ড. মইনুল ইসলাম
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পর ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান নিজের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। বিএনপিতে দেশের বাম ঘরানার ও দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকদের কেনাবেচার মাধ্যমে দলে ভেড়ানোর দায়িত্বটি অর্পণ করা হয়েছিল রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে, প্রধানত সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইকে। লাইসেন্স, পারমিট, ব্যাংকঋণ, প্লট ইত্যাদি নানা রকমের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এই অ্যাসাইনমেন্টটি সম্পন্ন করেছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, প্রয়োজনে ব্ল্যাকমেলের আশ্রয়ও নিত তারা। ক্যান্টনমেন্টে বসে রাজনৈতিক দল বানানোর এই খেলা শুরুর আগে ১৯৭৭ সালে জিয়া দেশের রাষ্ট্রপতির আসনটিও জবরদখল করেছিলেন। বিএনপি প্রতিষ্ঠার ৫ মাস ১৮ দিনের মধ্যেই ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজনও সম্পন্ন করেন তিনি। ব্যাপক ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং-অনুসৃত’ ওই নির্বাচনে ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে বিএনপি ২০৭টি দখল করেছিল। (পরে উপনির্বাচনের মাধ্যমে আরও দুটো আসন বিএনপির দখলে যাওয়ায় ওই সংসদে বিএনপির আসনসংখ্যা ২০৯-এ উন্নীত হয়। প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যে এত বেশি আসনে একটি রাজনৈতিক দল সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী হওয়ার নজির বিশ্বে একটিও নেই।)
১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিএনপি থেকে যে ২০৭ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তার মধ্যে মুসলিম লীগ থেকে বিএনপিতে যোগদানকারী নেতা ছিলেন ৬৩ জন (৩০ দশমিক ৪৩ শতাংশ), ভাসানী ন্যাপ থেকে বিএনপিতে যোগদানকারী ছিলেন ৩৫ জন (১৬ দশমিক ৯ শতাংশ), ইউপিপি ও অন্যান্য বামপন্থী ছিলেন ১৩ জন (৬ দশমিক ২৮ শতাংশ), ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ (যেটা জামায়াতে ইসলামীর তদানীন্তন নাম) থেকে ছিলেন ৭ জন, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার ছিলেন ১৭ জন এবং অবসরপ্রাপ্ত সিভিল আমলা ছিলেন ২৩ জন।
ওই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মুসলিম লীগার থেকে বিএনপিতে যোগদানকারীরা যে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেটাই ছিল স্বাভাবিক। কারণ, বিএনপি যে পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাইনবোর্ড পাল্টানো বাংলাদেশি সংস্করণ, সেটা মোটেও গোপন ব্যাপার ছিল না। মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও জিয়ার পাকিস্তানি সত্তার ভূরি ভূরি প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর শাসনামলের সব কর্মকাণ্ডে। নিচে উল্লিখিত জিয়ার পাকিস্তানি সত্তার অকাট্য প্রমাণগুলো দেখুন:
১. জিয়া বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী ও পাকিস্তানের দালাল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামের মতো দলগুলোকে ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দলবিধি আদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করে গেছেন। (নেজামে ইসলাম বর্তমানে ইসলামী ঐক্যজোটের অন্তর্ভুক্ত দল হিসেবে পরিচয় গোপন করে চলেছে)।
২. ১৯৭৮ সালে মাকে দেখতে আসার নাম করে জিয়ার অনুমতি নিয়ে গোলাম আযম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন। জিয়ার জীবদ্দশায় গোলাম আযম প্রায় তিন বছর পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থানের পরও জিয়া এ ব্যাপারে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেননি।
৩. জিয়াউর রহমান কয়েক শ মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছিলেন তাঁর শাসনামলে ১৮-২১টি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের অভিযোগে। তাঁদের সবাইকে প্রাণ দিতে হয়েছিল কোর্ট মার্শালের নামে বসানো ‘ক্যাঙারু কোর্টের’ বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়ে। জিয়াকে ১৯৮১ সালে প্রাণ দিতে হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের প্রতিশোধের শিকার হয়ে।
৪. জিয়া সব কুখ্যাত স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক-দালালকে বিএনপিতে যোগদান করার সুযোগ দিয়েছিলেন। কুখ্যাত পাকিস্তানি দালাল শাহ আজিজুর রহমানকে জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে জেলে মৃত্যুবরণ করা আবদুল আলীমকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন।
৫. জিয়া চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী সরকারি আমলা-কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রকৌশলী, ডাক্তার, পেশাজীবী ও সামরিক কর্মকর্তাকে চাকরিতে পুনর্বাসিত করেছিলেন। তাঁদের প্রায় সবাই আজীবন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
৬. জিয়া সব প্রচারমাধ্যমে ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী’র পরিবর্তে শুধুই ‘হানাদার বাহিনী’ বলার নির্দেশ জারি করেছিলেন। জিয়া দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা বধ্যভূমি, অগ্নিসংযোগ, শরণার্থী ক্যাম্প ও গণহত্যার চিত্র মিডিয়ায় প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
৭. পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের ইস্যুকে জিয়া কখনোই কূটনৈতিক নীতিতে অগ্রাধিকার দেননি। বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারিদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য পাকিস্তানের ওপর জিয়া যথাযথ চাপ সৃষ্টি করেননি।
৮. জিয়া দেশের সব স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এমনকি সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পুনর্নির্মাণের কাজও জিয়ার আমলে পরিত্যক্ত হয়েছিল।
৯. জিয়া ঘাতক-দালালদের বিচারসংক্রান্ত সব আইন বাতিল করে দেওয়ায় জেলে আটক প্রায় ১১ হাজার স্বাধীনতাবিরোধীকে আর বিচারের সম্মুখীন করা যায়নি।
১০. জিয়া যেহেতু করাচিতে কৈশোর ও তারুণ্য কাটিয়েছিলেন, তাই তিনি বাংলা পড়তে এবং বাংলায় কথা বলতে পারলেও বাংলা লিখতে শেখেননি। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা বানানোর সংগ্রামের পথ ধরে ধাপে ধাপে যে বাংলাদেশ স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল, ১৯৭৫ সালে সেই বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করে ১৯৮১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত শাসন করা সত্ত্বেও জিয়া বাংলা লিখতে শেখার গরজ বোধ করেননি, ইংরেজিতেই নোট লিখতেন।
১৯৮৩ সালে জিয়াউর রহমানের উত্তরসূরি হিসেবে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে খালেদা জিয়া (এবং তারেক রহমান) ৪০ বছর ধরে জিয়াউর রহমানের ওই পাকিস্তানপ্রেমী রাজনীতিকে বিএনপির মাধ্যমে সযত্নে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপির মূল রাজনৈতিক আদর্শ পাকিস্তান প্রেম ও আওয়ামী লীগবিরোধিতা, জন্মসূত্রেই আওয়ামী লীগের ‘নেমেসিস’ বিএনপি। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও বিএনপি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কীভাবে জনপ্রিয় রয়ে গেল? এর উত্তর হলো, আওয়ামী লীগবিরোধী, পাকিস্তানপ্রেমী, অন্ধ ভাসানীভক্ত ও মুজিব-অপছন্দকারী এবং হিন্দুবিদ্বেষীরাই বিএনপির ‘কোর সমর্থক’। ক্ষমতায় গেলে যেহেতু দুর্নীতির কারণে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় ধস নামে, তাই বিএনপির জনপ্রিয়তায় তখন জোয়ার আসে। আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর গোষ্ঠীগুলোই বারবার এই জোয়ার নিয়ে আসছে। তাদের সবাই স্বাধীনতাবিরোধী না হলেও তারা হিন্দুবিদ্বেষী ও ভারতবিদ্বেষী। তারা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে জানপ্রাণ কবুল করতেও রাজি। সে জন্যই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে সব ক্ষেত্রেই ছাড়িয়ে গেলেও বিএনপি-ভক্তদের মন গলছে না। ২০০৯-২৩ পর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ বিএনপি-জামায়াতের ২০০১-০৬ মেয়াদের শাসনামলের তুলনায় চমকপ্রদভাবে এগিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বিএনপির জনপ্রিয়তায় তেমন ধস নামেনি। বর্তমানে পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে চরম বিপর্যয়ে পতিত হওয়া সত্ত্বেও বিএনপির পাকিস্তানপ্রেমীদের প্রেমে ভাটা পড়েনি। তাঁদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা শেখ হাসিনার কাছে কল্কে না পেয়ে বিএনপিতে ভিড়ে গেছেন। ২০১৮ সালে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি, গণফোরাম, আ স ম আবদুর রবের জেএসডি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মনসুরের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন এহেন শেখ হাসিনা-উৎখাত-চক্র গঠনের চূড়ান্ত নজির। পরে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছিলেন। (আগামী নির্বাচনে কাদের সিদ্দিকী নাকি আওয়ামী লীগ ঘরানায় যোগ দিচ্ছেন)! কিন্তু হাসিনা-উৎখাতে বদ্ধপরিকর নেতাদের ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও ক্রোধ থেকে উৎসারিত মিশন ২০১৮ সালে বাংলাদেশের রাজনীতিকে ১৯৭৫ সালের মতো আরেকটি মহাবিপর্যয়ে নিক্ষেপ করতে যাচ্ছিল। ওই ধরনের মহাবিপদ আগামী নির্বাচন ঘিরে আবারও ঘনীভূত হওয়ার আলামত পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগের রাতের ব্যালট জবরদখলের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ওই মহাবিপদ থেকে বাঁচতে পারলেও আগামী নির্বাচনে একই খেলা তারা খেলতে পারবে বলে মনে হয় না। (তারেক রহমান কয়েকবারই ঘোষণা করেছেন, ‘বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী আপন মায়ের পেটের ভাই’। তাই আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলছি বাহ্যিক দূরত্ব-রক্ষার ফন্দি-ফিকির সত্ত্বেও আগামী নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত আসবেই এবং ঐক্যবদ্ধভাবেই আসবে)!
কিন্তু এখন থেকে যদি শেখ হাসিনা সত্যিকারভাবে দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন এবং পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্যভাবে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন, তাহলে হয়তো আগামী ১০ মাসে আওয়ামী লীগ তাদের হারানো জনপ্রিয়তা অনেকখানি পুনরুদ্ধার করতে পারবে। ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সামরিক বাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, তার জন্য এককভাবে দায়ী ছিল ওই সরকারের সফল দুর্নীতি দমন অভিযান। মানুষের কাছে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের জন্য চিহ্নিত হোমরাচোমরা রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের ওই সময় যেভাবে নাকানি-চুবানি খেতে হয়েছিল, সেটা এখনো জনগণ ভুলে যায়নি। ওই ধরনের অভিযান যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবিলম্বে শুরু করেন, তাহলে তাঁর নেতৃত্বে অর্জিত দেশের প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং ২০২২-২৩ সালে বাস্তবায়িত মেগা প্রজেক্টগুলোর সুফল তিনি আগামী নির্বাচনে ঘরে তুলতে পারবেন আশা করি।
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পর ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান নিজের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। বিএনপিতে দেশের বাম ঘরানার ও দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকদের কেনাবেচার মাধ্যমে দলে ভেড়ানোর দায়িত্বটি অর্পণ করা হয়েছিল রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে, প্রধানত সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইকে। লাইসেন্স, পারমিট, ব্যাংকঋণ, প্লট ইত্যাদি নানা রকমের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এই অ্যাসাইনমেন্টটি সম্পন্ন করেছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, প্রয়োজনে ব্ল্যাকমেলের আশ্রয়ও নিত তারা। ক্যান্টনমেন্টে বসে রাজনৈতিক দল বানানোর এই খেলা শুরুর আগে ১৯৭৭ সালে জিয়া দেশের রাষ্ট্রপতির আসনটিও জবরদখল করেছিলেন। বিএনপি প্রতিষ্ঠার ৫ মাস ১৮ দিনের মধ্যেই ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজনও সম্পন্ন করেন তিনি। ব্যাপক ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং-অনুসৃত’ ওই নির্বাচনে ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে বিএনপি ২০৭টি দখল করেছিল। (পরে উপনির্বাচনের মাধ্যমে আরও দুটো আসন বিএনপির দখলে যাওয়ায় ওই সংসদে বিএনপির আসনসংখ্যা ২০৯-এ উন্নীত হয়। প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যে এত বেশি আসনে একটি রাজনৈতিক দল সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী হওয়ার নজির বিশ্বে একটিও নেই।)
১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিএনপি থেকে যে ২০৭ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তার মধ্যে মুসলিম লীগ থেকে বিএনপিতে যোগদানকারী নেতা ছিলেন ৬৩ জন (৩০ দশমিক ৪৩ শতাংশ), ভাসানী ন্যাপ থেকে বিএনপিতে যোগদানকারী ছিলেন ৩৫ জন (১৬ দশমিক ৯ শতাংশ), ইউপিপি ও অন্যান্য বামপন্থী ছিলেন ১৩ জন (৬ দশমিক ২৮ শতাংশ), ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ (যেটা জামায়াতে ইসলামীর তদানীন্তন নাম) থেকে ছিলেন ৭ জন, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার ছিলেন ১৭ জন এবং অবসরপ্রাপ্ত সিভিল আমলা ছিলেন ২৩ জন।
ওই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মুসলিম লীগার থেকে বিএনপিতে যোগদানকারীরা যে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেটাই ছিল স্বাভাবিক। কারণ, বিএনপি যে পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাইনবোর্ড পাল্টানো বাংলাদেশি সংস্করণ, সেটা মোটেও গোপন ব্যাপার ছিল না। মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও জিয়ার পাকিস্তানি সত্তার ভূরি ভূরি প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর শাসনামলের সব কর্মকাণ্ডে। নিচে উল্লিখিত জিয়ার পাকিস্তানি সত্তার অকাট্য প্রমাণগুলো দেখুন:
১. জিয়া বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী ও পাকিস্তানের দালাল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামের মতো দলগুলোকে ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দলবিধি আদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করে গেছেন। (নেজামে ইসলাম বর্তমানে ইসলামী ঐক্যজোটের অন্তর্ভুক্ত দল হিসেবে পরিচয় গোপন করে চলেছে)।
২. ১৯৭৮ সালে মাকে দেখতে আসার নাম করে জিয়ার অনুমতি নিয়ে গোলাম আযম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন। জিয়ার জীবদ্দশায় গোলাম আযম প্রায় তিন বছর পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থানের পরও জিয়া এ ব্যাপারে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেননি।
৩. জিয়াউর রহমান কয়েক শ মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছিলেন তাঁর শাসনামলে ১৮-২১টি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের অভিযোগে। তাঁদের সবাইকে প্রাণ দিতে হয়েছিল কোর্ট মার্শালের নামে বসানো ‘ক্যাঙারু কোর্টের’ বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়ে। জিয়াকে ১৯৮১ সালে প্রাণ দিতে হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের প্রতিশোধের শিকার হয়ে।
৪. জিয়া সব কুখ্যাত স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক-দালালকে বিএনপিতে যোগদান করার সুযোগ দিয়েছিলেন। কুখ্যাত পাকিস্তানি দালাল শাহ আজিজুর রহমানকে জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে জেলে মৃত্যুবরণ করা আবদুল আলীমকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন।
৫. জিয়া চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী সরকারি আমলা-কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রকৌশলী, ডাক্তার, পেশাজীবী ও সামরিক কর্মকর্তাকে চাকরিতে পুনর্বাসিত করেছিলেন। তাঁদের প্রায় সবাই আজীবন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
৬. জিয়া সব প্রচারমাধ্যমে ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী’র পরিবর্তে শুধুই ‘হানাদার বাহিনী’ বলার নির্দেশ জারি করেছিলেন। জিয়া দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা বধ্যভূমি, অগ্নিসংযোগ, শরণার্থী ক্যাম্প ও গণহত্যার চিত্র মিডিয়ায় প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
৭. পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের ইস্যুকে জিয়া কখনোই কূটনৈতিক নীতিতে অগ্রাধিকার দেননি। বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারিদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য পাকিস্তানের ওপর জিয়া যথাযথ চাপ সৃষ্টি করেননি।
৮. জিয়া দেশের সব স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এমনকি সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পুনর্নির্মাণের কাজও জিয়ার আমলে পরিত্যক্ত হয়েছিল।
৯. জিয়া ঘাতক-দালালদের বিচারসংক্রান্ত সব আইন বাতিল করে দেওয়ায় জেলে আটক প্রায় ১১ হাজার স্বাধীনতাবিরোধীকে আর বিচারের সম্মুখীন করা যায়নি।
১০. জিয়া যেহেতু করাচিতে কৈশোর ও তারুণ্য কাটিয়েছিলেন, তাই তিনি বাংলা পড়তে এবং বাংলায় কথা বলতে পারলেও বাংলা লিখতে শেখেননি। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা বানানোর সংগ্রামের পথ ধরে ধাপে ধাপে যে বাংলাদেশ স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল, ১৯৭৫ সালে সেই বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করে ১৯৮১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত শাসন করা সত্ত্বেও জিয়া বাংলা লিখতে শেখার গরজ বোধ করেননি, ইংরেজিতেই নোট লিখতেন।
১৯৮৩ সালে জিয়াউর রহমানের উত্তরসূরি হিসেবে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে খালেদা জিয়া (এবং তারেক রহমান) ৪০ বছর ধরে জিয়াউর রহমানের ওই পাকিস্তানপ্রেমী রাজনীতিকে বিএনপির মাধ্যমে সযত্নে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপির মূল রাজনৈতিক আদর্শ পাকিস্তান প্রেম ও আওয়ামী লীগবিরোধিতা, জন্মসূত্রেই আওয়ামী লীগের ‘নেমেসিস’ বিএনপি। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও বিএনপি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কীভাবে জনপ্রিয় রয়ে গেল? এর উত্তর হলো, আওয়ামী লীগবিরোধী, পাকিস্তানপ্রেমী, অন্ধ ভাসানীভক্ত ও মুজিব-অপছন্দকারী এবং হিন্দুবিদ্বেষীরাই বিএনপির ‘কোর সমর্থক’। ক্ষমতায় গেলে যেহেতু দুর্নীতির কারণে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় ধস নামে, তাই বিএনপির জনপ্রিয়তায় তখন জোয়ার আসে। আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর গোষ্ঠীগুলোই বারবার এই জোয়ার নিয়ে আসছে। তাদের সবাই স্বাধীনতাবিরোধী না হলেও তারা হিন্দুবিদ্বেষী ও ভারতবিদ্বেষী। তারা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে জানপ্রাণ কবুল করতেও রাজি। সে জন্যই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে সব ক্ষেত্রেই ছাড়িয়ে গেলেও বিএনপি-ভক্তদের মন গলছে না। ২০০৯-২৩ পর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ বিএনপি-জামায়াতের ২০০১-০৬ মেয়াদের শাসনামলের তুলনায় চমকপ্রদভাবে এগিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বিএনপির জনপ্রিয়তায় তেমন ধস নামেনি। বর্তমানে পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে চরম বিপর্যয়ে পতিত হওয়া সত্ত্বেও বিএনপির পাকিস্তানপ্রেমীদের প্রেমে ভাটা পড়েনি। তাঁদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা শেখ হাসিনার কাছে কল্কে না পেয়ে বিএনপিতে ভিড়ে গেছেন। ২০১৮ সালে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি, গণফোরাম, আ স ম আবদুর রবের জেএসডি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মনসুরের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন এহেন শেখ হাসিনা-উৎখাত-চক্র গঠনের চূড়ান্ত নজির। পরে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছিলেন। (আগামী নির্বাচনে কাদের সিদ্দিকী নাকি আওয়ামী লীগ ঘরানায় যোগ দিচ্ছেন)! কিন্তু হাসিনা-উৎখাতে বদ্ধপরিকর নেতাদের ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও ক্রোধ থেকে উৎসারিত মিশন ২০১৮ সালে বাংলাদেশের রাজনীতিকে ১৯৭৫ সালের মতো আরেকটি মহাবিপর্যয়ে নিক্ষেপ করতে যাচ্ছিল। ওই ধরনের মহাবিপদ আগামী নির্বাচন ঘিরে আবারও ঘনীভূত হওয়ার আলামত পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগের রাতের ব্যালট জবরদখলের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ওই মহাবিপদ থেকে বাঁচতে পারলেও আগামী নির্বাচনে একই খেলা তারা খেলতে পারবে বলে মনে হয় না। (তারেক রহমান কয়েকবারই ঘোষণা করেছেন, ‘বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী আপন মায়ের পেটের ভাই’। তাই আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলছি বাহ্যিক দূরত্ব-রক্ষার ফন্দি-ফিকির সত্ত্বেও আগামী নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত আসবেই এবং ঐক্যবদ্ধভাবেই আসবে)!
কিন্তু এখন থেকে যদি শেখ হাসিনা সত্যিকারভাবে দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন এবং পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্যভাবে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন, তাহলে হয়তো আগামী ১০ মাসে আওয়ামী লীগ তাদের হারানো জনপ্রিয়তা অনেকখানি পুনরুদ্ধার করতে পারবে। ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সামরিক বাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, তার জন্য এককভাবে দায়ী ছিল ওই সরকারের সফল দুর্নীতি দমন অভিযান। মানুষের কাছে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের জন্য চিহ্নিত হোমরাচোমরা রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের ওই সময় যেভাবে নাকানি-চুবানি খেতে হয়েছিল, সেটা এখনো জনগণ ভুলে যায়নি। ওই ধরনের অভিযান যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবিলম্বে শুরু করেন, তাহলে তাঁর নেতৃত্বে অর্জিত দেশের প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং ২০২২-২৩ সালে বাস্তবায়িত মেগা প্রজেক্টগুলোর সুফল তিনি আগামী নির্বাচনে ঘরে তুলতে পারবেন আশা করি।
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
১ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৫ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৫ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ দিন আগে