মহিউদ্দিন খান মোহন
আমাদের দেশে বিয়েবাড়িতে একটু-আধটু গোলমাল, তর্ক-বিতর্ক, মনোমালিন্য, ঝগড়াঝাঁটি অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। বর এবং কনেপক্ষের মধ্যে নানা বিষয়ে তর্কাতর্কি হয়েই থাকে। এটা আমাদের দেশের একটি নেতিবাচক ঐতিহ্যও বলা চলে। ছেলেবেলায় এ ধরনের অনেক ঘটনা দেখেছি। বড় হয়ে বর কিংবা কনেপক্ষের মাতব্বর হিসেবে অমন দু-চারটে বিবাদ মিটমাটও করেছি। আত্মীয় পরিমণ্ডলে আমি আবার ‘কম্প্রোমাইজিং মাস্টার’ হিসেবে খ্যাত!
বিয়েবাড়িতে সাধারণত যেসব গন্ডগোল হয়, সেগুলোর পরিসমাপ্তি ঘটে হাসিঠাট্টার মধ্য দিয়ে। একটা সময় ছিল যখন কোনো বাড়িতে বিয়ে হবে আর দুই পক্ষের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হবে না, এটা ছিল অবিশ্বাস্য। তা ছাড়া, বিয়ের অনুষ্ঠানে দু-চারজন লোক থাকত, যাদের কাজই ছিল যেকোনো ছুতোয় একটা হইহট্টগোল বাধিয়ে দেওয়া। কোথাও দেখা যেত বরপক্ষ কনের বিবাহসামগ্রীর (আমাদের বিক্রমপুরে বলে লোয়াজিমা) মধ্যে হয়তো কাজলদানি কিংবা তেলের বাটি আনেনি। আর যায় কোথায়! শুরু হয়ে গেল বাগ্যুদ্ধ। এসব ঘটনা সাধারণত যুবকদের মধ্যেই ঘটত। পরে মুরব্বিদের হস্তক্ষেপে যুদ্ধরত দুই পক্ষের মধ্যে ‘ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি’ হয়ে শান্তি ফিরে আসত। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল, পরিবেশ শান্ত হওয়ার পরে দেখা যেত, এতক্ষণ যারা পরস্পরের প্রতি বাক্যগোলা নিক্ষেপ করেছে, তারা কোথাও বসে একসঙ্গে মজাসে মুখ দিয়ে ধোঁয়া উদ্গিরণ করছে। বিয়েবাড়ির এসব ঘটনার অনেক স্মৃতিই আছে।
একবার এক বিয়ের বরযাত্রী হয়ে পড়েছিলাম বেজায় বিপাকে। সে সময় গ্রামাঞ্চলে বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো হতো রাতে। শীতের এক রাতে বরযাত্রী হিসেবে গেলাম আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে লৌহজং উপজেলার মৌছামান্দ্রা গ্রামে। রাত ১০টায় রওনা করে কনের বাড়িতে পৌঁছালাম রাত সাড়ে ১১টার দিকে। হেঁটে অত দূর ভ্রমণজনিত কারণে পাকস্থলী তখন প্রায় শূন্য। পেটের মধ্যে ইঁদুর যেন দৌড়াদৌড়ি করছে। বাংলাঘরে (সে সময় প্রায় সব বাড়িতেই বাইরের দিকে অনুষ্ঠানাদির জন্য একটি ঘর থাকত, যেটাকে বাংলাঘর বলত) সবাই সারিবদ্ধভাবে বসেছি খানাপিনার আশায়। কিন্তু খানা আসছে না। পরিবর্তে ভেতর বাড়ি থেকে সমবেত উচ্চকণ্ঠের আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। ধীরে ধীরে সে আওয়াজ নিকটবর্তী এবং স্পষ্ট হলো। বাংলাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কনেপক্ষের একজন উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বরপক্ষ মিষ্টি না আনবে, ততক্ষণ পর্যন্ত খাবার দেওয়া হবে না!
আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকলাম। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ পেল, বর এবং কনেপক্ষের মধ্যে চুক্তি ছিল এক মণ মিষ্টি নেওয়ার। কিন্তু বরপক্ষ মিষ্টি নিয়েছে আধা মণ। সুতরাং কনেপক্ষের সাফ কথা, ‘আনো মিষ্টি, পাতো পাত’। না হলে বসে থাকো শুকনো মুখে। ভীষণ বিব্রতকর অবস্থা। দুই পক্ষের তর্কাতর্কি চলতেই থাকল। এ সময় আমরা কয়েকজন যুবক কনেপক্ষের সমবয়সী দুজনকে ম্যানেজ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার উদ্যোগ নিলাম। আপসরফায় এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেল, দুই পক্ষের চারজন লোক কনের বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে সাতঘড়িয়া গ্রামে ‘গান্ধী ঘোষে’র বাড়িতে গিয়ে মিষ্টি নিয়ে আসবেন। গান্ধী ঘোষের মিষ্টি তখন বিক্রমপুরে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। পরবর্তীকালে গান্ধী ঘোষের ছেলেরা ঢাকার নারিন্দার শরৎগুপ্ত রোডে একটি মিষ্টির দোকান খুলেছিলেন।
যা-ই হোক, মুরব্বিরা আমাদের প্রস্তাব কণ্ঠভোটে অনুমোদন করার পর চারজন চলে গেলেন মিষ্টি আনতে। তাঁরা মিষ্টিসহ ফিরলেন রাত দুইটায়। ততক্ষণে পোলাও-কোরমা-কালিয়া পৌষের হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় জুড়ানপুরে চলে গেছে। আমরা বরযাত্রীরা ভুলের খেসারত হিসেবে সেই ঠান্ডা মোরগ-পোলাও গলাধঃকরণ করে তৃপ্তির কৃত্রিম ঢেকুর তুললাম। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, সকালে চা-নাশতা খেয়ে বর-বধূকে পালকিতে চড়িয়ে আমরা যখন প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশে গাত্রোত্থান করছি, তখন রাতে যাঁরা প্রায় যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা এসে কোলাকুলি করে ‘ভাই, কিছু মনে করবেন না, খুব কষ্ট দিয়েছি আপনাদের’, ‘আমরা লজ্জিত’ ইত্যাদি বলে মুখে ‘চিনিমাখা’ হাসি ফুটিয়ে মাফ চাইতে থাকলেন। আমরাও ‘না না, এতে আর এমন কী হয়েছে? বিয়েবাড়িতে অমন হতেই পারে’ বলে ভদ্রতা রক্ষা করে মনের কষ্ট মনে চেপে চলে এলাম। এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়তো অনেকেরই আছে। তবে ওই সব ঘটনার পরিসমাপ্তি হতো সাধারণত শান্তি ও সৌহার্দ্য স্থাপনের মধ্য দিয়ে।
কিন্তু ৪ মার্চ নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার এক বিয়েবাড়িতে যে বিয়োগান্ত ঘটনাটি ঘটে গেছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত তো বটেই, অবিশ্বাস্যও। ৫ মার্চের পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, কনের বাড়িতে বর ও কনেপক্ষের মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষে বরের পিতা নিহত হয়েছেন।
ঘটনার সূত্রপাত খাবারে টান পড়া নিয়ে। কনেপক্ষের সঙ্গে বরপক্ষের কথা ছিল, বরযাত্রীর সংখ্যা হবে ১০০ জন। কিন্তু বরযাত্রী আসে ২৫০ জন। সংগত কারণেই কনেপক্ষ পড়ে বিব্রতকর অবস্থায়। খাবারে পড়ে টান। বিয়েশাদি শেষে বরপক্ষ যখন বর-বধূ নিয়ে ফিরে আসছিল, তখন বরের পিতা কনের পিতাকে ডেকে অভিযোগ করে বলেন, আপনাদের আপ্যায়ন ভালো হয়নি। মাংস কম ছিল। এ নিয়ে দুই বেয়াই জড়িয়ে পড়েন কথা-কাটাকাটিতে। এ সময় দুই পক্ষের লোকজনও তাতে অংশ নেন। একপর্যায়ে বেধে যায় সংঘর্ষ। তাতে বরের পিতা নূর মোহাম্মদ গুরুতর আহত হন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক, সন্দেহ নেই।
উৎসবমুখর একটি বাড়ি প্রথমে পরিণত হলো রণক্ষেত্রে, পরে সেখানে নেমে এল শোকের ছায়া। বোধকরি একেই বলে ‘হরিষে বিষাদ’। আগেই বলেছি, বিয়েবাড়িতে ছোটখাটো বিষয়ে তর্কাতর্কি অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু তা সংঘর্ষে রূপ নেওয়া এবং তার পরিণামে একজন মানুষের প্রাণ চলে যাওয়াকে নিশ্চয়ই স্বাভাবিক ঘটনা বলা যাবে না। পত্রিকায় খবরটি পড়ে কেবলই ভাবছি, এমন ঘটনা ঘটার কারণ কী? ওই বিয়েবাড়িতে কি এমন একজন মানুষও ছিলেন না, যিনি উভয় পক্ষকে নিরস্ত করতে পারতেন? সম্ভবত না; বরং আগুনে বাতাস দেওয়ার মানুষের অভাব হয়তো ছিল না। যে কারণে বর-কনে উভয় পক্ষের ক্রোধের আগুন না নিভে আরও লেলিহান হয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, মানুষ আজকাল বড় বেশি অসহিষ্ণু হয়ে গেছে। জলঢাকার মর্মান্তিক ঘটনা তারই প্রমাণ। মানুষের ধৈর্য-সহ্য প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। একজন আরেকজনের ওপর চড়াও হতে এখন আর দ্বিধা করে না। একটুও হাত কাঁপে না কারও বুকে ছুরি বসিয়ে দিতে। আমাদের সমাজে নিত্য যেসব নৃশংস ঘটনা ঘটে, তার পেছনেও রয়েছে অসহিষ্ণুতা। মানুষ আজকাল নিজেকে শক্তিশালী প্রমাণ করতে যা খুশি তা-ই করতে দ্বিধা করে না। তাদের বিবেক যেন লোপ পেয়েছে। জলঢাকায় যারা সংঘর্ষে জড়িয়েছিল, তারা কি একবারও ভেবেছিল কাজটি ঠিক হচ্ছে কি না? বোধ হয় তা ভাবেনি; বরং দুই পক্ষের বাগ্বিতণ্ডাকে সংঘর্ষে গড়াতে উসকানি দিয়ে থাকবে।
পবিত্র আল কোরআনের সুরা মায়েদায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেছেন, ‘তোমরা সীমা লঙ্ঘন কোরো না, আমি সীমা লঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করি না।’ তারপরও মানুষ কখনো কখনো সীমা ছাড়িয়ে যায়। আর তার পরিণতিতে ঘটে নানা রকম মর্মান্তিক ঘটনা। নীলফামারীর জলঢাকায়ও তা-ই ঘটেছে। মানুষকে বিপথে পরিচালিত করতে যে ছয়টি রিপু কাজ করে, ক্রোধ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। ক্রোধকে পরাজিত করতে পারে সংযম। এ জন্যই মনীষীরা মানুষকে সংযমী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সেদিন যদি বর ও কনেপক্ষ সংযমী হতো, তাহলে জলঢাকা একটি মর্মন্তুদ ঘটনার সাক্ষী হতো না। সৃষ্টি হতো না একটি ন্যক্কারজনক ঘটনার উদাহরণ। কিন্তু তারপরও কি আমরা সংযমী হব?
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
আমাদের দেশে বিয়েবাড়িতে একটু-আধটু গোলমাল, তর্ক-বিতর্ক, মনোমালিন্য, ঝগড়াঝাঁটি অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। বর এবং কনেপক্ষের মধ্যে নানা বিষয়ে তর্কাতর্কি হয়েই থাকে। এটা আমাদের দেশের একটি নেতিবাচক ঐতিহ্যও বলা চলে। ছেলেবেলায় এ ধরনের অনেক ঘটনা দেখেছি। বড় হয়ে বর কিংবা কনেপক্ষের মাতব্বর হিসেবে অমন দু-চারটে বিবাদ মিটমাটও করেছি। আত্মীয় পরিমণ্ডলে আমি আবার ‘কম্প্রোমাইজিং মাস্টার’ হিসেবে খ্যাত!
বিয়েবাড়িতে সাধারণত যেসব গন্ডগোল হয়, সেগুলোর পরিসমাপ্তি ঘটে হাসিঠাট্টার মধ্য দিয়ে। একটা সময় ছিল যখন কোনো বাড়িতে বিয়ে হবে আর দুই পক্ষের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হবে না, এটা ছিল অবিশ্বাস্য। তা ছাড়া, বিয়ের অনুষ্ঠানে দু-চারজন লোক থাকত, যাদের কাজই ছিল যেকোনো ছুতোয় একটা হইহট্টগোল বাধিয়ে দেওয়া। কোথাও দেখা যেত বরপক্ষ কনের বিবাহসামগ্রীর (আমাদের বিক্রমপুরে বলে লোয়াজিমা) মধ্যে হয়তো কাজলদানি কিংবা তেলের বাটি আনেনি। আর যায় কোথায়! শুরু হয়ে গেল বাগ্যুদ্ধ। এসব ঘটনা সাধারণত যুবকদের মধ্যেই ঘটত। পরে মুরব্বিদের হস্তক্ষেপে যুদ্ধরত দুই পক্ষের মধ্যে ‘ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি’ হয়ে শান্তি ফিরে আসত। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল, পরিবেশ শান্ত হওয়ার পরে দেখা যেত, এতক্ষণ যারা পরস্পরের প্রতি বাক্যগোলা নিক্ষেপ করেছে, তারা কোথাও বসে একসঙ্গে মজাসে মুখ দিয়ে ধোঁয়া উদ্গিরণ করছে। বিয়েবাড়ির এসব ঘটনার অনেক স্মৃতিই আছে।
একবার এক বিয়ের বরযাত্রী হয়ে পড়েছিলাম বেজায় বিপাকে। সে সময় গ্রামাঞ্চলে বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো হতো রাতে। শীতের এক রাতে বরযাত্রী হিসেবে গেলাম আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে লৌহজং উপজেলার মৌছামান্দ্রা গ্রামে। রাত ১০টায় রওনা করে কনের বাড়িতে পৌঁছালাম রাত সাড়ে ১১টার দিকে। হেঁটে অত দূর ভ্রমণজনিত কারণে পাকস্থলী তখন প্রায় শূন্য। পেটের মধ্যে ইঁদুর যেন দৌড়াদৌড়ি করছে। বাংলাঘরে (সে সময় প্রায় সব বাড়িতেই বাইরের দিকে অনুষ্ঠানাদির জন্য একটি ঘর থাকত, যেটাকে বাংলাঘর বলত) সবাই সারিবদ্ধভাবে বসেছি খানাপিনার আশায়। কিন্তু খানা আসছে না। পরিবর্তে ভেতর বাড়ি থেকে সমবেত উচ্চকণ্ঠের আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। ধীরে ধীরে সে আওয়াজ নিকটবর্তী এবং স্পষ্ট হলো। বাংলাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কনেপক্ষের একজন উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বরপক্ষ মিষ্টি না আনবে, ততক্ষণ পর্যন্ত খাবার দেওয়া হবে না!
আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকলাম। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ পেল, বর এবং কনেপক্ষের মধ্যে চুক্তি ছিল এক মণ মিষ্টি নেওয়ার। কিন্তু বরপক্ষ মিষ্টি নিয়েছে আধা মণ। সুতরাং কনেপক্ষের সাফ কথা, ‘আনো মিষ্টি, পাতো পাত’। না হলে বসে থাকো শুকনো মুখে। ভীষণ বিব্রতকর অবস্থা। দুই পক্ষের তর্কাতর্কি চলতেই থাকল। এ সময় আমরা কয়েকজন যুবক কনেপক্ষের সমবয়সী দুজনকে ম্যানেজ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার উদ্যোগ নিলাম। আপসরফায় এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেল, দুই পক্ষের চারজন লোক কনের বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে সাতঘড়িয়া গ্রামে ‘গান্ধী ঘোষে’র বাড়িতে গিয়ে মিষ্টি নিয়ে আসবেন। গান্ধী ঘোষের মিষ্টি তখন বিক্রমপুরে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। পরবর্তীকালে গান্ধী ঘোষের ছেলেরা ঢাকার নারিন্দার শরৎগুপ্ত রোডে একটি মিষ্টির দোকান খুলেছিলেন।
যা-ই হোক, মুরব্বিরা আমাদের প্রস্তাব কণ্ঠভোটে অনুমোদন করার পর চারজন চলে গেলেন মিষ্টি আনতে। তাঁরা মিষ্টিসহ ফিরলেন রাত দুইটায়। ততক্ষণে পোলাও-কোরমা-কালিয়া পৌষের হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় জুড়ানপুরে চলে গেছে। আমরা বরযাত্রীরা ভুলের খেসারত হিসেবে সেই ঠান্ডা মোরগ-পোলাও গলাধঃকরণ করে তৃপ্তির কৃত্রিম ঢেকুর তুললাম। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, সকালে চা-নাশতা খেয়ে বর-বধূকে পালকিতে চড়িয়ে আমরা যখন প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশে গাত্রোত্থান করছি, তখন রাতে যাঁরা প্রায় যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা এসে কোলাকুলি করে ‘ভাই, কিছু মনে করবেন না, খুব কষ্ট দিয়েছি আপনাদের’, ‘আমরা লজ্জিত’ ইত্যাদি বলে মুখে ‘চিনিমাখা’ হাসি ফুটিয়ে মাফ চাইতে থাকলেন। আমরাও ‘না না, এতে আর এমন কী হয়েছে? বিয়েবাড়িতে অমন হতেই পারে’ বলে ভদ্রতা রক্ষা করে মনের কষ্ট মনে চেপে চলে এলাম। এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়তো অনেকেরই আছে। তবে ওই সব ঘটনার পরিসমাপ্তি হতো সাধারণত শান্তি ও সৌহার্দ্য স্থাপনের মধ্য দিয়ে।
কিন্তু ৪ মার্চ নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার এক বিয়েবাড়িতে যে বিয়োগান্ত ঘটনাটি ঘটে গেছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত তো বটেই, অবিশ্বাস্যও। ৫ মার্চের পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, কনের বাড়িতে বর ও কনেপক্ষের মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষে বরের পিতা নিহত হয়েছেন।
ঘটনার সূত্রপাত খাবারে টান পড়া নিয়ে। কনেপক্ষের সঙ্গে বরপক্ষের কথা ছিল, বরযাত্রীর সংখ্যা হবে ১০০ জন। কিন্তু বরযাত্রী আসে ২৫০ জন। সংগত কারণেই কনেপক্ষ পড়ে বিব্রতকর অবস্থায়। খাবারে পড়ে টান। বিয়েশাদি শেষে বরপক্ষ যখন বর-বধূ নিয়ে ফিরে আসছিল, তখন বরের পিতা কনের পিতাকে ডেকে অভিযোগ করে বলেন, আপনাদের আপ্যায়ন ভালো হয়নি। মাংস কম ছিল। এ নিয়ে দুই বেয়াই জড়িয়ে পড়েন কথা-কাটাকাটিতে। এ সময় দুই পক্ষের লোকজনও তাতে অংশ নেন। একপর্যায়ে বেধে যায় সংঘর্ষ। তাতে বরের পিতা নূর মোহাম্মদ গুরুতর আহত হন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক, সন্দেহ নেই।
উৎসবমুখর একটি বাড়ি প্রথমে পরিণত হলো রণক্ষেত্রে, পরে সেখানে নেমে এল শোকের ছায়া। বোধকরি একেই বলে ‘হরিষে বিষাদ’। আগেই বলেছি, বিয়েবাড়িতে ছোটখাটো বিষয়ে তর্কাতর্কি অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু তা সংঘর্ষে রূপ নেওয়া এবং তার পরিণামে একজন মানুষের প্রাণ চলে যাওয়াকে নিশ্চয়ই স্বাভাবিক ঘটনা বলা যাবে না। পত্রিকায় খবরটি পড়ে কেবলই ভাবছি, এমন ঘটনা ঘটার কারণ কী? ওই বিয়েবাড়িতে কি এমন একজন মানুষও ছিলেন না, যিনি উভয় পক্ষকে নিরস্ত করতে পারতেন? সম্ভবত না; বরং আগুনে বাতাস দেওয়ার মানুষের অভাব হয়তো ছিল না। যে কারণে বর-কনে উভয় পক্ষের ক্রোধের আগুন না নিভে আরও লেলিহান হয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, মানুষ আজকাল বড় বেশি অসহিষ্ণু হয়ে গেছে। জলঢাকার মর্মান্তিক ঘটনা তারই প্রমাণ। মানুষের ধৈর্য-সহ্য প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। একজন আরেকজনের ওপর চড়াও হতে এখন আর দ্বিধা করে না। একটুও হাত কাঁপে না কারও বুকে ছুরি বসিয়ে দিতে। আমাদের সমাজে নিত্য যেসব নৃশংস ঘটনা ঘটে, তার পেছনেও রয়েছে অসহিষ্ণুতা। মানুষ আজকাল নিজেকে শক্তিশালী প্রমাণ করতে যা খুশি তা-ই করতে দ্বিধা করে না। তাদের বিবেক যেন লোপ পেয়েছে। জলঢাকায় যারা সংঘর্ষে জড়িয়েছিল, তারা কি একবারও ভেবেছিল কাজটি ঠিক হচ্ছে কি না? বোধ হয় তা ভাবেনি; বরং দুই পক্ষের বাগ্বিতণ্ডাকে সংঘর্ষে গড়াতে উসকানি দিয়ে থাকবে।
পবিত্র আল কোরআনের সুরা মায়েদায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেছেন, ‘তোমরা সীমা লঙ্ঘন কোরো না, আমি সীমা লঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করি না।’ তারপরও মানুষ কখনো কখনো সীমা ছাড়িয়ে যায়। আর তার পরিণতিতে ঘটে নানা রকম মর্মান্তিক ঘটনা। নীলফামারীর জলঢাকায়ও তা-ই ঘটেছে। মানুষকে বিপথে পরিচালিত করতে যে ছয়টি রিপু কাজ করে, ক্রোধ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। ক্রোধকে পরাজিত করতে পারে সংযম। এ জন্যই মনীষীরা মানুষকে সংযমী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সেদিন যদি বর ও কনেপক্ষ সংযমী হতো, তাহলে জলঢাকা একটি মর্মন্তুদ ঘটনার সাক্ষী হতো না। সৃষ্টি হতো না একটি ন্যক্কারজনক ঘটনার উদাহরণ। কিন্তু তারপরও কি আমরা সংযমী হব?
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
১ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৫ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৫ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ দিন আগে