হাসান মামুন
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে তিন দিন দেরি হয়েছিল। এ অবস্থায় বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছু বাড়তি অবনতি ঘটে। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রসমাজ ও সেনাবাহিনী সচেষ্ট থাকলেও তাতে আশানুরূপ কাজ হয়নি। নজিরবিহীন আন্দোলনে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকা একটি স্বেচ্ছাচারী সরকারের পতন হলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাতে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা কঠিনও বটে।
এর মধ্যে আবার পুলিশ গিয়েছিল লাপাত্তা হয়ে। বেসামরিক প্রশাসনও ঠিকমতো কাজ করছিল না। গোটা প্রশাসনই ছিল ভয়াবহ দলীয়করণের শিকার। এর ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সেনাবাহিনীই কেবল ভিন্ন অবস্থান নিতে সক্ষম হয়। তারা এই মুহূর্তে পুলিশের অনেক দায়িত্বও পালন করছে। শেখ হাসিনা সরকারের রেখে যাওয়া পুলিশকে তো সক্রিয় করা যায়নি এখনো!
পুলিশসহ প্রশাসনে বড় রদবদল অবশ্য হয়েছে গত এক মাসে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে পুলিশের যে ঘৃণ্য ভূমিকা, তাতে এর খোলনলচে বদলে ফেলা জরুরি। ইতিমধ্যে তাদের পোশাকটা অন্তত বদলে ফেলতে পারলে ভালো হতো। নতুন পোশাকে আবির্ভূত হওয়াটাও একটা সংস্কার। তাতে পুলিশ এটুকু অনুভব করবে যে, তারা একটা নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি। তবে পুলিশের ভেতরগত পরিবর্তন হতে সময় লাগবে। এ জন্য বিধিবিধানে পরিবর্তন আনা এবং তাদের একটি স্বতন্ত্র কমিশনের অধীনে পরিচালনার বিষয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। এর ‘এলিট ফোর্স’ কিন্তু আগে থেকেই বিতর্কিত। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা আছে এর ওপর। আন্দোলন দমনে এর হেলিকপ্টার ব্যবহারও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নতুন দৃষ্টান্ত হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। এই বাহিনীর ‘বিলুপ্তি’র কথাও তুলছেন কেউ কেউ। কাজটা অবশ্য সহজ নয়। কোনো কিছু বিলুপ্ত না করে সংস্কার করাও ভালো। এরই মধ্যে একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনায় আনসার বাহিনী নিয়েও কথা উঠেছে। অনিয়মিত আনসার সদস্য অনেক বাড়িয়ে ফেলেছিল বিগত সরকার। এ নিয়েও আছে বিস্তর অভিযোগ। একতরফা বা ভোটারবিহীন নির্বাচনে এই সব কটি বাহিনীই বাজেভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে পুলিশের অব্যাহত ব্যবহারও তাদের ‘দেশের রাজা’য় পরিণত করে। এখান থেকে তাদের বের করে এনে স্বাভাবিক দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত করা কঠিন।
অন্তর্বর্তী সরকারে স্বভাবতই রাজনৈতিক সরকারের চেয়ে অনেক কম উপদেষ্টা রয়েছেন। প্রত্যেককে নিতে হয়েছে একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। কাজের চাপ অনেক। ড. ইউনূসসহ তাঁদের একাংশ আবার প্রবীণ। এর বড় অংশটা এসেছে বরাবরের মতোই নাগরিক সমাজ থেকে। তাঁদের সরকারি প্রশাসনযন্ত্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই। এই সরকারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক। এটা আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের নতুন অধ্যায় ও অভিজ্ঞতা। যে পরিস্থিতিতে তাঁরা দায়িত্ব নিয়েছেন, তাতে এক মাসের মধ্যে অবশ্য কাজের কোনো যথাযথ মূল্যায়ন হয় না। এমন তো নয় যে, তিন মাসের জন্য একটি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ দায়িত্ব নিয়েছে সুষ্ঠুভাবে জাতীয় নির্বাচন করতে। এটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়। সেই বিধানও বাতিল হয় হাসিনা সরকারের আমলেই। তাঁরা যে ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন, ড. ইউনূসের সরকার সে ধরনেরও নয়। এটি গণ-অভ্যুত্থান থেকে উৎসারিত। তার চরিত্র স্বভাবতই ভিন্ন। তবে লক্ষ্য অভিন্ন বলেই বর্ণনা করা হচ্ছে। সেটা হলো, দেরিতে হলেও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর। তার আগে কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার, সে বিষয়েও স্বভাবতই চলছে আলোচনা।
এর আগে ‘ওয়ান-ইলেভেন সরকার’ও সংস্কারে ব্যাপক আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু তৎপরতা দেখাতে পারলেও তারা সাফল্য রেখে যেতে পারেনি। এবার প্রেক্ষাপট যেহেতু গুণগতভাবে ভিন্ন, তাই অন্তত জরুরি সংস্কারগুলোর ব্যাপারে প্রত্যাশা অনেক বেড়েছে। চাপও আছে প্রধানত ছাত্র-জনতার ভেতর থেকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাজনীতিতে একটা বিশেষ পক্ষ হিসেবে আবির্ভূত। তারা সরকারে আছে; মাঠেও উপস্থিত। ড. ইউনূস এর মধ্যে দেওয়া এক ভাষণে বলেছেন, দায়িত্ব পালন শেষে তাঁদের প্রস্থানের সময়টা ‘রাজনৈতিক আলোচনা’র ভেতর থেকেই আসবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির মতো বড় দলের পাশাপাশি ছাত্রনেতাদের বক্তব্যও গুরুত্ব পাবে নিশ্চয়ই। তাঁরা বড় ধরনের সংস্কারে অব্যাহতভাবে আগ্রহ দেখিয়ে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোও অস্থিরতা দেখাচ্ছে না দ্রুত নির্বাচনের ব্যাপারে। জামায়াতের মতো কোনো কোনো দল অন্তর্বর্তী সরকারকে বেশি সময় দেওয়ারও পক্ষপাতী। তারা হয়তো এই সুযোগে দল গোছাতে চায়। এই জায়গাটায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগই কেবল অনুপস্থিত। গণ-অভ্যুত্থানে তাদের সরকার উৎখাত হয়ে যাওয়াটা দলটির নিরপরাধ সমর্থকদেরও নজিরবিহীন সংকটে ফেলেছে। সরকারের তরফ থেকে আবার বলে দেওয়া হয়েছে—বিচারের আগে তাদের ‘পুনর্বাসনের’ সুযোগ নেই। এ বিষয়ে সবাই যে একমত হবেন, তা অবশ্য নয়। এসব প্রশ্নে ভিন্নমতের সুযোগ রাখাও উচিত হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক পক্ষ থেকে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে না, তা অবশ্য নয়। বিগত এক মাসে অনেক ঘটনাই ঘটেছে, যাতে ভারতে অবস্থানরত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের উসকানি ছিল বলেই ধারণা। তবে ঘটনার ভেতরে যা-ই থাকুক, সরকার মাথা ঠান্ডা রেখেই তা মোকাবিলা করে চলেছে। ইউনূস সাহেব তাঁর বাসভবনের সামনে অবস্থান নেওয়া বিভিন্ন দাবি আদায়কারী পক্ষের ব্যাপারেও সহনশীলতা দেখিয়েছেন। কিন্তু এরও শেষ আছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে জরুরি কাজগুলো সারতে সরকারকে কঠোর হতে হয় বৈকি। সেটাও ক্রমে দেখতে পাওয়া গেছে। হাসিনা সরকারের পতনে অতি উৎসাহী হয়ে কিছু গোষ্ঠী গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। এতে কেবল দেশে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে না; আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশ্ন ওঠার অবকাশ তৈরি হচ্ছে। ড. ইউনূস বারবার বলছেন, আমরা ‘একটি পরিবার’। এ দেশে সবাই সম-অধিকার ও সমমর্যাদা নিয়ে থাকবে। দেশ হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, উদার ও গণতান্ত্রিক। মুক্তিযুদ্ধেও আমরা কিন্তু এমন একটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়েছিলাম। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারকে কুশলতার সঙ্গে গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাবিরোধী শক্তিগুলোকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। তাদের তৎপরতা অব্যাহত থাকলে সরকার পড়ে যাবে প্রশ্নের মুখে এবং তখন ঘোষিত লক্ষ্যে দেশ পরিচালনা করাও হবে কঠিন। সরকারকে দ্রুততার সঙ্গে জুলাইয়ের রক্তাক্ত ঘটনাবলির যথাযথ তদন্ত আর ন্যায়বিচারও নিশ্চিত করতে হবে। জাতিসংঘ এ বিষয়ে স্বাধীনভাবে তদন্ত পরিচালনা করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সাধারণভাবে পশ্চিমা বিশ্ব কিন্তু স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিবর্তনকে। তাদের কাছ থেকে বর্ধিত আর্থিক সহায়তাও চাইছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার।
এই সরকারে কয়েকজন সুযোগ্য অর্থনীতিবিদ রয়েছেন। হাসিনা সরকার, বিশেষ করে শেষ কয়েক বছরে অর্থনীতি পরিচালনায় তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিল। সেটা সংকটময় অধ্যায়ে উপনীত হওয়ার আগেই অবশ্য প্রস্থান ঘটল তাদের। এই চ্যালেঞ্জ এখন মোকাবিলা করতে হচ্ছে বর্তমান সরকারকে।
আমরা সবাই জানি, ব্যাংক খাতের কী অবস্থা; বিশেষ করে একগুচ্ছ ব্যাংকের। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পলাতক অবস্থায়ই করেছেন পদত্যাগ। আর নতুন গভর্নরকে দায়িত্ব নিয়েই একগাদা ব্যাংকে বদলাতে হচ্ছে পরিচালনা পর্ষদ। আমানতকারীদের আস্থা ধরে রাখতে হচ্ছে তাঁকে। শেয়ারবাজারেও আস্থা ফিরিয়ে আনার প্রয়াস চলছে। মোটামুটি একই গোষ্ঠী ব্যাংক ও শেয়ারবাজার থেকে জনগণের অর্থ লুটে নিচ্ছিল। সেই প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়াটাও বড় ব্যাপার। লুণ্ঠিত অর্থের পাচারও নিশ্চয়ই কমে এসেছে; অন্তত সরকারের সমর্থনে এসব আর হচ্ছে না। এদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ে বাজে অবস্থায় আছে দেশ অনেক দিন ধরে। আন্দোলন চলাকালে এটা স্বভাবতই আরও বেড়েছিল। এখন যত দ্রুত সম্ভব এটা কমিয়ে আনতে হবে। কিন্তু দ্রুত কমিয়ে আনার সুযোগ বড় একটা নেই। এ অবস্থায় সরকারকে সময়ে সময়ে বলতে হবে, কেন প্রত্যাশা অনুযায়ী উন্নতি হচ্ছে না। এ সরকার দায়িত্ব নিতে না নিতেই একটা বড় বন্যার ধাক্কা গেল। চলতি মাসেও শঙ্কা আছে নতুন বন্যার। এ অবস্থায় খাদ্যশস্যের কাম্য মজুত ও ফসল উৎপাদন স্বাভাবিক রাখাটা জরুরি। ডলারের সংকটেও সার, বীজ ও জ্বালানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। নিকটবর্তী উৎস ভারত থেকে আমদানি যেন বিঘ্নিত না হয়। প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখা যায় বৈকি। আর রাজনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে হবে দুই দিক থেকেই। বাংলাদেশ থেকে এ ক্ষেত্রে চেষ্টার কোনো ঘাটতি হবে না, এটা স্পষ্ট করেই বলা হচ্ছে। ভারতও আশা করা যায় বাংলাদেশের পরিবর্তিত বাস্তবতা বুঝে পথ চলবে।
পরবর্তী মাসে অন্যান্য কাজের পাশাপাশি দুটি ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি হতে হবে—আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনীতি। বিশেষত রপ্তানি খাত সচল রাখা। উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতে শ্রমবাজারে অস্থিরতা বিপজ্জনক। সংস্কারের প্রতি ব্যাপক মানুষের সমর্থন ধরে রাখতেও এ দুই ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নয়ন জরুরি।
লেখক: হাসান মামুন
সাংবাদিক, বিশ্লেষক
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে তিন দিন দেরি হয়েছিল। এ অবস্থায় বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছু বাড়তি অবনতি ঘটে। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রসমাজ ও সেনাবাহিনী সচেষ্ট থাকলেও তাতে আশানুরূপ কাজ হয়নি। নজিরবিহীন আন্দোলনে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকা একটি স্বেচ্ছাচারী সরকারের পতন হলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাতে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা কঠিনও বটে।
এর মধ্যে আবার পুলিশ গিয়েছিল লাপাত্তা হয়ে। বেসামরিক প্রশাসনও ঠিকমতো কাজ করছিল না। গোটা প্রশাসনই ছিল ভয়াবহ দলীয়করণের শিকার। এর ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সেনাবাহিনীই কেবল ভিন্ন অবস্থান নিতে সক্ষম হয়। তারা এই মুহূর্তে পুলিশের অনেক দায়িত্বও পালন করছে। শেখ হাসিনা সরকারের রেখে যাওয়া পুলিশকে তো সক্রিয় করা যায়নি এখনো!
পুলিশসহ প্রশাসনে বড় রদবদল অবশ্য হয়েছে গত এক মাসে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে পুলিশের যে ঘৃণ্য ভূমিকা, তাতে এর খোলনলচে বদলে ফেলা জরুরি। ইতিমধ্যে তাদের পোশাকটা অন্তত বদলে ফেলতে পারলে ভালো হতো। নতুন পোশাকে আবির্ভূত হওয়াটাও একটা সংস্কার। তাতে পুলিশ এটুকু অনুভব করবে যে, তারা একটা নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি। তবে পুলিশের ভেতরগত পরিবর্তন হতে সময় লাগবে। এ জন্য বিধিবিধানে পরিবর্তন আনা এবং তাদের একটি স্বতন্ত্র কমিশনের অধীনে পরিচালনার বিষয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। এর ‘এলিট ফোর্স’ কিন্তু আগে থেকেই বিতর্কিত। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা আছে এর ওপর। আন্দোলন দমনে এর হেলিকপ্টার ব্যবহারও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নতুন দৃষ্টান্ত হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। এই বাহিনীর ‘বিলুপ্তি’র কথাও তুলছেন কেউ কেউ। কাজটা অবশ্য সহজ নয়। কোনো কিছু বিলুপ্ত না করে সংস্কার করাও ভালো। এরই মধ্যে একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনায় আনসার বাহিনী নিয়েও কথা উঠেছে। অনিয়মিত আনসার সদস্য অনেক বাড়িয়ে ফেলেছিল বিগত সরকার। এ নিয়েও আছে বিস্তর অভিযোগ। একতরফা বা ভোটারবিহীন নির্বাচনে এই সব কটি বাহিনীই বাজেভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে পুলিশের অব্যাহত ব্যবহারও তাদের ‘দেশের রাজা’য় পরিণত করে। এখান থেকে তাদের বের করে এনে স্বাভাবিক দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত করা কঠিন।
অন্তর্বর্তী সরকারে স্বভাবতই রাজনৈতিক সরকারের চেয়ে অনেক কম উপদেষ্টা রয়েছেন। প্রত্যেককে নিতে হয়েছে একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। কাজের চাপ অনেক। ড. ইউনূসসহ তাঁদের একাংশ আবার প্রবীণ। এর বড় অংশটা এসেছে বরাবরের মতোই নাগরিক সমাজ থেকে। তাঁদের সরকারি প্রশাসনযন্ত্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই। এই সরকারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক। এটা আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের নতুন অধ্যায় ও অভিজ্ঞতা। যে পরিস্থিতিতে তাঁরা দায়িত্ব নিয়েছেন, তাতে এক মাসের মধ্যে অবশ্য কাজের কোনো যথাযথ মূল্যায়ন হয় না। এমন তো নয় যে, তিন মাসের জন্য একটি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ দায়িত্ব নিয়েছে সুষ্ঠুভাবে জাতীয় নির্বাচন করতে। এটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়। সেই বিধানও বাতিল হয় হাসিনা সরকারের আমলেই। তাঁরা যে ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন, ড. ইউনূসের সরকার সে ধরনেরও নয়। এটি গণ-অভ্যুত্থান থেকে উৎসারিত। তার চরিত্র স্বভাবতই ভিন্ন। তবে লক্ষ্য অভিন্ন বলেই বর্ণনা করা হচ্ছে। সেটা হলো, দেরিতে হলেও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর। তার আগে কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার, সে বিষয়েও স্বভাবতই চলছে আলোচনা।
এর আগে ‘ওয়ান-ইলেভেন সরকার’ও সংস্কারে ব্যাপক আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু তৎপরতা দেখাতে পারলেও তারা সাফল্য রেখে যেতে পারেনি। এবার প্রেক্ষাপট যেহেতু গুণগতভাবে ভিন্ন, তাই অন্তত জরুরি সংস্কারগুলোর ব্যাপারে প্রত্যাশা অনেক বেড়েছে। চাপও আছে প্রধানত ছাত্র-জনতার ভেতর থেকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাজনীতিতে একটা বিশেষ পক্ষ হিসেবে আবির্ভূত। তারা সরকারে আছে; মাঠেও উপস্থিত। ড. ইউনূস এর মধ্যে দেওয়া এক ভাষণে বলেছেন, দায়িত্ব পালন শেষে তাঁদের প্রস্থানের সময়টা ‘রাজনৈতিক আলোচনা’র ভেতর থেকেই আসবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির মতো বড় দলের পাশাপাশি ছাত্রনেতাদের বক্তব্যও গুরুত্ব পাবে নিশ্চয়ই। তাঁরা বড় ধরনের সংস্কারে অব্যাহতভাবে আগ্রহ দেখিয়ে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোও অস্থিরতা দেখাচ্ছে না দ্রুত নির্বাচনের ব্যাপারে। জামায়াতের মতো কোনো কোনো দল অন্তর্বর্তী সরকারকে বেশি সময় দেওয়ারও পক্ষপাতী। তারা হয়তো এই সুযোগে দল গোছাতে চায়। এই জায়গাটায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগই কেবল অনুপস্থিত। গণ-অভ্যুত্থানে তাদের সরকার উৎখাত হয়ে যাওয়াটা দলটির নিরপরাধ সমর্থকদেরও নজিরবিহীন সংকটে ফেলেছে। সরকারের তরফ থেকে আবার বলে দেওয়া হয়েছে—বিচারের আগে তাদের ‘পুনর্বাসনের’ সুযোগ নেই। এ বিষয়ে সবাই যে একমত হবেন, তা অবশ্য নয়। এসব প্রশ্নে ভিন্নমতের সুযোগ রাখাও উচিত হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক পক্ষ থেকে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে না, তা অবশ্য নয়। বিগত এক মাসে অনেক ঘটনাই ঘটেছে, যাতে ভারতে অবস্থানরত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের উসকানি ছিল বলেই ধারণা। তবে ঘটনার ভেতরে যা-ই থাকুক, সরকার মাথা ঠান্ডা রেখেই তা মোকাবিলা করে চলেছে। ইউনূস সাহেব তাঁর বাসভবনের সামনে অবস্থান নেওয়া বিভিন্ন দাবি আদায়কারী পক্ষের ব্যাপারেও সহনশীলতা দেখিয়েছেন। কিন্তু এরও শেষ আছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে জরুরি কাজগুলো সারতে সরকারকে কঠোর হতে হয় বৈকি। সেটাও ক্রমে দেখতে পাওয়া গেছে। হাসিনা সরকারের পতনে অতি উৎসাহী হয়ে কিছু গোষ্ঠী গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। এতে কেবল দেশে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে না; আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশ্ন ওঠার অবকাশ তৈরি হচ্ছে। ড. ইউনূস বারবার বলছেন, আমরা ‘একটি পরিবার’। এ দেশে সবাই সম-অধিকার ও সমমর্যাদা নিয়ে থাকবে। দেশ হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, উদার ও গণতান্ত্রিক। মুক্তিযুদ্ধেও আমরা কিন্তু এমন একটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়েছিলাম। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারকে কুশলতার সঙ্গে গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাবিরোধী শক্তিগুলোকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। তাদের তৎপরতা অব্যাহত থাকলে সরকার পড়ে যাবে প্রশ্নের মুখে এবং তখন ঘোষিত লক্ষ্যে দেশ পরিচালনা করাও হবে কঠিন। সরকারকে দ্রুততার সঙ্গে জুলাইয়ের রক্তাক্ত ঘটনাবলির যথাযথ তদন্ত আর ন্যায়বিচারও নিশ্চিত করতে হবে। জাতিসংঘ এ বিষয়ে স্বাধীনভাবে তদন্ত পরিচালনা করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সাধারণভাবে পশ্চিমা বিশ্ব কিন্তু স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিবর্তনকে। তাদের কাছ থেকে বর্ধিত আর্থিক সহায়তাও চাইছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার।
এই সরকারে কয়েকজন সুযোগ্য অর্থনীতিবিদ রয়েছেন। হাসিনা সরকার, বিশেষ করে শেষ কয়েক বছরে অর্থনীতি পরিচালনায় তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিল। সেটা সংকটময় অধ্যায়ে উপনীত হওয়ার আগেই অবশ্য প্রস্থান ঘটল তাদের। এই চ্যালেঞ্জ এখন মোকাবিলা করতে হচ্ছে বর্তমান সরকারকে।
আমরা সবাই জানি, ব্যাংক খাতের কী অবস্থা; বিশেষ করে একগুচ্ছ ব্যাংকের। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পলাতক অবস্থায়ই করেছেন পদত্যাগ। আর নতুন গভর্নরকে দায়িত্ব নিয়েই একগাদা ব্যাংকে বদলাতে হচ্ছে পরিচালনা পর্ষদ। আমানতকারীদের আস্থা ধরে রাখতে হচ্ছে তাঁকে। শেয়ারবাজারেও আস্থা ফিরিয়ে আনার প্রয়াস চলছে। মোটামুটি একই গোষ্ঠী ব্যাংক ও শেয়ারবাজার থেকে জনগণের অর্থ লুটে নিচ্ছিল। সেই প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়াটাও বড় ব্যাপার। লুণ্ঠিত অর্থের পাচারও নিশ্চয়ই কমে এসেছে; অন্তত সরকারের সমর্থনে এসব আর হচ্ছে না। এদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ে বাজে অবস্থায় আছে দেশ অনেক দিন ধরে। আন্দোলন চলাকালে এটা স্বভাবতই আরও বেড়েছিল। এখন যত দ্রুত সম্ভব এটা কমিয়ে আনতে হবে। কিন্তু দ্রুত কমিয়ে আনার সুযোগ বড় একটা নেই। এ অবস্থায় সরকারকে সময়ে সময়ে বলতে হবে, কেন প্রত্যাশা অনুযায়ী উন্নতি হচ্ছে না। এ সরকার দায়িত্ব নিতে না নিতেই একটা বড় বন্যার ধাক্কা গেল। চলতি মাসেও শঙ্কা আছে নতুন বন্যার। এ অবস্থায় খাদ্যশস্যের কাম্য মজুত ও ফসল উৎপাদন স্বাভাবিক রাখাটা জরুরি। ডলারের সংকটেও সার, বীজ ও জ্বালানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। নিকটবর্তী উৎস ভারত থেকে আমদানি যেন বিঘ্নিত না হয়। প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখা যায় বৈকি। আর রাজনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে হবে দুই দিক থেকেই। বাংলাদেশ থেকে এ ক্ষেত্রে চেষ্টার কোনো ঘাটতি হবে না, এটা স্পষ্ট করেই বলা হচ্ছে। ভারতও আশা করা যায় বাংলাদেশের পরিবর্তিত বাস্তবতা বুঝে পথ চলবে।
পরবর্তী মাসে অন্যান্য কাজের পাশাপাশি দুটি ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি হতে হবে—আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনীতি। বিশেষত রপ্তানি খাত সচল রাখা। উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতে শ্রমবাজারে অস্থিরতা বিপজ্জনক। সংস্কারের প্রতি ব্যাপক মানুষের সমর্থন ধরে রাখতেও এ দুই ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নয়ন জরুরি।
লেখক: হাসান মামুন
সাংবাদিক, বিশ্লেষক
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে