আটপৌরে

রাজীব কুমার সাহা
প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২৪, ০৭: ৩৭

বাংলা ভাষায় একটি অতিপরিচিত শব্দ হলো ‘আটপৌরে’। আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তায় আটপৌরের মতো এমন অনেক শব্দই আমরা যথাযথ উৎস এবং অর্থ না জেনেই ব্যবহার করি। তাতে অবশ্য মনের ভাব প্রকাশে তেমন অসুবিধা না হলেও প্রকৃত অর্থ জানা থাকলে কথা বলার আগেই হয়তো আমরা খানিকটা চমকে উঠব। আমাদের গ্রামীণ জীবন ও জনপদে এই অতি ব্যবহার্য শব্দটি প্রতিনিয়ত নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্কের বন্ধন সুদৃঢ় করে চলেছে। আমরা বলি, আটপৌরে শাড়ি, আটপৌরে জীবন, আটপৌরে ভাষা প্রভৃতি। প্রশ্ন হলো, আটপৌরে শব্দের প্রকৃত অর্থ কী? বাংলা ভাষায় কীভাবে আটপৌরে শব্দটি বিবিধ প্রায়োগিক অর্থে স্থান করে নিয়েছে? তবে চলুন, আটঘাট বেঁধে আজ জানব আটপৌরের আদি-অন্ত।

আটপৌরে বাংলা শব্দ। এটি বিশেষণ পদ। আটপৌরে শব্দের অর্থ হলো সর্বদা ব্যবহারের উপযুক্ত; পোশাকি নয় এমন বা সাধারণ; আনুষ্ঠানিক বা ফরমাল নয় এমন। বস্তুত শব্দটি এসেছেও সর্বক্ষণ পরিধান করে থাকা যায় এমন কাপড় বোঝাতে। তাপমাত্রার তারতম্য সত্ত্বেও যে কাপড়টি সর্বদা পরে থাকা যায়, সেটিকে ব্যাকরণিকভাবে বলে আটপৌরে; অর্থাৎ অষ্টপ্রহর পরিধেয় এমন। এবার আটপৌরে শব্দটিকে আর একটুখানি কাটাছেঁড়া করে দেখা যাক এর মধ্যে কী আছে।

মূলত আটপৌরে শব্দটি সময়ের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিভাজনের সঙ্গে সম্পর্কিত। সময় পরিমাপের বিজ্ঞানকে বলা হয় ক্রনোমিটার। আর সময় পরিমাপের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো দিনপঞ্জিকা ও ঘড়ি। সাধারণত দিনরাতের বিভাজনকে আমরা প্রহর বলে জানি। যেখান থেকে জাত শব্দ হলো, অষ্টপ্রহর, দ্বিপ্রহর প্রভৃতি। কিন্তু এই প্রহরেরও যে নির্দিষ্ট সময়সীমা আছে, সে ব্যাপারে আমরা বেমালুম ভুলে যাই। সময় গণনার উপমহাদেশীয় একক হিসেবে একসময় প্রহর শব্দটি ব্যবহৃত হতো। যার অতি অল্প ব্যবহার এখনো পরিলক্ষিত হয়। সমকালে, বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের হরিনাম সংকীর্তনের ব্যানার বা পোস্টারে লেখা থাকে ‘২৪ বা ৪৮ প্রহরব্যাপী হরিনাম সংকীর্তন’। সেই হিসেবে জানা দরকার এই ‘২৪ বা ৪৮ প্রহর’ সমান কত সময়? প্রকৃতপক্ষে সময় বিভাজনের আভিধানিক হিসাবে এক প্রহর সমান হলো ৩ ঘণ্টা। আর অষ্টপ্রহর সমান হলো এক দিন। সে হিসেবে ২৪ প্রহরে হলো ৩ দিন আর ৪৮ প্রহরে ৬ দিন।

প্রহরের হিসাবে দিন শুরু সকাল ৬টায়, এই সময়ের সঙ্গে সূর্য ওঠার বা ভোরের আলো ফোটার সময়ের সম্পর্ক রয়েছে। আর রাত শুরু সন্ধ্যা ৬টায়, সূর্য ডোবার পর; অর্থাৎ প্রথম প্রহর মানে সকাল ৬-৯টা, দ্বিতীয় প্রহর মানে সকাল ৯-১২টা, তৃতীয় প্রহর দুপুর ১২-৩টা, চতুর্থ প্রহর মানে বিকেল ৩-৬টা, পঞ্চম প্রহর মানে সন্ধ্যা ৬-৯টা, ষষ্ঠ প্রহর মানে রাত ৯-১২টা, সপ্তম প্রহর মানে রাত ১২-৩টা, অষ্টম প্রহর মানে শেষ প্রহর রাত ৩টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত। এই বিভাজন অনুসারেই আমরা দিনের দ্বিতীয় প্রহর হিসেবে দ্বিপ্রহর বা দুপুরবেলাকে বুঝি; অর্থাৎ দুপুর ১২টা হলো দিনের দ্বিতীয় প্রহর বা দ্বিপ্রহর।

আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তায় আমরা যে আটপৌরে শব্দটি উচ্চারণ করি, এখানেও কিন্তু প্রহর শব্দটির যোগ আছে। অষ্টপ্রহর শব্দ থেকেই আটপৌরে শব্দটি ক্রমপরিণতি পেয়েছে। ‘আটপৌরে’ শব্দের অর্থই হলো অষ্ট বা আট প্রহর, যা পরে থাকা হয়। মানে ২৪ ঘণ্টা যা পরে থাকা হয় তাই আটপৌরে; অর্থাৎ অনানুষ্ঠানিকভাবে যা পরিধান করা হয় তাই আটপৌরে।

আটপৌরে শব্দটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় শাড়ির সঙ্গে। তবে অন্যান্য কাপড়ের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়, যা অনানুষ্ঠানিক পরিচ্ছদ হিসেবে পরিচিত। আটপৌরে শব্দটি সব সময়ের পরিচ্ছদ অর্থের পাশাপাশি ক্রমে শাড়ি পরার একটি স্টাইল বা ধরনকেও নির্দেশ করে। সাধারণত যে শাড়িটি কুঁচি ছাড়া পেঁচিয়ে পরা হয়, সেটাকে আটপৌরে বলে বোঝানো হয়। অপরদিকে বাড়ির বাইরে যেতে হলে কুঁচি দিয়ে পরিপাটিরূপে যেভাবে শাড়ি পরা হয়, সেটি কিন্তু আটপৌরে নয়।

আটপৌরে থেকে পোশাকি আর পোশাকি থেকে আটপৌরে পরিধেয়র মধ্য দিয়েই জীবনকে যাপন করতে হয়। আবার কখনো কখনো জীবনের আটপৌরে অনুভূতিগুলোকে পোশাকি আলমারিতে তুলেও রাখতে হয়।

লেখক: রাজীব কুমার সাহা
আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত