এ কে এম শামসুদ্দিন
পবিত্র ঈদুল ফিতর সমাগত। দেশের মানুষ যখন ঈদের আনন্দে মেতে ওঠার অপেক্ষায়, তখন অন্য একটি বিষয়ে পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে হচ্ছে বলে প্রথমে দুঃখ প্রকাশ করছি। এক মাসের সিয়াম সাধনার পর আমরা খুশির ঈদে শামিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চারপাশে কী ঘটছে না ঘটছে সে ব্যাপারেও চোখ-কান খোলা রাখব।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা। লাখো শহীদের তাজা রক্ত ও মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। দীর্ঘদিনের সংগ্রাম ও একাত্তরের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও বাঙালি জাতির মুক্তি কি অর্জিত হয়েছে? বঙ্গবন্ধু একাত্তরের সাতই মার্চ ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বলে যে ঐতিহাসিক ভাষণ শেষ করেছিলেন সেই ‘মুক্তির সংগ্রাম’ কি আজও শেষ হয়েছে? সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল সেই লক্ষ্য কি আজও পূরণ হয়েছে? স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর যখন পেছনে ফিরে তাকাই, তখন দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, দরিদ্রতা ও সামাজিক নিপীড়ন থেকে বাঙালির যে মুক্তির কথা ছিল তা আজও অর্জিত হয়নি! ‘এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ’ অথবা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম…’ বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ঘোষণার প্রতিফলন সমাজে আজও খুব কমই দেখা যায়; বরং মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে একশ্রেণির মানুষ ব্যক্তিগত ফায়দা আদায় করে নেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত।
মাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার যুদ্ধ। শোষণমুক্ত সমাজ গড়াই ছিল বাঙালি জাতির আজন্ম লালিত স্বপ্ন। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার চেতনা লালন করে স্বাধীন ও সার্বভৌম যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই রাষ্ট্র কি আমরা পেয়েছি। বাঙালির সেই চেতনার পেছনে আরও একটি লক্ষ্য কাজ করেছিল, তা হলো—গণতান্ত্রিক ও অসম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সেই গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র কি পেয়েছি? একটি কথা মনে রাখতে হবে, যুদ্ধ হয় শত্রুর বিরুদ্ধে, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে। বঞ্চনা, নিপীড়ন, অত্যাচার ও নিষ্পেষণ থেকে মুক্তির জন্যই মুক্তিপাগল জাতি সেদিন জাতি-ধর্মনির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। সেদিন হাতে অস্ত্র নিয়ে যাঁরা শত্রুর মোকাবিলা করেছিলেন, সেই অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা এখন যখন দেশে ও সমাজের চারদিকে অবক্ষয় দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, তখন দুঃখবোধ হয় বৈকি। কিছু কিছু ব্যক্তি বাহুবলে মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই যখন অমর্যাদা করে, তখন সাধারণ নাগরিকেরা বেশ অসহায় বোধ করে।
দুঃখ লাগে যখন দেখি মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ভূলুণ্ঠিত হয়। দুঃখ লাগে যখন রাজাকারের নামের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকাভুক্ত হয়। কষ্ট লাগে মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করে রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার পরও নামমাত্র শাস্তি ভোগ করে তারা পার পেয়ে যায়। স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা আমাদের অনেক দূর পিছিয়ে দিয়েছে। সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে জাতি স্বাধীনতা অর্জন করেছে, অর্থনৈতিক মুক্তি, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের প্রত্যাশায় কেন সে জাতি আজও সংগ্রাম করবে? স্বাধীনতার পর থেকে রাজনৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের যে অবক্ষয় ঘটেছে, তা ধীরে ধীরে সামাজিক অস্থিরতাকে উসকে দিয়েছে। ফলে সমাজে নীতি-নৈতিকতাবিবর্জিত মানসিকতাসম্পন্ন এক বিশেষ শ্রেণির মানুষের উত্থান ঘটেছে। এসব মানুষের লোভ-লালসা ও স্বভাব-চরিত্র এতই মর্যাদাহানিকর যে উচ্চারণ করতেও লজ্জা লাগে।
আগেই উল্লেখ করেছি, কিছু ধুরন্ধর মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে ব্যক্তিগত ফায়দা লোটার চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত! তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করায় ওই ধুরন্ধরদের লোভের মাত্রা বেড়েছে। দুঃখজনক হলো এটাই যে সরকারের মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সচিব, পুলিশ সদস্যসহ সমাজের নানা শ্রেণির মানুষ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নিজেদের নাম ওঠানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। যদিও এরই মধ্যে বেশ কয়েক হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করা হয়েছে। এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে যাদের নাম সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, তাদের মধ্যে পাঁচজন সচিবের ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল হওয়ার ঘটনা অন্যতম। তাঁরা হলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী, একই মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব আবুল কাসেম তালুকদার, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব নিয়াজউদ্দিন মিয়া, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক সচিব এ কে এম আমির হোসেন ও প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান।
২৬ এপ্রিল ঢাকার একটি সংবাদপত্রের শিরোনাম অনেকেরই হয়তো দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শিরোনামটি ছিল এ রকম, ‘সবাই হতে চান মুক্তিযোদ্ধা’। খবরে উল্লেখ করা হয়, ‘আওয়ামী লীগের নেতাসহ ৮১ মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল, বাতিল হচ্ছে মৎস্যমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ও এমপি ফারুক খানের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) ডাকা হচ্ছে শ ম রেজাউলকে, ফারুক খানের তথ্য নিশ্চিত হতে সেনাসদরের মতামত চেয়েছে জামুকা। মুক্তিযুদ্ধ না করেও জালিয়াতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা বনে যান বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনু। ক্ষমতার দাপটে ২০২১ সালের ৩০ জানুয়ারি যাচাই-বাছাইকালে আদমদীঘির প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবরের নাম বাদ দিয়ে তাঁর লাল মুক্তিবার্তা নম্বর ব্যবহার করে নিজ পিতা জসমতুল্লাহর নাম বদলে মশমতুল্লাহ লিখে মজিবর রহমান মজনু মুক্তিযোদ্ধা বনে যান। এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তাঁর নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির জন্য আবেদন করলে তা জামুকার বিশেষ উপকমিটি পর্যালোচনা করে পর্যবেক্ষণ দেয় তিনি ‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণিত নন’। একই কমিটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিব খাজা মিয়ার পিতা জনাব সোবরাব হোসেনকেও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ ছাড়া মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিয়ে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠায় পুনরায় যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামুকা।
উল্লিখিত বিশেষ ব্যক্তিদের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জামুকার অন্যতম সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর ওয়াকার হাসান (অব.) বীর প্রতীক জানান, ‘এগুলোর বিষয়ে আমি জোর আপত্তি দিলেও জামুকার অন্য সদস্যরা আমলে নেননি।’ তারপর মেজর ওয়াকার ফারুক খান সম্পর্কে যে ভয়ংকর অভিযোগ উত্থাপন করেন তা সত্যিই প্রণিধানযোগ্য। প্রয়োজনে মেজর ওয়াকারের অভিযোগ তদন্ত করে সঠিক প্রমাণিত হলে সেই মোতাবেক আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘এসব বলার পরও তারা কোনো তোয়াক্কা করেননি। অথচ এই দুজনের গেজেট জারি করে মন্ত্রণালয়।’ এরপর মেজর ওয়াকার যে কথাটি উচ্চারণ করেন তা সত্যিই কষ্টদায়ক। তিনি বলেছেন, ‘এই শ্রেণির ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া মানে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মহত্যার শামিল।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, দেখা যাক তাঁদের ব্যাপারে নতুন করে কী সিদ্ধান্ত আসে। প্রয়োজনে আমি আবারও ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেব।
মেজর ওয়াকার হাসান মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রথম ওয়ার কোর্সের একজন কমিশনপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর সিলেটের কানাইঘাট এলাকায় প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পক্ষে পাকিস্তান ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। কয়েক ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ করে ওয়াকার হাসান ও তাঁর সহযোদ্ধাদের দুঃসাহসিকতা ও বীরত্বে পাকিস্তানি সেনারা ব্যাপক হারে নিহত বা আহত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে বাধ্য হয়। পালানোর সময় ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর সারওয়ার নিহত হন। এই বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করে। তিনি যখন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবেন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন তাঁর মা তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমার তিনটা কথা তুমি মনে রেখো। যদি যুদ্ধে যাও তবে বীরের মতো যুদ্ধ করবে। যদি তোমাকে মরতেই হয়, তবে বীরের মতো মরবে। বুলেটটা যেন তোমার পেছনে না লাগে। আর যদি যুদ্ধ শেষে ফিরে আসতে হয়, তবে বীরের মতো ফিরে এসো।’ মেজর ওয়াকার হাসান তাঁর মায়ের কথা রেখেছিলেন। যুদ্ধ শেষে তিনি বীরের বেশেই ফিরেছিলেন। তিনি বর্তমানে আরও একটি মহৎ যুদ্ধে অবতীর্ণ রয়েছেন। আমরা আশাকরি, একজন প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়ে অ-মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বনে যাওয়ার এই অপচেষ্টা ঠেকাতে তিনি সক্ষম হবেন।
এ কথা সত্য, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা যখন দেখেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়েও কিছু মানুষ জালিয়াতি করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত, তখন স্বাভাবিক কারণেই মেজর ওয়াকার হাসানের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবেই। আমাদের প্রত্যাশা, জামুকার অন্য সদস্যরাও তাঁর মতো সচেতন হবেন এবং জাতিকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নির্ভেজাল তালিকা উপহার দিয়ে নিজেদের মর্যাদা রক্ষা করবেন। পাঠকদের আগাম ঈদের শুভেচ্ছা, ঈদ মোবারক।
পবিত্র ঈদুল ফিতর সমাগত। দেশের মানুষ যখন ঈদের আনন্দে মেতে ওঠার অপেক্ষায়, তখন অন্য একটি বিষয়ে পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে হচ্ছে বলে প্রথমে দুঃখ প্রকাশ করছি। এক মাসের সিয়াম সাধনার পর আমরা খুশির ঈদে শামিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চারপাশে কী ঘটছে না ঘটছে সে ব্যাপারেও চোখ-কান খোলা রাখব।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা। লাখো শহীদের তাজা রক্ত ও মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। দীর্ঘদিনের সংগ্রাম ও একাত্তরের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও বাঙালি জাতির মুক্তি কি অর্জিত হয়েছে? বঙ্গবন্ধু একাত্তরের সাতই মার্চ ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বলে যে ঐতিহাসিক ভাষণ শেষ করেছিলেন সেই ‘মুক্তির সংগ্রাম’ কি আজও শেষ হয়েছে? সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল সেই লক্ষ্য কি আজও পূরণ হয়েছে? স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর যখন পেছনে ফিরে তাকাই, তখন দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, দরিদ্রতা ও সামাজিক নিপীড়ন থেকে বাঙালির যে মুক্তির কথা ছিল তা আজও অর্জিত হয়নি! ‘এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ’ অথবা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম…’ বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ঘোষণার প্রতিফলন সমাজে আজও খুব কমই দেখা যায়; বরং মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে একশ্রেণির মানুষ ব্যক্তিগত ফায়দা আদায় করে নেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত।
মাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার যুদ্ধ। শোষণমুক্ত সমাজ গড়াই ছিল বাঙালি জাতির আজন্ম লালিত স্বপ্ন। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার চেতনা লালন করে স্বাধীন ও সার্বভৌম যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই রাষ্ট্র কি আমরা পেয়েছি। বাঙালির সেই চেতনার পেছনে আরও একটি লক্ষ্য কাজ করেছিল, তা হলো—গণতান্ত্রিক ও অসম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সেই গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র কি পেয়েছি? একটি কথা মনে রাখতে হবে, যুদ্ধ হয় শত্রুর বিরুদ্ধে, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে। বঞ্চনা, নিপীড়ন, অত্যাচার ও নিষ্পেষণ থেকে মুক্তির জন্যই মুক্তিপাগল জাতি সেদিন জাতি-ধর্মনির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। সেদিন হাতে অস্ত্র নিয়ে যাঁরা শত্রুর মোকাবিলা করেছিলেন, সেই অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা এখন যখন দেশে ও সমাজের চারদিকে অবক্ষয় দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, তখন দুঃখবোধ হয় বৈকি। কিছু কিছু ব্যক্তি বাহুবলে মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই যখন অমর্যাদা করে, তখন সাধারণ নাগরিকেরা বেশ অসহায় বোধ করে।
দুঃখ লাগে যখন দেখি মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ভূলুণ্ঠিত হয়। দুঃখ লাগে যখন রাজাকারের নামের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকাভুক্ত হয়। কষ্ট লাগে মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করে রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার পরও নামমাত্র শাস্তি ভোগ করে তারা পার পেয়ে যায়। স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা আমাদের অনেক দূর পিছিয়ে দিয়েছে। সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে জাতি স্বাধীনতা অর্জন করেছে, অর্থনৈতিক মুক্তি, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের প্রত্যাশায় কেন সে জাতি আজও সংগ্রাম করবে? স্বাধীনতার পর থেকে রাজনৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের যে অবক্ষয় ঘটেছে, তা ধীরে ধীরে সামাজিক অস্থিরতাকে উসকে দিয়েছে। ফলে সমাজে নীতি-নৈতিকতাবিবর্জিত মানসিকতাসম্পন্ন এক বিশেষ শ্রেণির মানুষের উত্থান ঘটেছে। এসব মানুষের লোভ-লালসা ও স্বভাব-চরিত্র এতই মর্যাদাহানিকর যে উচ্চারণ করতেও লজ্জা লাগে।
আগেই উল্লেখ করেছি, কিছু ধুরন্ধর মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে ব্যক্তিগত ফায়দা লোটার চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত! তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করায় ওই ধুরন্ধরদের লোভের মাত্রা বেড়েছে। দুঃখজনক হলো এটাই যে সরকারের মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সচিব, পুলিশ সদস্যসহ সমাজের নানা শ্রেণির মানুষ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নিজেদের নাম ওঠানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। যদিও এরই মধ্যে বেশ কয়েক হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করা হয়েছে। এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে যাদের নাম সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, তাদের মধ্যে পাঁচজন সচিবের ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল হওয়ার ঘটনা অন্যতম। তাঁরা হলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী, একই মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব আবুল কাসেম তালুকদার, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব নিয়াজউদ্দিন মিয়া, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক সচিব এ কে এম আমির হোসেন ও প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান।
২৬ এপ্রিল ঢাকার একটি সংবাদপত্রের শিরোনাম অনেকেরই হয়তো দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শিরোনামটি ছিল এ রকম, ‘সবাই হতে চান মুক্তিযোদ্ধা’। খবরে উল্লেখ করা হয়, ‘আওয়ামী লীগের নেতাসহ ৮১ মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল, বাতিল হচ্ছে মৎস্যমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ও এমপি ফারুক খানের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) ডাকা হচ্ছে শ ম রেজাউলকে, ফারুক খানের তথ্য নিশ্চিত হতে সেনাসদরের মতামত চেয়েছে জামুকা। মুক্তিযুদ্ধ না করেও জালিয়াতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা বনে যান বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনু। ক্ষমতার দাপটে ২০২১ সালের ৩০ জানুয়ারি যাচাই-বাছাইকালে আদমদীঘির প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবরের নাম বাদ দিয়ে তাঁর লাল মুক্তিবার্তা নম্বর ব্যবহার করে নিজ পিতা জসমতুল্লাহর নাম বদলে মশমতুল্লাহ লিখে মজিবর রহমান মজনু মুক্তিযোদ্ধা বনে যান। এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তাঁর নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির জন্য আবেদন করলে তা জামুকার বিশেষ উপকমিটি পর্যালোচনা করে পর্যবেক্ষণ দেয় তিনি ‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণিত নন’। একই কমিটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিব খাজা মিয়ার পিতা জনাব সোবরাব হোসেনকেও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ ছাড়া মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিয়ে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠায় পুনরায় যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামুকা।
উল্লিখিত বিশেষ ব্যক্তিদের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জামুকার অন্যতম সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর ওয়াকার হাসান (অব.) বীর প্রতীক জানান, ‘এগুলোর বিষয়ে আমি জোর আপত্তি দিলেও জামুকার অন্য সদস্যরা আমলে নেননি।’ তারপর মেজর ওয়াকার ফারুক খান সম্পর্কে যে ভয়ংকর অভিযোগ উত্থাপন করেন তা সত্যিই প্রণিধানযোগ্য। প্রয়োজনে মেজর ওয়াকারের অভিযোগ তদন্ত করে সঠিক প্রমাণিত হলে সেই মোতাবেক আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘এসব বলার পরও তারা কোনো তোয়াক্কা করেননি। অথচ এই দুজনের গেজেট জারি করে মন্ত্রণালয়।’ এরপর মেজর ওয়াকার যে কথাটি উচ্চারণ করেন তা সত্যিই কষ্টদায়ক। তিনি বলেছেন, ‘এই শ্রেণির ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া মানে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মহত্যার শামিল।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, দেখা যাক তাঁদের ব্যাপারে নতুন করে কী সিদ্ধান্ত আসে। প্রয়োজনে আমি আবারও ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেব।
মেজর ওয়াকার হাসান মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রথম ওয়ার কোর্সের একজন কমিশনপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর সিলেটের কানাইঘাট এলাকায় প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পক্ষে পাকিস্তান ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। কয়েক ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ করে ওয়াকার হাসান ও তাঁর সহযোদ্ধাদের দুঃসাহসিকতা ও বীরত্বে পাকিস্তানি সেনারা ব্যাপক হারে নিহত বা আহত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে বাধ্য হয়। পালানোর সময় ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর সারওয়ার নিহত হন। এই বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করে। তিনি যখন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবেন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন তাঁর মা তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমার তিনটা কথা তুমি মনে রেখো। যদি যুদ্ধে যাও তবে বীরের মতো যুদ্ধ করবে। যদি তোমাকে মরতেই হয়, তবে বীরের মতো মরবে। বুলেটটা যেন তোমার পেছনে না লাগে। আর যদি যুদ্ধ শেষে ফিরে আসতে হয়, তবে বীরের মতো ফিরে এসো।’ মেজর ওয়াকার হাসান তাঁর মায়ের কথা রেখেছিলেন। যুদ্ধ শেষে তিনি বীরের বেশেই ফিরেছিলেন। তিনি বর্তমানে আরও একটি মহৎ যুদ্ধে অবতীর্ণ রয়েছেন। আমরা আশাকরি, একজন প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়ে অ-মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বনে যাওয়ার এই অপচেষ্টা ঠেকাতে তিনি সক্ষম হবেন।
এ কথা সত্য, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা যখন দেখেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়েও কিছু মানুষ জালিয়াতি করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত, তখন স্বাভাবিক কারণেই মেজর ওয়াকার হাসানের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবেই। আমাদের প্রত্যাশা, জামুকার অন্য সদস্যরাও তাঁর মতো সচেতন হবেন এবং জাতিকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নির্ভেজাল তালিকা উপহার দিয়ে নিজেদের মর্যাদা রক্ষা করবেন। পাঠকদের আগাম ঈদের শুভেচ্ছা, ঈদ মোবারক।
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৬ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৬ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৬ দিন আগে