শাইখ সিরাজ
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কৃষির জন্য আশীর্বাদ। খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি আমাদের এখন নিরাপদ খাদ্য নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। বেশি উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা পরিবেশের দূষণ করেছি। পানি নষ্ট করেছি, বাতাস নষ্ট করেছি, মাটিকে করেছি অনুর্বর।
১৩ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ পত্রিকা ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার সম্পাদকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। সভার বিষয়, ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয়’। সেখানে আমার উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ তুলে ধরেন। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. আব্দুল মান্নান চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সম্পর্কে চমৎকার একটি প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন। তিনি তুলে ধরেন, প্রযুক্তির হাত ধরে ভবিষ্যৎ কোন দিকে হাঁটছে। আমার সম্পাদক বন্ধুরাও তাঁদের মতামত তুলে ধরেন। গণমাধ্যমের একজন হিসেবে আমি সেই সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিটিভি থেকে বর্তমান পর্যন্ত ভিডিও টেপের পরিবর্তনটাকে তুলে ধরেছি।
বিসিএন স্পুল থেকে ইউমেটিক টেপ, বেটা টেপ, ডিভি টেপ, এখন শেষে মেমোরি কার্ড। একটা ছোট চিপে রেকর্ড হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টার ভিডিও দৃশ্য। এটা শুধু একটা উদাহরণ। সবকিছুতেই এই পরিবর্তন এসেছে। যেহেতু আমার কাজের বড় একটা অংশ কৃষিকে নিয়ে। দেশ-বিদেশের কৃষি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আমি ভাবছিলাম বাংলাদেশের কৃষিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কতটুকু ভূমিকা রাখছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কতটুকু পথ আমরা হাঁটতে পেরেছি।
পাঠক, আপনি কি ১০০ গরুর মাঝে কোনো নির্দিষ্ট গরুকে চেহারা দেখে আলাদা করতে পারবেন? নিশ্চয়ই না। কিন্তু আধুনিক যন্ত্র ঠিকই গরুর মুখে ক্যামেরা ধরে বলে দিতে পারে গরুর নম্বর কত, গরুর শারীরিক অবস্থা কেমন, কী পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করেছে। প্রযুক্তি, বিশেষ করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) এবং আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) উৎপাদনব্যবস্থাকে নিয়ে যাচ্ছে অবিশ্বাস্য রকম এক প্রান্তে; যা কিছুদিন আগেও ছিল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, আজ তা চরম বাস্তব। একা একজনের পক্ষে একটি বিশাল খামার পরিচালনা করা কঠিন কাজ নয়। ২০১৮ সালে দেখেছি দক্ষিণ কোরিয়ার চুংনাম প্রভিন্সের থম্বক গ্রামে কিম নামের এক কৃষক দুই শতাধিক গরুর একটি খামার একাই পরিচালনা করছিলেন। অফিসকক্ষে বসে কম্পিউটারে সব নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। গরুর খাবার দেওয়া থেকে শুরু করে দুধ দোহানো, দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ সবই হচ্ছিল অটোমেটিক যন্ত্রের সাহায্যে।
একটা সময় ছিল বলা হতো, ‘নলেজ ইজ পাওয়ার’, এরপর সেটা পাল্টে গিয়ে বলা হতে থাকল, ‘ইনফরমেশন ইজ পাওয়ার’। আর এখন শুধু ইনফরমেশন থাকলেই হবে না, সে-ই বেশি শক্তিশালী, যে ইনফরমেশনকে যন্ত্রের ভাষায় দ্রুত রূপান্তরিত করে কাজে লাগাতে পারবে। তাই প্রতিযোগিতা এখন সময়ের ন্যূনতম এককে। ২০১৫ সালে নেদারল্যান্ডসে কাজ করতে গিয়ে দারুণ এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলাম। হার্লিন থেকে আলসমিয়েরে যাওয়ার পথে আমাদের গাইড হেলেন বলল, আলসমিয়েরে এখন বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি আরও ১৫ মিনিট পর থামবে। আমার কাছে বিষয়টা নতুন ছিল। কখন বৃষ্টি হবে, কতক্ষণ ধরে বৃষ্টি হবে, কতটুকু বৃষ্টি হবে, সেই হিসাব তাদের হাতের মুঠোয়। তখন ভাবছিলাম এ তথ্যটা যদি আমাদের কৃষকের হাতে থাকত! তাহলে কত সুবিধাই না হতো! ২০১৯ সালের এপ্রিলে নাটোরে ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
এ অনুষ্ঠানটি সাধারণত সন্ধ্যায় গ্রামের কোনো খোলা মাঠে হাজার হাজার কৃষক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের সরাসরি উপস্থিতিতে ধারণ করা হয়। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল, শীতল বাতাস বইছিল। বোঝা যাচ্ছিল কাছে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। আমি অনুষ্ঠানটি দীর্ঘায়িত করব কি না, এ দ্বিধায় ছিলাম। আমার সহকর্মীরা গুগল ওয়েদার দেখে বলল, ‘আটটার আগে এখানে বৃষ্টি হবে না। আপনি অনুষ্ঠান চালিয়ে যান।’ আটটার আগে আমি অনুষ্ঠান শেষ করলাম। ক্যামেরা গোছানো হলো। গাড়িতে উঠলাম। আর বৃষ্টি শুরু হলো। কোথায়, কখন, কতটুকু বৃষ্টি হবে, শুধু এ তথ্যটুকুই বাঁচিয়ে দিতে পারে কৃষকের হাজার টাকা। ফলে উৎপাদন খরচ কমে আসবে অনেকখানি।
২০১৭ সাল থেকে প্রতিবছর চীনের আন্তর্জাতিক কৃষি যন্ত্রপাতির মেলায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। প্রতিবছর গিয়েই অবাক হয়েছি নতুন নতুন যন্ত্র দেখে। যন্ত্রে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন ফিচার। ইউরোপ, আমেরিকা যে যন্ত্রটা তৈরি করছে, সেটার মূল্য হয়তো অনেক।
চীন মুহূর্তে সেটা কপি করে ফেলছে এবং অনেক কম মূল্যে বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে। চীন সেই দ্রুতগামী চিতা, যে সমগ্র পৃথিবীকে নিয়ে নিচ্ছে নিজের হাতের মুঠোয়। চীনারা নিজের ভাষার বাইরে গিয়ে অন্য ভাষায় খুব একটা পারদর্শী নয় বটে, কিন্তু যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার ভাষা ঠিকই বুঝে নিয়েছে। ওরা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের শেখাচ্ছে কীভাবে রোবট বানাতে হয়। শুধু তা-ই নয়, তারা আয়োজন করছে রোবট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যন্ত্র বানানো নিয়ে নানান প্রতিযোগিতার। এমন একটি আয়োজনে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল আমার চীনের চিংদাও শহরে। আমি অবাক হয়েছি ১২-১৩ বছরের কিশোর-কিশোরীরা সত্যি সত্যি দল বেঁধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নানান যন্ত্রপাতি তৈরি করেছে। যেমন একটা যন্ত্র হচ্ছে কমলাগাছ থেকে পাকা কমলা হার্ভেস্টের। একটা প্লাস্টিকের গাছে সবুজ ও কমলা রঙের কৃত্রিম কমলা ঝুলিয়ে দিয়ে দেখাল শিক্ষার্থীদের তৈরি মেশিন কীভাবে শুধু পাকা কমলাগুলো হার্ভেস্ট করে আনল। দেখে অভিভূত হয়েছি। আমাদের চ্যানেল আইয়ে একটি রিয়েলিটি শো ছিল, ‘এসো রোবট বানাই’। সারা দেশ থেকে শিক্ষার্থীদের বাছাই করে আনা হয়েছিল। সেখানে আমরা উন্নতমানের কোনো প্রোটোটাইপ বানাতে পারিনি অর্থের অভাবে। চীন বা অন্যান্য দেশে মেশিন উৎপাদনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগ করে এবং আবিষ্কৃত মেশিনটাও তারা কিনে নিয়ে ডেভেলপ করে। আমাদের দেশের কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসেনি এবং অর্থ বিনিয়োগেও তাদের কোনো ইচ্ছে নেই।
আমি মনে করি চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কৃষির জন্য আশীর্বাদ। খাদ্যনিরাপত্তার পাশাপাশি আমাদের এখন নিরাপদ খাদ্য নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। বেশি উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা পরিবেশের দূষণ করেছি। পানি নষ্ট করেছি, বাতাস নষ্ট করেছি, মাটিকে করেছি অনুর্বর। কিন্তু প্রযুক্তির কৃষির সম্প্রসারণ ঊর্ধ্বমুখী। একই সঙ্গে কম জায়গায় অধিক ফলন নিশ্চিত করছে। যেমন ধরা যাক আইপিআরএসের কথা। স্বাভাবিকভাবে পুকুরে যেখানে হেক্টরপ্রতি বছরে ১০ টন মাছ উৎপাদন সম্ভব। সেখানে আইপিআরএসে প্রতি হেক্টর থেকে বছরে ৯০ টন মাছ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে এবং সেখানে কোনো গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করতে হচ্ছে না। একই ভাবে বলা যায় গ্রিনহাউসে টমেটো বা স্ট্রবেরি উৎপাদনের কথা। প্রতিটি গাছ থেকে কী পরিমাণ ফলন আসবে, তা আগে থেকেই হিসাব করা। ফলে কৃষি মূলত ইন্ডাস্ট্রির রূপ পাচ্ছে। আর দুর্ভিক্ষ ও ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়তে এর বিকল্প নেই।
এশিয়ায় চীনের পর জাপান প্রযুক্তির কৃষিতে এগিয়ে। জাপানের কৃষি খাতে বর্তমানে প্রতি ১০ জন কৃষকের মধ্যে ৬ জনেরই বয়স ৬০ বছরের ওপর। ফলে জাপান সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেয়। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান দেশটির কৃষি ও কৃষি প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ শুরু করেছে। বৃহৎ পরিসরে ধান ও সবজি উৎপাদন এবং বিনিয়োগে নিয়োজিত রয়েছে ইয়োন সুপার মার্কেটিং চেইন, লসন ও সেভেন অ্যান্ড আই হোল্ডিংসের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো। জাপানে কৃষি উৎপাদন খাতে তথ্যপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগে অগ্রণী প্রতিষ্ঠান হলো ফুজিতসু। ২০১২ সালে ক্লাউডভিত্তিক তথ্য ব্যবস্থাপনা সেবা ‘আকিসাই’ চালুর মাধ্যমে এ খাতে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া এ খাতে বিনিয়োগ করেছে এইসি, হিটাসি, তোশিবা ও টয়োটার মতো জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। কনসাই অঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে প্যানাসনিক উদ্ভাবিত ‘প্যাসিভ হাউস’ নামে একধরনের গ্রিনহাউস ইদানীং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এতে চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় আলো, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ব্যত্যয় ঘটলেই সেন্সরে ধরা পড়ে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা সমন্বয় হয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতও প্রযুক্তির কৃষি নিয়ে অনেক দূর হাঁটার স্বপ্ন দেখছে। সেই তুলনায় আমরা খুব একটা এগোতে পারিনি। এসিআই ‘রুপালি’ প্রযুক্তির মাধ্যমে ‘প্যাটার্ন অ্যানালাইসিস’ আর ‘আইওটি’ ব্যবহার করে মৎস্যচাষিদের দিচ্ছে অটোমাইজড পরামর্শসেবা।
‘ফসলি’ নামেও ডিজিটাল কৃষিসেবা দিচ্ছে এসিআই। ‘মার্স’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান আবহাওয়ার তথ্য দিয়ে কৃষকদের সহায়তার জন্য নিজেদের সিস্টেম দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু কৃষক অবধি পৌঁছানো পর্যন্ত অবকাঠামো এখনো তৈরি করতে পারেনি। বাংলাদেশ সরকার সারা দেশে ৪ হাজার ৫০১টি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করেছে। এই ডিজিটাল সেন্টারগুলো ‘মার্স’-এর কাছ থেকে পাওয়া প্রতিদিনের আবহাওয়ার তথ্যটুকু কৃষকদের অবহিত করার কোনো সিস্টেম দাঁড় করাতে পারলে কৃষকেরা উপকৃত হতেন। গ্রামীণফোন ডিজি কাউ নামে একটা প্রযুক্তি শুরু করলেও এর প্রসার খুব একটা লক্ষ করা যাচ্ছে না। বিদেশি অর্থায়নে কয়েকটি প্রজেক্ট শুরু হলেও এখন বন্ধ হয়ে গেছে—এমন খবর পেয়েছি।
তবে আশার কথা হচ্ছে, তরুণেরা এগিয়ে আসছেন। তাঁরা আগামী পৃথিবীর পথে দেশকে নিয়ে হাঁটছেন অল্প অল্প করে। আমাদের উচিত হবে তাঁদের অনুপ্রেরণা দেওয়া এবং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও বেশি বিজ্ঞানমুখী করা। প্রযুক্তির গতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে, সবকিছুতেই পিছিয়ে পড়তে হবে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কৃষির জন্য আশীর্বাদ। খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি আমাদের এখন নিরাপদ খাদ্য নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। বেশি উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা পরিবেশের দূষণ করেছি। পানি নষ্ট করেছি, বাতাস নষ্ট করেছি, মাটিকে করেছি অনুর্বর।
১৩ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ পত্রিকা ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার সম্পাদকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। সভার বিষয়, ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয়’। সেখানে আমার উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ তুলে ধরেন। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. আব্দুল মান্নান চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সম্পর্কে চমৎকার একটি প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন। তিনি তুলে ধরেন, প্রযুক্তির হাত ধরে ভবিষ্যৎ কোন দিকে হাঁটছে। আমার সম্পাদক বন্ধুরাও তাঁদের মতামত তুলে ধরেন। গণমাধ্যমের একজন হিসেবে আমি সেই সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিটিভি থেকে বর্তমান পর্যন্ত ভিডিও টেপের পরিবর্তনটাকে তুলে ধরেছি।
বিসিএন স্পুল থেকে ইউমেটিক টেপ, বেটা টেপ, ডিভি টেপ, এখন শেষে মেমোরি কার্ড। একটা ছোট চিপে রেকর্ড হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টার ভিডিও দৃশ্য। এটা শুধু একটা উদাহরণ। সবকিছুতেই এই পরিবর্তন এসেছে। যেহেতু আমার কাজের বড় একটা অংশ কৃষিকে নিয়ে। দেশ-বিদেশের কৃষি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আমি ভাবছিলাম বাংলাদেশের কৃষিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কতটুকু ভূমিকা রাখছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কতটুকু পথ আমরা হাঁটতে পেরেছি।
পাঠক, আপনি কি ১০০ গরুর মাঝে কোনো নির্দিষ্ট গরুকে চেহারা দেখে আলাদা করতে পারবেন? নিশ্চয়ই না। কিন্তু আধুনিক যন্ত্র ঠিকই গরুর মুখে ক্যামেরা ধরে বলে দিতে পারে গরুর নম্বর কত, গরুর শারীরিক অবস্থা কেমন, কী পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করেছে। প্রযুক্তি, বিশেষ করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) এবং আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) উৎপাদনব্যবস্থাকে নিয়ে যাচ্ছে অবিশ্বাস্য রকম এক প্রান্তে; যা কিছুদিন আগেও ছিল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, আজ তা চরম বাস্তব। একা একজনের পক্ষে একটি বিশাল খামার পরিচালনা করা কঠিন কাজ নয়। ২০১৮ সালে দেখেছি দক্ষিণ কোরিয়ার চুংনাম প্রভিন্সের থম্বক গ্রামে কিম নামের এক কৃষক দুই শতাধিক গরুর একটি খামার একাই পরিচালনা করছিলেন। অফিসকক্ষে বসে কম্পিউটারে সব নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। গরুর খাবার দেওয়া থেকে শুরু করে দুধ দোহানো, দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ সবই হচ্ছিল অটোমেটিক যন্ত্রের সাহায্যে।
একটা সময় ছিল বলা হতো, ‘নলেজ ইজ পাওয়ার’, এরপর সেটা পাল্টে গিয়ে বলা হতে থাকল, ‘ইনফরমেশন ইজ পাওয়ার’। আর এখন শুধু ইনফরমেশন থাকলেই হবে না, সে-ই বেশি শক্তিশালী, যে ইনফরমেশনকে যন্ত্রের ভাষায় দ্রুত রূপান্তরিত করে কাজে লাগাতে পারবে। তাই প্রতিযোগিতা এখন সময়ের ন্যূনতম এককে। ২০১৫ সালে নেদারল্যান্ডসে কাজ করতে গিয়ে দারুণ এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলাম। হার্লিন থেকে আলসমিয়েরে যাওয়ার পথে আমাদের গাইড হেলেন বলল, আলসমিয়েরে এখন বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি আরও ১৫ মিনিট পর থামবে। আমার কাছে বিষয়টা নতুন ছিল। কখন বৃষ্টি হবে, কতক্ষণ ধরে বৃষ্টি হবে, কতটুকু বৃষ্টি হবে, সেই হিসাব তাদের হাতের মুঠোয়। তখন ভাবছিলাম এ তথ্যটা যদি আমাদের কৃষকের হাতে থাকত! তাহলে কত সুবিধাই না হতো! ২০১৯ সালের এপ্রিলে নাটোরে ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
এ অনুষ্ঠানটি সাধারণত সন্ধ্যায় গ্রামের কোনো খোলা মাঠে হাজার হাজার কৃষক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের সরাসরি উপস্থিতিতে ধারণ করা হয়। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল, শীতল বাতাস বইছিল। বোঝা যাচ্ছিল কাছে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। আমি অনুষ্ঠানটি দীর্ঘায়িত করব কি না, এ দ্বিধায় ছিলাম। আমার সহকর্মীরা গুগল ওয়েদার দেখে বলল, ‘আটটার আগে এখানে বৃষ্টি হবে না। আপনি অনুষ্ঠান চালিয়ে যান।’ আটটার আগে আমি অনুষ্ঠান শেষ করলাম। ক্যামেরা গোছানো হলো। গাড়িতে উঠলাম। আর বৃষ্টি শুরু হলো। কোথায়, কখন, কতটুকু বৃষ্টি হবে, শুধু এ তথ্যটুকুই বাঁচিয়ে দিতে পারে কৃষকের হাজার টাকা। ফলে উৎপাদন খরচ কমে আসবে অনেকখানি।
২০১৭ সাল থেকে প্রতিবছর চীনের আন্তর্জাতিক কৃষি যন্ত্রপাতির মেলায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। প্রতিবছর গিয়েই অবাক হয়েছি নতুন নতুন যন্ত্র দেখে। যন্ত্রে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন ফিচার। ইউরোপ, আমেরিকা যে যন্ত্রটা তৈরি করছে, সেটার মূল্য হয়তো অনেক।
চীন মুহূর্তে সেটা কপি করে ফেলছে এবং অনেক কম মূল্যে বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে। চীন সেই দ্রুতগামী চিতা, যে সমগ্র পৃথিবীকে নিয়ে নিচ্ছে নিজের হাতের মুঠোয়। চীনারা নিজের ভাষার বাইরে গিয়ে অন্য ভাষায় খুব একটা পারদর্শী নয় বটে, কিন্তু যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার ভাষা ঠিকই বুঝে নিয়েছে। ওরা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের শেখাচ্ছে কীভাবে রোবট বানাতে হয়। শুধু তা-ই নয়, তারা আয়োজন করছে রোবট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যন্ত্র বানানো নিয়ে নানান প্রতিযোগিতার। এমন একটি আয়োজনে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল আমার চীনের চিংদাও শহরে। আমি অবাক হয়েছি ১২-১৩ বছরের কিশোর-কিশোরীরা সত্যি সত্যি দল বেঁধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নানান যন্ত্রপাতি তৈরি করেছে। যেমন একটা যন্ত্র হচ্ছে কমলাগাছ থেকে পাকা কমলা হার্ভেস্টের। একটা প্লাস্টিকের গাছে সবুজ ও কমলা রঙের কৃত্রিম কমলা ঝুলিয়ে দিয়ে দেখাল শিক্ষার্থীদের তৈরি মেশিন কীভাবে শুধু পাকা কমলাগুলো হার্ভেস্ট করে আনল। দেখে অভিভূত হয়েছি। আমাদের চ্যানেল আইয়ে একটি রিয়েলিটি শো ছিল, ‘এসো রোবট বানাই’। সারা দেশ থেকে শিক্ষার্থীদের বাছাই করে আনা হয়েছিল। সেখানে আমরা উন্নতমানের কোনো প্রোটোটাইপ বানাতে পারিনি অর্থের অভাবে। চীন বা অন্যান্য দেশে মেশিন উৎপাদনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগ করে এবং আবিষ্কৃত মেশিনটাও তারা কিনে নিয়ে ডেভেলপ করে। আমাদের দেশের কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসেনি এবং অর্থ বিনিয়োগেও তাদের কোনো ইচ্ছে নেই।
আমি মনে করি চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কৃষির জন্য আশীর্বাদ। খাদ্যনিরাপত্তার পাশাপাশি আমাদের এখন নিরাপদ খাদ্য নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। বেশি উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা পরিবেশের দূষণ করেছি। পানি নষ্ট করেছি, বাতাস নষ্ট করেছি, মাটিকে করেছি অনুর্বর। কিন্তু প্রযুক্তির কৃষির সম্প্রসারণ ঊর্ধ্বমুখী। একই সঙ্গে কম জায়গায় অধিক ফলন নিশ্চিত করছে। যেমন ধরা যাক আইপিআরএসের কথা। স্বাভাবিকভাবে পুকুরে যেখানে হেক্টরপ্রতি বছরে ১০ টন মাছ উৎপাদন সম্ভব। সেখানে আইপিআরএসে প্রতি হেক্টর থেকে বছরে ৯০ টন মাছ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে এবং সেখানে কোনো গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করতে হচ্ছে না। একই ভাবে বলা যায় গ্রিনহাউসে টমেটো বা স্ট্রবেরি উৎপাদনের কথা। প্রতিটি গাছ থেকে কী পরিমাণ ফলন আসবে, তা আগে থেকেই হিসাব করা। ফলে কৃষি মূলত ইন্ডাস্ট্রির রূপ পাচ্ছে। আর দুর্ভিক্ষ ও ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়তে এর বিকল্প নেই।
এশিয়ায় চীনের পর জাপান প্রযুক্তির কৃষিতে এগিয়ে। জাপানের কৃষি খাতে বর্তমানে প্রতি ১০ জন কৃষকের মধ্যে ৬ জনেরই বয়স ৬০ বছরের ওপর। ফলে জাপান সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেয়। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান দেশটির কৃষি ও কৃষি প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ শুরু করেছে। বৃহৎ পরিসরে ধান ও সবজি উৎপাদন এবং বিনিয়োগে নিয়োজিত রয়েছে ইয়োন সুপার মার্কেটিং চেইন, লসন ও সেভেন অ্যান্ড আই হোল্ডিংসের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো। জাপানে কৃষি উৎপাদন খাতে তথ্যপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগে অগ্রণী প্রতিষ্ঠান হলো ফুজিতসু। ২০১২ সালে ক্লাউডভিত্তিক তথ্য ব্যবস্থাপনা সেবা ‘আকিসাই’ চালুর মাধ্যমে এ খাতে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া এ খাতে বিনিয়োগ করেছে এইসি, হিটাসি, তোশিবা ও টয়োটার মতো জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। কনসাই অঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে প্যানাসনিক উদ্ভাবিত ‘প্যাসিভ হাউস’ নামে একধরনের গ্রিনহাউস ইদানীং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এতে চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় আলো, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ব্যত্যয় ঘটলেই সেন্সরে ধরা পড়ে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা সমন্বয় হয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতও প্রযুক্তির কৃষি নিয়ে অনেক দূর হাঁটার স্বপ্ন দেখছে। সেই তুলনায় আমরা খুব একটা এগোতে পারিনি। এসিআই ‘রুপালি’ প্রযুক্তির মাধ্যমে ‘প্যাটার্ন অ্যানালাইসিস’ আর ‘আইওটি’ ব্যবহার করে মৎস্যচাষিদের দিচ্ছে অটোমাইজড পরামর্শসেবা।
‘ফসলি’ নামেও ডিজিটাল কৃষিসেবা দিচ্ছে এসিআই। ‘মার্স’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান আবহাওয়ার তথ্য দিয়ে কৃষকদের সহায়তার জন্য নিজেদের সিস্টেম দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু কৃষক অবধি পৌঁছানো পর্যন্ত অবকাঠামো এখনো তৈরি করতে পারেনি। বাংলাদেশ সরকার সারা দেশে ৪ হাজার ৫০১টি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করেছে। এই ডিজিটাল সেন্টারগুলো ‘মার্স’-এর কাছ থেকে পাওয়া প্রতিদিনের আবহাওয়ার তথ্যটুকু কৃষকদের অবহিত করার কোনো সিস্টেম দাঁড় করাতে পারলে কৃষকেরা উপকৃত হতেন। গ্রামীণফোন ডিজি কাউ নামে একটা প্রযুক্তি শুরু করলেও এর প্রসার খুব একটা লক্ষ করা যাচ্ছে না। বিদেশি অর্থায়নে কয়েকটি প্রজেক্ট শুরু হলেও এখন বন্ধ হয়ে গেছে—এমন খবর পেয়েছি।
তবে আশার কথা হচ্ছে, তরুণেরা এগিয়ে আসছেন। তাঁরা আগামী পৃথিবীর পথে দেশকে নিয়ে হাঁটছেন অল্প অল্প করে। আমাদের উচিত হবে তাঁদের অনুপ্রেরণা দেওয়া এবং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও বেশি বিজ্ঞানমুখী করা। প্রযুক্তির গতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে, সবকিছুতেই পিছিয়ে পড়তে হবে।
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৬ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৬ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৬ দিন আগে