শুধু আবেগ নয়, যুক্তিনির্ভরও হতে হবে

আনোয়ারুল হক
প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৪, ১৫: ৪৫
আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০২৪, ১৬: ১৩

একরোখা মনোভাব নিয়ে সরকারবিরোধী বা সরকার উৎখাত আন্দোলনে সফল হওয়া গেলেও সরকার বা দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে একরোখা মনোভাব নিয়ে সফল হওয়া যায় না। যার প্রমাণ তো নব্বই-উত্তর দুই প্রধানমন্ত্রীই রেখে গেছেন।

বিজয়ের পরে বিজয়মালা পরতে হলেও মাথাটা একটু নোয়াতে হয়। ছাত্র-তরুণেরা তো আন্দোলনের বিজয়ী বীরই শুধু নয়, তারা এখন রাষ্ট্র পরিচালনার অংশীদার। আবেগ অবশ্যই থাকবে; কিন্তু শুধু আবেগ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করা কঠিন। আর রাষ্ট্রকে সংস্কার বা রূপান্তর করা তো আরও কঠিন। ছাত্র-তরুণেরা যখন ‘কঠিনেরে ভালোবেসেছে’, তখন তাদের আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে বাস্তবতার মাটিতেও পা রাখতে হবে।

শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাতের সংগ্রামে ছাত্রসমাজের স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েত, গুলির সামনে বুক পেতে লড়াই, মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে শত শত শহীদান শুধু আমাদের দেশের ইতিহাসেই নয়, দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল। আর এই সংগ্রামে দেশবাসী তাদের নিঃশর্ত সমর্থন ও স্বৈরাচার পতনের ম্যান্ডেট দিয়ে থাকলেও দেশ ও সরকার পরিচালনার জন্য নিঃশর্ত ম্যান্ডেট দেয়নি। তাই রাষ্ট্র পরিচালনায় অন্যান্য অংশীজনের ভাবনা এবং কথাকেও ছাত্রদের মূল্য দিতে হবে। নীতির ক্ষেত্রে অটল থেকেও অনেক সময় কৌশলে নমনীয় হতে হয়। তা না হলে নৈরাজ্য সৃষ্টির আশঙ্কা থেকে যায়। নৈরাজ্য বিপ্লবকে দুর্বল করে দেয়, এমনকি পরাজিতও করে দিতে পারে।

এ কথা তো সবারই জানা, পতিত স্বৈরাচার আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধিকারের সংগ্রাম ও সেই সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দলীয়করণ করে এবং মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকে অতিব্যবহার ও অপব্যবহার করে দেশবাসীর মাঝে বিরক্তি-ক্ষোভ সৃষ্টি করেছিলেন। তার দায় তো পতিত স্বৈরাচারের—এ দায় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আর প্রায় ৫০ বছর আগে প্রয়াত শেখ মুজিবুর রহমানের নয়। তারপরও যুক্তির খাতিরে মেনে নিলাম কেউ বিরক্তি ও ভ্রান্তি থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকেও হাসিনা সরকারের প্রতীক মনে করে তা ভাঙায় অংশ নিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তাজউদ্দীনসহ মুক্তিযুদ্ধকালীন চার নেতা, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এবং মুজিবনগর স্মৃতিসৌধকে তো শেখ হাসিনা সরকার দলীয়করণ করেনি; বরং অবহেলা করেছে। তারপরও মুক্তিযুদ্ধের এসব স্মৃতি ভাঙচুর করা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। একাত্তরের পরাজয়ের মনোবেদনা থেকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বকে এ বিষয়ে তাদের বক্তব্যকে সুস্পষ্ট করতে হবে।

অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ার নামে উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী সমাজ ও রাজনীতির মূল স্রোতোধারায় আসতে চাইলে তাদেরও পরিবর্তিত হতে হবে। তারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছে প্যান্ট, টি-শার্ট পরিহিত হাজার হাজার ছাত্রী এবারের আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁদের মধ্য থেকে শহীদও হয়েছেন। আবার তাঁদের সঙ্গে শত শত হিজাব পরিহিত ছাত্রীও ছিলেন। কে কী পোশাক পরবেন, কে কী খাবেন, কে কোন ধর্ম পালন করবেন, কে কাকে বিয়ে করবেন, কে শহীদের কবরে ফুল দেবেন, নীরবতা পালন করবেন আর কে মোনাজাত করবেন—এসব যাঁর যাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও পছন্দের বিষয়। এটাকে মেনে নিতে পারলেই অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে উঠতে পারে।

ইতিহাসের কোনো কোনো পর্বে, কোথাও কোথাও একক ব্যক্তি এত বিশাল গগনচুম্বী সর্বপ্লাবী ভূমিকা পালন করেন, তাঁর অবদান কেন্দ্রীয় ও চূড়ান্ত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা তেমনই সর্বপ্লাবী। তাঁর সেই তর্জনী, স্বাধীনতার পথ নির্দেশ। এই ঐতিহাসিক সত্য না মেনে ও স্বাধীনতা সংগ্রামে কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা বা দুঃখ প্রকাশ না করে কি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়া সম্ভব হবে?

আনোয়ারুল হক, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত