ব্যাংকে ডলারের হাহাকার

ফারুক মেহেদী ও জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা
আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০২২, ১০: ৪০
Thumbnail image

ডলারের সেই সুদিন নেই। রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি। রেমিট্যান্সেও মন্দাভাব। বিদেশি ঋণের মাধ্যমে যে ডলার আসত, কমেছে তা-ও। মজুতে টান পড়েছে বেশ আগেই। এখন রীতিমতো সংকট। কয়েক মাস আগেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মজুত থেকে কিছু কিছু করে ডলার ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হতো। রিজার্ভ কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে আসায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সে পথ বন্ধ করে ঘোষণা দিয়ে ডলার বিক্রি স্থগিত করেছে। ফলে ব্যাংকগুলোর সহজে ডলার পাওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে।

বলা হয়েছে, যত দামেই হোক, ব্যাংকগুলোকেই নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে ডলার সংগ্রহ করতে হবে। এতে পেরে উঠছে না অনেক ব্যাংক। দিন যত যাচ্ছে ব্যাংকে ডলারের জন্য হাহাকার বাড়ছে। 

ব্যবসায়ীদের পক্ষে আমদানির ঋণপত্র খুলতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। এতে পোশাক, চামড়াসহ বিভিন্ন রপ্তানিমুখী পণ্যের কাঁচামাল, চাল, চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। এদিকে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্সের মাধ্যমে ডলারের প্রবাহ বাড়াতে আজ সোমবার থেকে কোনো মাশুল ছাড়াই রেমিট্যান্স পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা)। গতকাল রোববার সংগঠনের জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাশাপাশি ছুটির দিনেও বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউস খোলা রাখা, ১০৭ টাকায় রেমিট্যান্স এবং ১০০ টাকায় রপ্তানি আয় সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ব্যাংক, ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

আইএমএফের পরামর্শ মেনে নিট হিসাবে গণনা করলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের ঘরে। ডলারে ভর করে ১৩ মাস আগেও যে রিজার্ভের রমরমা অবস্থা ছিল, সেখানে এখন খরা চলছে। চাইলেও বাংলাদেশ ব্যাংক হাত খুলে ডলার খরচ করতে পারছে না।

বরং অতিমাত্রায় সতর্ক হয়ে আইএমএফের সব শর্তে হ্যাঁ বলে সাড়ে চার বিলিয়ন বা সাড়ে চার শ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে ডলারের মজুত বাড়াতে মরিয়া। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় কম পণ্য আমদানি করে বেশি বিল শোধ করার চাপ, বিদেশি ঋণের কিস্তি শোধ, অত্যাবশ্যকীয় জ্বালানি তেল আমদানির দায় মেটানোসহ নানান কারণেই সামনে কী হয়, না হয়—এই আতঙ্ক খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে।

এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর ডলার সংগ্রহের প্রধান উৎস প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। বিভিন্ন ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ডলারপ্রতি ১০৭ টাকা দরে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। তারা বাধ্য হয়ে কখনো কখনো ১১১-১১২ টাকায়ও ডলার কিনছে। কিন্তু হুন্ডি চক্র, প্রবাসীদের কাছ থেকে তার চেয়েও বেশি দাম দিয়ে ডলার কিনছে। এতে ব্যাংকের মাধ্যমে ডলারের প্রবাহ কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের অক্টোবর মাসে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১৫২ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের অক্টোবরের তুলনায় তা ৭ দশমিক ৪ শতাংশ কম।

এফবিসিসিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ডলার-সংকটে আমাদের এলসি খোলা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে না চাইলে সামনের দিনগুলোতে উৎপাদন কমে যাবে। এতে রপ্তানি কমে একপর্যায়ে রপ্তানি আয়ও কমে যাবে। যার প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় চাপ বাড়বে।’

ডলার বাঁচাতে কড়াকড়ির ফলে ঋণপত্র খোলার হার প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বৈশ্বিক সংকটের প্রভাবে ডলারের বাজারে অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। আর ডলারের সংকট উত্তরণে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যবেক্ষণ করছে।’ 

এদিকে, আমদানিকারকেরা শতভাগ মার্জিন রেখেও ব্যাংকে এলসি খুলতে পারছেন না। ব্যাংকে ঋণপত্র খুলতে গেলে, ব্যাংক ডলার সংকটের কথা জানিয়ে ঋণপত্র খোলায় নিরুৎসাহিত করছে। এতে আমদানি কমে যাচ্ছে। সরকার বিলাসী পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করলেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিতে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরে জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ৬৬ শতাংশ মূলধনী যন্ত্রপাতি, ১৪ শতাংশ শিল্পের কাঁচামাল ও ১৪ শতাংশ মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে। ডলার দিন দিন দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ায় ঋণপত্র খোলা কমেছে। সূত্র আরও জানায়, সব ব্যাংকই কমবেশি ডলার-সংকট মোকাবিলা করছে। এর মধ্যে অন্তত ২০টি ব্যাংকে ডলারের সংকট তীব্র হয়েছে। এরা তাদের গ্রাহক, বিশেষ করে বিভিন্ন খাতের আমদানিকারক, রপ্তানিকারক, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তার চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছে না। কারণ, তাদের হাতে পর্যাপ্ত ডলার নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, গত ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকে ডলারের ঘাটতি ছিল ২৫ কোটির বেশি। একই অবস্থা আরও অনেক ব্যাংকের। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক রেমিট্যান্স আনার দিক থেকে সবার চেয়ে এগিয়ে। এ ব্যাংকটি ঘাটতিতে না থাকলেও তাদের মজুতও কমছে বলে জানা যায়।

ডলার-সংকটের বিষয়ে ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী বলেন, বর্তমানে অধিকাংশ ব্যাংক ডলারের অভাবে সময়মতো আমদানি বিল পরিশোধ করতে পারছে না। এখন উচিত হবে ডলারের মজুত নিশ্চিত করে নতুন এলসি খোলা। কারণ, এলসির বিল পরিশোধ না করতে পারলে বিদেশি ব্যাংক ও করেসপন্ডিং প্রতিষ্ঠান আস্থা হারাতে পারে।

আমদানিকারকেরা জানান, ডলারের সংকটে অত্যাবশ্যকীয় চাল আমদানিতেও ঋণপত্র খুলতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা। বেসরকারি চাল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নিউ মুক্তা রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী দীন মোহাম্মদ স্বপন বলেন, ‘আমরা গত কিছুদিন ধরে ব্যাংকে ব্যাংকে ধরনা দিয়েও এলসি খুলতে পারছি না। ব্যাংকে গেলেই তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ি ও ডলার-সংকটের কথা বলে ঋণপত্র খুলছে না। আরও কিছুদিন অপেক্ষা করার পরামর্শ দেয়। শতভাগ মার্জিন রেখেও কাজ হচ্ছে না।’

শতভাগ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জিহান ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহজাদা আহমেদ রনি বলেন, ‘আমাদের ডলার দিয়েই আমরা কাঁচামাল আমদানির দায় শোধ করি। তবে, এখন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো রপ্তানির বিল ঠিকমতো পরিশোধ করছে না। অনেকে তাদের দেশে পণ্য বিক্রি কমে গেছে বলে শিপমেন্ট পিছিয়ে দিচ্ছে। এতে ডলারের প্রবাহ কমছে। সামনে এ ধারা চলতে থাকলে, আমাদের জমা ডলারের পরিমাণ কমে গেলে কাঁচামাল আমদানিতে সমস্যা হতে পারে।’

আমদানি ব্যাহত হওয়ায় অন্যান্য পণ্যের মতো গত দেড় মাসে চিকিৎসা সরঞ্জামের দামও বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। সার্জিক্যাল পণ্য আমদানিকারক মেসার্স হেলথওয়ের স্বত্বাধিকারী নূর হোসেন বলেন, ডলার-সংকটের কারণে ব্যাংক ঋণপত্র খুলছে না। মেডিকেল পণ্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংকের দোহাই দিয়ে অন্যান্য ব্যাংক এলসি খুলছে না। বাংলাদেশ মেডিকেল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যান্ড হসপিটাল ইনস্ট্রুমেন্ট ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের ঢাকা জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন বলেন, ডলারের দাম বেশি হওয়ায় আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে। যার প্রভাব পণ্যের ওপর পড়েছে।

মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব সেখ হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘ডলারের সংকটে আমদানি কমেছে। কিন্তু ডলারের সংকট দূর হচ্ছে না। আবার রেমিট্যান্স কমেছে। পাশাপাশি বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের কাছ থেকে আমরাও খোলা বাজারে তেমন একটা ডলার পাচ্ছি না। কারণ রেট কম।’

এদিকে, ডলার-সংকটের বিষয়ে বাফেদা চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম বলেন, ‘দেশে ডলারের ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু আমাদের কোনো নিত্যপণ্যের আমদানি বিল পরিশোধে বিলম্ব হচ্ছে না। কোনো ব্যাংকের ক্ষেত্রে এসব পণ্যে সাত দিনের বেশি বিলম্বের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যদি ব্যবসায়ীরা বিলম্বের দাবির পক্ষে উপযুক্ত প্রমাণ দিতে পারেন, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত