বিশেষ শিশুদের ভবিষ্যৎ কী

বাসন্তি সাহা
প্রকাশ : ২৭ মে ২০২৪, ০৮: ১৭

আমি প্রতিদিন বাবিকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে অফিসে যাই। স্কুলের কম্পাউন্ডে ঢুকি না। ছুটির সময়ও আমি বাইরেই থাকি। কারণ ওখানে ২০ বছরের ছেলেরাও ভাষাহীন চোখে তাকিয়ে থাকে। দোলনায় দোল খায়। ছুটির সময় মা আসতে দেরি করলে চিৎকার করে কাঁদে। এই অভয়ারণ্যে শিশুরা জীবনচর্চা শেখার অনুশীলনে ব্যস্ত।

যদিও সম্ভাবনার গণ্ডি সীমিত; তবুও বাবা, মা, শিক্ষকেরা মিলে চেষ্টা করেন তার জীবনচর্চাটাকে সহজ করার জন্য। আমার যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে। আমি কেবল বাবিকে নামিয়ে দিই আর নিয়ে আসি। শুধু বলেছি, আমার বাবি যেন আদরে থাকে, আমার আর কোনো প্রত্যাশা নেই আপনাদের কাছে।

মাঝে মাঝে দু-একজন বাবা বা মা আমাকে ফোন করেন, ‘আমার বাচ্চাটা তিন বছরের, একটুও বসে না; সারাক্ষণ শুধু দৌড়াচ্ছে, অকারণে কাঁদছে; কোলে থাকতেই চায় না, আমাকে একটুও বসতে দেয় না, কোনো কিছু পেলে সেটা ঘোরাতে থাকে, এখনো কথা বলা শুরু করেনি, চোখের দিকেও তাকায় না; কী করব? আপনি কী করেছেন?’

আর দুই বছর আগে হলেও আমি গল্পের ঝাঁপি নিয়ে বসতাম তার সঙ্গে—কী করেছি, কী করতে হবে। আজ আর তা করি না। বলি, একজন চাইল্ড নিউরোলজিস্টকে দেখান। ঠিকানাও দিয়ে দিই কখনো।

পাশের ফ্ল্যাটের ভাবি হয়তো বলল, ‘আপনার ছেলের তো কোনো শব্দ পাই না। ও তো নিজের মতো থাকে। আমার ভাইয়ের ছেলেটা সারাক্ষণ চিৎকার করে। ওর মাকে একদণ্ড বসতে দেয় না।’ আমি চুপ করে শুনি, মা-বাবারা কখনো আশাহত হন—কেন আমি তাদের ম্যাজিকটা বলে দিলাম না!

আমরাও যখন বুঝতে পেরেছিলাম, ডাক্তার আমাদের বলেছিলেন, ওর অটিজম আছে, তখন ভেবেছিলাম এটা চার-পাঁচ বছরের জার্নি, তাই সবকিছু ছেড়ে দিয়ে ওকে নিয়েই পড়েছিলাম। স্পেশাল স্কুল, বাসায় স্পেশাল টিচার, মূলধারার স্কুলে গাইড টিচারের সহায়তা নিয়ে সেখানে রাখা, ছুটির দিনে পার্কে নিয়ে যাওয়া, বাসায় কথা বলা, গান শোনানো সব করেছি—তারপর একদিন শক্তি কমে এসেছে। মেনে নিতে শিখেছি, বাবিও শান্ত হয়েছে। কিছুটা বুঝেছে হয়তো নিজেকে কী করে চালাতে হবে। অথবা নিজেই নিজেকে মেনে নিয়েছে।

কম্পিউটারে বিভিন্ন রকম বিজ্ঞাপন দেখে হাসে, আবার কাঁদেও। পৃথিবীর আর কোনো সুখ-দুঃখ তাকে স্পর্শ করে না। কেবল দরকারমতো ওয়াশরুমে যায়, খেতে ইচ্ছে করলে খাবার টেবিলে গিয়ে বসে। কখনো নিজেই খাবার নিয়ে নেয়। সে জানে ঘরে কোথায় কী আছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অটিজম সোসাইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ১ শতাংশ অটিজম সমস্যায় ভুগছে। বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজারে ১৭ জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বা অটিজম আক্রান্ত মানুষ রয়েছে। ঢাকা শহরে এই শিশুদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু বিশেষায়িত সেবা দেওয়া বা সে রকম মানসম্মত স্কুল বাড়েনি। স্কুল প্রতিটি রাস্তার মোড়ে মোড়েই আছে, বিউটি পারলারের মতো।

সন্তানের অটিজম রয়েছে—এমন মা-বাবা অথবা শিক্ষক যাঁরা আগে এমন বিশেষায়িত স্কুলে কাজ করেছেন, তাঁরা কয়েকজন মিলে স্কুল করেছেন। বেশির ভাগ স্কুলেই প্রশিক্ষণহীন শিক্ষক যাঁরা খুব কম বেতনে এসব শিশুর সঙ্গে কাজ করছেন। আমার সন্তান কথা বলতে পারে না। তার স্পিচ থেরাপি দরকার। কটা স্পিচ থেরাপি ক্লাস পায় স্কুলে, জিজ্ঞেস করায় শিক্ষক বললেন—একজন স্পিচ থেরাপিস্ট।এতগুলো বাচ্চা। মাসে তিনি একটা সেশন পান।

বাবির অস্থিরতা বেড়েছে। বয়ঃসন্ধি চলছে। কী করব? বলি, আপনাদের অকুপেশনাল থেরাপিস্ট নেই? কী বলছেন তিনি? কী করলে কমবে এই অস্থিরতা?

‘আমাদের স্কুলে আপাতত অকুপেশনাল থেরাপিস্ট নেই। আমরা খুঁজছি, পেয়ে যাব।’ এ রকম অবস্থা বেশির ভাগ স্কুলের। বিশেষ শিশুদের পরিবেশ, জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া শেখাতে অনেক সাপোর্ট লাগে। মা-বাবা একা এটা পেরে ওঠেন না। স্কুলে দিলেও তাকে আনা-নেওয়া কখনো মায়ের পক্ষে ভীষণ কষ্টকর হয়। কখনো দেখি ছোট বাচ্চাটাকে বুকে বেঁধে নিয়েছেন বেল্ট দিয়ে, তারপর এই বিশেষ শিশুকে ধরে রিকশা খুঁজছেন।

এই শিশুর নিয়মিত চিকিৎসা, স্পেশাল স্কুল, স্পিচ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপির দরকার হয়; যা একটা সাধারণ পরিবারের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট বা স্পিচ থেরাপিস্ট প্রতি ৪৫ মিনিটের সেশনে ৮০০ বা তারও বেশি টাকা নেন। যে সময়টার বেশির ভাগ বাচ্চার স্থির হয়ে বসতে বসতে শেষ হয়ে যায়। থেরাপিস্টের এত সময় নেই।

পরবর্তী ৪৫ মিনিট বুক করা আছে আরেক বাচ্চার জন্য। কোনো কোনো থেরাপিস্টের সিরিয়াল পেতে রাত থেকে অপেক্ষা করতে হয়।আগেই বলেছি, প্রতিটি বড় রাস্তায় এই স্কুল আছে। স্কুলগুলো কতটুকু বিশেষায়িত সেবা দিতে পারে, সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। যদিও এগুলোর মাসিক টিউশন ফি ৭ থেকে ১৫ হাজার টাকা। যদিও জানি, বেশির ভাগ স্কুলে তিন-চারটি শিশুর জন্য একজন শিক্ষক থাকেন।

কখনো কখনো ‘ওয়ান টু ওয়ান’ সাপোর্টও থাকে। এই শিশুদের টয়লেট ও অন্যান্য সাপোর্টের জন্য আয়া দরকার হয়। গেটে দুজনকে রাখতে হয় এদের দেখেশুনে রাখার জন্য। ঢাকা শহরে বাড়িভাড়া নিয়ে এমন একটি স্কুল চালানোও ব্যয়বহুল। ফলে মা-বাবার খরচ বেড়ে যায়। সরকারি স্কুলে একীভূত শিক্ষার কথা বলা হলেও এ ধরনের শিশু মূলধারার স্কুলে টিকে থাকতে পারে না। অন্যান্য বেসরকারি স্কুলে বিশেষ শিশু ভর্তি করতে মা-বাবাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। এ অবস্থায় সরকার পরিচালিত বিশেষ স্কুল বাড়ানো দরকার।

যেখানে সরকারের সব ধরনের সহায়তায় দরিদ্র বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের বিশেষ শিশুরা স্কুলের সেবা পাবে, মা-বাবা একটু শ্বাস নিতে পারবেন। কেবল বিশেষ স্কুলের ব্যয়ভার বহন করতে পারবেন না বলে অনেকেই সন্তানদের বাড়িতে রেখে দিয়েছেন।

বিশেষ শিশুর জীবনযাপন, তার স্কুলে যাওয়া সবই ব্যয়বহুল। সাধারণ একটা পরিবারের পক্ষে এটা বহন করা দুঃসাধ্য। তবু এ আশায় তাঁরা চেষ্টা করে যান, একদিন তার ছেলেটা বা মেয়েটা ভালো হবে, কথা বলবে। তাই কেউ জমি বিক্রি করে মফস্বল থেকে এসে ঢাকার স্কুলে ভর্তি করান। কখনো ঢাকার বাইরে থেকে এসে থেরাপি করান। কিন্তু আমরা যারা অভিজ্ঞ বাবা-মা, তারা জানি এই জার্নি চার-পাঁচ বছরের নয়। এই যাত্রা দীর্ঘদিনের, কখনো সারা জীবনেরও হতে পারে। তাই রাষ্ট্রীয় সহায়তায় এ ধরনের বিশেষায়িত স্কুল ও সেবা বাড়ানো দরকার।তাদের পুনর্বাসন দরকার, নইলে কী হবে যখন তাদের মা-বাবা, আপনজন থাকবে না?

কোনো দুঃখ-বেদনাই অনন্তকাল থাকে না। হয় দুঃখ-বেদনা চলে যায় অথবা মানুষটাই চলে যায়। বিশেষ শিশুদের মা-বাবারা অনন্তকালের দিকে তাকিয়ে আছেন। যদিও তাঁরা জানেন, তাঁরা থাকবেন না; কিন্তু তাঁদের এই সন্তান, এই দুঃখ থাকবে। অন্তকালে তার একটা ভালো পরিণতি হবে, নিরাপদে থাকবে, সেটা অন্তত তাঁরা ভাবতে চান। এর শেষ কোথায়, আমরা কেউই জানি না।

লেখক: কো-অর্ডিনেটর, রিসার্চ অ্যান্ড ডকুমেন্টেশন, দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত