চিররঞ্জন সরকার
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কয়েক মাস ধরেই দেশের রাজনীতিতে তোলপাড় চলছিল। এবার তা চরম রূপ পেয়েছে। ভিসা নীতি ঘোষণার প্রায় চার মাসের মাথায় গত শুক্রবার থেকে এর প্রয়োগের ঘোষণা জানান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার। তাঁর বিবৃতিতে উঠে এসেছে যে ভিসা নীতির আওতায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।
এ ছাড়া নির্বাচন-প্রক্রিয়া ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত হিসেবে প্রমাণিত অন্য ব্যক্তিরাও ভবিষ্যতে এই নীতির অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার জন্য অযোগ্য বিবেচিত হতে পারেন বলে বলা হয়েছে। পাশাপাশি, ভিসা নীতির আওতায় থাকা ওই সব ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরাও।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গত ২৪ মে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যকে সহায়তা করতে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছিলেন। তখন বাংলাদেশ সরকার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিল, ভিসা নীতি যেন বস্তুনিষ্ঠতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে প্রয়োগ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, সরকার ও বিরোধী—সব পক্ষের জন্যই ভিসা নীতি প্রযোজ্য হবে।
বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে কেউ বাধা দিলে তার বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞার যে হুমকি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, সেটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিন্তু কম হয়নি। অনেকেই এমন প্রশ্নও করছেন যে এর পেছনে কি বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন দেখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষাই কাজ করছে, নাকি এর পেছনে আরও কোনো গভীর ‘কৌশলগত’ হিসাব-নিকাশও আছে?
বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক যে খুব একটা মধুর নয়, এটা সবাই জানে। পদ্মা সেতু ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল বর্তমান সরকরের বিরুদ্ধে। সম্পর্কের তিক্ততা আরও বাড়ে যখন মানবাধিকারের কথা বলে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তাকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এরপর গত কয়েক বছরে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে মার্কিন কর্তাব্যক্তিদের দফায় দফায় অনেক আলোচনা হয়েছে।
সর্বশেষ ভারতে অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী তাঁর কন্যাসহ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সেলফি তুলেছেন। এই সেলফি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তখন কেউ কেউ মনে করেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের সব ঝামেলা মিটে গেছে। কোনো একটা আপসরফা হয়তো হয়েছে। কিন্তু আকস্মিক ভিসা নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ শুরু হওয়ায় রাজনৈতিক মহলে নতুন করে চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র যে এই প্রথম কোনো দেশের বিরুদ্ধে এ ধরনের ভিসা নীতি নিয়েছে, তা কিন্তু নয়। অতীতে নাইজেরিয়া ও উগান্ডার মতো কিছু দেশের ক্ষেত্রে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এটা জানানোর জন্য যে এসব দেশের নির্বাচন-প্রক্রিয়া তারা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে এবং তাতে তারা নানা অনিয়ম দেখতে পেয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা ব্যতিক্রম তা হচ্ছে, এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে নির্বাচনের আগে। অন্য দেশগুলোতে যা হয়েছে মূলত নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই নতুন মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পেছনে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানো, বিএনপি লবির ভূমিকার চেয়ে ভূরাজনৈতিক কৌশলগত দিক অধিক বিবেচ্য বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যুক্তরাষ্ট্র আসলে মনেপ্রাণে চায় বাংলাদেশকে চীনের প্রভাববলয়ের বাইরে রাখতে।
বাংলাদেশ অনেক বছর আগেই চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হয়েছে। ২০২১ সালের মে মাসে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশ যেন মার্কিন নেতৃত্বাধীন ‘কোয়াড’ নামের ‘বেইজিংবিরোধী ক্লাবে’ যোগ না দেয় এবং এটা করলে চীন-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মারাত্মক ক্ষতি হবে। তাঁর এ মন্তব্য ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিলে একে ‘অপ্রত্যাশিত’ এবং ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
বাংলাদেশ অবশ্য ‘কোয়াড’, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও যুক্তরাজ্যকে নিয়ে গঠিত কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়ালগের অংশ নয়। তবে এ দেশগুলো যে বাংলাদেশকে বাইডেন প্রশাসনের বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির অংশ করতে চায়, তা গত মার্চ মাসে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার এক বক্তব্যে পরিষ্কার হয়েছে।
মূলত চীনের অর্থনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব ঠেকানোই এই কৌশলের মূল লক্ষ্য। এই প্রেক্ষাপটে পরের মাসেই, অর্থাৎ এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের আগে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য বাংলাদেশের রূপরেখা ঘোষণা করেন। তাতে ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব এবং কারও সাথে শত্রুতা নয়’—এ নীতির ভিত্তিতে ‘ভারসাম্যের’ পথ নেওয়ার কথাও ঘোষণা করা হয়।
বাংলাদেশে চীন অনেক প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে—এটা যুক্তরাষ্ট্রের অজানা নয়। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের নিবিড় ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি সম্পর্কেও যুক্তরাষ্ট্র সচেতন। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার আরও অনেক দেশের মতোই—ভারত ও চীন উভয়ের সঙ্গেই ভারসাম্য রেখে চলতে চায়। তবে যুক্তরাষ্ট্র এসব দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চায় এবং এটাও দেখতে চায় যেন তারা চীনের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে না পড়ে।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে অনেকে একটা গুরুতর ‘স্ববিরোধিতা’র কথা তুলে ধরেন। পৃথিবীতে এমন অনেক দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও দেখা যায় যেখানে গণতন্ত্র বা নির্বাচন বলতে তেমন কিছুই নেই এবং যেসব দেশের মানবাধিকার নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন আছে, ওই দেশগুলোকে ফেলে ওয়াশিংটন হঠাৎ বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে কি না, তা নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে উঠেছে কেন?
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার মতো যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তার পেছনে আসল উদ্দেশ্য এই ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত স্বার্থ—গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন বা মানবাধিকার নয়। গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন বা মানবাধিকার যদি তাদের কাছে মূল আলোচ্য বিষয় হতো, তাহলে সবার আগে আফগানিস্তান, ইয়েমেন বা সৌদি আরবের মতো দেশগুলোর ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করার কথা। ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, লিবিয়া, ফিলিস্তিন প্রভৃতি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সারা পৃথিবীতে নিন্দা কুড়িয়েছে। মাত্র কয়েক দিন আগেও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর ক্ষেত্রে তারা প্রত্যক্ষ ইন্ধন জুগিয়েছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রশ্নে তাই যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ বিশ্বাসযোগ্য নয়।
এ কথা সবাই জানেন যে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে বিশ্ব পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মোড়লের ভূমিকায় রয়েছে। নিকট অতীতেও দেশটির বিরুদ্ধে অনেক গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতে সহযোগিতা কিংবা ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও মার্কিন ভূমিকা ঘৃণার অক্ষরে লেখা হয়ে আছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন সিদ্ধান্ত যে গভীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা বলাই বাহুল্য।
যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞার নীতি কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছে। যদিও এই তালিকায় কারা আছেন, তা জানানো হয়নি। এটা নাকি ‘ভিসা-গোপনীয়তার নীতি’। ঢাকঢোল পিটিয়ে ভিসা নিষেধাজ্ঞার কথা প্রচার করা হচ্ছে, আবার গোপনীয়তার নীতির কথাও বলা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, নামই যদি প্রকাশ না করা হয়, তাহলে এটা একটা ‘জুজু বুড়ির ভয়’ নয়তো? যুক্তরাষ্ট্র তো প্রতিদিন ৯০ শতাংশ ভিসা আবেদন এমনিতেই গ্রহণ করে না। সবচেয়ে অবাক ঘটনা হলো, বাংলাদেশে এখনো তফসিল ঘোষণা করা হয়নি, নির্বাচন তো বহুদূর! এত আগে তারা জানল কীভাবে, কারা নির্বাচনে বিঘ্ন ঘটাবে?
আরেকটি কথা, বর্তমান রাজনৈতিক-প্রশাসনিক বাস্তবতায় আমলা ও পুলিশ মূলত সরকারের আজ্ঞাবাহী। তারা সরকারের নির্দেশ পালন ও সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে মাত্র। তারা সুষ্ঠু নির্বাচন বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু রাখা বা না-রাখার ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে না। তাহলে কেন যুক্তরাষ্ট্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বা আমলাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল? ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিতে হলে দিতে হবে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের ওপর। তা না করে আসলে কাকে, কী বুঝ দেওয়া হচ্ছে?
আর আমেরিকার বন্ধু কিংবা শত্রু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়। একসময় ভিয়েতনামে আমেরিকা সরাসরি আগ্রাসন চালিয়েছিল। এখন আবার সেই ভিয়েতনামের সঙ্গেই আমেরিকার সুসম্পর্ক। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে নরেন্দ্র মোদির ওপরও যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সেই মোদিকেই তারা লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়েছে।
এ কথা ঠিক যে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের সদস্যদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা অত্যন্ত অপমান ও অমর্যাদার। এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল রয়েছে। সাধারণত আমেরিকা কাউকে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিলে কানাডা, ইউরোপসহ অন্যান্য পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশ আমেরিকাকে অনুসরণ করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন কিছু হলে তার দায়দায়িত্ব রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকেই বহন করতে হবে।
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কয়েক মাস ধরেই দেশের রাজনীতিতে তোলপাড় চলছিল। এবার তা চরম রূপ পেয়েছে। ভিসা নীতি ঘোষণার প্রায় চার মাসের মাথায় গত শুক্রবার থেকে এর প্রয়োগের ঘোষণা জানান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার। তাঁর বিবৃতিতে উঠে এসেছে যে ভিসা নীতির আওতায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।
এ ছাড়া নির্বাচন-প্রক্রিয়া ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত হিসেবে প্রমাণিত অন্য ব্যক্তিরাও ভবিষ্যতে এই নীতির অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার জন্য অযোগ্য বিবেচিত হতে পারেন বলে বলা হয়েছে। পাশাপাশি, ভিসা নীতির আওতায় থাকা ওই সব ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরাও।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গত ২৪ মে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যকে সহায়তা করতে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছিলেন। তখন বাংলাদেশ সরকার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিল, ভিসা নীতি যেন বস্তুনিষ্ঠতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে প্রয়োগ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, সরকার ও বিরোধী—সব পক্ষের জন্যই ভিসা নীতি প্রযোজ্য হবে।
বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে কেউ বাধা দিলে তার বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞার যে হুমকি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, সেটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিন্তু কম হয়নি। অনেকেই এমন প্রশ্নও করছেন যে এর পেছনে কি বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন দেখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষাই কাজ করছে, নাকি এর পেছনে আরও কোনো গভীর ‘কৌশলগত’ হিসাব-নিকাশও আছে?
বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক যে খুব একটা মধুর নয়, এটা সবাই জানে। পদ্মা সেতু ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল বর্তমান সরকরের বিরুদ্ধে। সম্পর্কের তিক্ততা আরও বাড়ে যখন মানবাধিকারের কথা বলে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তাকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এরপর গত কয়েক বছরে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে মার্কিন কর্তাব্যক্তিদের দফায় দফায় অনেক আলোচনা হয়েছে।
সর্বশেষ ভারতে অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী তাঁর কন্যাসহ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সেলফি তুলেছেন। এই সেলফি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তখন কেউ কেউ মনে করেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের সব ঝামেলা মিটে গেছে। কোনো একটা আপসরফা হয়তো হয়েছে। কিন্তু আকস্মিক ভিসা নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ শুরু হওয়ায় রাজনৈতিক মহলে নতুন করে চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র যে এই প্রথম কোনো দেশের বিরুদ্ধে এ ধরনের ভিসা নীতি নিয়েছে, তা কিন্তু নয়। অতীতে নাইজেরিয়া ও উগান্ডার মতো কিছু দেশের ক্ষেত্রে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এটা জানানোর জন্য যে এসব দেশের নির্বাচন-প্রক্রিয়া তারা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে এবং তাতে তারা নানা অনিয়ম দেখতে পেয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা ব্যতিক্রম তা হচ্ছে, এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে নির্বাচনের আগে। অন্য দেশগুলোতে যা হয়েছে মূলত নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই নতুন মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পেছনে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানো, বিএনপি লবির ভূমিকার চেয়ে ভূরাজনৈতিক কৌশলগত দিক অধিক বিবেচ্য বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যুক্তরাষ্ট্র আসলে মনেপ্রাণে চায় বাংলাদেশকে চীনের প্রভাববলয়ের বাইরে রাখতে।
বাংলাদেশ অনেক বছর আগেই চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হয়েছে। ২০২১ সালের মে মাসে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশ যেন মার্কিন নেতৃত্বাধীন ‘কোয়াড’ নামের ‘বেইজিংবিরোধী ক্লাবে’ যোগ না দেয় এবং এটা করলে চীন-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মারাত্মক ক্ষতি হবে। তাঁর এ মন্তব্য ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিলে একে ‘অপ্রত্যাশিত’ এবং ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
বাংলাদেশ অবশ্য ‘কোয়াড’, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও যুক্তরাজ্যকে নিয়ে গঠিত কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়ালগের অংশ নয়। তবে এ দেশগুলো যে বাংলাদেশকে বাইডেন প্রশাসনের বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির অংশ করতে চায়, তা গত মার্চ মাসে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার এক বক্তব্যে পরিষ্কার হয়েছে।
মূলত চীনের অর্থনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব ঠেকানোই এই কৌশলের মূল লক্ষ্য। এই প্রেক্ষাপটে পরের মাসেই, অর্থাৎ এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের আগে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য বাংলাদেশের রূপরেখা ঘোষণা করেন। তাতে ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব এবং কারও সাথে শত্রুতা নয়’—এ নীতির ভিত্তিতে ‘ভারসাম্যের’ পথ নেওয়ার কথাও ঘোষণা করা হয়।
বাংলাদেশে চীন অনেক প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে—এটা যুক্তরাষ্ট্রের অজানা নয়। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের নিবিড় ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি সম্পর্কেও যুক্তরাষ্ট্র সচেতন। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার আরও অনেক দেশের মতোই—ভারত ও চীন উভয়ের সঙ্গেই ভারসাম্য রেখে চলতে চায়। তবে যুক্তরাষ্ট্র এসব দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চায় এবং এটাও দেখতে চায় যেন তারা চীনের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে না পড়ে।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে অনেকে একটা গুরুতর ‘স্ববিরোধিতা’র কথা তুলে ধরেন। পৃথিবীতে এমন অনেক দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও দেখা যায় যেখানে গণতন্ত্র বা নির্বাচন বলতে তেমন কিছুই নেই এবং যেসব দেশের মানবাধিকার নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন আছে, ওই দেশগুলোকে ফেলে ওয়াশিংটন হঠাৎ বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে কি না, তা নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে উঠেছে কেন?
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার মতো যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তার পেছনে আসল উদ্দেশ্য এই ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত স্বার্থ—গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন বা মানবাধিকার নয়। গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন বা মানবাধিকার যদি তাদের কাছে মূল আলোচ্য বিষয় হতো, তাহলে সবার আগে আফগানিস্তান, ইয়েমেন বা সৌদি আরবের মতো দেশগুলোর ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করার কথা। ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, লিবিয়া, ফিলিস্তিন প্রভৃতি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সারা পৃথিবীতে নিন্দা কুড়িয়েছে। মাত্র কয়েক দিন আগেও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর ক্ষেত্রে তারা প্রত্যক্ষ ইন্ধন জুগিয়েছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রশ্নে তাই যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ বিশ্বাসযোগ্য নয়।
এ কথা সবাই জানেন যে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে বিশ্ব পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মোড়লের ভূমিকায় রয়েছে। নিকট অতীতেও দেশটির বিরুদ্ধে অনেক গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতে সহযোগিতা কিংবা ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও মার্কিন ভূমিকা ঘৃণার অক্ষরে লেখা হয়ে আছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন সিদ্ধান্ত যে গভীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা বলাই বাহুল্য।
যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞার নীতি কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছে। যদিও এই তালিকায় কারা আছেন, তা জানানো হয়নি। এটা নাকি ‘ভিসা-গোপনীয়তার নীতি’। ঢাকঢোল পিটিয়ে ভিসা নিষেধাজ্ঞার কথা প্রচার করা হচ্ছে, আবার গোপনীয়তার নীতির কথাও বলা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, নামই যদি প্রকাশ না করা হয়, তাহলে এটা একটা ‘জুজু বুড়ির ভয়’ নয়তো? যুক্তরাষ্ট্র তো প্রতিদিন ৯০ শতাংশ ভিসা আবেদন এমনিতেই গ্রহণ করে না। সবচেয়ে অবাক ঘটনা হলো, বাংলাদেশে এখনো তফসিল ঘোষণা করা হয়নি, নির্বাচন তো বহুদূর! এত আগে তারা জানল কীভাবে, কারা নির্বাচনে বিঘ্ন ঘটাবে?
আরেকটি কথা, বর্তমান রাজনৈতিক-প্রশাসনিক বাস্তবতায় আমলা ও পুলিশ মূলত সরকারের আজ্ঞাবাহী। তারা সরকারের নির্দেশ পালন ও সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে মাত্র। তারা সুষ্ঠু নির্বাচন বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু রাখা বা না-রাখার ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে না। তাহলে কেন যুক্তরাষ্ট্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বা আমলাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল? ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিতে হলে দিতে হবে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের ওপর। তা না করে আসলে কাকে, কী বুঝ দেওয়া হচ্ছে?
আর আমেরিকার বন্ধু কিংবা শত্রু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়। একসময় ভিয়েতনামে আমেরিকা সরাসরি আগ্রাসন চালিয়েছিল। এখন আবার সেই ভিয়েতনামের সঙ্গেই আমেরিকার সুসম্পর্ক। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে নরেন্দ্র মোদির ওপরও যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সেই মোদিকেই তারা লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়েছে।
এ কথা ঠিক যে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের সদস্যদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা অত্যন্ত অপমান ও অমর্যাদার। এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল রয়েছে। সাধারণত আমেরিকা কাউকে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিলে কানাডা, ইউরোপসহ অন্যান্য পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশ আমেরিকাকে অনুসরণ করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন কিছু হলে তার দায়দায়িত্ব রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকেই বহন করতে হবে।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৬ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৬ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১০ দিন আগে