পাভেল পার্থ
আজকের পত্রিকায় ৬ এপ্রিল শিরোনাম হয়েছে, ‘পানি উঠছে না শত শত নলকূপে’। প্রতিবেদনটি জানায়, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় শত শত নলকূপে পানি উঠছে না ঝিনাইদহে। ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে কোনো নিয়ম মানা হচ্ছে না; বিশেষ করে বোরো মৌসুমে ধানের জমিতে সেচকাজের জন্য পানি তোলায় পানির স্তর নিচে নেমে চাপ পড়ছে অগভীর নলকূপে। আগে ২০-৩০ ফুট মাটির নিচে পানির স্তর পাওয়া গেলেও এখন ৩০-৩৫ ফুট নিচেও পানির স্তর মিলছে না।
জেলার ছয় উপজেলায় ৫০ হাজারের বেশি নলকূপে সামান্য পানি উঠছে। কেবল ভূগর্ভস্থ নয়, ভূ-উপরিস্থ প্রাকৃতিক পানির আধারগুলোও এই দক্ষিণ-পশ্চিমের গুরুত্বপূর্ণ ভূগোলে প্রতিদিন উধাও হচ্ছে। খাল-বিল, বাঁওড়, ডোবা, পুকুর, নদ-নদী সবই আজ দখল ও দূষণে চুরমার। জেলার শৈলকুপা, কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর, মহেশপুর, হরিণাকুণ্ডু এবং ঝিনাইদহ সদরে প্রবাহিত ১০ নদী ও ২ নদের প্রায় ৮০ ভাগ শুকিয়ে গেছে শুষ্ক মৌসুমে। চিত্রা, নবগঙ্গা, কুমার, বেগবতী, কপোতাক্ষ, ইছামতী, কালীগঙ্গা কিংবা ডাকুয়ার মতো ঐতিহাসিক নদ-নদীগুলোর সবই আজ মুমূর্ষু ও রুগ্ণ। নিখোঁজ নদীতে কৃষিকাজও হচ্ছে। ভূ-উপরিস্থ এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির আধারের পাশাপাশি জলবায়ু বিপর্যয়জনিত কারণে বাড়তে থাকা অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং বৃষ্টিহীনতাও এলাকায় প্রাকৃতিক পানির প্রাপ্যতাকে অনিশ্চিত করে তুলছে দিন দিন।
তাহলে কীভাবে নিশ্চিত হবে কৃষিকাজের পানি? কম পানি ও কম সেচনির্ভর কৃষি হয়তো সম্ভব, কিন্তু একেবারে পানি বিনা কৃষিকাজ অসম্ভব। যদিও এ ঘটনা কেবল ঝিনাইদহসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল নয় কিংবা দীর্ঘস্থায়ী খরাপীড়িত দেশের উত্তরাঞ্চল নয়; দেশের সব কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চলেই পানির আকাল তৈরি হচ্ছে। কৃষিকাজ, খাবার ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত পানি—সবই আজ নিদারুণভাবে অধরা হয়ে পড়ছে। এক দুঃসহ পানিসংকট প্রবল হয়ে উঠছে চারপাশে।
প্রতিদিন দখল, ছিনতাই, খুন হচ্ছে প্রাকৃতিক ও উন্মুক্ত জলাধার। প্রতিদিন নিচে নামছে পাতাল পানির স্তর। এমনকি জলবায়ু-সংকটের কারণে মেঘের দেখাও মিলছে না আকাশে, আসমান থেকেও ঝরছে না পানি। কেবল কৃষি বা উৎপাদন নয়, পানির এই সংকট গভীরভাবে যন্ত্রণা তৈরি করছে জীবনযাপনের প্রতিটি স্তরে।
পানি নিয়ে বাড়ছে দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও নানামুখী উত্তেজনা। গ্রামের এক কৃষকের সঙ্গে প্রতিবেশী কৃষকের পানি-দ্বন্দ্ব আজ গ্রাম ছাপিয়ে দেশ, দেশ ছাপিয়ে রাষ্ট্র কী করপোরেট এজেন্সির একতরফা খবরদারি হয়ে উঠছে। সেচের পানিপ্রাপ্যতা অনিশ্চিত হওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে উৎপাদনে এবং খাদ্যনিরাপত্তায়; সর্বোপরি জাতীয় অর্থনীতি এবং সামাজিক জীবনে।
ঝিনাইদহের খবরটি প্রমাণ করছে, কোনো এলাকায় পাতাল পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নীতি অস্পষ্ট এবং এ ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর ব্যবস্থাপনা এবং তদারকি নেই। অপরিকল্পিতভাবে পাতাল পানির ব্যবহার এবং একই সঙ্গে ওপরের পানির নিশ্চিহ্নকরণ কোন বিপদের মুখে দাঁড় করাচ্ছে—এ বিষয়ে ভাবার সময় হয়তো আমাদের কাছে নেই। পানি ও সেচ ব্যবস্থাপনায় দরকার সদিচ্ছা, দায়িত্বশীলতা এবং জবাবদিহি। আশা করব, ঝিনাইদহের স্থানীয় সরকার, জনপ্রতিনিধি, কৃষি বিভাগ, কর্তৃপক্ষ, পানি উন্নয়ন বোর্ড এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল হবে।
কেন কোনো এলাকায় একের পর এক যন্ত্র বসিয়ে পাতাল পানি তুলবে মানুষ? একটি এলাকার আয়তন, জনগোষ্ঠী, ঋতুভিত্তিক চাহিদা এবং পানির প্রাপ্যতা সবকিছু বিবেচনায় এনে অংশগ্রহণমূলক পানি ব্যবস্থাপনা কেন গড়ে তোলা হবে না? ঝিনাইদহের এই নিদারুণ চিত্র দেশের সর্বত্রই দেখা যায়। কিন্তু এই অবস্থা এমনি এমনি হয়নি। একে পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে। ষাটের দশকের সবুজবিপ্লব অ্যাজেন্ডার মাধ্যমে এই বিপজ্জনক কৃষিভিত্তিক বাণিজ্য চাঙা হয়েছে। মাটির তলার পাতাল পানি যন্ত্র দিয়ে টেনে তোলা যায়, এ কথা দেশের কৃষকসমাজ প্রথমে বিশ্বাসই করেনি। কিন্তু আজ যন্ত্রচালিত সেচের পানির জন্য দেশের কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন।
ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলায় প্রায় ৩৭ হাজার ৫০০ নলকূপ আছে, যদিও এর ভেতর সরকারি নলকূপ ১ হাজার ৫০০টি। কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের বরাতে গণমাধ্যম জানাচ্ছে, অনুমতি নিয়ে জেলায় ১৭০টি গভীর এবং ৭ হাজার ৯২১টি অগভীর নলকূপ আছে। বাদবাকি হাজার হাজার নলকূপের কোনো সরকারি অনুমোদন নেই। তাহলে এই সব যন্ত্রপাতির উৎপাদন এবং বিক্রিকে কেন প্রশ্ন করা হচ্ছে না? প্রতিদিন কেন সেচ যন্ত্রপাতির বাজার বাড়ে? মাটির তলায় নামে পানির স্তর, কিন্তু মুনাফা বাড়ে সেচযন্ত্র কোম্পানির। কৃষিকে ঘিরে বহাল থাকা করপোরেট বাজার এবং এর প্রবল নিয়ন্ত্রণকে প্রশ্ন না করে কোনোভাবেই ঝিনাইদহ কি, দেশের কোথাও কৃষিতে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
একটা মুখস্থ বুলি আছে—দুনিয়ার চার ভাগের তিন ভাগ পানি। কিন্তু সেখানে পান ও ব্যবহারযোগ্য মিঠাপানির পরিমাণ খুবই অল্প। এর ভেতর মিঠাপানির প্রায় ৭০ ভাগই কৃষিতে এবং কারখানায় ২০ ও গৃহস্থালি কাজে বাকি ১০ ভাগ ব্যবহৃত হয়। সামগ্রিকভাবে পৃথিবীতে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন কিউবিক কিলোমিটার পানি আছে। যদিও এর ভেতর ৪৫ হাজার কিউবিক কিলোমিটার পানি ব্যবহারযোগ্য। এই ব্যবহারযোগ্য পানির ভেতর মাত্র ৯ থেকে ১৪ হাজার কিউবিক কিলোমিটার পানি কেবল মানুষের উপযোগী। সৌরজগতের অন্য কোনো গ্রহে পানি আছে কি না, আমাদের জানা নেই। কিন্তু পৃথিবীতেই যে পানি আছে তা মানুষের জন্য খুবই নিতান্ত; মানে মানুষের ব্যবহারযোগ্য পানি আছে মোট পানির মাত্র ০.০০১ ভাগ। আর এই পানির যাচ্ছেতাই অপরিকল্পিত ব্যবহার কিংবা এমন ধরনের কৃষি প্রকল্প জারি রাখা জরুরি কি না, যা লাগাতার পানির আধারকে বিনষ্ট করে? এসব ভাবতেই হবে এবং এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক অঙ্গীকার জোরালো করতে হবে।
আবার দুনিয়ার সব পানি ছড়িয়ে আছে নানা জায়গায়। দ্য ওয়ার্ল্ড ওয়াটারের প্রতিবেদনমতে, বিশ্বের পানযোগ্য পানির ৬৫ ভাগই আছে ১৩টি দেশে। ব্রাজিলে ১৪ দশমিক ৯, রাশিয়ায় ৮ দশমিক ২, কানাডায় ৬, যুক্তরাষ্ট্রে ৫ দশমিক ৬, ইন্দোনেশিয়ায় ৫ দশমিক ২, চীনে ৫ দশমিক ১, কলম্বিয়ায় ৩ দশমিক ৯, ভারত ও পেরুতে ৩ দশমিক ৫, কঙ্গোতে ২ দশমিক ৩, ভেনেজুয়েলা ও বাংলাদেশে ২ দশমিক ২ ভাগ পানি আছে। কিন্তু বিপজ্জনক বার্তাটি হলো, বাংলাদেশ এই পানির আধার থেকেই মূলত কৃষিতে সেচকাজে পানি ব্যবহার করে। এই পানির আধারই দেশের শিল্পকারখানায় ও মানুষের দৈনন্দিন কাজেও ব্যবহৃত হয়। একই আধার থেকে পানি নানা কাজে ব্যবহার করলে কেবল কৃষিজমির জন্য নলকূপ কেন, ভবিষ্যতে পান করার জন্য এক গ্লাস পানিও আর খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ।অবশ্যই পাতাল পানি এবং ভূ-উপরিস্থ পানির আধার বাড়াতে হবে। ভূ-উপরিস্থ পানিকে কৃষি ও শিল্পে ব্যবহার করে পাতিল পানিকে ভবিষ্যতের জন্য সুরক্ষিত রাখতে হবে।
১৯৫৯-৬০ সালে মোট কৃষিজমির প্রায় ৭ ভাগ প্রচলিত সেচের আওতায় ছিল; বিশেষ করে সিলেট, ময়মনসিংহের হাওরাঞ্চল এবং রাজশাহীর মতো বরেন্দ্র অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে বোরো আবাদের জন্য ভূ-উপরিস্থ পানি প্রচলিত সেচের জন্য ব্যবহৃত হতো। কিন্তু দিনে দিনে যন্ত্রনির্ভর ভূগর্ভস্থ সেচ বেড়েছে এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে এক বিশাল বাণিজ্যিক কার্যক্রম। সেচযন্ত্র পরিচালনা, কারিগরি ও ব্যবস্থাপনার বিষয়টি দেশের কেবল কৃষক নন, কৃষিবিদদের জন্যও ছিল নতুন অভিজ্ঞতা।
প্রথমদিকে সেচযন্ত্রভিত্তিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে নানা ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণও সম্পন্ন হয়েছে। বহুপক্ষীয় ব্যাংক এবং বৈশ্বিক ক্ষমতাকাঠামোর মাধ্যমে পরিচালিত সেচ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক প্রকল্প এবং কার্যক্রমগুলো বারবার সেচব্যবস্থাপনা ও কার্যক্রমকে বেসরকারীকরণের জন্য সুপারিশ করেছে এবং বৈশ্বিক মুক্তবাজার ও নয়া উদারবাদীব্যবস্থার ক্ষমতার নীতি এ ক্ষেত্রে দেশের সেচব্যবস্থাপনাকেও প্রভাবিত করেছে। সেচযন্ত্র এবং যন্ত্রাংশ, সেচকাজে বিদ্যুৎ কিংবা জীবাশ্ম জ্বালানির (ডিজেল) ব্যবহার সরাসরি বৈশ্বিক বাজার এবং রাষ্ট্রীয় বিবেচনা ও নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। দেখা যায় বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি স্থানীয় সেচকার্যকে প্রভাবিত করছে কিংবা কখনো কোনো সরকার সেচযন্ত্র-সম্পর্কিত বাণিজ্যকে শুল্কমুক্ত করছে বা করপোরেট কোম্পানির সেচযন্ত্র বাণিজ্য প্রসারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
এক বা দুই দিনে নয়, ঝিনাইদহের নলকূপে পানি না আসার ইতিহাস দীর্ঘ। এর সঙ্গে কৃষিভিত্তিক করপোরেট বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বৈশ্বিক রাজনীতি এবং কৃষকের প্রতি কাঠামোগত বৈষম্য—সবকিছুই জড়িয়ে আছে। রাষ্ট্র কি কৃষি ও প্রাকৃতিক সম্পদনির্ভর এসব বিষয় খুব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেবে? দেশের নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমও কি এসব বিষয়ে তৎপর ও সক্রিয় হবে? কারণ এই কৃষি উৎপাদনব্যবস্থাই এখনো আমাদের খাদ্য, বেঁচে থাকা এবং ভবিষ্যৎ বিকাশের মৌলভিত্তি।
লেখক ও গবেষক
আজকের পত্রিকায় ৬ এপ্রিল শিরোনাম হয়েছে, ‘পানি উঠছে না শত শত নলকূপে’। প্রতিবেদনটি জানায়, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় শত শত নলকূপে পানি উঠছে না ঝিনাইদহে। ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে কোনো নিয়ম মানা হচ্ছে না; বিশেষ করে বোরো মৌসুমে ধানের জমিতে সেচকাজের জন্য পানি তোলায় পানির স্তর নিচে নেমে চাপ পড়ছে অগভীর নলকূপে। আগে ২০-৩০ ফুট মাটির নিচে পানির স্তর পাওয়া গেলেও এখন ৩০-৩৫ ফুট নিচেও পানির স্তর মিলছে না।
জেলার ছয় উপজেলায় ৫০ হাজারের বেশি নলকূপে সামান্য পানি উঠছে। কেবল ভূগর্ভস্থ নয়, ভূ-উপরিস্থ প্রাকৃতিক পানির আধারগুলোও এই দক্ষিণ-পশ্চিমের গুরুত্বপূর্ণ ভূগোলে প্রতিদিন উধাও হচ্ছে। খাল-বিল, বাঁওড়, ডোবা, পুকুর, নদ-নদী সবই আজ দখল ও দূষণে চুরমার। জেলার শৈলকুপা, কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর, মহেশপুর, হরিণাকুণ্ডু এবং ঝিনাইদহ সদরে প্রবাহিত ১০ নদী ও ২ নদের প্রায় ৮০ ভাগ শুকিয়ে গেছে শুষ্ক মৌসুমে। চিত্রা, নবগঙ্গা, কুমার, বেগবতী, কপোতাক্ষ, ইছামতী, কালীগঙ্গা কিংবা ডাকুয়ার মতো ঐতিহাসিক নদ-নদীগুলোর সবই আজ মুমূর্ষু ও রুগ্ণ। নিখোঁজ নদীতে কৃষিকাজও হচ্ছে। ভূ-উপরিস্থ এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির আধারের পাশাপাশি জলবায়ু বিপর্যয়জনিত কারণে বাড়তে থাকা অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং বৃষ্টিহীনতাও এলাকায় প্রাকৃতিক পানির প্রাপ্যতাকে অনিশ্চিত করে তুলছে দিন দিন।
তাহলে কীভাবে নিশ্চিত হবে কৃষিকাজের পানি? কম পানি ও কম সেচনির্ভর কৃষি হয়তো সম্ভব, কিন্তু একেবারে পানি বিনা কৃষিকাজ অসম্ভব। যদিও এ ঘটনা কেবল ঝিনাইদহসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল নয় কিংবা দীর্ঘস্থায়ী খরাপীড়িত দেশের উত্তরাঞ্চল নয়; দেশের সব কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চলেই পানির আকাল তৈরি হচ্ছে। কৃষিকাজ, খাবার ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত পানি—সবই আজ নিদারুণভাবে অধরা হয়ে পড়ছে। এক দুঃসহ পানিসংকট প্রবল হয়ে উঠছে চারপাশে।
প্রতিদিন দখল, ছিনতাই, খুন হচ্ছে প্রাকৃতিক ও উন্মুক্ত জলাধার। প্রতিদিন নিচে নামছে পাতাল পানির স্তর। এমনকি জলবায়ু-সংকটের কারণে মেঘের দেখাও মিলছে না আকাশে, আসমান থেকেও ঝরছে না পানি। কেবল কৃষি বা উৎপাদন নয়, পানির এই সংকট গভীরভাবে যন্ত্রণা তৈরি করছে জীবনযাপনের প্রতিটি স্তরে।
পানি নিয়ে বাড়ছে দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও নানামুখী উত্তেজনা। গ্রামের এক কৃষকের সঙ্গে প্রতিবেশী কৃষকের পানি-দ্বন্দ্ব আজ গ্রাম ছাপিয়ে দেশ, দেশ ছাপিয়ে রাষ্ট্র কী করপোরেট এজেন্সির একতরফা খবরদারি হয়ে উঠছে। সেচের পানিপ্রাপ্যতা অনিশ্চিত হওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে উৎপাদনে এবং খাদ্যনিরাপত্তায়; সর্বোপরি জাতীয় অর্থনীতি এবং সামাজিক জীবনে।
ঝিনাইদহের খবরটি প্রমাণ করছে, কোনো এলাকায় পাতাল পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নীতি অস্পষ্ট এবং এ ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর ব্যবস্থাপনা এবং তদারকি নেই। অপরিকল্পিতভাবে পাতাল পানির ব্যবহার এবং একই সঙ্গে ওপরের পানির নিশ্চিহ্নকরণ কোন বিপদের মুখে দাঁড় করাচ্ছে—এ বিষয়ে ভাবার সময় হয়তো আমাদের কাছে নেই। পানি ও সেচ ব্যবস্থাপনায় দরকার সদিচ্ছা, দায়িত্বশীলতা এবং জবাবদিহি। আশা করব, ঝিনাইদহের স্থানীয় সরকার, জনপ্রতিনিধি, কৃষি বিভাগ, কর্তৃপক্ষ, পানি উন্নয়ন বোর্ড এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল হবে।
কেন কোনো এলাকায় একের পর এক যন্ত্র বসিয়ে পাতাল পানি তুলবে মানুষ? একটি এলাকার আয়তন, জনগোষ্ঠী, ঋতুভিত্তিক চাহিদা এবং পানির প্রাপ্যতা সবকিছু বিবেচনায় এনে অংশগ্রহণমূলক পানি ব্যবস্থাপনা কেন গড়ে তোলা হবে না? ঝিনাইদহের এই নিদারুণ চিত্র দেশের সর্বত্রই দেখা যায়। কিন্তু এই অবস্থা এমনি এমনি হয়নি। একে পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে। ষাটের দশকের সবুজবিপ্লব অ্যাজেন্ডার মাধ্যমে এই বিপজ্জনক কৃষিভিত্তিক বাণিজ্য চাঙা হয়েছে। মাটির তলার পাতাল পানি যন্ত্র দিয়ে টেনে তোলা যায়, এ কথা দেশের কৃষকসমাজ প্রথমে বিশ্বাসই করেনি। কিন্তু আজ যন্ত্রচালিত সেচের পানির জন্য দেশের কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন।
ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলায় প্রায় ৩৭ হাজার ৫০০ নলকূপ আছে, যদিও এর ভেতর সরকারি নলকূপ ১ হাজার ৫০০টি। কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের বরাতে গণমাধ্যম জানাচ্ছে, অনুমতি নিয়ে জেলায় ১৭০টি গভীর এবং ৭ হাজার ৯২১টি অগভীর নলকূপ আছে। বাদবাকি হাজার হাজার নলকূপের কোনো সরকারি অনুমোদন নেই। তাহলে এই সব যন্ত্রপাতির উৎপাদন এবং বিক্রিকে কেন প্রশ্ন করা হচ্ছে না? প্রতিদিন কেন সেচ যন্ত্রপাতির বাজার বাড়ে? মাটির তলায় নামে পানির স্তর, কিন্তু মুনাফা বাড়ে সেচযন্ত্র কোম্পানির। কৃষিকে ঘিরে বহাল থাকা করপোরেট বাজার এবং এর প্রবল নিয়ন্ত্রণকে প্রশ্ন না করে কোনোভাবেই ঝিনাইদহ কি, দেশের কোথাও কৃষিতে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
একটা মুখস্থ বুলি আছে—দুনিয়ার চার ভাগের তিন ভাগ পানি। কিন্তু সেখানে পান ও ব্যবহারযোগ্য মিঠাপানির পরিমাণ খুবই অল্প। এর ভেতর মিঠাপানির প্রায় ৭০ ভাগই কৃষিতে এবং কারখানায় ২০ ও গৃহস্থালি কাজে বাকি ১০ ভাগ ব্যবহৃত হয়। সামগ্রিকভাবে পৃথিবীতে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন কিউবিক কিলোমিটার পানি আছে। যদিও এর ভেতর ৪৫ হাজার কিউবিক কিলোমিটার পানি ব্যবহারযোগ্য। এই ব্যবহারযোগ্য পানির ভেতর মাত্র ৯ থেকে ১৪ হাজার কিউবিক কিলোমিটার পানি কেবল মানুষের উপযোগী। সৌরজগতের অন্য কোনো গ্রহে পানি আছে কি না, আমাদের জানা নেই। কিন্তু পৃথিবীতেই যে পানি আছে তা মানুষের জন্য খুবই নিতান্ত; মানে মানুষের ব্যবহারযোগ্য পানি আছে মোট পানির মাত্র ০.০০১ ভাগ। আর এই পানির যাচ্ছেতাই অপরিকল্পিত ব্যবহার কিংবা এমন ধরনের কৃষি প্রকল্প জারি রাখা জরুরি কি না, যা লাগাতার পানির আধারকে বিনষ্ট করে? এসব ভাবতেই হবে এবং এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক অঙ্গীকার জোরালো করতে হবে।
আবার দুনিয়ার সব পানি ছড়িয়ে আছে নানা জায়গায়। দ্য ওয়ার্ল্ড ওয়াটারের প্রতিবেদনমতে, বিশ্বের পানযোগ্য পানির ৬৫ ভাগই আছে ১৩টি দেশে। ব্রাজিলে ১৪ দশমিক ৯, রাশিয়ায় ৮ দশমিক ২, কানাডায় ৬, যুক্তরাষ্ট্রে ৫ দশমিক ৬, ইন্দোনেশিয়ায় ৫ দশমিক ২, চীনে ৫ দশমিক ১, কলম্বিয়ায় ৩ দশমিক ৯, ভারত ও পেরুতে ৩ দশমিক ৫, কঙ্গোতে ২ দশমিক ৩, ভেনেজুয়েলা ও বাংলাদেশে ২ দশমিক ২ ভাগ পানি আছে। কিন্তু বিপজ্জনক বার্তাটি হলো, বাংলাদেশ এই পানির আধার থেকেই মূলত কৃষিতে সেচকাজে পানি ব্যবহার করে। এই পানির আধারই দেশের শিল্পকারখানায় ও মানুষের দৈনন্দিন কাজেও ব্যবহৃত হয়। একই আধার থেকে পানি নানা কাজে ব্যবহার করলে কেবল কৃষিজমির জন্য নলকূপ কেন, ভবিষ্যতে পান করার জন্য এক গ্লাস পানিও আর খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ।অবশ্যই পাতাল পানি এবং ভূ-উপরিস্থ পানির আধার বাড়াতে হবে। ভূ-উপরিস্থ পানিকে কৃষি ও শিল্পে ব্যবহার করে পাতিল পানিকে ভবিষ্যতের জন্য সুরক্ষিত রাখতে হবে।
১৯৫৯-৬০ সালে মোট কৃষিজমির প্রায় ৭ ভাগ প্রচলিত সেচের আওতায় ছিল; বিশেষ করে সিলেট, ময়মনসিংহের হাওরাঞ্চল এবং রাজশাহীর মতো বরেন্দ্র অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে বোরো আবাদের জন্য ভূ-উপরিস্থ পানি প্রচলিত সেচের জন্য ব্যবহৃত হতো। কিন্তু দিনে দিনে যন্ত্রনির্ভর ভূগর্ভস্থ সেচ বেড়েছে এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে এক বিশাল বাণিজ্যিক কার্যক্রম। সেচযন্ত্র পরিচালনা, কারিগরি ও ব্যবস্থাপনার বিষয়টি দেশের কেবল কৃষক নন, কৃষিবিদদের জন্যও ছিল নতুন অভিজ্ঞতা।
প্রথমদিকে সেচযন্ত্রভিত্তিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে নানা ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণও সম্পন্ন হয়েছে। বহুপক্ষীয় ব্যাংক এবং বৈশ্বিক ক্ষমতাকাঠামোর মাধ্যমে পরিচালিত সেচ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক প্রকল্প এবং কার্যক্রমগুলো বারবার সেচব্যবস্থাপনা ও কার্যক্রমকে বেসরকারীকরণের জন্য সুপারিশ করেছে এবং বৈশ্বিক মুক্তবাজার ও নয়া উদারবাদীব্যবস্থার ক্ষমতার নীতি এ ক্ষেত্রে দেশের সেচব্যবস্থাপনাকেও প্রভাবিত করেছে। সেচযন্ত্র এবং যন্ত্রাংশ, সেচকাজে বিদ্যুৎ কিংবা জীবাশ্ম জ্বালানির (ডিজেল) ব্যবহার সরাসরি বৈশ্বিক বাজার এবং রাষ্ট্রীয় বিবেচনা ও নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। দেখা যায় বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি স্থানীয় সেচকার্যকে প্রভাবিত করছে কিংবা কখনো কোনো সরকার সেচযন্ত্র-সম্পর্কিত বাণিজ্যকে শুল্কমুক্ত করছে বা করপোরেট কোম্পানির সেচযন্ত্র বাণিজ্য প্রসারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
এক বা দুই দিনে নয়, ঝিনাইদহের নলকূপে পানি না আসার ইতিহাস দীর্ঘ। এর সঙ্গে কৃষিভিত্তিক করপোরেট বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বৈশ্বিক রাজনীতি এবং কৃষকের প্রতি কাঠামোগত বৈষম্য—সবকিছুই জড়িয়ে আছে। রাষ্ট্র কি কৃষি ও প্রাকৃতিক সম্পদনির্ভর এসব বিষয় খুব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেবে? দেশের নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমও কি এসব বিষয়ে তৎপর ও সক্রিয় হবে? কারণ এই কৃষি উৎপাদনব্যবস্থাই এখনো আমাদের খাদ্য, বেঁচে থাকা এবং ভবিষ্যৎ বিকাশের মৌলভিত্তি।
লেখক ও গবেষক
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
১ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৫ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৫ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ দিন আগে