কোটাবিরোধী আন্দোলন: সরকারের জন্য অশনিসংকেত কি

এ কে এম শামসুদ্দিন
প্রকাশ : ০৬ জুলাই ২০২৪, ১১: ৩২
আপডেট : ০৬ জুলাই ২০২৪, ২৩: ০১

২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে নিয়োগের কোটাব্যবস্থা বাতিল করে সরকার যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল, গত ৫ জুন হাইকোর্ট সেটি অবৈধ ঘোষণা করে মুক্তিযোদ্ধা কোটাব্যবস্থা পুনর্বহাল করার রায় ঘোষণা করেছেন। ফলে উল্লিখিত দুই ক্যাটাগরির সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরে আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করাকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট করেন। এই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এ রায় দেন। রায় স্থগিত চেয়ে গত ৯ জুন সরকারপক্ষ আপিল করে। কিন্তু এই রায় ঘোষণার প্রতিবাদে দেশব্যাপী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। কয়েক দিন ধরেই সড়ক-মহাসড়ক থেকে শুরু করে রেলপথ অবরোধ ও অবস্থান ধর্মঘটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কোটাবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। দিন দিন এই আন্দোলন বেগবান হচ্ছে। হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৪ জুলাই প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চে কোনো শুনানি হয়নি। তবে রাষ্ট্রপক্ষকে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে নিয়মিত লিভ টু আপিল করতে বলেছেন সর্বোচ্চ আদালত। সরকারপক্ষ হাইকোর্টের রায়ের ফলে চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলনের কথা তুলে ধরলে প্রধান বিচারপতি কিছুটা অসন্তুষ্ট কণ্ঠে অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে বলেন, আন্দোলন হচ্ছে হোক। আন্দোলনের চাপ দিয়ে কি হাইকোর্টের রায় পরিবর্তন করবেন? তারপর তিনি বলেন, ‘আপাতত হাইকোর্টের রায় যেভাবে আছে, সেভাবে থাকুক। রায় প্রকাশ হলে আপনারা নিয়মিত লিভ টু আপিল করেন, আমরা শুনব।’

কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায় স্থগিত না হওয়ায় তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা। সর্বোচ্চ আদালতে শুনানি হয়নি শুনে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শাহবাগের মোড়ে অবস্থান নেন এবং কোটাবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেন। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ করেন। তাঁরা হাইকোর্টের রায়কে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে বক্তব্য দেয়, ‘কোটাপদ্ধতি একটি মীমাংসিত ইস্যু। নতুন করে কোটাপদ্ধতি ফিরিয়ে আনা ছাত্রসমাজের সঙ্গে তামাশা। কোনোভাবেই বৈষম্যমূলক কোটাপদ্ধতি মেনে নেব না। আমরা মেধাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়তে চাই। সকল শিক্ষার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হোক।’

মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে একশ্রেণির মানুষ লাভবান হবে, সেটি মেনে নেওয়ার মতো নয়। কোটাব্যবস্থা মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ-প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শিক্ষার্থীদের দাবি, নিয়োগ-প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে মেধার ভিত্তিতে হোক, যাতে যোগ্যতম প্রার্থীরাই চাকরি পান। তাঁরা দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করে, ‘শরীরের শেষ রক্তবিন্দু থাকতে কোটাপদ্ধতি স্থায়ীভাবে বহাল হতে দেওয়া হবে না।’

দেশের প্রত্যেক নাগরিক লেখাপড়া শেষে ভালো চাকরির প্রত্যাশা করে। বেকারের কাছে সরকারি চাকরির চাহিদা সোনার হরিণের মতো। মেধাবী প্রত্যেক শিক্ষার্থীর প্রত্যাশা হলো, সরকারি চাকরি। কিন্তু দেশে বেকারসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় দিনে দিনে সংকুচিত হচ্ছে চাকরির বাজার। এ অবস্থায় কোটা পুনর্বহালে আদালতের রায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরির প্রত্যাশাকে আরও সংকুচিত করবে। এ কারণে হাইকোর্টের রায়ের সমালোচনা করে অনেকেই বলছেন, কোটা প্রদান করা হয় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ইতিমধ্যে অনেকেই সরকারি চাকরি পেয়েছেন। কোটাপদ্ধতির কারণে সরকারি চাকরিতে মেধাহীনদের ঢুকে পড়ার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। আর এতে দুর্বল প্রশাসন তৈরি হচ্ছে। আবার সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। এই কোটাপদ্ধতি যদি পুনরায় চালু হয়, তাহলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করবে। এ রায় আবারও মুক্তিযোদ্ধা কোটার নামে পাকিস্তান আমলের মতো নতুনভাবে বৈষম্যের সূচনা করবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, আসলেই কি কোটাপদ্ধতিতে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের অমেধাবী সন্তানেরা সরকারি চাকরিতে ঢুকে পড়ছে? অনেকে সরকারি চাকরির নিয়োগপদ্ধতির উল্লেখ করে বলেন, কোটা প্রয়োগ হয় সব ধরনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর মেধাতালিকার ভিত্তিতে। পরীক্ষায় কোনো কোটাপদ্ধতি নেই। প্রার্থীরা প্রিলিমিনারি, লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী মেধাতালিকা প্রস্তুত হয়। প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্য থেকে কমবেশি পাঁচ হাজার মেধাতালিকায় স্থান পায়। তারপর সেই তালিকা থেকে অধিকাংশ প্রার্থীকে মেধা কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়। তারপর মুক্তিযোদ্ধা বা অন্যান্য কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ হতে পারে; অর্থাৎ প্রাথমিক মেধাতালিকায় আসতে সবাইকে পরীক্ষায় মেধার স্বাক্ষর রেখেই আসতে হয়। কোটা থাকে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে। এ তো গেল নিয়মের কথা। প্রশ্ন হচ্ছে, কোটার নামে যাদের নেওয়া হয়, তাতে সবক্ষেত্রেই কি এই নিয়ম মানা হয়? নাকি রাজনৈতিক আনুগত্য যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়?

মুক্তিযোদ্ধা কোটা ‘পোষ্য কোটা’য় পরিণত হয়েছে। উল্লেখ্য, সামাজিক নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে ১৯৭২ সালের গণপরিষদ অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে কোটাপদ্ধতি প্রবর্তন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই নিহত হয়েছিলেন, অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অনেকের পরিবার আবার সর্বস্ব হারিয়েছিলেন। যুদ্ধের পর তাঁদের যথোপযুক্ত পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়নি। এ কথা বিবেচনা করে নিহত, যুদ্ধাহত এবং নিঃস্ব মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছিল। আমাদের সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধা কোটার নামে কোনো বিধান নেই, এই কোটাপদ্ধতি যুগ যুগ ধরে চালু থাকবে—সে রকম কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনাও তখন ছিল না।

কিন্তু যুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এর সরাসরি প্রতিক্রিয়া তাঁদের সন্তানদের ওপরও পড়েছিল, এ কথা বিবেচনা করে পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এই কোটার সুযোগ গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। এর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের এই কোটার সুযোগ করে দেওয়া হয়। কিন্তু নাতি-নাতনিদের অন্তর্ভুক্ত করার পর এ দেশের জনগণ এ ব্যবস্থাকে সহজভাবে নিতে পারেনি। জনমনে প্রশ্ন, সাধারণ মানুষের আবেগ জিম্মি করে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা—এ দুটি স্পর্শকাতর ইস্যু ব্যবহার করে, রাজনৈতিক সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যেই এ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের গণপরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, একটি অন্তর্বর্তীকালীন কোটাব্যবস্থাকে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার জন্য যুগের পর যুগ চালু রাখা যায় না। বর্তমান কোটাপদ্ধতি সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক! এ ছাড়া সংবিধানের ১৯ (১) এবং ১৯ (২) ধারারও পরিপন্থী। ১৯ (১) ধারায় বলা আছে, ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।’ ১৯ (২) ধারায় চাকরিতে নিয়োগ সম্পর্কে আরও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ থাকিবে।’

সরকারের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠা সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির খবরে সরকার যখন অনেকটাই কোণঠাসা, বাংলাদেশের বুকের ওপর দিয়ে সড়ক ও রেলপথ ব্যবহারে ভারতকে একপক্ষীয় সুবিধা দিয়ে চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষরের পর সরকার যখন দেশবাসীর তীব্র সমালোচনার মুখে, তখন মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের ইস্যু সামনে এনে সবার দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর অপচেষ্টা কি না—এ নিয়ে জনগণের ভেতর সন্দেহ আছে।

এ ছাড়া পেনশন স্কিম প্রত্যয় নিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলনও বেগবান হচ্ছে। ফলে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি এবং ভারতের সঙ্গে একপেশে চুক্তির বিষয়টি আড়ালে চলে যাচ্ছে। সরকার সম্ভবত এসব আন্দোলনকে একটি সীমাবদ্ধতার মধ্যে রাখার চেষ্টা করবে। সরকার বিশ্বাস করে, আন্দোলনের তীব্রতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলে সুবিধাজনক সময়ে তা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে।

সরকার যদি মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধী আন্দোলন হালকাভাবে দেখে তাহলে ভুল করবে। 	আজকের পত্রিকাউল্লেখ্য, পেনশন স্কিম প্রত্যয় নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনে সরকার অনুগত শিক্ষকেরাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে সরকার যদি মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধী আন্দোলনকে হালকাভাবে দেখে তাহলে ভুল করবে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে কোটাবিরোধী এই আন্দোলন যদি সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়, তাহলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।

হাইকোর্টের রায়ের পর শিক্ষার্থীরা যে কোটাবিরোধী আন্দোলনে নেমেছেন, তাতে দেশের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সুশীল সমাজ এই দাবির পক্ষে সহমত পোষণ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। কোটাবিরোধী এই আন্দোলন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক। শিক্ষিত ও মেধাবী চাকরিপ্রত্যাশী যুবসমাজের কর্মসংস্থানের প্রশ্নে এই দাবি গণমানুষের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটানো হবে—এটাই এখন সবার প্রত্যাশা।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত