ঐতিহাসিক ৭ মার্চ: কালজয়ী এক ভাষণ

মোনায়েম সরকার
আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২৪, ১০: ২০
Thumbnail image

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণটি আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে ইউনেসকোর স্বীকৃতি পেয়েছে। ওই ভাষণ যেমন ছিল উদ্দীপনামূলক, তেমনি ছিল দিকনির্দেশনামূলকও। একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাঁকে ওই ভাষণ দিতে হয়েছিল। ভাষণে একদিকে ছিল জাতির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে স্বাধীনতার মন্ত্রণা, আবার কেউ যেন তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারে, সেদিকে নজর রেখে ভারসাম্যমূলক শব্দ চয়ন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি। তাঁর জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো কি না, বলা মুশকিল। তিনি মানুষের মধ্য থেকে উঠে আসা একজন নেতা। তিনি সারা জীবন লড়েছেন বঞ্চনা-বৈষম্যের বিরুদ্ধে। পরাধীন বাঙালি জাতিকে তিনিই দেখিয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বপ্ন। শুধু স্বপ্নই দেখাননি, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে বিশ্বসভায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন অসংখ্য ভাষণ দিয়েছেন। কিন্তু যে ভাষণ দিয়ে তিনি নিপীড়িত বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, সেই ভাষণ তিনি দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে। মাত্র আঠারো মিনিটের জ্বালাময়ী ভাষণ শুধু সেদিনের মুক্তিপাগল মানুষকেই মুক্তির জন্য উদ্বুদ্ধ করেনি, পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সামরিক কর্মকর্তা মেজর জিয়া, মেজর সফিউল্লাহসহ সবাই স্বীকার করেছেন যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল তাঁদের কাছে গ্রিন সিগন্যাল। ৭ মার্চের ভাষণ শুধু একাত্তরের প্রেরণা ছিল না, পরবর্তী সময়ে নতুন প্রজন্মকেও দারুণভাবে নাড়া দেয়।

এ প্রসঙ্গে দুটি ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে। প্রয়াত জাসদ নেতা মইনউদ্দিন খান বাদলের ছেলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে এতটাই আবেগতাড়িত হয়ে গিয়েছিল যে সে তার বাবাকে (মইনউদ্দিন খান বাদল) বলেছিল, ‘বাবা, তোমরা কি এই লোকটার বিরুদ্ধে গিয়ে নতুন দল জাসদ করেছিলে? আই হেট টু টক টু ইউ ফাদার’—এ কথার সত্যতা জানার জন্য আমি বাদলের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, ঘটনাটা সত্য। প্রয়াত সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্তের লেখায়ও এ ঘটনাটি পড়েছিলাম।

আরেকটি ঘটনাও ঠিক একই রকমের। আমাদের বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনে আনান নামের এক কিশোর মাঝে মাঝে আসে। সে ভালোবেসে আমাকে ‘বন্ধু’ বলে ডাকে। একদিন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে সে তার মাকে বলে, ‘মা, জানো বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে আমার রক্ত গরম হয়ে যায়; আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে।’ যে ভাষণের সংগ্রামী বাণী নাবালক শিশুকেও আলোড়িত করে, সেই ভাষণ পরাধীন মানুষকে শিকল ভাঙার শক্তি জোগাবে—এটাই তো স্বাভাবিক।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন জনগণের নেতা। তিনি মানুষের দুঃখ-কষ্ট বুঝতেন বলেই তাদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন। কয়দিনের রাজনৈতিক অস্থিরতায় যেসব সাধারণ মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের কথা মনে ছিল বলে বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দূর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করব। যাঁরা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকাপয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন। আর এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছেন, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাঁদের বেতন পৌঁছায়ে দেবেন।’

জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে তিনি যে নির্দেশ দেওয়ার বৈধ অধিকার পেয়েছেন, হয়তো সেটা আবারও মনে করিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো, কেউ দেবে না।’

বিভেদ-বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটপাট করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-অবাঙালি যারা আছে, তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপরে। আমাদের যেন বদনাম না হয়।’

রেসকোর্স ময়দানে সমবেত লাখ লাখ মানুষ তখন কিছুটা যেন চঞ্চল। কারণ সবার আগ্রহ তো বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার। দলের মধ্যেও তরুণদের চাপ ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা যেন বঙ্গবন্ধু ওই সমাবেশ থেকেই দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জানতেন, তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে কী পরিণতি হতে পারে। সেনাবাহিনী তৈরি ছিল তোপ দাগার জন্য। বঙ্গবন্ধু এটাও জানতেন যে তিনি যদি মানুষের মনের ভাষা প্রকাশ না করেন তাহলে তাঁরা হতাশ হবেন। তিনি কৌশলের আশ্রয় নিলেন। শাসকগোষ্ঠীর চোখে ধুলো দিয়ে জনতার উদ্দীপনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে ভাষণের একেবারে শেষে এসে শোনালেন সেই মহাকাব্যিক বাণী ‘যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে-শুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ উচ্ছ্বসিত জনতা পেয়ে গেল স্বাধীনতার ঘোষণা।

জ্যাকব এফ ফিল্ড ২০১৩ সালে গ্রেট ব্রিটেন থেকে একটি বই প্রকাশ করেন ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস’ নামে। এ বইটির উপশিরোনাম হলো ‘দ্য স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্ট্রি’। এই বইয়ে জ্যাকব এফ ফিল্ড বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদের ৪১টি ভাষণ সংকলিত করে ইংরেজিতে প্রকাশ করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩১ অব্দ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বনেতাদের ঐতিহাসিক ভাষণগুলো এতে স্থান পেয়েছে। বইটির নামকরণ করা হয়েছে ১৯৪০ সালে প্রদত্ত উইনস্টন চার্চিলের বিখ্যাত ভাষণের শিরোনাম অবলম্বনে। এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি প্রায় ৫০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। পৃথিবীর আর কোনো ভাষণ এতগুলো ভাষায় অনূদিত হয়েছে কি না, এই মুহূর্তে তা আমার জানা নেই। পৃথিবীর এতগুলো ভাষায় যে ভাষণ অনূদিত হতে পারে, সেই ভাষণের গুরুত্ব কতখানি তা সহজেই অনুমেয়।

৭ মার্চের সংক্ষিপ্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির আন্দোলন-সংগ্রাম ও প্রত্যাশার কথা যুক্তি ও আবেগ দিয়ে তুলে ধরেছিলেন। মাত্র কয়েক মিনিটের একটি ভাষণে ইতিহাস এবং ভবিষ্যতের করণীয় সম্পর্কে এমন প্রাঞ্জল ও আবেগময় ভাষায় পৃথিবীর আর কোনো নেতা তুলে ধরতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই। আমরা আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতা বলি আর মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ এ ড্রিমের’ কথাই বলি, পৃথিবীর কোনো নেতার ভাষণই বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মতো এত আলোড়ন আর স্বাধীনতার স্বপ্ন তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। এমন ইতিহাসসমৃদ্ধ কাব্যিক ভাষণ রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দেওয়াই সম্ভব হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর আগে ও পরে আর কোনো বাঙালির ভাষণ বিশ্ববাসীর এত মনোযোগ আকর্ষণ করেনি।

লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক ও চেয়ারম্যান, বিএফডিআর

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত