শিক্ষায় কত অভিঘাত

মামুনুর রশীদ
প্রকাশ : ০৮ জুন ২০২৩, ১০: ০১

স্বাধীনতা শব্দটির সঙ্গে একদা দ্রুত যুক্ত হয়ে গিয়েছিল আরও কয়েকটি শব্দ—ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ইত্যাদি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই সব শব্দের ওপর একের পর এক আক্রমণে আমরা দিশাহারা হয়ে যাই। সবচেয়ে বেশি আক্রমণ হয় ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িক শব্দটির ওপর। সামরিক শাসন আসার পর গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র তো গেলই, পরের আক্রমণটা ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর। সংবিধান থেকেই এর যাত্রা শুরু।

এরপর স্বাধীনতাবিরোধীদের ভোঁতা অস্ত্র ধারালো হতে থাকল। ক্ষেত্র হিসেবে তারা বেছে নেয় শিক্ষাকে। সহজ পথই তাদের জন্য যেটি খোলা ছিল, সেটি হলো মাদ্রাসা শিক্ষা। আমরা সেই পাকিস্তান আমলে কিছু মাদ্রাসা দেখেছি, যেখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি ইংরেজি, বাংলা, গণিত ও অন্যান্য বিষয়ও পড়ানো হতো। যেহেতু মাদ্রাসাগুলোতে আবাসিক ব্যবস্থা ছিল এবং লেখাপড়া ভালোই হতো, তাই মেধাবী ছেলেরা একটু বড় হয়ে সাধারণ স্কুলে (হাইস্কুল/ হাই ইংলিশ স্কুল) ভর্তি হয়ে যেত। পরবর্তীকালে তারা প্রবেশিকা বা এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করে বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করত।

এরও আগে একেবারে ব্রিটিশ আমলে মাদ্রাসাগুলোতে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের ছেলেরাই লেখাপড়া করত। এই যে সামরিক শাসনামলে যার গোড়াপত্তন হলো, তা দিন দিন বিকশিত হতে হতে অসংখ্য মাদ্রাসার জন্ম দিতে শুরু করল। মাদ্রাসায় নতুনভাবে যুক্ত হলো মহিলা মাদ্রাসা। যেখানে হাজার হাজার মেয়ে ভর্তি হতে শুরু করল। যার একটা ভয়ংকর ফলাফল দেখা গেল ফেনীসহ বহু এলাকায়।

যেকোনো ধর্মের মধ্যেই নানা ধরনের মতবাদ থাকে, সেই মতবাদ নিয়ে কোনো আপস চলে না; বরং যুদ্ধবিগ্রহও হতে থাকে। সেই সব মতবাদকে ভিত্তি করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠে। তবে বাংলাদেশে মাদ্রাসার যে ব্যাপকতা বেড়েছে তা হলো, কওমি মাদ্রাসা। এই মাদ্রাসার অর্থায়ন সরকারি খাত থেকে হয় না। সাধারণত কোনো ধনাঢ্য ব্যক্তি এখানে অর্থায়ন করে থাকে। তার আয়ের উৎস নিয়ে কোনো প্রশ্ন কেউ করে না। এমনকি সরকারও না। তারা যুক্ত হয়ে যায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে, প্রকারান্তরে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। ওখানে কী ধরনের শিক্ষা দেওয়া হয়, তা-ও জানার উপায় থাকে না।

প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সরকারের নজরদারি থাকে। সেই সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে যেসব মাদ্রাসা, তার ওপরও একটা নিয়ন্ত্রণ থাকে। কিন্তু কওমি মাদ্রাসা বা আরও কিছু নতুন ধরনের মাদ্রাসার ওপর রাষ্ট্রের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

হঠাৎ করেই একদিন ভোরে রাজধানীর শাপলা চত্বরে দেখা গেল হাজার হাজার শিশু-কিশোর-যুবা-প্রবীণ-বৃদ্ধের সমাবেশ। তাদের দাবি-দাওয়া সব রাজনৈতিক, যার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার লেশমাত্র নেই।

বিরোধী দলের নেতারাও যুক্ত হয়ে গেলেন। এমনভাবে সেই সমাবেশ জমে উঠতে থাকল, যেন রাজধানীই তাদের দখলে চলে যাবে। সে সময় গণজাগরণ মঞ্চ চলছিল। একটা পর্যায়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌল আদর্শভিত্তিক ওই মঞ্চই সমাবেশকারীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলো।

সেদিন শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় আমার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক ‘টার্গেট প্লাটুন’ চলছিল। হঠাৎ লক্ষ করলাম, অভিনয়ের আগে আগে লাঠিসোঁটা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি তাদের আক্রমণের দ্বিতীয় লক্ষ্যবস্তুতে চিহ্নিত হলো। শিল্পকলা একাডেমির নিরাপত্তা বাহিনী ও পুলিশ এবং সংস্কৃতিকর্মীদের মিলিত প্রতিরোধে তারা ঢুকতে পারেনি। শুধু যে দৈহিক আক্রমণ তা-ই নয়, তার সঙ্গে ছিল ওদের পরিচালিত সামাজিক গণমাধ্যমে উসকানিমূলক বক্তব্য। তাদের কর্মকাণ্ডে বোঝা গেল, তারা একটা প্রশিক্ষিত বাহিনীও তৈরি করে ফেলেছে। সরকার সে সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় সেই সমাবেশ ভেঙে দিয়েছিল। কিন্তু লড়াইটা চলতে লাগল রাজধানীর বাইরেও অনেক জায়গায়।

এরপর তারা আপাতত রণে ভঙ্গ দিলেও দাবিদাওয়া থেকে সরে গেল না। তাদের আক্রমণের ক্ষেত্র হয়ে গেল শিক্ষা। পাঠ্যপুস্তকে তারা হাত দিল। সরকার এ সময় বেশ কিছু ক্ষেত্রে আপসও করে নিল। বোঝা গেল এই মাদ্রাসাগুলোর উদ্দেশ্যের মধ্যে শিক্ষা একটা বাতাবরণ মাত্র। প্রধান উদ্দেশ্য রাজনৈতিক। সুদীর্ঘ সময় ধরে তারা গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকভাবে কাজ করেছে সমাজের দরিদ্র ও অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে, যেখানে মূলধারার কোনো রাজনৈতিক দলও কখনো পৌঁছায়নি; বিশেষ করে নারীদের মধ্যে কাজ করে তাদের হিজাব-বোরকা পরিয়ে মাদ্রাসার ছাত্রী করতে সক্ষম হয়েছে। এই মাদ্রাসার ছাত্রী বা শিক্ষকেরা তাদের রাজনৈতিক ভাবনাকে ধর্মের মোড়কে বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে।

সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, প্রগতিশীল দলগুলো তাদের কর্মকাণ্ড আলাপ-আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের এলাকা সংকুচিত হয়ে গেছে। গ্রামাঞ্চলের নারীদের সংস্কৃতি চিন্তা শহরকেও গ্রাস করেছে। পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রাচীন মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরেছে। শুধু নারী নয়, অত্যন্ত সুকৌশলে তরুণ সমাজকেও এর মধ্যে তারা যুক্ত করতে পেরেছে।

আফগানিস্তানে তালেবানি শাসন কায়েম হওয়ার পর সেখানকার নারীদের অবস্থান ও সামাজিক পশ্চাৎপদতা দেখার পরও কোথাও উচ্চারিত হচ্ছে, ‘বাংলা হবে আফগান’। দুঃখজনক হলেও এ কথা চরম সত্য যে দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন মানেই যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা দখল। এই ক্ষমতা দখলের প্রবল লড়াইয়ে উপেক্ষিত হচ্ছে সমাজ। সামাজিক মূল্যবোধ, মানবিক সমাজ গড়ার কোনো তাগিদই মূলধারার রাজনীতি উপলব্ধি করে না; বরং সর্বত্র শুধুই রাজনৈতিক দলকেন্দ্রিক বিভাজন। সমাজে এত বিভক্তি যে কোনো ন্যায্য প্রশ্নেও মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। এই সুযোগে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারই মুখ্য হয়ে পড়ছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত একজন শিশুকে পরিপূর্ণ মানুষ করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, সেই পথকে অনুসরণ করা। পৃথিবীটা হবে তার কাছে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষের আবাসভূমি। সেখানে যেকোনো খণ্ডিত ব্যবস্থা তাকে খণ্ডিত মানুষ হিসেবেই গড়ে তুলবে। অর্থ ও জৈবিক তাড়নায় নব্য ধনীরা একধরনের উদ্দেশ্যহীন সমাজ সৃষ্টি করার প্রয়াসে লিপ্ত হয়েছে। নিজেদের সন্তানসন্ততিদের তারা শিখিয়েছে—এ দেশ বাসের যোগ্য নয়। তাই তারা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করতে মরিয়া। লোকগুলোর মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাস নেই। কিন্তু ধর্মীয় আচার-আচরণে তাদের খুবই উৎসাহ। অবৈধ অর্থ, লুটপাটের টাকা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে, ভেজাল দিয়ে অর্থ উপার্জন করে মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণে তাদের আগ্রহ। কওমি মাদ্রাসার অর্থায়নও তারাই করে থাকে। তারাই এলাকার সংসদ সদস্য হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে লেগে আছে।

সৎ, পরিশ্রমলব্ধ উপার্জন করে যখন মানুষ দুবেলা দুমুঠো খেতে পারে না, ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ রচনা করতে পারে না, তখন অদৃষ্টবাদী হয়ে সন্তানকে মাদ্রাসায় দেওয়া ছাড়া কোনো পথ খুঁজে পায় না। এসব থেকে মানুষ মুক্ত হতে পারত যদি সঠিক শিক্ষা তাকে দেওয়া যেত। অবশ্যই কওমি মাদ্রাসা কোনো পথ নয়, কিন্তু সেদিকে কি দেশের সরকার বা রাজনীতিবিদদের কোনো ভাবনা আছে? আর উপেক্ষিত হয়েছে আবহমানকালের হাজার বছরের সংস্কৃতি। তার চর্চার জায়গা সংকুচিত।

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত