চিররঞ্জন সরকার
কিছুদিন আগুনে পুড়েছে দেশ। গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল লোডশেডিং। প্রচন্ড গরম আর মূল্যবৃদ্ধির জাঁতাকলে পিষ্ট মানুষের নাভিশ্বাস দশা হয়ে পড়েছিল।গরম খানিকটা কমলেও কিছু কিছু জায়গায় লোডশেডিং চলছেই, আর মূল্য এখনো লাগামছাড়া। ভয়ানক সংকটগ্রস্ত মানুষের তাই এবার বাজেট নিয়ে খুব একটা উৎসাহ নেই। তাদের মনের মধ্যে ক্ষোভ। ক্রমাগত জিনিসপত্রের দাম বাড়ার জন্য ক্ষোভ, বিদ্যুৎ-সমস্যার সমাধান না হওয়ার জন্য ক্ষোভ।
তবে মানুষজনকে সবচেয়ে বেশি কাবু করে ফেলেছিল গত কয়েক দিনের প্রচন্ড গরম। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সামনের বছর আরও বাড়বে তাপমাত্রা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রচন্ড তাপপ্রবাহ জীবিকার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ শ্রমশক্তি কাজ করে এমন পরিস্থিতিতে, যেখানে সূর্যালোক ও উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাব এড়ানোর উপায় নেই। ১৯৯০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে, আমাদের দেশ বছরে গড়ে ২৩টি তাপপ্রবাহ দেখেছে, যা আগের ২০ বছরের তাপপ্রবাহের বার্ষিক গড়ের দ্বিগুণ।
কেবল ২০২২ সালেই ২০২১-এর তুলনায় দ্বিগুণ বেশি তাপপ্রবাহ-সংকুল দিন দেখেছি আমরা। ২০২৩ সালের সূচনাও আশঙ্কাজনক। তাপজনিত বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা বাড়ছে। অথচ তাপ এড়ানোর উপায় নেই শ্রমিকের। দেশের অধিকাংশ নির্মাণকাজ হয় শহরগুলোতে, যেখানে কংক্রিটের আধিক্য। তাপ শোষণকারী কংক্রিট আশপাশের এলাকার উত্তাপ বাড়ায়। শহরে আবদ্ধ গরম হাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বস্তিবাসী। তাদের একটি বড় অংশ গ্রাম থেকে এবং অন্যান্য শহর থেকে আসা শ্রমজীবী মানুষ। বস্তির আবাসন প্রায়ই নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে তৈরি হয়, যা পর্যাপ্ত তাপ নিরোধক নয়, বস্তির গঠনও বায়ু চলাচলের সহায়ক নয়। বহু শ্রমিক তাঁদের কর্মস্থলে, যেমন নির্মীয়মাণ ইমারতে কিংবা রাস্তার ধারে প্লাস্টিক বা ত্রিপলের তাঁবুতে বাস করেন, যা তাঁদের জীবনীশক্তি ও কর্মশক্তির ক্ষয় করে।
উচ্চ তাপ শ্রমিকদের অনুপস্থিতি, এমনকি মৃত্যুরও কারণ হতে পারে। ফলে উৎপাদন হ্রাসের পরিমাণও কম নয়। এর প্রভাব পড়বে দেশের জিডিপির ওপর—কোনো পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ শতাংশ হ্রাসের সম্ভাবনা দেখছেন, কেউবা ২০৩৫ সালের মধ্যে জিডিপির আড়াই শতাংশ হারানোর আশঙ্কা করছেন।
বিপন্নতা বাড়ছে দিনমজুরদেরও। এখনই গ্রীষ্মের গোড়ায় গরম এত তীব্র যে একাধিক মহানগরে পূর্ণ কর্মদিবস কাজ হয় না। নানা ধরনের উৎপাদন, বিপণন, বিভিন্ন পরিষেবা, নির্মাণকাজ এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের বিবিধ কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে নিয়োগকারী সংস্থাগুলো। ফলে প্রায়ই সম্পূর্ণ মজুরি মেলে না শ্রমিকদের। পরিবেশের সুরক্ষায় উদ্যোগী হবে বিভিন্ন দেশের সরকার, এমন আশা ক্রমেই কমে আসছে। ফলে বিশ্ব উষ্ণায়নের সঙ্গে মানিয়ে কী করে শ্রমিকের জীবন-জীবিকা সুরক্ষিত রাখা যায়, তার উপায় খুঁজতে হচ্ছে সরকার এবং শিল্প—উভয় ক্ষেত্রকেই।
তাপপ্রবাহের জন্য বিনষ্ট কর্মদিবসের ক্ষতি পূরণ করতে বহু দেশ সামাজিক সুরক্ষা প্রদানের পথ নিয়েছে। যেমন কোন তাপমাত্রার ওপরে উন্মুক্ত পরিবেশে কাজ বিপজ্জনক, তা ঘোষণা করা হচ্ছে। আবহাওয়ার আগাম সতর্কীকরণ এবং সেই সব দিনে কর্মহীনতার জন্য শ্রমিকদের বিমা, বেকার ভাতা প্রভৃতি দেওয়ার নীতি নিয়েছে ইউরোপের নানা দেশ। প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগে কর্মস্থলগুলোকে তাপ-নিরোধক করে তোলাও প্রয়োজন। সমস্যা এই যে গত কয়েক বছরে শ্রম-সংক্রান্ত সরকারি বিধিগুলো ক্রমেই শিথিল হয়েছে। অস্থায়ী কর্মীদের সামাজিক সুরক্ষা, কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা—এ সব ব্যবস্থাই আমাদের দেশে মানা হয় না। এই পরিস্থিতিতে তাপপ্রবাহজনিত কর্মদিবস হ্রাস ও মজুরির ক্ষতি পূরণ করার কোন পথ নেবে সরকার, সে প্রশ্নটি অনেক বড় হয়ে উঠেছে।
পরিবেশবিদেরা বারবার সাবধান করা সত্ত্বেও কেন রাজনীতিকেরা গুরুত্ব দেন না—এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট জানাচ্ছেন, পরিবেশকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে, যথেচ্ছ গাছ কেটে, জলাভূমি ভরাট করে ‘উন্নয়নের যজ্ঞে’ শামিল হওয়ার কারণেই এই দশা। বস্তুত জাতিসংঘের অধীন বিজ্ঞান সংস্থা ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের সম্প্রতি প্রকাশিত জলবায়ু রিপোর্টে পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীরা অভিযোগ করেছেন, বিশ্বজুড়ে রাজনীতিবিদেরা জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্রতা কমাতে মোটেই সক্রিয় নন এবং সাবধান করা সত্ত্বেও এক দশকে এই প্রবণতা আটকাতে প্রায় কিছুই করেননি।
আইপিসিসি রিপোর্ট জানাচ্ছে যে শেষের শুরু আটকাতে আর এক দশকও হাতে নেই। অবিলম্বে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫০ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ না কমালে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারকে শূন্যের দিকে ঠেলে দিতে না পারলে, ২০৩০ সালের মধ্যে যেকোনো সময়ে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি ছাড়াবে। বহুলাংশে বাড়বে বিপদ। বলা হয়েছে, ভয়ংকর ক্ষতির সম্মুখীন হতে চলেছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার গরিব মানুষেরা, যাদের পৃথিবীর উষ্ণায়ন বৃদ্ধিতে তেমন ভূমিকা নেই।
এক দিকে হিমালয়, অন্য দিকে বঙ্গোপসাগর এবং মাঝখানে খটখটে মালভূমি অঞ্চল নিয়ে অন্যতম জলবায়ু বিপন্ন দেশ বাংলাদেশ, যার মধ্যে সুন্দরবন অঞ্চল পৃথিবীর অন্যতম ক্লাইমেট হটস্পটের তকমা পাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এ দেশের রাজনীতিক এবং সরকার কী করছে?
আমাদের দেশের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে নির্বাচন ঘিরে। আগামী নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হবে, সেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না, বিরোধীপক্ষ নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, সেই বিতর্ক রাজনীতিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এর বাইরে দেশের অন্য কোনো সমস্যা খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথ এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, মতবিরোধ ভালো, কিন্তু তার প্রকাশের ওপর একটা নিয়মের শাসন থাকা প্রয়োজন। মজা করেছিলেন এই বলে যে নতুবা বরযাত্রী ও কন্যাপক্ষে ঝগড়া করে বিবাহটাকেই পণ্ড করে দেবে! আমাদের দেশে এখন অনেকটা সেই হাল, যেখানে সর্বগ্রাসী ঝগড়ায় মত্ত যাবতীয় রাজনৈতিক দল। ক্ষমতাসীনেরা কতটা স্বৈরাচার, কতটা ব্যর্থ, বিরোধীরা কতটা নৈরাজ্যমুখী ও অযোগ্য, এ নিয়ে চলছে বিরামহীন বিবাদ। কে কাকে কতক্ষণে কথার প্যাঁচে ধরাশায়ী করে ‘কেমন দিলাম’ বলতে পারে, তার প্রতিযোগিতা চলছে। এই সমীকরণের এক শ মাইলের মধ্যে কোথাও টেকসই উন্নয়নের কথা নেই, জলবায়ু বিপর্যয় থেকে বাঁচার উপায় খোঁজাকে অগ্রাধিকার দেওয়া নেই। আপনি (দল ও দলের নেতা-কর্মী) বাঁচলে, তবে তো জলবায়ুর নাম!
কিন্তু এতে দল ও দলীয় রাজনীতি বাঁচলেও দেশ বাঁচবে তো? তথ্য বলছে, লড়াইটা ইতিমধ্যেই কঠিন। মাঠে নামতে যত দেরি হবে, তত তা কঠিনতর হবে। জানা যাচ্ছে, ‘এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না’ বলে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো যদি বসে থাকে, তবে আর পাঁচ দশকের মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, যশোর, খুলনাসহ অধিকাংশ শহরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি ছুঁই-ছুঁই হতে পারে; অর্থাৎ আজকের চুয়াডাঙ্গা হয়তোবা আগামীকালের ঢাকা; রাজশাহীকে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির দৌড়ে হারাতে পারে তুলনামূলকভাবে শীতল পঞ্চগড়! ইতিমধ্যেই ‘সাইক্লোন রাজধানী’ বলে ঘোষিত সুন্দরবনে আরও নিয়মিত মারাত্মক ঝড় আছড়ে পড়তে পারে, যার ধাক্কা পড়বে গোটা দক্ষিণবঙ্গে। পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরের জলস্তর এখনকার তুলনায় প্রায় চার গুণ বেড়ে ভাসাবে আরও বহু নিচু অঞ্চলকে। বাড়বে দীর্ঘমেয়াদি বিপন্নতাও; প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবিকার সংকটে পড়বে দেশের এক বড় অংশের মানুষ। অস্তিত্বের সংকট তো ছেড়েই দিলাম।
এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন যে এখন থেকে জলবায়ু বিপর্যয়কে কোনো প্রশাসনিক পরিকল্পনা ও প্রয়োগের একেবারে কেন্দ্রে রাখা হবে, বাড়ানো হবে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের সচেতনতা, ক্ষমতা ও সক্রিয়তা; বিশেষ করে জলবায়ু বিপন্ন অঞ্চলগুলোতে। যেভাবে কোভিডকালে প্রধানমন্ত্রী সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন; সারা বছর ধরে চাই তার অ্যাকশন রিপ্লে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও জলবায়ু বিপন্নতাকে আলোচনার সামনের সারিতে তুলে আনতে হবে। এখন যাঁরা বিরোধী, তাঁরাও ক্ষমতায় থাকাকালে পরিবেশ কল্কে পায়নি। বিরোধীদের প্রশ্ন তুলতে হবে যে অন্যতম বিপন্ন অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও কেন জলবায়ুসংক্রান্ত কাজ করার মাপকাঠিতে আমরা শেষের সারিতে?
গোটা পৃথিবীর সঙ্গে বাংলাদেশেও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে আজ বলার সময় হয়েছে, ‘নাও অর নেভার’। এসি গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসি ঘরে ঢোকার ফাঁকে রাজনীতিকেরা যদি কয়েক মিনিট দাঁড়ান, তাহলে নিশ্চয়ই টের পাবেন জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ!
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
কিছুদিন আগুনে পুড়েছে দেশ। গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল লোডশেডিং। প্রচন্ড গরম আর মূল্যবৃদ্ধির জাঁতাকলে পিষ্ট মানুষের নাভিশ্বাস দশা হয়ে পড়েছিল।গরম খানিকটা কমলেও কিছু কিছু জায়গায় লোডশেডিং চলছেই, আর মূল্য এখনো লাগামছাড়া। ভয়ানক সংকটগ্রস্ত মানুষের তাই এবার বাজেট নিয়ে খুব একটা উৎসাহ নেই। তাদের মনের মধ্যে ক্ষোভ। ক্রমাগত জিনিসপত্রের দাম বাড়ার জন্য ক্ষোভ, বিদ্যুৎ-সমস্যার সমাধান না হওয়ার জন্য ক্ষোভ।
তবে মানুষজনকে সবচেয়ে বেশি কাবু করে ফেলেছিল গত কয়েক দিনের প্রচন্ড গরম। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সামনের বছর আরও বাড়বে তাপমাত্রা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রচন্ড তাপপ্রবাহ জীবিকার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ শ্রমশক্তি কাজ করে এমন পরিস্থিতিতে, যেখানে সূর্যালোক ও উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাব এড়ানোর উপায় নেই। ১৯৯০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে, আমাদের দেশ বছরে গড়ে ২৩টি তাপপ্রবাহ দেখেছে, যা আগের ২০ বছরের তাপপ্রবাহের বার্ষিক গড়ের দ্বিগুণ।
কেবল ২০২২ সালেই ২০২১-এর তুলনায় দ্বিগুণ বেশি তাপপ্রবাহ-সংকুল দিন দেখেছি আমরা। ২০২৩ সালের সূচনাও আশঙ্কাজনক। তাপজনিত বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা বাড়ছে। অথচ তাপ এড়ানোর উপায় নেই শ্রমিকের। দেশের অধিকাংশ নির্মাণকাজ হয় শহরগুলোতে, যেখানে কংক্রিটের আধিক্য। তাপ শোষণকারী কংক্রিট আশপাশের এলাকার উত্তাপ বাড়ায়। শহরে আবদ্ধ গরম হাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বস্তিবাসী। তাদের একটি বড় অংশ গ্রাম থেকে এবং অন্যান্য শহর থেকে আসা শ্রমজীবী মানুষ। বস্তির আবাসন প্রায়ই নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে তৈরি হয়, যা পর্যাপ্ত তাপ নিরোধক নয়, বস্তির গঠনও বায়ু চলাচলের সহায়ক নয়। বহু শ্রমিক তাঁদের কর্মস্থলে, যেমন নির্মীয়মাণ ইমারতে কিংবা রাস্তার ধারে প্লাস্টিক বা ত্রিপলের তাঁবুতে বাস করেন, যা তাঁদের জীবনীশক্তি ও কর্মশক্তির ক্ষয় করে।
উচ্চ তাপ শ্রমিকদের অনুপস্থিতি, এমনকি মৃত্যুরও কারণ হতে পারে। ফলে উৎপাদন হ্রাসের পরিমাণও কম নয়। এর প্রভাব পড়বে দেশের জিডিপির ওপর—কোনো পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ শতাংশ হ্রাসের সম্ভাবনা দেখছেন, কেউবা ২০৩৫ সালের মধ্যে জিডিপির আড়াই শতাংশ হারানোর আশঙ্কা করছেন।
বিপন্নতা বাড়ছে দিনমজুরদেরও। এখনই গ্রীষ্মের গোড়ায় গরম এত তীব্র যে একাধিক মহানগরে পূর্ণ কর্মদিবস কাজ হয় না। নানা ধরনের উৎপাদন, বিপণন, বিভিন্ন পরিষেবা, নির্মাণকাজ এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের বিবিধ কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে নিয়োগকারী সংস্থাগুলো। ফলে প্রায়ই সম্পূর্ণ মজুরি মেলে না শ্রমিকদের। পরিবেশের সুরক্ষায় উদ্যোগী হবে বিভিন্ন দেশের সরকার, এমন আশা ক্রমেই কমে আসছে। ফলে বিশ্ব উষ্ণায়নের সঙ্গে মানিয়ে কী করে শ্রমিকের জীবন-জীবিকা সুরক্ষিত রাখা যায়, তার উপায় খুঁজতে হচ্ছে সরকার এবং শিল্প—উভয় ক্ষেত্রকেই।
তাপপ্রবাহের জন্য বিনষ্ট কর্মদিবসের ক্ষতি পূরণ করতে বহু দেশ সামাজিক সুরক্ষা প্রদানের পথ নিয়েছে। যেমন কোন তাপমাত্রার ওপরে উন্মুক্ত পরিবেশে কাজ বিপজ্জনক, তা ঘোষণা করা হচ্ছে। আবহাওয়ার আগাম সতর্কীকরণ এবং সেই সব দিনে কর্মহীনতার জন্য শ্রমিকদের বিমা, বেকার ভাতা প্রভৃতি দেওয়ার নীতি নিয়েছে ইউরোপের নানা দেশ। প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগে কর্মস্থলগুলোকে তাপ-নিরোধক করে তোলাও প্রয়োজন। সমস্যা এই যে গত কয়েক বছরে শ্রম-সংক্রান্ত সরকারি বিধিগুলো ক্রমেই শিথিল হয়েছে। অস্থায়ী কর্মীদের সামাজিক সুরক্ষা, কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা—এ সব ব্যবস্থাই আমাদের দেশে মানা হয় না। এই পরিস্থিতিতে তাপপ্রবাহজনিত কর্মদিবস হ্রাস ও মজুরির ক্ষতি পূরণ করার কোন পথ নেবে সরকার, সে প্রশ্নটি অনেক বড় হয়ে উঠেছে।
পরিবেশবিদেরা বারবার সাবধান করা সত্ত্বেও কেন রাজনীতিকেরা গুরুত্ব দেন না—এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট জানাচ্ছেন, পরিবেশকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে, যথেচ্ছ গাছ কেটে, জলাভূমি ভরাট করে ‘উন্নয়নের যজ্ঞে’ শামিল হওয়ার কারণেই এই দশা। বস্তুত জাতিসংঘের অধীন বিজ্ঞান সংস্থা ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের সম্প্রতি প্রকাশিত জলবায়ু রিপোর্টে পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীরা অভিযোগ করেছেন, বিশ্বজুড়ে রাজনীতিবিদেরা জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্রতা কমাতে মোটেই সক্রিয় নন এবং সাবধান করা সত্ত্বেও এক দশকে এই প্রবণতা আটকাতে প্রায় কিছুই করেননি।
আইপিসিসি রিপোর্ট জানাচ্ছে যে শেষের শুরু আটকাতে আর এক দশকও হাতে নেই। অবিলম্বে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫০ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ না কমালে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারকে শূন্যের দিকে ঠেলে দিতে না পারলে, ২০৩০ সালের মধ্যে যেকোনো সময়ে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি ছাড়াবে। বহুলাংশে বাড়বে বিপদ। বলা হয়েছে, ভয়ংকর ক্ষতির সম্মুখীন হতে চলেছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার গরিব মানুষেরা, যাদের পৃথিবীর উষ্ণায়ন বৃদ্ধিতে তেমন ভূমিকা নেই।
এক দিকে হিমালয়, অন্য দিকে বঙ্গোপসাগর এবং মাঝখানে খটখটে মালভূমি অঞ্চল নিয়ে অন্যতম জলবায়ু বিপন্ন দেশ বাংলাদেশ, যার মধ্যে সুন্দরবন অঞ্চল পৃথিবীর অন্যতম ক্লাইমেট হটস্পটের তকমা পাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এ দেশের রাজনীতিক এবং সরকার কী করছে?
আমাদের দেশের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে নির্বাচন ঘিরে। আগামী নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হবে, সেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না, বিরোধীপক্ষ নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, সেই বিতর্ক রাজনীতিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এর বাইরে দেশের অন্য কোনো সমস্যা খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথ এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, মতবিরোধ ভালো, কিন্তু তার প্রকাশের ওপর একটা নিয়মের শাসন থাকা প্রয়োজন। মজা করেছিলেন এই বলে যে নতুবা বরযাত্রী ও কন্যাপক্ষে ঝগড়া করে বিবাহটাকেই পণ্ড করে দেবে! আমাদের দেশে এখন অনেকটা সেই হাল, যেখানে সর্বগ্রাসী ঝগড়ায় মত্ত যাবতীয় রাজনৈতিক দল। ক্ষমতাসীনেরা কতটা স্বৈরাচার, কতটা ব্যর্থ, বিরোধীরা কতটা নৈরাজ্যমুখী ও অযোগ্য, এ নিয়ে চলছে বিরামহীন বিবাদ। কে কাকে কতক্ষণে কথার প্যাঁচে ধরাশায়ী করে ‘কেমন দিলাম’ বলতে পারে, তার প্রতিযোগিতা চলছে। এই সমীকরণের এক শ মাইলের মধ্যে কোথাও টেকসই উন্নয়নের কথা নেই, জলবায়ু বিপর্যয় থেকে বাঁচার উপায় খোঁজাকে অগ্রাধিকার দেওয়া নেই। আপনি (দল ও দলের নেতা-কর্মী) বাঁচলে, তবে তো জলবায়ুর নাম!
কিন্তু এতে দল ও দলীয় রাজনীতি বাঁচলেও দেশ বাঁচবে তো? তথ্য বলছে, লড়াইটা ইতিমধ্যেই কঠিন। মাঠে নামতে যত দেরি হবে, তত তা কঠিনতর হবে। জানা যাচ্ছে, ‘এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না’ বলে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো যদি বসে থাকে, তবে আর পাঁচ দশকের মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, যশোর, খুলনাসহ অধিকাংশ শহরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি ছুঁই-ছুঁই হতে পারে; অর্থাৎ আজকের চুয়াডাঙ্গা হয়তোবা আগামীকালের ঢাকা; রাজশাহীকে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির দৌড়ে হারাতে পারে তুলনামূলকভাবে শীতল পঞ্চগড়! ইতিমধ্যেই ‘সাইক্লোন রাজধানী’ বলে ঘোষিত সুন্দরবনে আরও নিয়মিত মারাত্মক ঝড় আছড়ে পড়তে পারে, যার ধাক্কা পড়বে গোটা দক্ষিণবঙ্গে। পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরের জলস্তর এখনকার তুলনায় প্রায় চার গুণ বেড়ে ভাসাবে আরও বহু নিচু অঞ্চলকে। বাড়বে দীর্ঘমেয়াদি বিপন্নতাও; প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবিকার সংকটে পড়বে দেশের এক বড় অংশের মানুষ। অস্তিত্বের সংকট তো ছেড়েই দিলাম।
এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন যে এখন থেকে জলবায়ু বিপর্যয়কে কোনো প্রশাসনিক পরিকল্পনা ও প্রয়োগের একেবারে কেন্দ্রে রাখা হবে, বাড়ানো হবে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের সচেতনতা, ক্ষমতা ও সক্রিয়তা; বিশেষ করে জলবায়ু বিপন্ন অঞ্চলগুলোতে। যেভাবে কোভিডকালে প্রধানমন্ত্রী সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন; সারা বছর ধরে চাই তার অ্যাকশন রিপ্লে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও জলবায়ু বিপন্নতাকে আলোচনার সামনের সারিতে তুলে আনতে হবে। এখন যাঁরা বিরোধী, তাঁরাও ক্ষমতায় থাকাকালে পরিবেশ কল্কে পায়নি। বিরোধীদের প্রশ্ন তুলতে হবে যে অন্যতম বিপন্ন অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও কেন জলবায়ুসংক্রান্ত কাজ করার মাপকাঠিতে আমরা শেষের সারিতে?
গোটা পৃথিবীর সঙ্গে বাংলাদেশেও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে আজ বলার সময় হয়েছে, ‘নাও অর নেভার’। এসি গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসি ঘরে ঢোকার ফাঁকে রাজনীতিকেরা যদি কয়েক মিনিট দাঁড়ান, তাহলে নিশ্চয়ই টের পাবেন জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ!
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে