অগ্নিকুণ্ড সীতাকুণ্ড

মইনুল হাসান 
প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২২, ০৬: ৪০
আপডেট : ১৩ জুন ২০২২, ১০: ১০

বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই মানুষ জানে যে একদিন তার মৃত্যু হবে। এই পৃথিবীতে কেউ চিরদিনের জন্য আসে না, একদিন বিদায় নিতেই হবে। আজ পর্যন্ত এই নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।

জীবনের পথ কখনোই খুব একটা মসৃণ নয়। সবচেয়ে সুখী ব্যক্তিটির জীবনও দুঃখবিহীন নয়। সুখ, আনন্দ, বেদনা জীবনেরই অংশ। মানুষ তা জানে। তবে কখন, কীভাবে কার মৃত্যু হবে, তা আগে থেকে কেউ জানে না! প্রত্যেক মানুষই চায় যেন তার মৃত্যু স্বাভাবিক হয়, ক্লেশহীন হয়। অপমৃত্যু কারোরই কাম্য নয়। কিন্তু মানুষ যা চায়, সব সময় তা হয় না। কোনো কোনো সময় তা হয় বড় বেশি বীভৎস, অতিমাত্রায় নিষ্ঠুর, নির্মম।

বাংলাদেশে ৪ জুন শনিবার ছিল আরেকটি কালো দিন, অত্যন্ত ভয়াবহ এবং বিষাদের দিন। রাত সাড়ে ৯টায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ফলে মৃত্যু ঘটে ৪৮ জন মানুষের। মর্গে জমে ওঠে পরিচয়হীন লাশের স্তূপ। ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় অনেকের দেহ। মৃত্যু যে নির্মম হতে পারে তা পুড়ে যাওয়া মানুষের দেহাবশেষ, মাথার খুলি ও হাড়গোড় দেখেই অনুমান করা যায়। সরকারি হিসাব মতে, এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৪৮। নিহতদের মধ্যে ১০ জন উদ্ধারকর্মীও রয়েছেন। আহত হয়েছেন বহু মানুষ। শ্বাসনালি, চোখসহ প্রায় পুরো শরীর পুড়ে যাওয়া, হাত-পা হারিয়ে তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে মানুষ। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁদের কষ্ট অন্য কেউ চেষ্টা করেও অনুভব করতে পারবে না। অন্যদের সে দায়ও নেই।

মানুষের প্রাণহানিতে যাঁদের দায় আছে, তাঁরা অনেকেই প্রভাব, অর্থ, প্রতিপত্তি, রাজনৈতিক খুঁটির জোরে রেহাই পেয়ে যাবেন বলেই আশা করছেন। আমাদের দেশে আইন আছে, তবে তা সবার জন্য সমান নয়। একচোখা আইন সুবিচার নিশ্চিত করতে পারে না।

এমন সব ভয়াবহ বিপর্যয়ের পরপরই গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় ওঠে। ছবি আর ভিডিওতে দেখা যায় মৃত মানুষের ছিন্নবিচ্ছিন্ন, রক্তাক্ত দেহ, স্বজনদের আহাজারির ছবি। লেখা হয় জীবনের আলো নিভে যাওয়া কারও কারও পরিবারের স্বপ্নের মৃত্যু, বিষাদের কাহিনি। সংবাদপত্রে পাতার পর পাতা লেখা হয়, টক শোতে উত্তপ্ত বাদানুবাদ শুরু হয়। তড়িঘড়ি করে তদন্ত কমিটি গঠন করাও বাদ যায় না কখনোই। ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারকে বড় অঙ্কের অর্থ প্রদান এখন অনেকটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থ দিয়ে অনেক কিছু কেনা গেলেও, অশ্রু কেনা যায় না, অর্থ দিয়ে দুঃখ মুছিয়ে দেওয়া যায় না।

দুঃখের এবং দুর্ভাগ্যের কথা হলো, মানুষের এমন নির্মম, করুণ মৃত্যুকে নিছক ‘দুর্ঘটনা’ বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা ‘পিলার ধরে ঝাঁকুনি দিয়েছিল’ বা ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে’—এ-জাতীয় নিষ্ঠুর পরিহাসের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। অথবা ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীকে শনাক্ত করা হবে’—এমন সব হঠকারী বক্তব্য দিয়ে মাঠ গরম করেন। তাঁরা সমালোচনা, পরামর্শ শুনতে পছন্দ করেন না। তাঁদের পছন্দ শুধু স্তুতি, ক্ষমতা আর আকাশছোঁয়া সম্পদ। সাধারণ জনগণের আস্থাহীনতায় তাঁদের কিছু আসে-যায় না। অপরদিকে ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা বা বিপর্যয় এড়ানোর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, নজরদারি, সতর্কতা, প্রস্তুতি, কর্মপন্থা নির্ধারণ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, জবাবদিহির প্রশ্নে অনেকটা নীরব এবং নির্দিষ্ট ভূমিকা পালনে নির্লিপ্ত থাকেন।

কারও মৃত্যুতে পৃথিবী থেমে থাকে না। মৃত্যু উপত্যকায় প্রতিদিনের মতোই সূর্য উঠবে। ঘড়ির কাঁটা ধরে রাত নামবে, অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে। কিন্তু স্বজনহারা পরিবারগুলোর জীবনে দুঃস্বপ্নের কালো রাত শেষ হবে না। এর মধ্যে আবারও আরেকটি ‘দুর্ঘটনা’ এসে কেড়ে নেবে কিছু নিরীহ মানবসন্তানের জীবন। আবারও সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হবে সে কথা। হাহাকারে, মাতমে কাঁদবে অসহায় মানুষ, লাঞ্ছিত হবে মানবতা। আবারও বন্ধ্যা, নিষ্ফলা তদন্ত কমিটি হবে। মানসিক প্রতিবন্ধীদের মতো বক্তব্য দেবেন কিছু চেনা বক্তব্যজীবীরা। একদল অর্থ দিয়ে মুছিয়ে দিতে চাইবে দুঃখের অশ্রু। তারপর আবারও অনেকেই আমরা ভুলে যেতে থাকব সব।

যেমন ভুলে যেতে শুরু করেছি সুগন্ধা নদীর মাঝখানে মাঝরাতে লঞ্চে আগুন, পুরান ঢাকার নিমতলীর রাসায়নিক কারখানা, লালবাগের প্লাস্টিক কারখানা, রূপগঞ্জে হাসেম ফুডসের কারখানা, বনানীর এফআর টাওয়ার কিংবা তাজরীন ফ্যাশনসে আগুনের লেলিহান শিখায় জীবন্ত মানুষের অঙ্গার হয়ে যাওয়া অথবা রানা প্লাজার মতো বিশাল অট্টালিকা ভেঙে পড়ার মতো সব ঘটনা।

অতীত থেকে আমরা শিক্ষা নিতে চাই না। যাদের অবহেলায়, গাফিলতিতে তরতাজা মানুষগুলো লাশ হয়ে গেল, চিরজীবনের জন্য পঙ্গু হলো, অনেকেই মনে করেন যে কখনোই তাদের নাম জানা যাবে না। বিচারের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা ভালো লক্ষণ নয়। তাতে দুর্বৃত্তরা উৎসাহিত হয়। সরকারের সব অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

এমনিতেই নিরাপত্তাহীনতা, দুর্ঘটনা, বাজারে আগুনে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ছে। এ কথা ঠিক যে অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির কারণে আন্তর্জাতিক বাজার অস্থির, অতিমারির পরেই ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ বৈশ্বিক খাদ্য ও জ্বালানিসংকটের কারণ হয়েছে। ফলে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তুলছে। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, অর্থসম্পদ লিপ্সার কাছে বিবেক বন্ধক দেওয়া একশ্রেণির মানুষের সীমাহীন দুর্নীতি জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। মানুষের মনে তাই ক্ষোভের আগুন জ্বলছে। সে কারণেই যাঁরা ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, আশা করি তাঁরা তা বুঝতে শুরু করেছেন, অগ্নিকুণ্ডের ওপর আসীন হয়ে দেশ চালানো মোটেই সহজ নয়। দেশের মানুষ এবং দেশকে বাঁচাতে সব চেষ্টাই করতে হবে, কোনো রকম গাফিলতির অবকাশ নেই। আর তা যদি না হয়, তাহলে দুঃখজনক হলেও সত্য যে পুরো দেশটিই হবে অগ্নিকুণ্ড সীতাকুণ্ড।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত