আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে

আব্দুর রাজ্জাক
প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭: ৩১

শিগগিরই গঠিত হবে নতুন সরকার। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ—নৌকা প্রতীক ২২২টি সংসদীয় আসনে বিজয় লাভ করেছে। বিরোধী দলে থাকবে আওয়ামী লীগেরই সংসদ সদস্য, যাঁরা আওয়ামী লীগের বিপরীতে অথবা আওয়ামী লীগ মনোনীত ১৪ দল বা জাতীয় পার্টির বিপরীতে জয়লাভ করেছেন।

দেখার বিষয়, এখন কারা বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে। এই নির্বাচনে একটি ব্যাপার প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে, আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবকিছুর ঊর্ধ্বে ছাপিয়ে গেছেন। নির্বাচন হয়তো গ্রহণযোগ্য হবে আন্তর্জাতিকভাবেও। তেমন কোনো বড় দুর্ঘটনা ছাড়া সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে।

এখন আসা যাক মূল কথায়। যাঁরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্য থেকেই গঠিত হবে মন্ত্রিপরিষদ। এই মন্ত্রিপরিষদের কাজ হবে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। এককথায় বলতে গেলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের আর্থিক খাতে যে অব্যবস্থাপনা চলছে তা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। এ রকম আরও কিছুদিন চলতে থাকলে সবকিছুই ভেঙে পড়বে। সমাজে ঘুষ, দুর্নীতি, ব্যাংকিং খাতের অরাজকতা চলতে থাকলে রিজার্ভ কমে যাবে। এখান থেকেই শুরু হবে সামাজিক বিশৃঙ্খলা।

উন্নয়ন খাতে যে বরাদ্দ হয়, সেই বরাদ্দের বেশির ভাগ কাজই হয় না। যতটুকু কাজ করা হয় না তার অর্থ চলে যায় নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত। ১৫ বছরে অনেক উন্নয়নকাজ হয়েছে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন কিছু হয়েছে। এসব অপরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য আর্থিক ব্যয় বেড়ে গেছে। আমি আমার এলাকায় দেখেছি, ছোট ছোট খালের উৎসমুখ ১০-১২ ফিট আর গভীরতা ৪-৫ ফিট, কোনো নৌকা চলে না, চলবেও না। একটি রাস্তা গেছে ১৬ থেকে ২০ ফিটের। এই রাস্তার মাঝ থেকে একটি কালভার্ট করলে খরচ হতো ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। সেখানে দুই দিকে ২০০ ফিটের অ্যাপ্রোচ রোড করে, ৩০ ফিট চওড়ার একটি ব্রিজ করা হয়েছে, যদিও দুই পাশের রোড ১৫ থেকে ২০ ফিট। এ ব্রিজটি করতে খরচ হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। এর উদ্দেশ্য ছিল যত বড় কাজ, তত বড় টেন্ডার, তত বড় বাণিজ্য! আমি এলাকায় ঘুরে দেখেছি, এ রকম অপরিকল্পিত ব্রিজ আছে কমপক্ষে ২০টি।

সারা দেশে এ রকম পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যাবে এলজিআরডির এসব কাজে অপচয় হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। সমস্যা হলো, এই অপচয়ের অর্থ বিভিন্ন হাত হয়ে পাচার হয়ে যায় বিদেশে। কমিশন-বাণিজ্য হয়েছে, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও এমপিরা বছরের পর বছর এসব কাজকে প্রশ্রয় দিয়ে আসছেন। উন্নয়নকাজের নামে লুটপাট করেছেন।

এরপর ভূমি ব্যবস্থাপনা, কাস্টমস ইনকাম ট্যাক্সসহ প্রতিটি প্রকৌশল খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে; অর্থাৎ ঘুষ-বাণিজ্যের মাধ্যমে কয়েকজন লোকের হাতে চলে গেছে। এই টাকা বাংলাদেশে অনেকে সাদা করতে পারেনি, কোনো না কোনোভাবে লন্ডারিং হয়েছে। যার কারণে আমাদের দেশের আর্থিক খাতের অবস্থা নাজুক পর্যায়ে চলে এসেছে।

আমরা সবাই এসব চোখের সামনে দেখছি, কিন্তু কিছু করতে পারছি না। যাঁরা এসব করছেন, তাঁরাই ক্ষমতায়। তাঁদের গায়ে হাত দেওয়ার ক্ষমতা সাধারণ জনগণের নেই। যদি হাতেনাতে কিছু দুর্নীতিবাজ ধরা পড়ে তখন আমরা বলি, কিছু কিছু সমস্যা আছে; দু-একটি এ রকম ঘটনা ঘটতেই পারে! এ কথা থেকে মনে হয় দু-একটি দুর্নীতি হয়, আর সব সাধু। কিন্তু ব্যাপারটি হবে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। দু-একটি ভালো কাজ হয় সঠিকভাবে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘুষ-দুর্নীতি চলে ঘোষিত অথবা অঘোষিতভাবে।

ব্যাংকিং খাতের অবস্থা আরও খারাপ। ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের শিল্পপতিরা ঋণখেলাপি হন। অহরহ ব্যাংকারদের সহায়তায় ননফান্ডেড লোনকে ফান্ডেড লোনে পরিণত করেন। এই সব টাকা বিদেশে পাচার করেন, যার কারণে এখন ব্যাংকিং খাতে তারল্য-সংকট চলছে। ঘুষের দুর্নীতির টাকা কেউ ব্যাংকে বা সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রাখতে পারে না। এই টাকা রাখে ক্যাশ আকারে নিজের হাতে, যার কারণেও তারল্য-সংকট সৃষ্টি হয়।

এক বছরের মাথায় ডলারের বিনিময় হার শতকরা ৪০-৪৫ ভাগ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। আমদানি করা পণ্যের দাম স্বাভাবিকভাবেই একই হারে বেড়ে যাবে। আমাদের দেশের উৎপাদিত পণ্যের দামও বেড়ে যাওয়ার কথা। কেননা উৎপাদিত পণ্যের কাঁচামাল বা অন্যান্য যাবতীয় ব্যবহৃত পণ্য আমদানি করতে হয়। যার কারণে কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের দাম এক বছরের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সাধারণ মানুষের আয় গত এক-দেড় বছরে তেমন বাড়েনি। মানুষ দিশেহারা পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে, বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষ কুলিয়ে উঠতে পারছে না। আমি ১৫ দিন গ্রামে আছি। ভরা মৌসুমেও সবজির দাম এখানে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে, অন্যান্য পণ্যের কথা বাদই দিলাম।

নতুন যে সরকার গঠিত হবে, তাদের প্রথমেই নজর দিতে হবে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধের কাজে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অর্থ পাচার বা অর্থ পুঞ্জীভূত করে অব্যবহৃত রাখা যাবে না। অর্থ সঞ্চালন সঠিক করে ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। তাহলে হয়তো বাজার 
কিছুটা স্থিতিশীল হবে।

ঘুষ-দুর্নীতি চলতে থাকলে আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা হবে, অর্থ পাচার বেড়ে যাবে। ব্যাংকে রিজার্ভ কমে যাবে। ডলারের দাম বেড়ে যাবে। পণ্যমূল্য বেড়ে যাবে। কিছু কিছু দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষ তাদের সামান্য কিছু সম্পদ ধীরে ধীরে হারাবে। এসব সম্পদ চলে যাবে ধনী লুটেরা ও ঘুষখোরের হাতে। কিছু কিছু ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ আমলা ও রাজনীতিবিদ বিদেশে প্রচুর সম্পদ গড়বেন।নতুন সরকারের কাজ হবে আর্থিক খাতের সংস্কার করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা; বিশেষ করে অর্থ ও সম্পদ পাচার বন্ধ করা।

লেখক: প্রকৌশলী

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত