ডলার সংকট: বিদেশি ঋণের প্রকল্পে ভর

ফারুক মেহেদী ও জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা
প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০২৩, ০৮: ৩২

ডলারের দাম আবারও উত্তাপ ছড়াচ্ছে। রপ্তানি আর রেমিট্যান্সের (প্রবাসী আয়) ইতিবাচক ধারাও ডলারের দামে লাগাম টানতে পারছে না। উল্টো লাফিয়ে বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দর ১০৮ টাকা ৭৫ পয়সা নির্ধারণ করার পর গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেডা) তা ১০৯ টাকা করে দিয়েছে। আকুর দায় শোধ করার পর বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ আবারও ৩০ বিলিয়ন (৩ হাজার কোটি) ডলারের ঘরে নেমেছে। আইএমএফের হিসাবে তা আরও কম, অর্থাৎ ২৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। এটি ঝুঁকি বাড়াচ্ছে অর্থনীতিতে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার বিদেশি ঋণনির্ভর প্রকল্পে অগ্রাধিকার দিয়ে ডলারের মজুত বাড়াতে মরিয়া। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, এরই মধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অন্তত দুই ডজন প্রকল্পে বিদেশি ঋণ সহায়তা চেয়ে ইআরডিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। শুধু একটি প্রকল্পেই ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ডলার খরচ কমাতেও মনোযোগী সরকার। নতুন অর্থবছরের শুরুতেই বিদেশ ভ্রমণ, বিদেশি কেনাকাটা, আমদানিসহ নানাভাবে কৃচ্ছ্রসাধনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রক্ষণশীল মুদ্রানীতির সঙ্গে মিল রেখে বাজারে টাকার প্রবাহ কমানো এবং মানুষের ভোগ কমিয়ে আনার মাধ্যমেও সরকার টাকার পাশাপাশি ডলারের চাপ কমাতে চায়।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বর্তমানে রিজার্ভ যে স্তরে আছে, তা অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি করছে। আইএমএফের ঋণের কারণে সরকার আর ডলারের দর আটকে রাখতে পারবে না। তা বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। গতকাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক তা আংশিকভাবে কার্যকরও করেছে। সেপ্টেম্বরে তা পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে। তবে দুই দিন ধরেই ডলারের দর বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হলে ডলারের দর আরও নিয়ন্ত্রণহীন হবে। কারণ, তখন চাহিদা ও সরবরাহের ওপর বাজারই দর নির্ধারণ করবে। ফলে ডলারের মজুত আরও ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের ভেতরও সামনের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ আছে। তাই সরকার ডলারের মজুত বাড়ানোর পাশাপাশি খরচও কমানোর চেষ্টা করছে। অর্থবছরের শুরুতেই বিদেশভ্রমণ, গাড়ি কেনা, প্রকল্পের কাজে বিদেশি কেনাকাটাসহ বিভিন্ন খাতের খরচে লাগাম টানতে বিশেষ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, এতে একদিকে ডলারের ওপর চাপ কমানো হবে, অন্যদিকে ঘোষিত সংরক্ষণমূলক মুদ্রানীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজারে মুদ্রাপ্রবাহ কমানো হবে; যাতে সরকারকে ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ধার করতে না হয়। এভাবে ডলার সাশ্রয়ের পাশাপাশি সরকার ডলারের প্রবাহ বাড়ানোর ব্যাপারেও মনোযোগী। সম্প্রতি ইআরডির কাছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ১৪টি বিদেশি ঋণনির্ভর প্রকল্পে অর্থায়ন খুঁজে দেখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এতে বিপুল অঙ্কের ডলার আসবে বলে মনে করছে সরকার। এর মধ্যে ‘৫ম হেলথ পপুলেশন অ্যান্ড নিউট্রিশন সেক্টর প্রোগ্রাম (এইচপিএনএসপি)’ নামের একটি প্রকল্পের জন্যই চাওয়া হয়েছে ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। প্রতি ডলার ১০৯ টাকা হিসাবে এর পরিমাণ ২ লাখ ৯৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

তবে ধাপে ধাপে হলেও এই ঋণ অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান। তিনি গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিদেশি ঋণনির্ভর প্রকল্পে সরকার জোর দিলেও তা যেন দীর্ঘমেয়াদি ও সহজ শর্তে হয়। না হলে এ ঋণ পরে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।’

ইআরডি জানিয়েছে, সহজে ডলার পেতে তাদের কাছে বিদেশি ঋণনির্ভর যেসব প্রকল্পের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে ঢাকা ম্যাস র‍্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক প্রকল্প, মোংলা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ, খুলনা সিটিতে ভাসমান ও ছাদের ওপর সোলার প্ল্যান্ট স্থাপন প্রকল্প, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নের পৃথক প্রকল্প, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধ প্রকল্প অন্যতম। এসব প্রকল্পের জন্য ভারত, কোরিয়া, জাইকা, এডিবি, এনডিবি, বিশ্বব্যাংক, ইউএসএআইডিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর কাছে ঋণ চাওয়া হবে।

এ ব্যাপারে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিদেশি ঋণনির্ভর প্রকল্প বানিয়ে তা উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে দেওয়া এবং টাকার খোঁজ করাটা এখন আমাদের অগ্রাধিকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সম্প্রতি একনেক সভায় এ ব্যাপারে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। এটা লুকানোর কিছু নেই। আমরা যেহেতু ডলারের চাপে আছি, তাই বিদেশি ঋণের প্রকল্পে জোর দিচ্ছি। ঋণ তো আমাদেরই টাকা। খরচ করতে না পারাটা আমাদের দোষ। কিন্তু ঋণ আমরা যথাসময়েই শোধ করছি। তাই যত সহজে এবং দ্রুততার সঙ্গে প্রকল্পে ডলার ঢোকানো যায়, সেটাই আমাদের চেষ্টা।’

বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, প্রবাসী আয়ের ধারা ইতিবাচক। গত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় এসেছে জুনে। তবে এ প্রবৃদ্ধির পেছনের কারণ ঈদুল আজহা। এ সময়ে একটু বেশিই রেমিট্যান্স আসে।

তবে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এ ধারা অব্যাহত থাকবে কি না, সেটাই দেখার বিষয়। যদি তা না থাকে, তাহলে রিজার্ভে চাপ পড়বে। একইভাবে রপ্তানি আয়ও আগের অর্থবছরের চেয়ে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি এসেছে। কিন্তু এর চেয়ে আমদানি ও ডলারের দর বেশি থাকায় এর সুফল মিলছে না। বৈশ্বিক পরিস্থিতিসহ কোনো কারণে সামনে রপ্তানি আয় বাধাগ্রস্ত হলে তা-ও রিজার্ভে বড় চাপ তৈরি করতে পারে।

অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, ডলার সাশ্রয় ও খরচে লাগাম টানতে সরকারের দেওয়া নির্দেশনা কতটা কাজে দেবে, সেটি এখনই বলা মুশকিল। তবে এর নেতিবাচক দিকও আছে। এর ফলে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগে প্রভাব পড়বে। উন্নয়ন প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হবে, শিল্পকারখানায় বিনিয়োগ কমবে, কাঁচামালের সংকট দেখা দিতে পারে।  

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘গত অর্থবছরের মতোই অর্থনীতির অনেক সংকট এখনো রয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি, রিজার্ভের পরিস্থিতি খুব একটা উন্নতি হচ্ছে না, রেমিট্যান্স কিছুটা বেড়েছে ঠিক, তবে প্রবৃদ্ধি খুব বেশি না।’
ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগসহ অন্যান্য সহজ উৎস থেকে সরকার এখনই ডলারের মজুত না বাড়ালে সামনে অস্থিরতা বাড়ার আশঙ্কা আছে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত