ঘরের ভেতরে দিশেহারা মুখ

বাসন্তি সাহা
প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৮: ৩৪

অফিসে বসে কাজ করছি। থেকে থেকে একজন নারীর চিৎকার আমাকে বিচলিত করছে। আমি ওদের বললাম, ‘শুনতে পাচ্ছো তোমরা?’ হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছে সবাই। আমি দ্রুত কাজ করছি, আমাকে বের হতে হবে। কারুশিল্পীদের জেন্ডার ইকুয়িটি নিয়ে আমার একটা প্রেজেন্টেশন আছে পর্যটন ভবনে। কিন্তু চিৎকার বাড়ছেই। মরণপণ চিৎকার। বিল্ডিংয়ের সামনে সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে?’ কেয়ারটেকার ঘুরে এসে জানাল, ছেলে আর শাশুড়ি মিলে বউটাকে মারছে। মোবাইল ফোন নিয়ে কী একটা ঝামেলা হয়েছে। পারিবারিক ব্যাপার!

নিচে জানালার কাচ ভেঙে পড়েছে। চিৎকার বন্ধ হয়নি। ভাঙা কাচ যাতে মাথায় না পড়ে, সাবধানে এগিয়ে গেলাম। আমার জেন্ডার নিয়ে একটা প্রেজেন্টেশন আছে। আমি যাচ্ছি, মাথায় একটা অপরাধবোধ। আমি কী করতে পারতাম? আমার মনে পড়ল স্কুলে পড়া বয়সে দেখা একটা ঘটনার কথা। স্বামী তাঁর বউকে বাঁশ দিয়ে মারছে। বউটা মাটিতে গড়াগড়ি করে চিৎকার করছে। চারপাশে মানুষ ভিড় করে দেখছে। কেউ ধরছে না স্বামীটাকে। কারণ, পারিবারিক ব্যাপার। একটু পরে স্বামী ক্লান্ত হয়ে বাঁশটা ফেলে দিয়ে বিড়ি ধরাল। বউটার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছিল। সেও রক্ত মুছে রান্না করতে উঠে গেল। কারণ রান্না করতে দেরি হয়েছিল।

মাঝখানে সময়ের ব্যবধান প্রায় ৩৫ বছরের। ঘটনাটা একই রকম। কেবল বাঁশের বেড়ার ঘর থেকে বিষয়টা রড-সিমেন্টের দালানে এসেছে। ঘটনার পাত্র-পাত্রী সবই এক। কারণও কাছাকাছি। প্রেক্ষাপটও একই। পারিবারিক নির্যাতন। অনেক নারী বিষয়টিকে ব্যক্তিগত ব্যাপার হিসেবে ধরে নিয়ে চুপচাপ সহ্য করে যান। আবার পারিবারিক সহিংসতার ক্ষেত্রে যে আইনি প্রতিকার আছে, অনেকে সে সম্পর্কে জানেন না। খুব কমসংখ্যক নারী নিরুপায় হয়ে এ ক্ষেত্রে আইনের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনায় আইনি প্রতিকারের জন্য বাংলাদেশে ২০১০ সালে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন পাস হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন সার্ভে ২০১৫’ শীর্ষক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের বিবাহিত নারীদের ৮০ দশমিক ২ শতাংশ স্বামী ও শ্বশুরপক্ষীয়দের দ্বারা কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার। সেই নির্যাতন শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক বা যৌন হতে পারে। শহর এলাকায় এই হার ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশ এবং গ্রাম এলাকায় ৭৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ৪১ শতাংশ নারী স্বামীর শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার।

আমার সঙ্গে কাজ করছে জান্নাত। এখনো পড়াশোনা করছে। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কোনো স্বামীকে দেখেছ বউকে মারতে, নির্যাতন করতে?’ ও একটা চমৎকার কথা বলেছে আমাকে, ‘আমরা ফ্ল্যাট বাসায় থাকি তো। কেউ কারও খবর রাখি না। ফলে ভেতরে কী হচ্ছে আমরা দেখতে পাই না, শুনতেও পাই না। কিন্তু কোথাও কোথাও বন্ধুদের আলোচনায় শুনি এটা আছে, প্রবলভাবেই আছে।’ ঠিক তাই, আছে। কিন্তু আমরা নিজেদের আচরণে একটা সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করেছি যে, এটা তাদের পারিবারিক বিষয়, এখানে আমরা কথা বলতে পারি না। আমরা অন্যের ঝামেলায় জড়ানোর চেয়ে নিজের কমফোর্ট জোনটাতে থাকতে পছন্দ করি। আমরা নীরব থাকি, কারণ এই নীরবতার উল্টো দিকে আছে অনেক রকম অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ। ফলে আমরা নিজের চেনা পথেই হাঁটতে পছন্দ করি।

বহুদিন ধরে চলে আসা পারিবারিক নির্যাতন কোনো পারিবারিক বিষয় নয়। এর একটি তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া আছে। এর প্রভাব যেমন নির্যাতিত মানুষটির ওপর পড়ে, তেমনি পড়ে সন্তানদের ওপর। যে মেয়েটি কিশোরী বয়সে সামান্য কাচপোকা ও জোনাকির জন্য ভালোবাসা পুষে রেখেছিল, সে-ও হয়তো সংসারে এসে নির্যাতনের শিকার হয়। নোয়াখালীতে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল সালমার। ও একটি হোটেল কাম কমিউনিটি সেন্টারে কাজ করে। কাজ বলতে যেদিন কোনো অনুষ্ঠান থাকে, সেদিন তার পরিষ্কার করা, ধোয়ামোছার কাজ থাকে। মাত্র ১৮-১৯ বছর বয়স। বাবা

মারা যাওয়ার পরে মায়ের অন্য জায়গায় বিয়ে হয়েছে। নিজেও বিয়ে করেছিল ১৪ বছরে। একটা কন্যাসন্তানসহ স্বামী তাকে ছেড়ে দেয়। তারপর কেবল খাবারের জন্য, সন্তানের বাবার পরিচয়ের জন্য বিয়ে করেছে ৫৫ বছরের এক দারোয়ানকে। দারোয়ানের খুপরিতে তার আশ্রয় মিলেছে বটে, কিন্তু সেখানে মেয়ে রেখে কাজে আসতেও ভয় করে সালমার। কারণ ওই দারোয়ান ওর মেয়ের বাবা হয়ে ওঠেনি।

গত ৫০ বছরে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে আমাদের আচার-আচরণ, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, পারিবারিক সম্পর্ক—সবকিছুতেই একটা পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যম ও কোভিড-১৯ আমাদের সামাজিক সম্পর্কে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়ে গেছে। আমরা সামাজিক মাধ্যমে অনেক ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু পাশের ফ্ল্যাট বা পাশের বাড়ির খবর রাখি না; একই পাড়া বা গাঁয়ে থাকি। এটা মফস্বলেও নেই এখন। ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা রক্ষাকেও হয়তো মাথায় রাখছি আমরা, কিন্তু কখনো কখনো এর ফলে কারও কারও জীবন বিপন্ন হতে পারে।

মেরে ফেলে সেই লাশকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো, এখনো হয়। আমরা তো এখন কাউকে দেখে রোগা, কালো, মোটা, হাড়ঝিরঝিরে—এগুলো বলাও বন্ধ করেছি। কারণ এগুলো বডিশেমিং। এগুলো মানুষের মনোবল ভেঙে দেয়। কিন্তু ভেতরের জগতে, চারদেয়ালের মধ্যে নারীর ওপর পারিবারিক নির্যাতন বন্ধ হয়নি।

ইউনিসেফের (জাতিসংঘ শিশু তহবিল) একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা অপরিচিত মানুষের হামলাকে ভয় পায় না, বরং ভয় পায় কাছের মানুষের প্রতিদিনের সহিংসতাকে। দুধসাদা ফ্রক পরা মেয়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরবে, কিন্তু ঘরই যদি নিরাপদ না হয়, তবে রথের মেলায় হারিয়ে যাওয়া বালিকা ফিরবে কোথায়? তার গোপন চিৎকার বাতাসে ভেসে কোথাও পৌঁছাবে? নাকি কাচপোকার কান্না হয়ে জ্বলবে? তাই যত দ্রুত সম্ভব আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে পারিবারিক নির্যাতন বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। দেশের প্রতিটি নারী ও শিশুর ফেরার জায়গাকে নিরাপদ আশ্রয় করতে হবে; লুকিয়ে থাকার আড়াল না খুঁজে যেন প্রতিবাদ করতে পারে, সেই পরিবেশ দিতে হবে।

লেখক: কো-অর্ডিনেটর, রিসার্চ অ্যান্ড ডকুমেন্টেশন, দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত