চিররঞ্জন সরকার
ডেঙ্গু এখন আমাদের দেশে একটি স্থায়ী ব্যাধিতে পরিণত হতে চলেছে। প্রতিবছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব আগের বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সরকারি হিসাবে এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে অন্তত ৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এবার বছরের প্রথম ছয় মাসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এবার ডেঙ্গুর মৌসুম গত বছরের মতো দীর্ঘ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। সিটি করপোরেশনের জোরালো কার্যক্রমের পাশাপাশি নগরবাসী সচেতন না হলে পরিস্থিতি ভয়ানক রূপ নিতে পারে। আর আক্রান্ত বেশি হলে মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গত বছর দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করার পরও ঢাকা সিটি করপোরেশনের টনক নড়েছে বলে মনে হয় না। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের মশকনিধনে কার্যকর ব্যাপক কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি হলেও তা শুধু এখানেই থেমে নেই। এ বছর ৫০টি জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগ ডেঙ্গু রোগীর যে হিসাব দিচ্ছে, বাস্তবে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সারা দেশে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের। সরকারি হিসাব মতে, ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা যথাক্রমে ৬২ হাজার ৩২১ এবং ২৮১। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ১২ হাজার ছাড়িয়েছে।
দেশে ডেঙ্গুর এই প্রাদুর্ভাব নতুন নয়। প্রতিবছর বর্ষা ঋতুতে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশা রাজধানীসহ বিভিন্ন শহর দাপায়, প্রাণ কাড়ে, ডেঙ্গুর খবর সংবাদপত্রজুড়ে থাকে। প্রতিবছরই নিয়ম করে একই কথা ফিরে বলতে হয়: ডেঙ্গুর মোকাবিলায় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও স্বাস্থ্য দপ্তর কী কী করছে, কতটা করছে, ঠিকমতো ও ঠিক সময়ে করছে কি না।
বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে থেকে প্রস্তুত হয়ে থাকা জলাশয় ও যে যে জায়গায় পানি জমতে পারে, পূর্বানুমানে সেগুলো পরিষ্কার করার বন্দোবস্ত করা, জনবসতি জঞ্জালমুক্ত রাখা এবং সর্বোপরি ডেঙ্গু, তার উপসর্গ ও চিকিৎসা নিয়ে তৃণমূল স্তরে গিয়ে প্রচার অভিযান—এগুলো উপেক্ষিতই থাকছে। প্রতিবছর একই অভিযোগ, একই অবহেলা, এ-ই কি তবে ভবিতব্য?
আমাদের দেশে জনস্বাস্থ্যকে কখনোই গুরুত্ব দেওয়া হয় না। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আমলে নেওয়া হয় না। এমনকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিংবা সিটি করপোরেশনের প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজেদের রুটিন কাজটা ঠিকঠাকমতো করে না। নগরীতে কিছু কিছু এলাকায় মাঝে মাঝে মশক নিধন ওষুধ ছিটানো হয়, মেয়র সাহেবরা হঠাৎ হঠাৎ দু-চার জায়গা পরিভ্রমণ করে এক-দুজনকে জরিমানা করেন, হম্বিতম্বি করেন।এর বাইরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ কখনো দেখা যায় না।
ভুল পুনরাবৃত্ত হলে তা আর ভুল নয়, মূর্খামি—প্রবাদবাক্য। কর্তৃপক্ষের মূর্খতা নাগরিক দুর্ভোগ ও জীবনহানির কারণ হলে তার চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছুই নয়। কিন্তু ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবই কর্তৃপক্ষ তথা সরকারেরই দায়, এই মনোভাবও ক্ষতিকর। সচেতন হতে হবে নাগরিককেও। জ্বর মানেই তা ভাইরাল, এই মৌসুমে একটু-আধটু হয় বলে অবহেলাও নাগরিক অসচেতনতা, বাড়ির পাশে খোলা জায়গা, নর্দমা বা বাগানে নিজেরাই জঞ্জাল ফেলা, ফুলের টব বা ডাবের খোসায় পানি জমতে দেওয়াও নাগরিক কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় নয়। সরকারের ব্যবস্থাপনায় গলদ আছে ঠিক কথা, কিন্তু নাগরিক জীবনযাত্রায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনেক কিছুই কর্তৃপক্ষের সার্বিক নজরদারি এড়িয়ে যেতে পারে। তা নিয়ে সতর্ক হতে হবে নাগরিককেও। এই সচেতনতার বিকল্প নেই।
যেকোনো মৃত্যুই বড় বেদনার, বিশেষ করে ডেঙ্গুতে শিশু, তরুণদের মৃত্যু। অথচ আমরা যেন ধরেই নিয়েছি যে প্রতিবছর বর্ষাকালে ও বর্ষার আগে-পরে কিছু প্রাণ অকালে ঝরে যাবে। তাই শহরের অজস্র জায়গাকে আমরা মশকবাহিনীর জন্য ‘অভয়ারণ্য’ হিসেবে গড়ে তুলেছি। রাজপথে খানাখন্দ, যত্রতত্র না-বোজানো গর্ত, তা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই।
রাস্তার গর্তে বৃষ্টির পানি জমে, জমা পানিতে দ্রুতলয়ে ডিম পাড়ে মশকবাহিনী। মশার ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে ভোর আর সন্ধ্যায় পায়ে হুল ফুটিয়ে যায়। একজন থেকে ১০ জনের শরীরে ভাইরাস ছড়ালে রোগ ছড়ানোর দায়টা কার—পথের, মশার, সিটি করপোরেশন, নাগরিকদের, না সরকারের?
সরকার আর সিটি করপোরেশনের ওপর আমাদের রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ করি। পারলে লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। হ্যাঁ, তাদের ওপর হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়াই উচিত। কিন্তু নিজেদের দায়িত্বটাও কি আমরা কখনো ঠিকঠাকমতো পালন করি? নিয়ম করে সাফ করি নিজের বাড়ির ছাদের বা বারান্দার টবে, বালতিতে জমা পানি? আমরা বাড়ির ময়লা ফেলি যেখানে-সেখানে, ফুলদানির পানি একভাবে পড়ে থাকে দিনের পর দিন।
মাত্র আধা ইঞ্চি জমা পানিতেও ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়ার মশা ডিম পাড়ে, বছরভর এ নিয়ে কমবেশি প্রচার চালায় পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ। বর্ষা এলেই ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু নিয়ে নানা জায়গায় চোখে পড়ে বড় বড় হোর্ডিং, দেখেও কি দেখি আমরা? জ্বর হলেই ‘ও কিছু না, ভাইরাল ফিভার’ ধরে নিই। হাসপাতালে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার পরীক্ষা করাতে গড়িমসি করে বহু মানুষ। সেটা তার নিজের জন্য, সেই সঙ্গে সবার জন্য বিপদ ডেকে আনে। এ বছর ভয়ংকর আকার নিতে চলেছে ডেঙ্গু, এমন আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
কোভিডের একের পর এক ভয়ংকর ঢেউয়ে অসংখ্য স্বজনের মর্মান্তিক মৃত্যু চোখের সামনে দেখেও আমরা বুঝলাম না যে রোগ রুখে দেওয়ার উপায় আমাদের হাতেই আছে, তা প্রয়োগের ইচ্ছা আর উদ্যম থাকা দরকার এবং সেই উদ্যম বজায় রাখতে হবে সারা বছর, সব কাজে।
বড় বড় নির্মাণ করতে গিয়ে একটা এলাকার পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা রুদ্ধ হয়ে যায়। যেসব চক্র বৈধ বা অবৈধ নির্মাণ করতে গিয়ে গোটা এলাকার মানুষকে এভাবে বিপদে ফেলে, সেই সব ঘুঘুর বাসা ভাঙতে মাঝে মাঝে হুংকার দিলে কাজ হয় না। বেআইনি নির্মাণের সঙ্গে শহরের পানিনিষ্কাশনব্যবস্থার শুধু নয়, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও নির্দিষ্ট নানা রোগব্যাধি প্রতিরোধের সম্পর্ক গভীর। বেআইনি নির্মাণকে ‘জনস্বাস্থ্য সমস্যা’ বলে দেখা দরকার।
আরেকটি কথা। ভাইরাসঘটিত জটিল রোগগুলো একে অন্যের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। কোভিডের ভয় স্তিমিত হওয়ার পর থেকে ‘জাতীয় ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি’ নিয়ে শাসকের চোখে আঙুল, কানে তুলো। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এই ঘোষণার কথা এখন আর কোনো রাজনৈতিক দল উচ্চারণ পর্যন্ত করে না। স্বাস্থ্য খাতে, বিশেষ করে জনস্বাস্থ্যে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো দূরের কথা, স্বাস্থ্যও এখন পণ্য। ‘ফেলো কড়ি, নাও বড়ি’ নীতিতে ধুঁকছে দেশের কোটি কোটি মানুষ।
রোগ প্রতিরোধে ব্যর্থতার কালো টিকা মাথায় নিয়েই দেশ এগোচ্ছে অনির্দিষ্ট গন্তব্যে। রাজনৈতিক সংঘাত বাড়ছে। শাসক দল শক্তি প্রয়োগের নীতি নিয়ে টিকে থাকতে চাইছে। কিন্তু মানুষের প্রাণ রক্ষায় চোখে পড়ার মতো কোনো কর্মসূচি নেই। ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়া অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু প্রাণের সুরক্ষা আরও বড়। ডেঙ্গুর চিকিৎসায় রক্তের অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেট প্রায়ই অপরিহার্য। রোগী বাড়ছে, প্লাটিলেটের অভাবও দেখা দিচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে দরকার পাড়া-মহল্লায় রক্তদান শিবির। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল খেয়োখেয়ি না করে আগামী এক মাস নিয়মিত পাড়ায়-পাড়ায় রক্তদান শিবিরের আয়োজন করতে পারে। কোথায় ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল? কিংবা কৃষক-শ্রমিক-যুব সংগঠনগুলো?
হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের বাঁচাতে রক্তের জন্য হাহাকার চলছে। এমন অবস্থায় রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
জনকল্যাণে বা মানুষকে বাঁচানোর নতুন রাজনীতি যদি এখনো শুরু করা না হয়, তাহলে মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোকে সমর্থন করবে কিসের জন্য?
এলাকা বা মহল্লাভিত্তিক পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদার করা, বাসার ছাদ, বাড়ির আশপাশ, দুই বাড়ির সীমানায় নোংরা জায়গাগুলো পরিষ্কার করার কোনো কার্যক্রম নেই। অথচ উল্লিখিত সব স্থান, সেপটিক ট্যাংক, ঢাকা জলাধার বা নর্দমার মশার বংশ নাশ ও পরিবেশ পরিচ্ছন্ন না হলে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মিছিল আটকানো অসম্ভব। সুতরাং মানুষ ও সিটি করপোরেশন—উভয়েরই সমান সচেতনতা জরুরি।
প্রশ্ন হলো, মশা মারা ছাড়া সিটি করপোরেশনের কর্তাব্যক্তিদের কাজটা কী? জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পতাকা শোভিত গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো?
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
ডেঙ্গু এখন আমাদের দেশে একটি স্থায়ী ব্যাধিতে পরিণত হতে চলেছে। প্রতিবছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব আগের বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সরকারি হিসাবে এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে অন্তত ৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এবার বছরের প্রথম ছয় মাসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এবার ডেঙ্গুর মৌসুম গত বছরের মতো দীর্ঘ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। সিটি করপোরেশনের জোরালো কার্যক্রমের পাশাপাশি নগরবাসী সচেতন না হলে পরিস্থিতি ভয়ানক রূপ নিতে পারে। আর আক্রান্ত বেশি হলে মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গত বছর দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করার পরও ঢাকা সিটি করপোরেশনের টনক নড়েছে বলে মনে হয় না। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের মশকনিধনে কার্যকর ব্যাপক কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি হলেও তা শুধু এখানেই থেমে নেই। এ বছর ৫০টি জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগ ডেঙ্গু রোগীর যে হিসাব দিচ্ছে, বাস্তবে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সারা দেশে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের। সরকারি হিসাব মতে, ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা যথাক্রমে ৬২ হাজার ৩২১ এবং ২৮১। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ১২ হাজার ছাড়িয়েছে।
দেশে ডেঙ্গুর এই প্রাদুর্ভাব নতুন নয়। প্রতিবছর বর্ষা ঋতুতে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশা রাজধানীসহ বিভিন্ন শহর দাপায়, প্রাণ কাড়ে, ডেঙ্গুর খবর সংবাদপত্রজুড়ে থাকে। প্রতিবছরই নিয়ম করে একই কথা ফিরে বলতে হয়: ডেঙ্গুর মোকাবিলায় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও স্বাস্থ্য দপ্তর কী কী করছে, কতটা করছে, ঠিকমতো ও ঠিক সময়ে করছে কি না।
বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে থেকে প্রস্তুত হয়ে থাকা জলাশয় ও যে যে জায়গায় পানি জমতে পারে, পূর্বানুমানে সেগুলো পরিষ্কার করার বন্দোবস্ত করা, জনবসতি জঞ্জালমুক্ত রাখা এবং সর্বোপরি ডেঙ্গু, তার উপসর্গ ও চিকিৎসা নিয়ে তৃণমূল স্তরে গিয়ে প্রচার অভিযান—এগুলো উপেক্ষিতই থাকছে। প্রতিবছর একই অভিযোগ, একই অবহেলা, এ-ই কি তবে ভবিতব্য?
আমাদের দেশে জনস্বাস্থ্যকে কখনোই গুরুত্ব দেওয়া হয় না। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আমলে নেওয়া হয় না। এমনকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিংবা সিটি করপোরেশনের প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজেদের রুটিন কাজটা ঠিকঠাকমতো করে না। নগরীতে কিছু কিছু এলাকায় মাঝে মাঝে মশক নিধন ওষুধ ছিটানো হয়, মেয়র সাহেবরা হঠাৎ হঠাৎ দু-চার জায়গা পরিভ্রমণ করে এক-দুজনকে জরিমানা করেন, হম্বিতম্বি করেন।এর বাইরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ কখনো দেখা যায় না।
ভুল পুনরাবৃত্ত হলে তা আর ভুল নয়, মূর্খামি—প্রবাদবাক্য। কর্তৃপক্ষের মূর্খতা নাগরিক দুর্ভোগ ও জীবনহানির কারণ হলে তার চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছুই নয়। কিন্তু ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবই কর্তৃপক্ষ তথা সরকারেরই দায়, এই মনোভাবও ক্ষতিকর। সচেতন হতে হবে নাগরিককেও। জ্বর মানেই তা ভাইরাল, এই মৌসুমে একটু-আধটু হয় বলে অবহেলাও নাগরিক অসচেতনতা, বাড়ির পাশে খোলা জায়গা, নর্দমা বা বাগানে নিজেরাই জঞ্জাল ফেলা, ফুলের টব বা ডাবের খোসায় পানি জমতে দেওয়াও নাগরিক কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় নয়। সরকারের ব্যবস্থাপনায় গলদ আছে ঠিক কথা, কিন্তু নাগরিক জীবনযাত্রায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনেক কিছুই কর্তৃপক্ষের সার্বিক নজরদারি এড়িয়ে যেতে পারে। তা নিয়ে সতর্ক হতে হবে নাগরিককেও। এই সচেতনতার বিকল্প নেই।
যেকোনো মৃত্যুই বড় বেদনার, বিশেষ করে ডেঙ্গুতে শিশু, তরুণদের মৃত্যু। অথচ আমরা যেন ধরেই নিয়েছি যে প্রতিবছর বর্ষাকালে ও বর্ষার আগে-পরে কিছু প্রাণ অকালে ঝরে যাবে। তাই শহরের অজস্র জায়গাকে আমরা মশকবাহিনীর জন্য ‘অভয়ারণ্য’ হিসেবে গড়ে তুলেছি। রাজপথে খানাখন্দ, যত্রতত্র না-বোজানো গর্ত, তা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই।
রাস্তার গর্তে বৃষ্টির পানি জমে, জমা পানিতে দ্রুতলয়ে ডিম পাড়ে মশকবাহিনী। মশার ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে ভোর আর সন্ধ্যায় পায়ে হুল ফুটিয়ে যায়। একজন থেকে ১০ জনের শরীরে ভাইরাস ছড়ালে রোগ ছড়ানোর দায়টা কার—পথের, মশার, সিটি করপোরেশন, নাগরিকদের, না সরকারের?
সরকার আর সিটি করপোরেশনের ওপর আমাদের রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ করি। পারলে লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। হ্যাঁ, তাদের ওপর হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়াই উচিত। কিন্তু নিজেদের দায়িত্বটাও কি আমরা কখনো ঠিকঠাকমতো পালন করি? নিয়ম করে সাফ করি নিজের বাড়ির ছাদের বা বারান্দার টবে, বালতিতে জমা পানি? আমরা বাড়ির ময়লা ফেলি যেখানে-সেখানে, ফুলদানির পানি একভাবে পড়ে থাকে দিনের পর দিন।
মাত্র আধা ইঞ্চি জমা পানিতেও ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়ার মশা ডিম পাড়ে, বছরভর এ নিয়ে কমবেশি প্রচার চালায় পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ। বর্ষা এলেই ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু নিয়ে নানা জায়গায় চোখে পড়ে বড় বড় হোর্ডিং, দেখেও কি দেখি আমরা? জ্বর হলেই ‘ও কিছু না, ভাইরাল ফিভার’ ধরে নিই। হাসপাতালে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার পরীক্ষা করাতে গড়িমসি করে বহু মানুষ। সেটা তার নিজের জন্য, সেই সঙ্গে সবার জন্য বিপদ ডেকে আনে। এ বছর ভয়ংকর আকার নিতে চলেছে ডেঙ্গু, এমন আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
কোভিডের একের পর এক ভয়ংকর ঢেউয়ে অসংখ্য স্বজনের মর্মান্তিক মৃত্যু চোখের সামনে দেখেও আমরা বুঝলাম না যে রোগ রুখে দেওয়ার উপায় আমাদের হাতেই আছে, তা প্রয়োগের ইচ্ছা আর উদ্যম থাকা দরকার এবং সেই উদ্যম বজায় রাখতে হবে সারা বছর, সব কাজে।
বড় বড় নির্মাণ করতে গিয়ে একটা এলাকার পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা রুদ্ধ হয়ে যায়। যেসব চক্র বৈধ বা অবৈধ নির্মাণ করতে গিয়ে গোটা এলাকার মানুষকে এভাবে বিপদে ফেলে, সেই সব ঘুঘুর বাসা ভাঙতে মাঝে মাঝে হুংকার দিলে কাজ হয় না। বেআইনি নির্মাণের সঙ্গে শহরের পানিনিষ্কাশনব্যবস্থার শুধু নয়, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও নির্দিষ্ট নানা রোগব্যাধি প্রতিরোধের সম্পর্ক গভীর। বেআইনি নির্মাণকে ‘জনস্বাস্থ্য সমস্যা’ বলে দেখা দরকার।
আরেকটি কথা। ভাইরাসঘটিত জটিল রোগগুলো একে অন্যের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। কোভিডের ভয় স্তিমিত হওয়ার পর থেকে ‘জাতীয় ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি’ নিয়ে শাসকের চোখে আঙুল, কানে তুলো। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এই ঘোষণার কথা এখন আর কোনো রাজনৈতিক দল উচ্চারণ পর্যন্ত করে না। স্বাস্থ্য খাতে, বিশেষ করে জনস্বাস্থ্যে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো দূরের কথা, স্বাস্থ্যও এখন পণ্য। ‘ফেলো কড়ি, নাও বড়ি’ নীতিতে ধুঁকছে দেশের কোটি কোটি মানুষ।
রোগ প্রতিরোধে ব্যর্থতার কালো টিকা মাথায় নিয়েই দেশ এগোচ্ছে অনির্দিষ্ট গন্তব্যে। রাজনৈতিক সংঘাত বাড়ছে। শাসক দল শক্তি প্রয়োগের নীতি নিয়ে টিকে থাকতে চাইছে। কিন্তু মানুষের প্রাণ রক্ষায় চোখে পড়ার মতো কোনো কর্মসূচি নেই। ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়া অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু প্রাণের সুরক্ষা আরও বড়। ডেঙ্গুর চিকিৎসায় রক্তের অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেট প্রায়ই অপরিহার্য। রোগী বাড়ছে, প্লাটিলেটের অভাবও দেখা দিচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে দরকার পাড়া-মহল্লায় রক্তদান শিবির। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল খেয়োখেয়ি না করে আগামী এক মাস নিয়মিত পাড়ায়-পাড়ায় রক্তদান শিবিরের আয়োজন করতে পারে। কোথায় ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল? কিংবা কৃষক-শ্রমিক-যুব সংগঠনগুলো?
হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের বাঁচাতে রক্তের জন্য হাহাকার চলছে। এমন অবস্থায় রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
জনকল্যাণে বা মানুষকে বাঁচানোর নতুন রাজনীতি যদি এখনো শুরু করা না হয়, তাহলে মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোকে সমর্থন করবে কিসের জন্য?
এলাকা বা মহল্লাভিত্তিক পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদার করা, বাসার ছাদ, বাড়ির আশপাশ, দুই বাড়ির সীমানায় নোংরা জায়গাগুলো পরিষ্কার করার কোনো কার্যক্রম নেই। অথচ উল্লিখিত সব স্থান, সেপটিক ট্যাংক, ঢাকা জলাধার বা নর্দমার মশার বংশ নাশ ও পরিবেশ পরিচ্ছন্ন না হলে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মিছিল আটকানো অসম্ভব। সুতরাং মানুষ ও সিটি করপোরেশন—উভয়েরই সমান সচেতনতা জরুরি।
প্রশ্ন হলো, মশা মারা ছাড়া সিটি করপোরেশনের কর্তাব্যক্তিদের কাজটা কী? জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পতাকা শোভিত গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো?
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
১ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৫ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৫ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ দিন আগে