চিররঞ্জন সরকার
বাড়িতে আপনার ফ্রিজ আছে, এসি আছে, ওয়াশিং মেশিন আছে, ওভেন, এলইডি টিভি সব আছে। কিন্তু যদি বিদ্যুৎ না থাকে, তাহলে এসব জিনিসের কোনো উপযোগিতা বা কার্যকারিতা থাকে কি? ঠিক তেমনি দেশে যদি অনেক অত্যাধুনিক গাড়ি থাকে, উড়োজাহাজ থাকে, রাস্তা, ব্রিজ, ফ্লাইওভার, ফুটওভার এক্সপ্রেস হাইওয়ে, রেল—সবকিছু থাকে, কিন্তু তেল না থাকে, তাহলে এসবও নির্থক হয়ে যায়।
আসলে আধুনিক মানুষের জীবনে একসঙ্গে অনেক কিছু লাগে। এর একটি বাদ দিয়ে আরেকটি নয়। আমাদের জীবনে ফ্রিজ-টিভি-এসির যেমন দরকার আছে, এগুলো চালাতে বিদ্যুতের দরকার তার চেয়ে বেশি। শুধু বিদ্যুৎ হলে যেমন চলে না। আবার শুধু ফ্রিজ-টিভি-এসি থাকলেও হয় না। রাস্তা, ব্রিজে চলতে এবং গাড়ি চালাতে তেলেরও দরকার। তেল ছাড়া গাড়ি চলে না। আবার গাড়ি, রাস্তা, ব্রিজ ছাড়া কেবল তেল নিয়ে বসে থাকলেও তা কোনো উপকারে আসে না।
আমাদের দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর টেকসই সমাধান হচ্ছে না। এমনকি গত পঞ্চাশ বছরেও পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস সমস্যার সমাধান হয়নি। উল্টো সংকট যেন দিন দিন আরও বাড়ছে। এমনকি ক্ষুধার সমস্যারও তেমন কোনো সমাধান হয়নি। এ ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সামনে যাওয়ার পরিবর্তে পিছিয়ে পড়ছে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচক (গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স-জিএইচআই) ২০২২-এর প্রতিবেদন তারই প্রমাণ। গত বছরের তুলনায় এ বছর আট ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। সূচকে ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। অথচ আগের বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৬তম।
অর্থাৎ ক্ষুধা মেটানোর সক্ষমতায় এবার বাংলাদেশের অবস্থানের আট ধাপ অবনতি হয়েছে। এবারের বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ১৯ দশমিক ৬। এই স্কোর ১০ থেকে ১৯ দশমিক ৯-এর মধ্যে থাকলে কোনো দেশকে ‘মাঝারি মাত্রার’ ক্ষুধায় আক্রান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তালিকায় যথাক্রমে ১০৭ ও ৯৯তম স্থানে থাকা প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের নাম রয়েছে ‘মারাত্মক ক্ষুধায়’ (স্কোর ২০ থেকে ৩৪ দশমিক ৯) আক্রান্ত দেশের তালিকায়। তবে বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কা এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান। দেশ দুটির অবস্থান যথাক্রমে ৬৪ ও ৭১তম।
ইনডেক্সে ৫ পয়েন্টের কম পেয়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে বেলারুশ, চিলি, চীনসহ মোট ১৭টি দেশ। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে কারও স্কোর শূন্য হলে বুঝতে হবে, সেখানে ক্ষুধা নেই। আর স্কোর ১০০ হওয়ার অর্থ, সেখানে ক্ষুধার মাত্রা সর্বোচ্চ।
উল্লেখ্য, বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের মাধ্যমে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের ক্ষুধার মাত্রা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। অপুষ্টির মাত্রা, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজন, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের বয়স অনুযায়ী কম উচ্চতা এবং শিশুমৃত্যুর হার হিসাব করে ক্ষুধার মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বৈশ্বিক, আঞ্চলিক বা জাতীয়—যেকোনো পর্যায়ে ক্ষুধার মাত্রা নির্ণয় করতে এ সূচকগুলো
ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নিরসনের জন্য সব সরকারই কম-বেশি কাজ করেছে এবং করছে। কিন্তু তারপরও দেশে ক্ষুধার্ত মানুষের ভিড় কমছে না। এটা স্বীকৃত যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের যোগসূত্র অত্যন্ত নিবিড়; অর্থাৎ দরিদ্র ব্যক্তিরাই ক্ষুধার্ত। সাধারণ ধারণা অনুযায়ী ক্ষুধার্ত ব্যক্তির সংজ্ঞা হলো, যে ব্যক্তি অনাহারে রয়েছে। কারণ, খাদ্য ক্রয়ের কোনো সামর্থ্যই তার নেই। সাধারণ ধারণায় ক্ষুধা মানেই আহারের অভাব; অর্থাৎ এই অভাবের জন্যই জনমানুষ ক্ষুধার্ত হয়। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ক্ষুধার সংজ্ঞায় পুষ্টির অভাব বা অপুষ্টিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ সংজ্ঞায় কোনো ব্যক্তি যদি প্রতিদিন ১ হাজার ৮০০ ক্যালরির মানসম্পন্ন খাবার না খেতে পারে, তাহলে সে অপুষ্টির শিকার হবে। অপুষ্টির অর্থ প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব; অর্থাৎ নির্ধারিত পরিমাণের ক্যালরির ঘাটতি। এ সংজ্ঞায় খাদ্য গ্রহণের পরও মানুষ ক্ষুধার্ত হয়।
কোভিড এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জোড়া ধাক্কায় দেশের অর্থনীতি লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। কাজ নেই, ব্যবসা ছত্রখান। মূল্যবৃদ্ধির চাপে মানুষ নাজেহাল। ঘরে ঘরে তাই অনাহার তো বাড়বেই। যদিও বিষয়টি নিয়ে তেমন একটা আলোচনা নেই। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে আমরা ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছি—এটাই যা সান্ত্বনা।
ঢাকঢোল পিটিয়ে উন্নয়নের বাজনা বাজানো হচ্ছে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে, মাথাপিছু আয় বাড়ন্ত—এসব এখন নিয়মিত বুলি। কিন্তু যা শোনা যায় না তা হলো, রেকর্ড ফসল উৎপাদনের পরেও গরিবের ঘরে এখনো ক্ষুধা আর অনাহারের জ্বলন্ত উদাহরণের কথা। দেশে সর্বোচ্চ শিক্ষালাভের পরও মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলের কাজ না পাওয়ার কাহিনি। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় টাকা বিলানোর ঢালাও প্রচারের পরও অজ্ঞাত কারণে তা গরিবের উঠোনে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছায় না। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা—সরকারি প্রকল্পের শেষ নেই। বরাদ্দ টাকাও অঢেল। হাজার হাজার কোটির আয়োজন। কিন্তু স্থানীয় নেতা, তত্ত্বাবধানকারী অফিসার, দালাল আর উপরি কামাইয়ের সুযোগ নেওয়া ধান্দাবাজদের সৌজন্যে কোথায় যেন আসল উদ্দেশ্য হাওয়া হয়ে যায়। কেন ও কীভাবে? এই রহস্যের পর্দা ফাঁস কোনো সরকারের আমলেই হয় না।
আমাদের প্রশাসন কখনো কালো দিকটা দেখায় না, আমরাও তাই বাধ্য দেশবাসীর মতো তা সচরাচর দেখতে পাই না। এভাবেই আসল সত্যিটা হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। ওসব ছেড়ে আমরা নানা আমোদ-আহ্লাদে উদ্বাহু হই। চোখে পড়ে না গরিব শ্রমিক, কৃষক খেটে খাওয়া মানুষের ঘরের সংকট, ক্ষুধা, অনাহারের ইতিবৃত্ত। অথচ সরকার ঠান্ডা ঘরে বসে যা-ই দাবি করুক, প্রকৃত চিত্র কিন্তু আদৌ দারিদ্র্য-রেখা থেকে বেরিয়ে আসা মানুষের গৌরবময় উত্তরণের কথা বলছে না। গরিব আরও গরিব আর লুটপাটকারী ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে।
এ কথা ঠিক যে গোটা বিশ্বের ক্ষুধার সূচকের (গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স) প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের অবস্থা এখনো শোচনীয়। দেশে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা কিছুতেই কমছে না। উল্টো অনাহার ও খাদ্যের হাহাকার বাড়ছে।
আমাদের দেশে ক্ষুধা সূচক নিয়ে সরকার কিংবা বিরোধী দল—কেউই খুব একটা মাথা ঘামায় না। গরিব মানুষ তো ক্ষুধা সূচক বোঝেই না। খাবারের জোগাড় করতেই তারা জেরবার। নইলে ২০১৩ সালে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন তৈরি হওয়ার পর থেকেও আমাদের দেশে অপুষ্টি সমস্যার মোকাবিলায় কোনো বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি দেখেও রাজনৈতিক সমাজে কোনো আলোড়ন তৈরি হয়নি কেন? কিছু কিছু মানুষের বাড়িতে খাবার উপচে পড়ে, অথচ অনেক মানুষ ন্যূনতম খাবার পায় না। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প আছে। সেই প্রকল্পের সঠিক রূপায়ণ হলে গরিব মানুষের খাদ্যাভাব থাকারই কথা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাস্তব ছবিটা অন্য রকম। বিশেষজ্ঞরা এর কারণ হিসেবে মনে করেন, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, অবকাঠামোয় গলদ, অজ্ঞানতা আর প্রকল্প রূপায়ণে ত্রুটি। ফলে ক্ষুধা দূরীকরণে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাচ্ছে না; অর্থাৎ উপকরণ থাকা সত্ত্বেও বহু মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় কষ্ট পায়।
রাজনীতিকেরা আছেন তাঁদের নিজস্ব ধান্দায়। তাঁরা বিভিন্ন নন-ইস্যুকে ইস্যু করে রাজনীতির মাঠে ধুলা ওড়ানোর চেষ্টা করেন। বাংলাদেশ যেখানে আর্থিকভাবে শক্তিধর হতে চাইছে, ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সমানে উন্নয়নের খতিয়ান দিতে ব্যস্ত, সেখানে ক্ষুধা সূচকে কেন বাংলাদেশ পেছনে থাকবে? কেনই-বা একপেট ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যাবে বিপুলসংখ্যক মানুষ? আলোচ্য রিপোর্টেই আক্ষেপ করা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, খিদের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী লড়াই মোটেই ঠিক পথে এগোচ্ছে না। আশঙ্কা, এভাবে চললে সারা বিশ্ব, বিশেষ করে ৪৭টি দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধার হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সফল হতে পারবে না; অর্থাৎ ক্ষুধার রাজ্যে বাংলাদেশের মতো পৃথিবীও ক্রমে গদ্যময় হয়ে উঠবে।
ক্ষুধা নিয়ে আমাদের প্রত্যেকেরই দায় আছে। আছে করণীয়। সুমনের গানের কথায় বলতে হয়: ‘কেউ যদি বেশি খাও, খাবার হিসেব নাও/কেননা অনেক লোক ভালো করে খায় না;/খাওয়া না খাওয়ার খেলা, যদি চলে সারা বেলা/হঠাৎ কী ঘটে যায় কিচ্ছু বলা যায় না...’।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
বাড়িতে আপনার ফ্রিজ আছে, এসি আছে, ওয়াশিং মেশিন আছে, ওভেন, এলইডি টিভি সব আছে। কিন্তু যদি বিদ্যুৎ না থাকে, তাহলে এসব জিনিসের কোনো উপযোগিতা বা কার্যকারিতা থাকে কি? ঠিক তেমনি দেশে যদি অনেক অত্যাধুনিক গাড়ি থাকে, উড়োজাহাজ থাকে, রাস্তা, ব্রিজ, ফ্লাইওভার, ফুটওভার এক্সপ্রেস হাইওয়ে, রেল—সবকিছু থাকে, কিন্তু তেল না থাকে, তাহলে এসবও নির্থক হয়ে যায়।
আসলে আধুনিক মানুষের জীবনে একসঙ্গে অনেক কিছু লাগে। এর একটি বাদ দিয়ে আরেকটি নয়। আমাদের জীবনে ফ্রিজ-টিভি-এসির যেমন দরকার আছে, এগুলো চালাতে বিদ্যুতের দরকার তার চেয়ে বেশি। শুধু বিদ্যুৎ হলে যেমন চলে না। আবার শুধু ফ্রিজ-টিভি-এসি থাকলেও হয় না। রাস্তা, ব্রিজে চলতে এবং গাড়ি চালাতে তেলেরও দরকার। তেল ছাড়া গাড়ি চলে না। আবার গাড়ি, রাস্তা, ব্রিজ ছাড়া কেবল তেল নিয়ে বসে থাকলেও তা কোনো উপকারে আসে না।
আমাদের দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর টেকসই সমাধান হচ্ছে না। এমনকি গত পঞ্চাশ বছরেও পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস সমস্যার সমাধান হয়নি। উল্টো সংকট যেন দিন দিন আরও বাড়ছে। এমনকি ক্ষুধার সমস্যারও তেমন কোনো সমাধান হয়নি। এ ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সামনে যাওয়ার পরিবর্তে পিছিয়ে পড়ছে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচক (গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স-জিএইচআই) ২০২২-এর প্রতিবেদন তারই প্রমাণ। গত বছরের তুলনায় এ বছর আট ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। সূচকে ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। অথচ আগের বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৬তম।
অর্থাৎ ক্ষুধা মেটানোর সক্ষমতায় এবার বাংলাদেশের অবস্থানের আট ধাপ অবনতি হয়েছে। এবারের বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ১৯ দশমিক ৬। এই স্কোর ১০ থেকে ১৯ দশমিক ৯-এর মধ্যে থাকলে কোনো দেশকে ‘মাঝারি মাত্রার’ ক্ষুধায় আক্রান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তালিকায় যথাক্রমে ১০৭ ও ৯৯তম স্থানে থাকা প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের নাম রয়েছে ‘মারাত্মক ক্ষুধায়’ (স্কোর ২০ থেকে ৩৪ দশমিক ৯) আক্রান্ত দেশের তালিকায়। তবে বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কা এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান। দেশ দুটির অবস্থান যথাক্রমে ৬৪ ও ৭১তম।
ইনডেক্সে ৫ পয়েন্টের কম পেয়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে বেলারুশ, চিলি, চীনসহ মোট ১৭টি দেশ। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে কারও স্কোর শূন্য হলে বুঝতে হবে, সেখানে ক্ষুধা নেই। আর স্কোর ১০০ হওয়ার অর্থ, সেখানে ক্ষুধার মাত্রা সর্বোচ্চ।
উল্লেখ্য, বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের মাধ্যমে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের ক্ষুধার মাত্রা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। অপুষ্টির মাত্রা, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজন, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের বয়স অনুযায়ী কম উচ্চতা এবং শিশুমৃত্যুর হার হিসাব করে ক্ষুধার মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বৈশ্বিক, আঞ্চলিক বা জাতীয়—যেকোনো পর্যায়ে ক্ষুধার মাত্রা নির্ণয় করতে এ সূচকগুলো
ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নিরসনের জন্য সব সরকারই কম-বেশি কাজ করেছে এবং করছে। কিন্তু তারপরও দেশে ক্ষুধার্ত মানুষের ভিড় কমছে না। এটা স্বীকৃত যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের যোগসূত্র অত্যন্ত নিবিড়; অর্থাৎ দরিদ্র ব্যক্তিরাই ক্ষুধার্ত। সাধারণ ধারণা অনুযায়ী ক্ষুধার্ত ব্যক্তির সংজ্ঞা হলো, যে ব্যক্তি অনাহারে রয়েছে। কারণ, খাদ্য ক্রয়ের কোনো সামর্থ্যই তার নেই। সাধারণ ধারণায় ক্ষুধা মানেই আহারের অভাব; অর্থাৎ এই অভাবের জন্যই জনমানুষ ক্ষুধার্ত হয়। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ক্ষুধার সংজ্ঞায় পুষ্টির অভাব বা অপুষ্টিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ সংজ্ঞায় কোনো ব্যক্তি যদি প্রতিদিন ১ হাজার ৮০০ ক্যালরির মানসম্পন্ন খাবার না খেতে পারে, তাহলে সে অপুষ্টির শিকার হবে। অপুষ্টির অর্থ প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব; অর্থাৎ নির্ধারিত পরিমাণের ক্যালরির ঘাটতি। এ সংজ্ঞায় খাদ্য গ্রহণের পরও মানুষ ক্ষুধার্ত হয়।
কোভিড এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জোড়া ধাক্কায় দেশের অর্থনীতি লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। কাজ নেই, ব্যবসা ছত্রখান। মূল্যবৃদ্ধির চাপে মানুষ নাজেহাল। ঘরে ঘরে তাই অনাহার তো বাড়বেই। যদিও বিষয়টি নিয়ে তেমন একটা আলোচনা নেই। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে আমরা ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছি—এটাই যা সান্ত্বনা।
ঢাকঢোল পিটিয়ে উন্নয়নের বাজনা বাজানো হচ্ছে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে, মাথাপিছু আয় বাড়ন্ত—এসব এখন নিয়মিত বুলি। কিন্তু যা শোনা যায় না তা হলো, রেকর্ড ফসল উৎপাদনের পরেও গরিবের ঘরে এখনো ক্ষুধা আর অনাহারের জ্বলন্ত উদাহরণের কথা। দেশে সর্বোচ্চ শিক্ষালাভের পরও মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলের কাজ না পাওয়ার কাহিনি। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় টাকা বিলানোর ঢালাও প্রচারের পরও অজ্ঞাত কারণে তা গরিবের উঠোনে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছায় না। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা—সরকারি প্রকল্পের শেষ নেই। বরাদ্দ টাকাও অঢেল। হাজার হাজার কোটির আয়োজন। কিন্তু স্থানীয় নেতা, তত্ত্বাবধানকারী অফিসার, দালাল আর উপরি কামাইয়ের সুযোগ নেওয়া ধান্দাবাজদের সৌজন্যে কোথায় যেন আসল উদ্দেশ্য হাওয়া হয়ে যায়। কেন ও কীভাবে? এই রহস্যের পর্দা ফাঁস কোনো সরকারের আমলেই হয় না।
আমাদের প্রশাসন কখনো কালো দিকটা দেখায় না, আমরাও তাই বাধ্য দেশবাসীর মতো তা সচরাচর দেখতে পাই না। এভাবেই আসল সত্যিটা হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। ওসব ছেড়ে আমরা নানা আমোদ-আহ্লাদে উদ্বাহু হই। চোখে পড়ে না গরিব শ্রমিক, কৃষক খেটে খাওয়া মানুষের ঘরের সংকট, ক্ষুধা, অনাহারের ইতিবৃত্ত। অথচ সরকার ঠান্ডা ঘরে বসে যা-ই দাবি করুক, প্রকৃত চিত্র কিন্তু আদৌ দারিদ্র্য-রেখা থেকে বেরিয়ে আসা মানুষের গৌরবময় উত্তরণের কথা বলছে না। গরিব আরও গরিব আর লুটপাটকারী ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে।
এ কথা ঠিক যে গোটা বিশ্বের ক্ষুধার সূচকের (গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স) প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের অবস্থা এখনো শোচনীয়। দেশে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা কিছুতেই কমছে না। উল্টো অনাহার ও খাদ্যের হাহাকার বাড়ছে।
আমাদের দেশে ক্ষুধা সূচক নিয়ে সরকার কিংবা বিরোধী দল—কেউই খুব একটা মাথা ঘামায় না। গরিব মানুষ তো ক্ষুধা সূচক বোঝেই না। খাবারের জোগাড় করতেই তারা জেরবার। নইলে ২০১৩ সালে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন তৈরি হওয়ার পর থেকেও আমাদের দেশে অপুষ্টি সমস্যার মোকাবিলায় কোনো বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি দেখেও রাজনৈতিক সমাজে কোনো আলোড়ন তৈরি হয়নি কেন? কিছু কিছু মানুষের বাড়িতে খাবার উপচে পড়ে, অথচ অনেক মানুষ ন্যূনতম খাবার পায় না। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প আছে। সেই প্রকল্পের সঠিক রূপায়ণ হলে গরিব মানুষের খাদ্যাভাব থাকারই কথা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাস্তব ছবিটা অন্য রকম। বিশেষজ্ঞরা এর কারণ হিসেবে মনে করেন, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, অবকাঠামোয় গলদ, অজ্ঞানতা আর প্রকল্প রূপায়ণে ত্রুটি। ফলে ক্ষুধা দূরীকরণে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাচ্ছে না; অর্থাৎ উপকরণ থাকা সত্ত্বেও বহু মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় কষ্ট পায়।
রাজনীতিকেরা আছেন তাঁদের নিজস্ব ধান্দায়। তাঁরা বিভিন্ন নন-ইস্যুকে ইস্যু করে রাজনীতির মাঠে ধুলা ওড়ানোর চেষ্টা করেন। বাংলাদেশ যেখানে আর্থিকভাবে শক্তিধর হতে চাইছে, ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সমানে উন্নয়নের খতিয়ান দিতে ব্যস্ত, সেখানে ক্ষুধা সূচকে কেন বাংলাদেশ পেছনে থাকবে? কেনই-বা একপেট ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যাবে বিপুলসংখ্যক মানুষ? আলোচ্য রিপোর্টেই আক্ষেপ করা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, খিদের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী লড়াই মোটেই ঠিক পথে এগোচ্ছে না। আশঙ্কা, এভাবে চললে সারা বিশ্ব, বিশেষ করে ৪৭টি দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধার হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সফল হতে পারবে না; অর্থাৎ ক্ষুধার রাজ্যে বাংলাদেশের মতো পৃথিবীও ক্রমে গদ্যময় হয়ে উঠবে।
ক্ষুধা নিয়ে আমাদের প্রত্যেকেরই দায় আছে। আছে করণীয়। সুমনের গানের কথায় বলতে হয়: ‘কেউ যদি বেশি খাও, খাবার হিসেব নাও/কেননা অনেক লোক ভালো করে খায় না;/খাওয়া না খাওয়ার খেলা, যদি চলে সারা বেলা/হঠাৎ কী ঘটে যায় কিচ্ছু বলা যায় না...’।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
৩ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৭ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৭ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৭ দিন আগে