মামুনুর রশীদ
বাজেট নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। সপ্তাহ দেড়েক ধরে পত্রপত্রিকায়, টেলিভিশনে, সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন সভা-সেমিনারে, প্রকাশনায় আলোচনার বিষয়বস্তুর শীর্ষে আছে বাজেট। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি একটি বৃহৎ পুস্তিকাও বের করে ফেলেছে। বাজেট নিয়ে এই ব্যাপক আলোচনা একদিক থেকে অত্যন্ত ইতিবাচক। এই আলোচনার মধ্য দিয়ে আমাদের সাধারণ জ্ঞান বাড়ে, অর্থনীতি সম্পর্কে একটা উৎসাহ জাগে। অনেকটা আমাদের দেশের রাজনীতির মতো। এত বেশি রাজনীতিসচেতন মানুষ পৃথিবীর কোথাও আছে বলে মনে হয় না।
কিন্তু ফলাফলটি ইতিবাচক নয়। আগে আমরা বাজেট বলতে বুঝতাম, জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে কিছু কিছু জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করে। কিন্তু কোনো জিনিসেরই দাম কমে না। এখনো তাই। এবার অবশ্য ব্যবসায়ীবান্ধব বাজেটে রাষ্ট্র অনেক সুযোগ-সুবিধা করে দিয়েছে। বাজেটের দুই মাস আগে থেকেই জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁইছুঁই। সরকারের মন্ত্রীরা নানা রকম হুঁশিয়ারি দেওয়া সত্ত্বেও অকারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে চলেছে। যদিও দুটিই আমদানি করতে হয়। জ্বালানি তেলের দাম বাড়েনি। কিন্তু ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে চলেছে। সবজির দাম বেড়েছে এবং অদ্ভুত কাণ্ড, চালের ভরা মৌসুমে চালের দাম বেড়েছে।
দেখা যায়, বাজেটের ৩২ শতাংশ খরচ হয় পেনশন ও সঞ্চয়পত্রের সুদে। আরও একটি বড় অংশ খরচ হয়ে যায় জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং নানা সুযোগ-সুবিধায়। শুধু তা-ই নয়, উপসচিব থেকে মুখ্য সচিব পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তারা সুদমুক্ত ঋণ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। প্রতি মাসে ড্রাইভারের বেতন, তেলের খরচ এবং গাড়ি মেরামতের জন্য প্রত্যেক কর্মকর্তাকে ৪৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া আছে গৃহনির্মাণ ঋণ এবং আরও বহুবিধ ভাতায় আমাদের রাষ্ট্র জর্জরিত।
তারপরও আছে বিরাট অংশ, এই সব কর্মকর্তার ঘুষের জন্য বরাদ্দ। আমলাশাসিত এই বাজেট শুধু বছরের পর বছর আমলাদেরই কল্যাণের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এর বাইরে যে বৃহৎ জনগোষ্ঠী, তাদের কল্যাণের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ হয়, তা একেবারেই অপ্রতুল। কখনো কখনো লোকদেখানো। আমলারা রাষ্ট্রের কাজে সভা করেন। প্রতিদিনই তাঁরা কোনো না কোনো সভায় ব্যস্ত থাকেন। মুখস্থবিদ্যায় চাকরি পাওয়া এসব আমলা কোনো সৃজনশীল ক্ষমতা ছাড়াই দিনের পর দিন এই সভাগুলোতে উপস্থিত হয়ে বিপুল অর্থ ব্যয়ে নাশতা-পানি খেয়ে একটি প্যাকেট নিয়ে ফেরেন। দিনে এ রকম প্যাকেটের সংখ্যা কত হয় তা কি বাজেট বরাদ্দের মধ্যে থাকে? হয়তো সচিবালয়ের মধ্যে থাকলে থাকতেও পারে, কিন্তু বাইরের সংস্থাগুলোয় বাইরের বাজেটে তা থাকে না।
এরপরও জেলা প্রশাসনে আছে এলআর ফান্ড, সার্কিট হাউসের অতিথি আপ্যায়ন—এসব কাজে ওই অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে। জনপ্রশাসন একটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল বিভাগ। তৃণমূল থেকে শুরু করে একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত কোটি টাকার নিচে কোনো গাড়ি নেই। গাড়ির তেল খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত, ড্রাইভারের ওভারটাইম—এসব মিলে বিপুল অর্থ খরচ হয়ে যায়। বাজেটে এসব বিষয় সুরক্ষিত।
তেমনি সুরক্ষিত সেনাবাহিনীর বাজেট। কিন্তু অরক্ষিত হচ্ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতিসহ জনস্বার্থের এবং সুদূরপ্রসারী উন্নয়নের বিষয়গুলো। বাজেট একেবারে শক্তভাবে কখনোই নিয়ন্ত্রিত নয়। আছে থোক বরাদ্দের নিয়ম। অর্থমন্ত্রী এখানে সর্বেসর্বা। তিনি তাঁর ইচ্ছামতো কোনো খাতে বরাদ্দ বাড়াতে পারেন। রাষ্ট্রে কম্পট্রোলার জেনারেল বলে একটি সাংবিধানিক পদ আছে। এ পদটি একমাত্র রাষ্ট্রপতির কাছে বা সংসদের কাছে জবাবদিহি করে থাকে। রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের হিসাবের ওপর তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। খবরের কাগজে বা মিডিয়ায় অন্য সাংবিধানিক পদে নিয়োজিত ব্যক্তিদের নানা ধরনের মতামত এবং সংবাদ প্রকাশিত হয়। কিন্তু কম্পট্রোলার জেনারেলের কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয় না। তার মানে তাঁর কর্মকাণ্ড হতে পারে খুব গোপনীয় অথবা তিনি অবহেলিত। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় দ্বিতীয়টি হওয়াই স্বাভাবিক।
বাজেটে শিক্ষা খাতে কয়েক বছর ধরে একটা স্থিতাবস্থা লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষা ও সংস্কৃতির খাতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকা উচিত। কারণ, শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা যে কতটা পিছিয়ে তার প্রমাণ মিলবে সম্প্রতি গবেষণায় এসেছে পৃথিবীর ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই, তদুপরি বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েরই নাম নেই এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা ঘটছে, তাতে ছাত্র ও শিক্ষকের শিক্ষার মান, তাদের মূল্যবোধ—এসবেরই প্রমাণ মেলে। আর জোর করে শিক্ষিত করার প্রচেষ্টায় তৃণমূল পর্যায় থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার মান এত নিম্নমুখী যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তির জন্য উপযুক্ত একজন ছাত্রও পাওয়া যায় না। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে গত ৫০ বছরে যে ইতিহাস পাওয়া যায়, তা একটি জাতির দেউলিয়াপনাকেই প্রমাণ করে। ২০ বছর ধরে যদিও এ ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নয়ন সাধিত হয়েছে; তবু প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। শিক্ষাক্ষেত্রে লাগামহীন দুর্নীতি, সরকারি-বেসরকারি স্কুলের প্রশাসনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিপরায়ণতায় পর্যুদস্ত। শিক্ষকতা পেশা এখন আর মহৎ পেশা নয়। দক্ষ ও অদক্ষ শিক্ষকেরা কোচিং-বাণিজ্য করে বিপুল অর্থের মালিক। তৃণমূলের শিক্ষা প্রশাসন থেকে শুরু করে একেবারেই উচ্চপর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতিতে ভরা। বেশি বাজেট দিলে দুর্নীতিও বাড়ে। নানা ধরনের শিক্ষা কমিশন করে কোনো লাভ হয়নি; বরং কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনটি থাকলে হয়তো এই ক্ষেত্রে ভালো ফল পাওয়া যেত।
আমার স্কুলের শতবর্ষ উদ্যাপনে গিয়েছিলাম। আমরা টিনের ঘরে যেখানে পড়ালেখা করেছি, এখন সেখানে অট্টালিকা গড়ে উঠেছে, ইতিমধ্যেই সেখানে ফাটল দেখা দিয়েছে। আশপাশে নদী ও খাল ভরাট করে দেওয়া হয়েছে, গাছপালা কেটে একটা মরুভূমির রূপ নিয়েছে। স্কুলের টিনের ঘরের সেই লেখাপড়ায় শিক্ষকেরা ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ আর এখনকার শিক্ষকেরা শিক্ষার মান উন্নয়নে একেবারেই অনাগ্রহী।
স্বাস্থ্য খাতটি নানা দুর্দশায় জর্জরিত। দুটি ক্ষেত্রেই বাণিজ্য প্রবল, সেবা অবহেলিত। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মাদ্রাসাশিক্ষা এসেছে। মাদ্রাসাশিক্ষার ছাত্ররা এখন প্রাথমিকে ও উচ্চমাধ্যমিকে চাকরিপ্রত্যাশী হচ্ছে। ওখানে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের সঙ্গে মাদ্রাসার ছাত্রদের একটা দ্বন্দ্ব প্রথম থেকেই শুরু হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই স্কুলগুলোতে পড়ালেখা হয় না, শিক্ষকেরা ছাত্রদের পাঠিয়ে দেন নিজেদের প্রতিষ্ঠিত কোচিং সেন্টারে। স্বাস্থ্যব্যবস্থায় শুধু ডাক্তার নয়, এর সঙ্গে জড়িত থাকে প্রশাসন এবং সেই প্রশাসন আমলাশাসিত। বিসিএস পাস করা একজন ডাক্তারকে যদি তাঁর চেয়ে কম বয়স্ক কোনো প্রশাসনিক কর্মকর্তার নির্দেশ মানতে হয় এবং স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বোচ্চ পদগুলো যদি প্রশাসনের হাতে থাকে, তাহলে এ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বাজেটের জন্য প্রতিবছরই নানান কথাবার্তা হয়, কিন্তু বাজেট বাড়ে না। অথচ বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও গণতন্ত্রের উত্তরণের পথে সংস্কৃতিকর্মীদের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। সেই ভূমিকাকে পাশ কাটিয়ে তাদের একটা অবহেলার পর্যায়ে রেখে দেওয়া, মানে বাংলার সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করা। সর্বদাই শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ঘাপটি মারা কিছু সংস্কৃতিবিরোধী লোক থাকে। এই লোকগুলো মৌলবাদী সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। মুখস্থবিদ্যায় চাকরি পেয়ে সৃজনহীন, স্বপ্নহীন কিছু লোক রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে শুরু করে হুমায়ুন আজাদকে পর্যন্ত শত্রু ভেবে কাজ করতে থাকেন। তাঁদের চিহ্নিত করার কোনো উদ্যোগ আজ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা নিজেকে বঞ্চিত মনে করেন। সরকার সুযোগ পেলেই তাঁদের বিদেশভ্রমণের সুযোগ দিয়ে থাকে। তাঁদের বঞ্চিত ভাবার কারণ একটাই—তা হলো, বাজেট কম। বাজেট বেশি হলেই তাঁরা হয়তোবা এই বিভাগের জন্য অনেক কিছু করতে পারতেন। এই ক্ষোভ থেকেই তাঁরা কাজে গা লাগান না এবং অন্য মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার জন্য তদবির করে থাকেন।
আসলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থাকার কোনো প্রয়োজনই নেই। পৃথিবীর অনেক দেশেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নেই। কারণ, তাঁরা ভাবেন মন্ত্রণালয় থাকলেই নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি এসে যায়। কাজেই সংস্কৃতি যেহেতু লোকশিক্ষার বিষয়, শিক্ষা বিভাগের মধ্যে রাখাই সমীচীন।
তাই এতৎসত্ত্বেও বাজেট নিয়ে নানা কথাবার্তা হচ্ছে অধিকাংশই চর্বিতচর্বণ। বাজেট যে মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করে না, এটা বহু আগেই প্রমাণিত। তবু বাজেট আসে, কঠিন কঠিন শব্দ দিয়ে বাজেট সাজানো হয়। ভৌত অবকাঠামো ও ভূতাপেক্ষ প্রাক্কলনের চেয়েও কঠিন শব্দ সরকারি নথি ও বাজেটে দেখা যায়। আমাদের সংসদ সদস্যদের আলোচনা থেকে বোঝা যায় বাজেটটি পড়ার তাঁদের সময়ও হয় না। তাঁদের বক্তব্য পল্লবগ্রাহী এবং চিন্তাপ্রসূত নয়। তাই এটি অর্থনীতিবিদ ও আমলাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। ব্যবসায়ীরা প্রতিবারই সন্তুষ্ট হন। কারণ, বাজেটে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয় এবং এবারে অর্থ পাচারকারীদের জন্য বাজেট তো আরও সুখবর। ঋণখেলাপিদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা থাকে, কাজেই তারাও সন্তুষ্ট। সাধারণ জনগণ, বিত্তহীন মানুষ এসব তেমন একটা বোঝে না, কাজেই তাদের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়াও হয় না। এভাবেই উদ্ভট উটের পিঠে চলে স্বদেশের বাজেট।
বাজেট নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। সপ্তাহ দেড়েক ধরে পত্রপত্রিকায়, টেলিভিশনে, সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন সভা-সেমিনারে, প্রকাশনায় আলোচনার বিষয়বস্তুর শীর্ষে আছে বাজেট। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি একটি বৃহৎ পুস্তিকাও বের করে ফেলেছে। বাজেট নিয়ে এই ব্যাপক আলোচনা একদিক থেকে অত্যন্ত ইতিবাচক। এই আলোচনার মধ্য দিয়ে আমাদের সাধারণ জ্ঞান বাড়ে, অর্থনীতি সম্পর্কে একটা উৎসাহ জাগে। অনেকটা আমাদের দেশের রাজনীতির মতো। এত বেশি রাজনীতিসচেতন মানুষ পৃথিবীর কোথাও আছে বলে মনে হয় না।
কিন্তু ফলাফলটি ইতিবাচক নয়। আগে আমরা বাজেট বলতে বুঝতাম, জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে কিছু কিছু জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করে। কিন্তু কোনো জিনিসেরই দাম কমে না। এখনো তাই। এবার অবশ্য ব্যবসায়ীবান্ধব বাজেটে রাষ্ট্র অনেক সুযোগ-সুবিধা করে দিয়েছে। বাজেটের দুই মাস আগে থেকেই জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁইছুঁই। সরকারের মন্ত্রীরা নানা রকম হুঁশিয়ারি দেওয়া সত্ত্বেও অকারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে চলেছে। যদিও দুটিই আমদানি করতে হয়। জ্বালানি তেলের দাম বাড়েনি। কিন্তু ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে চলেছে। সবজির দাম বেড়েছে এবং অদ্ভুত কাণ্ড, চালের ভরা মৌসুমে চালের দাম বেড়েছে।
দেখা যায়, বাজেটের ৩২ শতাংশ খরচ হয় পেনশন ও সঞ্চয়পত্রের সুদে। আরও একটি বড় অংশ খরচ হয়ে যায় জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং নানা সুযোগ-সুবিধায়। শুধু তা-ই নয়, উপসচিব থেকে মুখ্য সচিব পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তারা সুদমুক্ত ঋণ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। প্রতি মাসে ড্রাইভারের বেতন, তেলের খরচ এবং গাড়ি মেরামতের জন্য প্রত্যেক কর্মকর্তাকে ৪৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া আছে গৃহনির্মাণ ঋণ এবং আরও বহুবিধ ভাতায় আমাদের রাষ্ট্র জর্জরিত।
তারপরও আছে বিরাট অংশ, এই সব কর্মকর্তার ঘুষের জন্য বরাদ্দ। আমলাশাসিত এই বাজেট শুধু বছরের পর বছর আমলাদেরই কল্যাণের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এর বাইরে যে বৃহৎ জনগোষ্ঠী, তাদের কল্যাণের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ হয়, তা একেবারেই অপ্রতুল। কখনো কখনো লোকদেখানো। আমলারা রাষ্ট্রের কাজে সভা করেন। প্রতিদিনই তাঁরা কোনো না কোনো সভায় ব্যস্ত থাকেন। মুখস্থবিদ্যায় চাকরি পাওয়া এসব আমলা কোনো সৃজনশীল ক্ষমতা ছাড়াই দিনের পর দিন এই সভাগুলোতে উপস্থিত হয়ে বিপুল অর্থ ব্যয়ে নাশতা-পানি খেয়ে একটি প্যাকেট নিয়ে ফেরেন। দিনে এ রকম প্যাকেটের সংখ্যা কত হয় তা কি বাজেট বরাদ্দের মধ্যে থাকে? হয়তো সচিবালয়ের মধ্যে থাকলে থাকতেও পারে, কিন্তু বাইরের সংস্থাগুলোয় বাইরের বাজেটে তা থাকে না।
এরপরও জেলা প্রশাসনে আছে এলআর ফান্ড, সার্কিট হাউসের অতিথি আপ্যায়ন—এসব কাজে ওই অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে। জনপ্রশাসন একটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল বিভাগ। তৃণমূল থেকে শুরু করে একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত কোটি টাকার নিচে কোনো গাড়ি নেই। গাড়ির তেল খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত, ড্রাইভারের ওভারটাইম—এসব মিলে বিপুল অর্থ খরচ হয়ে যায়। বাজেটে এসব বিষয় সুরক্ষিত।
তেমনি সুরক্ষিত সেনাবাহিনীর বাজেট। কিন্তু অরক্ষিত হচ্ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতিসহ জনস্বার্থের এবং সুদূরপ্রসারী উন্নয়নের বিষয়গুলো। বাজেট একেবারে শক্তভাবে কখনোই নিয়ন্ত্রিত নয়। আছে থোক বরাদ্দের নিয়ম। অর্থমন্ত্রী এখানে সর্বেসর্বা। তিনি তাঁর ইচ্ছামতো কোনো খাতে বরাদ্দ বাড়াতে পারেন। রাষ্ট্রে কম্পট্রোলার জেনারেল বলে একটি সাংবিধানিক পদ আছে। এ পদটি একমাত্র রাষ্ট্রপতির কাছে বা সংসদের কাছে জবাবদিহি করে থাকে। রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের হিসাবের ওপর তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। খবরের কাগজে বা মিডিয়ায় অন্য সাংবিধানিক পদে নিয়োজিত ব্যক্তিদের নানা ধরনের মতামত এবং সংবাদ প্রকাশিত হয়। কিন্তু কম্পট্রোলার জেনারেলের কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয় না। তার মানে তাঁর কর্মকাণ্ড হতে পারে খুব গোপনীয় অথবা তিনি অবহেলিত। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় দ্বিতীয়টি হওয়াই স্বাভাবিক।
বাজেটে শিক্ষা খাতে কয়েক বছর ধরে একটা স্থিতাবস্থা লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষা ও সংস্কৃতির খাতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকা উচিত। কারণ, শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা যে কতটা পিছিয়ে তার প্রমাণ মিলবে সম্প্রতি গবেষণায় এসেছে পৃথিবীর ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই, তদুপরি বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েরই নাম নেই এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা ঘটছে, তাতে ছাত্র ও শিক্ষকের শিক্ষার মান, তাদের মূল্যবোধ—এসবেরই প্রমাণ মেলে। আর জোর করে শিক্ষিত করার প্রচেষ্টায় তৃণমূল পর্যায় থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার মান এত নিম্নমুখী যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তির জন্য উপযুক্ত একজন ছাত্রও পাওয়া যায় না। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে গত ৫০ বছরে যে ইতিহাস পাওয়া যায়, তা একটি জাতির দেউলিয়াপনাকেই প্রমাণ করে। ২০ বছর ধরে যদিও এ ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নয়ন সাধিত হয়েছে; তবু প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। শিক্ষাক্ষেত্রে লাগামহীন দুর্নীতি, সরকারি-বেসরকারি স্কুলের প্রশাসনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিপরায়ণতায় পর্যুদস্ত। শিক্ষকতা পেশা এখন আর মহৎ পেশা নয়। দক্ষ ও অদক্ষ শিক্ষকেরা কোচিং-বাণিজ্য করে বিপুল অর্থের মালিক। তৃণমূলের শিক্ষা প্রশাসন থেকে শুরু করে একেবারেই উচ্চপর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতিতে ভরা। বেশি বাজেট দিলে দুর্নীতিও বাড়ে। নানা ধরনের শিক্ষা কমিশন করে কোনো লাভ হয়নি; বরং কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনটি থাকলে হয়তো এই ক্ষেত্রে ভালো ফল পাওয়া যেত।
আমার স্কুলের শতবর্ষ উদ্যাপনে গিয়েছিলাম। আমরা টিনের ঘরে যেখানে পড়ালেখা করেছি, এখন সেখানে অট্টালিকা গড়ে উঠেছে, ইতিমধ্যেই সেখানে ফাটল দেখা দিয়েছে। আশপাশে নদী ও খাল ভরাট করে দেওয়া হয়েছে, গাছপালা কেটে একটা মরুভূমির রূপ নিয়েছে। স্কুলের টিনের ঘরের সেই লেখাপড়ায় শিক্ষকেরা ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ আর এখনকার শিক্ষকেরা শিক্ষার মান উন্নয়নে একেবারেই অনাগ্রহী।
স্বাস্থ্য খাতটি নানা দুর্দশায় জর্জরিত। দুটি ক্ষেত্রেই বাণিজ্য প্রবল, সেবা অবহেলিত। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মাদ্রাসাশিক্ষা এসেছে। মাদ্রাসাশিক্ষার ছাত্ররা এখন প্রাথমিকে ও উচ্চমাধ্যমিকে চাকরিপ্রত্যাশী হচ্ছে। ওখানে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের সঙ্গে মাদ্রাসার ছাত্রদের একটা দ্বন্দ্ব প্রথম থেকেই শুরু হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই স্কুলগুলোতে পড়ালেখা হয় না, শিক্ষকেরা ছাত্রদের পাঠিয়ে দেন নিজেদের প্রতিষ্ঠিত কোচিং সেন্টারে। স্বাস্থ্যব্যবস্থায় শুধু ডাক্তার নয়, এর সঙ্গে জড়িত থাকে প্রশাসন এবং সেই প্রশাসন আমলাশাসিত। বিসিএস পাস করা একজন ডাক্তারকে যদি তাঁর চেয়ে কম বয়স্ক কোনো প্রশাসনিক কর্মকর্তার নির্দেশ মানতে হয় এবং স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বোচ্চ পদগুলো যদি প্রশাসনের হাতে থাকে, তাহলে এ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বাজেটের জন্য প্রতিবছরই নানান কথাবার্তা হয়, কিন্তু বাজেট বাড়ে না। অথচ বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও গণতন্ত্রের উত্তরণের পথে সংস্কৃতিকর্মীদের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। সেই ভূমিকাকে পাশ কাটিয়ে তাদের একটা অবহেলার পর্যায়ে রেখে দেওয়া, মানে বাংলার সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করা। সর্বদাই শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ঘাপটি মারা কিছু সংস্কৃতিবিরোধী লোক থাকে। এই লোকগুলো মৌলবাদী সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। মুখস্থবিদ্যায় চাকরি পেয়ে সৃজনহীন, স্বপ্নহীন কিছু লোক রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে শুরু করে হুমায়ুন আজাদকে পর্যন্ত শত্রু ভেবে কাজ করতে থাকেন। তাঁদের চিহ্নিত করার কোনো উদ্যোগ আজ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা নিজেকে বঞ্চিত মনে করেন। সরকার সুযোগ পেলেই তাঁদের বিদেশভ্রমণের সুযোগ দিয়ে থাকে। তাঁদের বঞ্চিত ভাবার কারণ একটাই—তা হলো, বাজেট কম। বাজেট বেশি হলেই তাঁরা হয়তোবা এই বিভাগের জন্য অনেক কিছু করতে পারতেন। এই ক্ষোভ থেকেই তাঁরা কাজে গা লাগান না এবং অন্য মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার জন্য তদবির করে থাকেন।
আসলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থাকার কোনো প্রয়োজনই নেই। পৃথিবীর অনেক দেশেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নেই। কারণ, তাঁরা ভাবেন মন্ত্রণালয় থাকলেই নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি এসে যায়। কাজেই সংস্কৃতি যেহেতু লোকশিক্ষার বিষয়, শিক্ষা বিভাগের মধ্যে রাখাই সমীচীন।
তাই এতৎসত্ত্বেও বাজেট নিয়ে নানা কথাবার্তা হচ্ছে অধিকাংশই চর্বিতচর্বণ। বাজেট যে মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করে না, এটা বহু আগেই প্রমাণিত। তবু বাজেট আসে, কঠিন কঠিন শব্দ দিয়ে বাজেট সাজানো হয়। ভৌত অবকাঠামো ও ভূতাপেক্ষ প্রাক্কলনের চেয়েও কঠিন শব্দ সরকারি নথি ও বাজেটে দেখা যায়। আমাদের সংসদ সদস্যদের আলোচনা থেকে বোঝা যায় বাজেটটি পড়ার তাঁদের সময়ও হয় না। তাঁদের বক্তব্য পল্লবগ্রাহী এবং চিন্তাপ্রসূত নয়। তাই এটি অর্থনীতিবিদ ও আমলাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। ব্যবসায়ীরা প্রতিবারই সন্তুষ্ট হন। কারণ, বাজেটে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয় এবং এবারে অর্থ পাচারকারীদের জন্য বাজেট তো আরও সুখবর। ঋণখেলাপিদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা থাকে, কাজেই তারাও সন্তুষ্ট। সাধারণ জনগণ, বিত্তহীন মানুষ এসব তেমন একটা বোঝে না, কাজেই তাদের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়াও হয় না। এভাবেই উদ্ভট উটের পিঠে চলে স্বদেশের বাজেট।
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৬ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৬ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৬ দিন আগে