মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন অবশেষে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। করোনার তৃতীয় বছরে এটি আমাদের জন্য তৃতীয় ঢেউ। প্রথম ঢেউ ২০২০ সালে যখন আঘাত হানে, তখনই দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তড়িঘড়ি করে বন্ধ করে দিতে হয়। করোনার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় দুনিয়াজুড়েই এক ভয়াবহ আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল। এর চিকিৎসা সম্পর্কে কারও কোনো ধারণা ছিল না, কোনো ওষুধও আবিষ্কৃত হয়নি। ছোঁয়াচে এ ভাইরাসটি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল। ফলে সব দেশেই লকডাউন, মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা উচ্চারিত হতে থাকে। কিন্তু এসবের কোনোটির সঙ্গেই মানুষ আগে পরিচিত বা অভ্যস্ত ছিল না। ডাক্তাররাও কী চিকিৎসা দেবেন, তা জানতেন না। ফলে বিভিন্ন দেশে এর প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন রকমের হয়। লকডাউন শুনে তো সবাই সবকিছুতেই যেন তালা মেরে দেওয়া বুঝেছিল। ঘর থেকে বের হওয়া নিষিদ্ধ, কলকারখানা, দোকানপাট, অফিস-আদালত—সবই বন্ধ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা পড়েছিল বেশ শক্তভাবেই।
এরই মধ্যে ২০২১-এ ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট সারা বিশ্বকে আরও বেশি বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেয়। ডেলটা যেন দ্বিতীয় মহা ঢেউ নিয়ে আছড়ে পড়েছিল। সত্যি সত্যি বাংলাদেশে তখন করোনার অভিঘাতে অনেক কিছু দীর্ঘ মেয়াদে এলোমেলো হয়ে যায়। বহু প্রাণ ঝরে যায়। প্রথম ঢেউ কিছুটা সীমিত আকারে আতঙ্কের মধ্যে রাখলেও, দ্বিতীয় ঢেউ গ্রাম ও শহরভেদে সর্বত্র মানুষকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। চারদিকে অক্সিজেনের হাহাকার, চিকিৎসার অভাব, ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। সেই অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালা খোলা নিয়ে আমরা ছিলাম অসহায়। দেড় বছরের বেশি সময় বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বন্ধ ছিল। শহরের কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইন পদ্ধতি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের কিছুটা ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংসদ টিভির ব্যবহার এবং অ্যাসাইনমেন্ট চালু করে বই-পুস্তকের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল। এ নিয়ে ব্যস্ত এবং তুষ্ট থাকতে হয়েছিল দেশের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে।
অবশেষে দ্বিতীয় ঢেউ সেপ্টেম্বর মাসে দুর্বল হয়ে গেলে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হয়। নির্ধারিত সময়ে না হওয়া এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা হয়। গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এই দুটো পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে এসএসসির ফলও প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষায় গতি পুরোপুরি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা থেকেই যায়। সীমিত আকারে ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা হলেও কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পরীক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুললেও অনেক পরীক্ষা নেওয়া যায়নি। ফলে শিক্ষাবর্ষ দীর্ঘায়িত হয়েছে। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবাই ধরে নিয়েছিলেন ২০২২-এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নতুন করে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পরিকল্পনামতো এগিয়ে যাবে। কিন্তু সে আশাও মনে হয় পূর্ণ হচ্ছে না।
এরই মধ্যে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞ মহল নিশ্চিত হয়ে যায় যে ওমিক্রনের ঢেউ থেকে আমরাও মুক্ত থাকতে পারব না। তবে আমরা অনেক দেশের চেয়ে কিছুটা সময় পেয়েছি, বুঝতে পেরেছি নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা সম্পর্কে। বিশেষত, করোনা প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার এবং প্রয়োগ শুরু হলে বাংলাদেশেও টিকাকরণ শুরু হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরাশক্তির রাজনীতি, কূটনীতি ও বাণিজ্যের কারণে প্রত্যাশিত টিকা পেতে আমাদেরও বেগ পেতে হয়েছে। সরকারের সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রাখার কারণে আমাদের টিকা প্রাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু ওমিক্রন নামের নতুন ভ্যারিয়েন্ট আমাদের দরজায় কড়া নাড়ার ফলে অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সরকারের গত দুই বছর দেশের অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি ধরে রাখার জন্য নানা আঁকাবাঁকা পথে হাঁটার সুফল বাংলাদেশ পেয়েছে। দেশের অর্থনীতির চাকা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। ফলে খাদ্যসংকটসহ বড় ধরনের কোনো অর্থনৈতিক সমস্যা তৈরি হয়নি। পোশাকশিল্প চালু থাকায় রপ্তানি খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। মানুষ কাজ হারিয়েছে, আয় কমেছে, ব্যয় বেড়েছে কিন্তু দেশজুড়ে হাহাকার দেখা দেয়নি। ওমিক্রন কিংবা পরবর্তী পরিস্থিতি কী হবে, সেটি নিয়ে এখন বিশ্বব্যাপী দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশও এই দুশ্চিন্তার বাইরে নয়।
এ অবস্থায় আবার শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী নাজুক এক পরিস্থিতির মুখে পড়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি আরও কিছুদিন শিক্ষার জটে আটকে পড়ে, তাহলে সংকট থেকে উত্তরণের উপায় অনেক দেশেরই বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হতে পারে।
২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে অবশ্য বোঝা গিয়েছিল যে একসঙ্গে সব জায়গায়, সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে না দিয়েও আমরা হয়তো শিক্ষাব্যবস্থা কিছুদিন কোনো না কোনোভাবে সচল রাখতে পারতাম। তাতে অসংক্রমিত অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ২০২০ সালটি মোটামুটি সচল থাকতে পারত। ২০২১ সালে অবশ্য গ্রামাঞ্চলে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে না দিয়ে উপায় ছিল না। তাতে ক্ষতির পরিমাণটা এত বিশাল হতো না। এটা আমরা পরে বুঝতে পেরেছি।
দুই বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় একদিকে যেমন শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে বাল্যবিবাহ, প্রশাসনের নজর এড়িয়ে নানা ধরনের মাদ্রাসা বেড়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে, প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক স্তরের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী স্কুল বন্ধ থাকার কারণে ওই সব প্রতিষ্ঠানে চলে গেছে। এ ছাড়া ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বেড়ে গেছে। শহর ও উপশহর অঞ্চলে কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইন পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সঙ্গে ধরে রাখতে পেরেছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ স্কুলের শিক্ষার্থীরা সেই সুযোগ পায়নি। ফলে তারা দুই ক্লাস ওপরে উঠে এলেও পঠনপাঠনের ঘাটতি তাদের ভবিষ্যতে বেশ বেকায়দায় ফেলবে বলেই মনে হচ্ছে।
ওমিক্রনের সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ না করে সরকার যেন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একসঙ্গে বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা না দেয়। এখন ১২ থেকে ১৮ বছরের শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া হচ্ছে। এই বয়সের সব শিক্ষার্থীকে যত দ্রুত টিকা দেওয়া যাবে, তত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সচল রাখার বাস্তবতা তৈরি হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তবে মাস্ক ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা যত বেশি নিখুঁতভাবে অনুসরণ করা হবে, তত বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকবে।
যেখানে তৃতীয় ঢেউ ছড়িয়ে পড়বে, সেখানেই কেবল বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা না-রাখার সিদ্ধান্ত কার্যকর করা যেতে পারে। অনলাইন পদ্ধতিতে এবং সংসদ টিভিতে মানসম্মত আকর্ষণীয় পাঠদানের ব্যবস্থাটি কীভাবে সব শিক্ষার্থীর জন্য নিশ্চিত করা যায়, সেটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। বিশেষত প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেটের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং অনলাইন পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করার ওপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জোর দিতে হবে। দরিদ্র ও অসচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত রাখার জন্য কিছু প্রণোদনার ব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।
এ ছাড়া শিক্ষকদেরও আধুনিক পাঠদান পদ্ধতির সঙ্গে প্রশিক্ষিত করে তোলার প্রতি নজর দিতে হবে। ওমিক্রনের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় রেখেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে হবে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি প্রতিষ্ঠানগুলোর থাকা বাঞ্ছনীয়। করোনার প্রাদুর্ভাব কমে আসার লক্ষণ দেখামাত্রই যেন শিক্ষার সব স্তরে আমরা মনোযোগ দিতে পারি, সেই সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের বেশ কিছু ক্ষতি দ্রুত পুষিয়ে নেওয়া গেলেও দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার করোনাজনিত ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা খুবই কঠিন হবে। তবে আমাদের সন্তানদের মানবসম্পদরূপে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো এবং মানের সমতা বিধান করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নেই।
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন অবশেষে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। করোনার তৃতীয় বছরে এটি আমাদের জন্য তৃতীয় ঢেউ। প্রথম ঢেউ ২০২০ সালে যখন আঘাত হানে, তখনই দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তড়িঘড়ি করে বন্ধ করে দিতে হয়। করোনার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় দুনিয়াজুড়েই এক ভয়াবহ আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল। এর চিকিৎসা সম্পর্কে কারও কোনো ধারণা ছিল না, কোনো ওষুধও আবিষ্কৃত হয়নি। ছোঁয়াচে এ ভাইরাসটি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল। ফলে সব দেশেই লকডাউন, মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা উচ্চারিত হতে থাকে। কিন্তু এসবের কোনোটির সঙ্গেই মানুষ আগে পরিচিত বা অভ্যস্ত ছিল না। ডাক্তাররাও কী চিকিৎসা দেবেন, তা জানতেন না। ফলে বিভিন্ন দেশে এর প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন রকমের হয়। লকডাউন শুনে তো সবাই সবকিছুতেই যেন তালা মেরে দেওয়া বুঝেছিল। ঘর থেকে বের হওয়া নিষিদ্ধ, কলকারখানা, দোকানপাট, অফিস-আদালত—সবই বন্ধ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা পড়েছিল বেশ শক্তভাবেই।
এরই মধ্যে ২০২১-এ ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট সারা বিশ্বকে আরও বেশি বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেয়। ডেলটা যেন দ্বিতীয় মহা ঢেউ নিয়ে আছড়ে পড়েছিল। সত্যি সত্যি বাংলাদেশে তখন করোনার অভিঘাতে অনেক কিছু দীর্ঘ মেয়াদে এলোমেলো হয়ে যায়। বহু প্রাণ ঝরে যায়। প্রথম ঢেউ কিছুটা সীমিত আকারে আতঙ্কের মধ্যে রাখলেও, দ্বিতীয় ঢেউ গ্রাম ও শহরভেদে সর্বত্র মানুষকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। চারদিকে অক্সিজেনের হাহাকার, চিকিৎসার অভাব, ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। সেই অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালা খোলা নিয়ে আমরা ছিলাম অসহায়। দেড় বছরের বেশি সময় বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বন্ধ ছিল। শহরের কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইন পদ্ধতি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের কিছুটা ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংসদ টিভির ব্যবহার এবং অ্যাসাইনমেন্ট চালু করে বই-পুস্তকের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল। এ নিয়ে ব্যস্ত এবং তুষ্ট থাকতে হয়েছিল দেশের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে।
অবশেষে দ্বিতীয় ঢেউ সেপ্টেম্বর মাসে দুর্বল হয়ে গেলে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হয়। নির্ধারিত সময়ে না হওয়া এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা হয়। গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এই দুটো পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে এসএসসির ফলও প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষায় গতি পুরোপুরি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা থেকেই যায়। সীমিত আকারে ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা হলেও কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পরীক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুললেও অনেক পরীক্ষা নেওয়া যায়নি। ফলে শিক্ষাবর্ষ দীর্ঘায়িত হয়েছে। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবাই ধরে নিয়েছিলেন ২০২২-এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নতুন করে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পরিকল্পনামতো এগিয়ে যাবে। কিন্তু সে আশাও মনে হয় পূর্ণ হচ্ছে না।
এরই মধ্যে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞ মহল নিশ্চিত হয়ে যায় যে ওমিক্রনের ঢেউ থেকে আমরাও মুক্ত থাকতে পারব না। তবে আমরা অনেক দেশের চেয়ে কিছুটা সময় পেয়েছি, বুঝতে পেরেছি নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা সম্পর্কে। বিশেষত, করোনা প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার এবং প্রয়োগ শুরু হলে বাংলাদেশেও টিকাকরণ শুরু হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরাশক্তির রাজনীতি, কূটনীতি ও বাণিজ্যের কারণে প্রত্যাশিত টিকা পেতে আমাদেরও বেগ পেতে হয়েছে। সরকারের সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রাখার কারণে আমাদের টিকা প্রাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু ওমিক্রন নামের নতুন ভ্যারিয়েন্ট আমাদের দরজায় কড়া নাড়ার ফলে অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সরকারের গত দুই বছর দেশের অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি ধরে রাখার জন্য নানা আঁকাবাঁকা পথে হাঁটার সুফল বাংলাদেশ পেয়েছে। দেশের অর্থনীতির চাকা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। ফলে খাদ্যসংকটসহ বড় ধরনের কোনো অর্থনৈতিক সমস্যা তৈরি হয়নি। পোশাকশিল্প চালু থাকায় রপ্তানি খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। মানুষ কাজ হারিয়েছে, আয় কমেছে, ব্যয় বেড়েছে কিন্তু দেশজুড়ে হাহাকার দেখা দেয়নি। ওমিক্রন কিংবা পরবর্তী পরিস্থিতি কী হবে, সেটি নিয়ে এখন বিশ্বব্যাপী দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশও এই দুশ্চিন্তার বাইরে নয়।
এ অবস্থায় আবার শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী নাজুক এক পরিস্থিতির মুখে পড়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি আরও কিছুদিন শিক্ষার জটে আটকে পড়ে, তাহলে সংকট থেকে উত্তরণের উপায় অনেক দেশেরই বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হতে পারে।
২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে অবশ্য বোঝা গিয়েছিল যে একসঙ্গে সব জায়গায়, সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে না দিয়েও আমরা হয়তো শিক্ষাব্যবস্থা কিছুদিন কোনো না কোনোভাবে সচল রাখতে পারতাম। তাতে অসংক্রমিত অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ২০২০ সালটি মোটামুটি সচল থাকতে পারত। ২০২১ সালে অবশ্য গ্রামাঞ্চলে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে না দিয়ে উপায় ছিল না। তাতে ক্ষতির পরিমাণটা এত বিশাল হতো না। এটা আমরা পরে বুঝতে পেরেছি।
দুই বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় একদিকে যেমন শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে বাল্যবিবাহ, প্রশাসনের নজর এড়িয়ে নানা ধরনের মাদ্রাসা বেড়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে, প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক স্তরের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী স্কুল বন্ধ থাকার কারণে ওই সব প্রতিষ্ঠানে চলে গেছে। এ ছাড়া ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বেড়ে গেছে। শহর ও উপশহর অঞ্চলে কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইন পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সঙ্গে ধরে রাখতে পেরেছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ স্কুলের শিক্ষার্থীরা সেই সুযোগ পায়নি। ফলে তারা দুই ক্লাস ওপরে উঠে এলেও পঠনপাঠনের ঘাটতি তাদের ভবিষ্যতে বেশ বেকায়দায় ফেলবে বলেই মনে হচ্ছে।
ওমিক্রনের সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ না করে সরকার যেন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একসঙ্গে বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা না দেয়। এখন ১২ থেকে ১৮ বছরের শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া হচ্ছে। এই বয়সের সব শিক্ষার্থীকে যত দ্রুত টিকা দেওয়া যাবে, তত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সচল রাখার বাস্তবতা তৈরি হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তবে মাস্ক ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা যত বেশি নিখুঁতভাবে অনুসরণ করা হবে, তত বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকবে।
যেখানে তৃতীয় ঢেউ ছড়িয়ে পড়বে, সেখানেই কেবল বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা না-রাখার সিদ্ধান্ত কার্যকর করা যেতে পারে। অনলাইন পদ্ধতিতে এবং সংসদ টিভিতে মানসম্মত আকর্ষণীয় পাঠদানের ব্যবস্থাটি কীভাবে সব শিক্ষার্থীর জন্য নিশ্চিত করা যায়, সেটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। বিশেষত প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেটের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং অনলাইন পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করার ওপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জোর দিতে হবে। দরিদ্র ও অসচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত রাখার জন্য কিছু প্রণোদনার ব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।
এ ছাড়া শিক্ষকদেরও আধুনিক পাঠদান পদ্ধতির সঙ্গে প্রশিক্ষিত করে তোলার প্রতি নজর দিতে হবে। ওমিক্রনের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় রেখেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে হবে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি প্রতিষ্ঠানগুলোর থাকা বাঞ্ছনীয়। করোনার প্রাদুর্ভাব কমে আসার লক্ষণ দেখামাত্রই যেন শিক্ষার সব স্তরে আমরা মনোযোগ দিতে পারি, সেই সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের বেশ কিছু ক্ষতি দ্রুত পুষিয়ে নেওয়া গেলেও দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার করোনাজনিত ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা খুবই কঠিন হবে। তবে আমাদের সন্তানদের মানবসম্পদরূপে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো এবং মানের সমতা বিধান করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নেই।
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
৩ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৭ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৭ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৭ দিন আগে