্য নানা রকম উদ্যোগ দেখিয়েছে এবং সেই সঙ্গে তাঁর চিকিৎসার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। তাঁর পুত্র কাজী সব্যসাচী বেশ কয়েকবার তদানীন্তন ক্ষমতাসীনদের কাছে দেনদরবারও করেছেন। কিন্তু কিছুই মেলেনি। পশ্চিমবঙ্গেও সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর জন্য নানা রকম প্রতিশ্রুতি এসেছে। কিন্তু এর ছোট্ট একটি অংশই তাঁর ভাগ্যে জুটেছে। 

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় তাঁর আগমন, অবস্থান—সবকিছুই যত্নের সঙ্গে পালন করার চেষ্টা হয়েছে। দুই দেশেই নজরুলের নামে ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু নজরুলচর্চা বা নজরুলের প্রতি মানুষের ভালোবাসাকে যথার্থ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। নজরুলের যৌবনে বাংলার শ্রেষ্ঠ গায়ক-গায়িকারা তাঁর গান গেয়েছেন, সুরকারেরা সুর দিয়েছেন, নজরুল তখন জীবন্ত হয়ে উঠেছিলেন। আজ জীবন্ত নজরুলকে আমরা দেখতে পাই না—না তাঁর গানে, না তাঁর সাহিত্যে। দায়সারা গোছের নজরুলজয়ন্তী উদ্‌যাপন, রেডিও-টেলিভিশনে কিছু গান অথবা তাঁর গল্পের নাট্যরূপ আমরা দেখতে পাই বটে, কিন্তু নজরুল আমাদের জীবনচর্চায় একটা স্থান দখল করতে পারতেন, যা আংশিকভাবেও হয়ে ওঠেনি।

মোল্লাদের প্রতি সেই সময়ে নজরুলের প্রবল ক্ষোভ ছিল, তাঁর সাহিত্যে এর স্পষ্ট প্রতিফলন আছে। আজ ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার বিরুদ্ধে নজরুল দাঁড়াতে পারতেন। এ কথাটাও আমরা প্রায় বিস্মৃত হতে চলেছি। তবুও নজরুল তাঁর সাহিত্যে, গানে চির অমর হয়ে থাকবেন। তাঁর সৃষ্টি সুধা পান করে বাঙালি এখনো একটা নবজীবন পেতে পারে।

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত